somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শৈশবের রমজান

২৪ শে মে, ২০১৮ বিকাল ৩:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

স্কুল ছুটি হলো। কাল প্রথম রমজান উপলক্ষে স্কুল বন্ধ। সরকারি স্কুলে পড়লে আরো অনেক বেশী মজা হতো ,পুরা রমজান মাসে বন্ধ পেতাম। আল্লাহ যা করেন হয়তো ভালোর জন্যই করেন, এই কথাটা সবসময় মাথায় রাখি। তখন, কেমন যেনো একটা প্রশান্তি আসে মনে। যা দিয়েছেন দয়ালু আল্লাহ,তা নিয়ে যদি সন্তুুষ্ট থাকতে পারতাম, তাহলে সমাজে এতো সমস্যার সৃষ্টি হতো না।

বিকালে বন্ধু সূর্য আর আমি খোঁজ নিতে থাকলাম, কখন কোন মসজিদে কয়টায় নামাজ এবং তারাবী কয়দিনে কোথায় শেষ হয় !

আমাদের হিসাব-নিকাশ বলছে মনছুরাবাদ মসজিদে যদি তারাবী পড়ি,তাহলে ৯দিন বাহিরে ঘুরতে পারবো। অর্থাৎ, ২১ দিনে মনছুরাবাদ মসজিদে তারাবী শেষ হবে।

তখন বাসা থেকে একটা নোকিয়া ৩৩০০ দিয়েছিলো। বন্ধুদের মিসকলড দেওয়া রীতি ছিলো আমাদের মাঝে। ভুলেও কল দিতাম না কাউকে। কারণ, আমাদের ফোনে যে টাকা থাকে না! টিফিনের খরচ বাঁচিয়ে কোনমতে ১১ টাকা দিতাম,আর লোডদাতা ১০ টাকা দিতেন ফোনে। আগে থেকে আমাদের প্ল্যাণ থাকতো,কোন মিসকলে কি করতে হবে !

স্কুল ছুটি হতো সাড়ে ১২ টায়,সকাল ১০ টায় শুরু হয়ে। বাকি পুরা দিন পড়ে থাকতো আমাদের হাতে । তখন দুই বন্ধু আর বড় দুই ভাই শায়ান আর দিয়াজ ভাইকে নিয়ে আমরা ক্যারাম খেলতাম। পুরা দিন এভাবে কেটে যেতো।

অন্য একটা স্কুলে দুপুরে ছুটি হতো। প্রায়ই একটা মেয়েকে দেখি এলাকা দিয়ে যেতে। হয়তো এই দেখা, ছোটবেলার সেই ভালোলাগা থেকেই। এতো Crazy ছিলাম,তার পুরা ইতিহাস বের করে আনলাম। অথচ মেয়েটা তার পরিবারের এতো ইতিহাস জানে কিনা কে জানে, যতটুকু আমি জানি!

কিন্তুু ভেজালে পড়ে গেলাম শুক্রবারে হুজুরের ওয়াজ শুনে। নারীদের দিকে তাকানোই যাবে না নাকি! যদি রাস্তাঘাটে সামনে পড়ে যায়, তাহলে চোখ পড়ার পরই সাথে সাথে চোখ নামিয়ে নিতে হবে। তা না হলে পরকালে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে।

আমি করলাম কি, পরের দিন শনিবার যথারীতি স্কুল খোলার দিন। ক্লাস শেষ করে,দুপুরে এলাকায় ক্যারাম খেলায় ব্যস্ত। দেখলাম সেই মেয়েটা ' সাফা ' আসছে, আমি এক পলকে, এক নজরে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। হুজুর তো বলছে, একবার দেখতে!

কিন্তুু আমার কেনো জানি মন খচখচানি শুরু করলো। রোজা হবে তো! এতো কষ্ট করে রেজে রেখে যদি,রোজাই না হয় সম্পূর্ণ ভাবে, তাহলে রোজা রেখে লাভ কি!

পরেরদিন থেকে দুপুরে সাফার স্কুল ছুটির সময়, আমি বাসায় ডুকে বসে থাকতাম। সময় দেখে বের হতাম, আবার ক্যারাম খেলতাম। আমি যখন কিছু সময়ের জন্য চলে যেতাম,তখন পিচ্ছি একটা, দিয়াজ ভাইয়ের ক্যারাম বোর্ডের পার্টনার হতো। তিনজনে তো আর বোর্ড খেলা যায় না!

প্রথম প্রথম খুবই মন চাইতো, না যাই, ওই একবারি তাকে দেখবো। একবার দেখলে কিছু হবে না! কিন্তুু একসময় খেয়াল করলাম আমি নিজেকে নিজেই নিয়ন্ত্রন করতে পারছি। হয়তো সেটা রোজা সম্পূর্ণ হবে কিনা সে ভয়েই।

আর তখন চোখে ভাসতো, আসলে মনকে বুঝাতাম জান্নাতী হুরের কথা ভেবে। হুজুর বলেছেন, যারা জান্নাত লাভ করবে,তাদের জন্য সত্তর জন জান্নাতী হুরের ব্যবস্থা থাকবে। যাদের সাথে পৃথিবীর নারীদের তুলনাই চলে না।

আবার এটাও বলেছেন, আপনার প্রিয় মানুষও আপনার সাথে জান্নাতে থাকবে। এইভেবে চিন্তা এলো,আমি যদি ঠিকমতো ইসলাম পালন করতে পারি, হয়তো সাফাকে আমি পাবো চিরস্থায়ী ভাবে। এই পৃথিবীর সময়টাতো ক্ষণস্থায়ী।

আমি যখন বাসায় থাকতাম, যত ফকিরই আসুক না কেনো পটে করে চাল দিতাম। কারণ রমজান মাসে দান করলে বেশী সওয়াব পাওয়া যায়। সেই সওয়াবের মর্যাদা সত্তর থেকে সাতশ গুণ পর্যন্ত হতে পারে। এই সুযোগ কি মিস করা যায় ! আম্মা প্রায়ই বকা দিতেন, যা আছে সব দিয়া দে। সব ফকিরকে যদি প্রতিদিন চাল দেস,তাহলে দেখবি তাদের লোভ বেড়ে যাবে। তারা প্রতিদিন এই দরজায় ভিড় করবে। কয়েকদিন না যেতেই বুঝলাম আম্মার কথাই সত্য।

আম্মা অবশ্য একটা বুদ্ধি শিখিয়ে দিয়েছেন। ভিক্ষা 'বিবেচনা' করে দিতে। অর্থাৎ যাকে-তাকে ভিক্ষা দেওয়া যাবে না। যাকে দেখতে মনে হবে, তার কাজ করার ক্ষমতা আছে। তাকে কেনো ভিক্ষা দিবো ! সে চেষ্ঠা করলে রোজগার করে খেতে পারে।

আরেকটা অভ্যাস আম্মার থেকে শিখলাম ! ইফতারের কিছুক্ষণ পর, খালাম্মা দুগা ইফতার দেন না ! বলে কয়েকটা ছিন্নমূল শিশু গেইটের সামনে চিৎকার করতো। আম্মা সবসময় একটু বেশীই ইফতার আইটেম তৈরী করতেন। যাতে তিনি এই ছিন্নমূল শিশুদের কিছু ইফতার দিতে পারেন। তারা হয়তো রোজা রাখে নি, কিন্তুু তাদেরও তো ইচ্ছা জাগে ইফতার করার।

প্রথমে প্রথমে দুজন আসতো, এর কয়েকদিন পর তারা চার পাঁচ জন আসা শুরু করলো। আম্মা এদের সামনে বিরক্ত প্রকাশ করলেও, ভিতরে ভিতরে খুশিই হতেন। তাদের বেশী করে ইফতার দিতেন।

আমি ইফতার নিয়ে আরেকটা মজার ঘটনা করতাম। হুজুর একদিন বলছিলো,মসজিদে ইফতার করলে নাকি বেশী সওয়াব পাওয়া যায়। তো আমি করতাম কি, বাসায় সামান্য ইফতার করে, দৌড় দিতাম মসজিদের দিকে। আম্মাকে বলে যেতাম, আমার জন্য রেখে দিয়ো, নামাজ পড়ে এসে খাবো। আম্মা তো আর জানতেন না,কেনো আমি দ্রুত মসজিদে যেতাম !

হুজুর আমাকে দেখেই বলতেন,এই,এইদিকে আসো। ইফতার করো। হুজুর আমাকে ভালো করেই চিনেন। কারণ তার কাছেই আরবী শিখেছি।আমি প্রথমে এমন ভাব ধরতাম, না হুজুর বাসায় ইফতার করছি, পেট ভরা ; কিন্তুু হুজুর আমাকে খাওয়াবেনই।

আর আমি লজ্জা লজ্জা মুখ করে বসে যেতাম। এতো মজার ইফতার আর কোথাও হয় বলে মনে হয় না। ছোটবেলার মসজিদে সেই ইফতারের কথা কখনো মন থেকে মুছে ফেলা যাবে না।

মাঝে মাঝে দেখতাম দুই একজনকে, যারা পথচারী। কিন্তুু তারা যদি বাসায় গিয়ে ইফতার করতে চায়, তাদের ইফতারের সময়সূচী পার হয়ে যাবে। তারাও মসজিদে আসতেন ইফতার করতে। মসজিদের এই ইফতার আসে এলাকার ধনী পরিবারের বাসা থেকে। হয়তো অধিক সওয়াবের আশায় তারা বেশী করে ইফতার মসজিদে পাঠাতেন।

রমজান মাসটা এমনি, যেদিকে যেই কাজ করেন না কেনো,সেটা যদি ভালো কাজ হয়। শুধু সওয়াব আর সওয়াব।

স্কুল শেষে এক,দুই টাকা পকেটে থাকতো। প্রতিদিন এক টাকা করে মসজিদের দান বাক্সে ফেলতাম। আর মনে হতো, আমি সাতশ টাকার সওয়াব পেয়ে গেছি ! ঈশ,আমার যদি অনেক টাকা থাকতো,তাহলে অনেক টাকা মসজিদে দান করতে পারতাম। মসজিদের বিভিন্ন কাজে সাহায্য করতে পারতাম।

এশার আযান দেওয়ার সাথে সাথে ওযু করে বাসা থেকে বের হয়ে যেতাম। নামাজের আগে দশ মিনিট রাস্তায় দুষ্টুমি করে কাটিয়ে দিতাম।

নামাজ পড়তাম আমরা পেছনের সারির দিকে। কারণ, কিছু মুরব্বি মনে করে,ছোটরা সামনে নামাজ পড়লে,তাদের নিজেদেরই নামাজ হবে না।

হয়তো মুরব্বিরা, ঠিকই বলেন।কারণ, আমার বন্ধুগুলা যে ইবলিশ ! রমজান মাসে শয়তানকে আল্লাহ বন্দী করে রাখেন,কিন্তুু আমার বন্ধুদের শয়তানী বন্ধ হয় না।

একদিন তারাবীর নামাজে, দশ রাকাত শেষে,পাশের আঙ্কেল বললেন,কিরে তুমি ভ্যাউয়া ব্যাঙের মতো লাফাই উঠলা কেন !? তোমার নামাজ হবে ! না মানে, পেছন থেকে পা টান দিছে !

এটা দিয়াজ ভাইয়ের কাজ, বয়সে বড় হলে কি হবে ! দুষ্টুমি সবার সাথে করে। সিজদাহর সময় ওনি করলেন কি, আমার পা দুইটা আকাশে উঠাই রাখলেন, আর হুজুরের আল্লাহু আকবর বলার সাথে সাথে পা ছেড়ে দিলেন ! নামাজ শেষে দেখি পিছনে কেউ নেই !

পরেরদিন থেকে দিয়াজ ভাইয়ের জ্বালায় আর নামাজ না হওয়ার ভয়ে,কয়েক কাতার সামনে গিয়ে নামাজ পড়া শুরু করলাম। বন্ধুগুলা ও দিয়াজ ভাই কয়েকবার আমাকে পেছনের কাতারে নিয়া যাইতে চাইছিলো।

কিসব দিন ফেলে এসেছি ! এখন মনে হয়,রমজান আমাদের জন্য কতোটা গুরুত্বপূর্ণ।

সবসময় নামাজ মসজিদে ঈমামের পিছনে দাঁড়িয়ে পড়তে পারি না। কিন্তুু রমজানে সেটা, ঠিকই পড়া হয় !

রমজান শেষেও এই অভ্যাস বেশ কিছুদিন থাকে। আবার, অগোছালো হয়ে যায় নামাজ।

এক রোজা হওয়ার ভয়ে, আমরা সঠিকভাবে, ঠিক সময়ে নামাজ মসজিদে আদায় করতে পারছি। খারাপ কাজ থেকে দূরে থাকতে পারছি। এভাবে যদি বাকি এগারো মাস পার করতে পারতাম,কতোই না ভালো হতো।

সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মে, ২০১৮ বিকাল ৩:৩১
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×