কবিতায় আসক্তি, ক্লান্ত দুপুরের ঘুঘুর ডাক ,ভোরের স্নিগ্ধতা ,সবুজ ঘাসের আলতো আদর , স্বপ্ন সরলতায় ভরা কিশোরীর চোখ অথবা ফাগুনের কৃষ্ণচূড়ায় এক ধরনের মাদকতা থাকে। মাদকতা থেকে যায় প্রিয়ফুলের সৌরভে অথবা প্রিয় সুগন্ধিতে !!!
নতুন উপহার পাওয়া পারফিউমের বটেল টাকে মনে হচ্ছিল স্বপ্ন সরলতায় ভরা কোন কিশোরীর চোখ ,যার একটু খানি চেয়ে থাকায় মাতাল হয় বনের কোকিল। সকালে গায়ে ছোঁয়ানোর পর থেকে টের পাচ্ছিলাম এর মাদকতা । শুনেছি ফুলের নির্যাস নিয়ে ফোটা ফোটা বিন্দু বিন্দুতে তৈরি করা হয় এই কৌটা ভর্তি ভালোবাসা । তাই ভাবি এক ফুলের সুবাসেই ধন্য আমি কেমন করে স'ই এতগুলো ফুলের
সুবাসিত ভালোবাসার আক্রমণ ।
বেশকিছু সময় চেস্টা করে ক্ষান্তদিলাম রোজকার গৃহকর্ম ,ততক্ষনে বুঝে ফেলেছি আজ আর সইবে না এই তুচ্ছ জাগতিক ভার !
"আজ আমি আর আমি নেই আমি যেন অন্য কেউ " আমার ও এক জোড়া চোখা ছিল কৈশোরের স্বপ্ন সরলতায় ভরা, সে চোখ কাউকে ছুয়ে দিলে তার হৃদয়ে হাজার তারার ফুল ফুটত। চোখের নেশাগ্রস্থরা সরল চাহনীর নির্মলতায় শুদ্ধ হত।
সেবারে বর্ষায় এল ঈদ, ঈদ এর ছুটি এলো আনন্দধারা নিয়ে রিম ঝিম রিম ঝিম , ঝম ঝম, ঝম ঝম , ঝিরি ঝিরি কখনো বা আর্তনাদের বিজলি । আমার চাচাত বোনের বিয়ে ঈদের ঠিক দুই দিন পর ,আব্বা কিভাবে যেন গ্রামে যাবার জন্য একটা নৌকা ঠিক করে ফেললেন ছটফটে আমি ভীষণ বিরক্ত এত লম্বা সময় ধরে খেলা থেকে বঞ্চিত হব ভেবে , মরার উপর খারার ঘা ঘাটে যেয়ে দেখি ইঞ্জিন ছাড়া নৌকা। বড় ভাই বোনেরা খুশি , ঠিক খুশি না বলে এক্সসাইটেড বলা যায় । বাংলা ব্যাকারন পরীক্ষার প্রশ্ন উত্তর আগেই শেখা হলে গেল ধরনের খুশি " নৌকা ভ্রমন" ;রচনা তে ফুল মার্কস ।আব্বা দেশে যাবার আনন্দ সামালাতে ব্যস্ত ,মা আব্বার সাথে এতক্ষন থাকতে পেরে আনন্দিত । খেলার সময় কমে যাচ্ছে ভেবে প্রায় কেঁদে ফেলার দশা এই এক আমারই । কিন্তু কে জানত এই বর্ষা হয়ে উঠবে আমার জীবনের জমিয়ে রাখা রত্ন স্মৃতির মাঝে অনন্য !!!
যাত্রা শুরু হবার পর ম্যাজিক এর মত সব পালটে গেল , সমস্ত পথ গান গল্প ,বৈঠায় পানি কাটার শব্দ , মাছেদের সংসার প্রান ভরে উপভোগ করলাম। মাঝে নৌকা থামিয়ে আঁখ কেনা , তারপর সূর্যের বাড়ি যাবার সময়ে নিজেদের বাড়ি ফেরা । বিক্রমপুরের গ্রাম সম্পর্কে যাদের ধারনা আছে তারা জানেন বর্ষায় সেখানে এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়ি যাবার জন্য ও নৌকা দরকার হয় প্রত্যেক বাড়ির ঘাটেই ছোট্ট একটি কোষা নৌকা থাকে , এখানে ৪ /৫ বছর বয়সী ছেলে মেয়েরা ও আনায়েসে নাও বেয়ে স্কুল অথবা মাঠে খেলতে চলে যেতে পারে। ঈদের সকাল থেকে শুরু হল গ্রামময় নৌ -চক্কর , পেয়ারা চুরি করে ফেরার পথে ধরা পরার ভয়ে ঈদের নতুন জামা সহ সাঁতরে গিয়ে নৌকায় উঠা ( পানিতে ডুবে থাকলে কোঁচড়ে কি আছে বোঝার উপায় নেই বলে )। বর্ষা ডোবা শশা মাচা থেকে কচি শশা তুলে খাওয়া । ভাই বোনদের সাথে বালিহাঁসের ফাঁদ পাততে দূরের বিলে চলে যাওয়া ।এমনি সব দুরন্তপনায় কেটে যাচ্ছিল সময় !সবচাইতে মজার ছিল কুমাড় বাড়ি তে হানা দেয়া ,চমৎকার সব পোড়া মাটির পুতুল , হাতি ঘোড়া , কলস , হাড়ি পাতিল কত শত জিনিশ যে ছিল ইয়াত্তা নেই । বিস্ময়ে বোবা হয়ে যেতাম কেমন করে চাকা ঘুরিয়ে ঠিক ঠাক চমৎকার সব আকৃতির জিনিষ তৈরি হত দেখে ।প্রিয় কিছু জিনিস তুলে নেয়া যেত অনায়েসে (তালুকদার বাড়ির মেয়ে হিসেবে) ।
বিয়ের দায়িত্ব বা সাজাগোজের আনন্দের চাইতে আমাদের আকর্ষণ ছিল ঝুম বৃষ্টিতে বড়দের চোখ ফাঁকি দিয়ে নৌকা নিয়ে আধা ডোবা ধানের ক্ষেতে চলে যাওয়া । মাথার উপরে বিশাল বৃষ্টিতে সাদা হয়ে যাওয়া আকাশ , আর নিচে দিগন্ত জোড়া সবুজ ধান ক্ষেত আহা! সেই স্বর্গীয় অনুভুতি ! বউ ভাত হবে আপুর শ্বশুর বাড়ি শ্রীনগরে নৌকায় বেশ কয়েক ঘন্টার পথ । খুব ভোরে বড় প্রায় দশ ডিঙ্গি নিয়ে চললাম আপু দুলাভাই কে আনতে পথে ছিল শাপলা বিল , লাল ,সাদা , হালকা মাঝে হলুদ ফুটন্ত শাপলা । শালুক গুলি চিনতে পারা একটু কঠিন যদিও । সারাটা পথ শাপলা তোলায় মেতে রইলাম, চলন্ত নৌকায় একটা সম্পূর্ণ শাপলা মূল সহ তোলা ভীষণ কঠিন আমার মত মফঃস্বল বাসীর কাছে । কখনো ফুলের পাপড়ি ছিড়ে গেল , কখন কেবল হাতে আসলো কিছু সাদা শাপলার পাপড়ি , পরিপূর্ণ চমৎকার একটা ও হাতে এল না । আনন্দের কমতি ছিল না যদিও পাশের নৌকা থেকে ,দুলাভাই বা বিয়াই সম্পর্কিত আত্মীয়দের বিভিন্ন মন্তব্য উড়ে আসছিলো " কেউ বলছেন কাল ঠিক হাটে শাপলার দোকান খুলবে "।কেউ জিজ্ঞেস করল শাপলার মালা কি নতুন দুলাভাইয়ের জন্য ? হাঁসি ঠাট্টা মাঝ বিলে প্রচন্ড বৃষ্টিতে নৌকা থামিয়ে কোরাস গাওয়া, সব সব আনন্দের মাঝে আমার ঠিক একটা বৃষ্টি ভেজা ভীষণ অহংকারী আদুরে শাপলার জন্য মন কেমন করছিল
কিশোরী মনের আপ্রাপ্তির বেদনা লুকাতে তখন শেখা হয়ে উঠে নি ,হয়ত অভিমানী চোখের কোনায় ছিল মুক্তর জল , কান্নায় ভারি হয়ে আসা মুখ লুকাতে আদিগন্ত বর্ষার পানিতে ডোবা মাঠের বুকে চোখ রেখেছিলাম । শাপলার বিল পার হবার পর ঠিক তেমনি ভুলে গেলাম কিছুক্ষন আগে সমস্ত হৃদয় মন দিয়ে পেতে চাওয়া জল রানী কে । দুপুরে পৌঁছে বউভাত খেয়ে আবার ফিরে চললাম বাড়ির পথে , তখন সন্ধ্যা নামে নামে প্রায় । ফেরার পথে মাঝে পরিচিত কিছু আত্মীয় 'র বাসায় হানা দেয়া , গ্রাম্য বাজারে নৌকা ভিরিয়ে চা , মিস্টি নিমকি খাওয়া । এতে আমাদের চার নৌকা পিছনে পরে যায় ।নতুন বর বউ কে নিয়ে মুরুব্বিরা তারাতারি বাড়ি পৌঁছুতে চাইলেন আর আমরা রয়ে গেলাম পিছনে ।
নিস্তব্ধ গভীর কালো বর্ষার রাত , অনেকেই সারাদিনের ক্লান্তিতে ঘুমাচ্ছিলেন বড় ভাই বোন রা মিলে কার্ড বের করে খেলায় মাতলেন মেঘের গর্জন আর ইলশেগুঁড়ির বৃষ্টি, মুহূর্ত গুল কে অসাধারন সুন্দর করে তুলেছিল । ঝিরঝিরি বৃষ্টির স্পর্শ পেতে ছই এর বাইরে গলুই এর কিনারাতে চলে এলাম । কল্পনার সব রঙ ঢেলে আত্ম মগ্ন আমি নিজের সাথেই নিজের গল্প বলেছি সেদিন । মনে মনে আমার ক্ষুদ্র জীবনের আজকের দিন কে সেরা দিন হিসেবে ভেবে নিয়ে ক্ষণগুলি নিজের করে নিচ্ছিলাম ।
তখন ও জানতে পারিনি এক জোড়া ঘুমহারা চোখের ফ্রেমে সারাক্ষন বন্দি ছিলাম আমি শাপলা তোলার অপ্রাপ্তি আমায় না যতটা অভিমানী করেছে ,তার বুকে বেজেছে একফোটা বেশি ; শাপলা বিলের অহংকারী সব আলহাদি ফুলগুলোকে জড়ো করে দূর থেকে আমার চরনে নিবেদন করেছিলো সে । বালিকার নিষ্ঠুর হৃদয় হটাৎ প্রাপ্তিতে খুশিতে আত্মহারা হয়েছিল ঠিকই কিন্তু যুবকের ভালোবাসার গভীরতা মেপে দেখিনি । ঠিক ভুলে গেয়েছিলাম সেই দিনের প্রাপ্তির আনন্দ ।
তিন বছর পর বাসায় খোঁজ নিয়ে আমার বিশ্ববিদ্যালয় হল গেটে এসেছিলো আমার ছোট ছোট চাওয়া গুলির যত্ন নিতে । কিন্তু তাকে তো মনে রাখিনি ,এমন কি জানতাম ও না কে সে ? সে কথা জানবার পর আহত হৃদয়ের করুন দৃষ্টি দেখেছিলাম আমি !
অভিমানী যুবকের সে দৃষ্টি বড্ড ভয়ংকর ।
দু'বছর আগের লেখা ;নিজেকে জানান দিতেই আবার প্রকাশ করলাম । তখন ও আমি কবিতা লেখা শুরু করিনি তেমন ভাবে ; আশা করছি ভালোলাগবে ।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ রাত ৯:০৪