পারশী শব্দ ‘শব’ এর অর্থ: রাত্র বা অন্ধকার; আরবি শব্দ ‘মে’রাজ’ এর অর্থ: উর্দ্ধারোহণ, মই, সিঁড়ি। অর্থাৎ শাব্দিক অর্থে: অন্ধকারে বা রাতে সিড়ি বাওয়া বা উর্দ্ধারোহণ; সাধারণ অর্থে: অন্ধকার, বর্বর যুগে (আইয়ামে জাহিলিয়া) জ্ঞানের উৎকর্ষ। এখানেই বলা ভাল যে, আল্লাহর খাস কাজ-কর্মগুলি সর্বদাই রাতের অন্ধকারে কেন করেন! তার কোন সদুত্তর কোরান কেতাবে নেই।
প্রচলিত মে’রাজ সম্বন্ধে যত বিবরণ পাওয়া যায় তার ০.০১% শতাংশ কোরানে এবং তারও ৯৯.০৯% শতাংশই অস্পষ্ট; বাকি সকল বিষয় হাদিছের মাধ্যমে। এ সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনার পূর্বে নিম্ন বর্ণিত আয়াতগুলির উপর পাঠকের অবশ্যই সকল সময়ের জন্য দৃঢ় ইমানের সহিত স্মরণ রাখা বাঞ্চনীয়:
ক. লা-বুছআহা। [২: ২৮৬; ৬: ১৫২; ৭: ৪২] ] অর্থ: আমি কাহাকেও তার সাধ্যাতীত দায়িত্ব অর্পণ করি না।
খ. ফা-লান -তাহবিলা। [১৭: ৭৭; ৩৫: ৪৩] অর্থ: তুমি আল্লাহর সুন্নাতে (বিধানে) কখনও কোন রদ-বদল পাবে না এবং আল্লাহর সুন্নাতে (বিধানে) কখনও কোন ব্যতিক্রমও পাবে না।
গ. ইন্নাল্লাহা-মীয়াদ। [৩: -৯] অর্থ: আল্লাহ কখনও অঙ্গীকার ভঙ্গ করেন না।
ঘ. মা ইউবাদ্দালু-আবিদ [৫০: ২৯] অর্থ:আমার কথার রদবদল হয় না এবং আমি আমার বান্দাদিগের প্রতি কোন অবিচার করি না।
ঙ. অ লাও তাকাব্বালা-হাযেজীন। [ ৬৯: ৪৪-৪৭] অর্থ: সে (রাছুল) যদি আমার নামে নিজে কিছু রচনা করতো. তবে অবশ্যই ডান হাত ধরে তাঁর জীবন ধমনী কেটে ফেলতাম এবং তোমারা কেহই তাঁকে রক্ষা করতে পারতে না।
চ. অ মা কানা-হাকিম। [৪২: ৫১] অর্থ: দেহধারী মানুষের এমন কোন ক্ষমতা নেই যে, আল্লাহ তার সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ বা কথা বলবেন -।
এবার মে’রাজ সম্বন্ধে বিশাল হাদিছটি লক্ষনীয়:
১. আনাছ (রাঃ) মালেক ইবনে সা’সাআ’হ (রাঃ) হইতে বর্ণনা করিয়াছেন, নবি ছাল্লাল্লাহু আলাইহিঅসাল্লামকে যেই রাত্রে আল্লাহতাআলা পরিভ্রমণে নিয়া গিয়াছিলেন সেই রাত্রের ঘটনা বর্ণনায় ছাহাবীগণের সম্মুখে তিনি বলিয়াছেন:
যখন আমি কা’বা গৃহের উন্মুক্ত অংশ হাতীমে (উপনীত হইলাম এবং তখনও আমি ভাঙ্গা ঘুমে ভারাক্রান্ত) উর্দ্ধমূখী শায়িত ছিলাম, হঠাৎ এক আগন্তুক (জিব্রাইল ফেরেশতা) আমার নিকট আসিলেন (এবং আমাকে নিকটবর্তী জম্জম্ কূপের সন্নিকটে নিয়া আসিলেন)। অতপর আমার বক্ষের উর্দ্ধসীমা হইতে পেটের নিম্ন সীমা পর্যন্ত চিরিয়া ফেলিলেন এবং আমার হৃদয় বা দিলটা বাহির করিলেন। অতঃপর একটি স্বর্ণপাত্র উপস্থিত করা হইল, যাহা ঈমান (পরিপক্ব সত্যিকার জ্ঞানবর্ধক) বস্তুতে পরিপূর্ণ ছিল। আমার দেলটাকে (জম্জমের পানিতে) ধৌত করিয়া তাহার ভিতরে ঐ বস্তু ভরিয়া দেওয়া হইল এবং দেলটাকে নির্ধারিত স্থানে রাখিয়া আমার বক্ষকে ঠিকঠাক করিয়া দেওয়া হইল (বন্ধনীর বিষয়গুলি ৪৫৫-৪০৬ পৃষ্ঠার হাদিছে উল্লেখ আছে)।
অতঃপর আমার জন্য খচ্চর হইতে একটু ছোট, গাধা হইতে একটু বড় শ্বেত বর্ণের একটি বাহন উপস্থিত করা হইল তাহার নাম “বোরাক”, যাহার প্রতি পদক্ষেপ দৃষ্টির শেষ সীমায়। সেই বাহনের উপর আমাকে সওয়ার করা হইল।
ঘটনা প্রবাহের ভিতর দিয়া জিব্রাইল (আঃ) আমাকে লইয়া নিকটবর্তী তথা প্রথম আসমানের দ্বারে পৌছিলেন এবং দরজা খুলিতে বলিলেন। ভিতর হইতে পরিচয় জিজ্ঞাসা করা হইল, জিব্রাইল স্বীয় পরিচয় প্রদান করিলেন। অতঃপর জিজ্ঞাসা করা হইল, আপনার সঙ্গে কে আছেন? জিব্রাইল বলিলেন, মুহাম্মদ (সঃ) আছেন। বলা হইল, (তাঁহাকে নিয়া আসিবার জন্যই ত আপনাকে) তাঁহার নিকট পাঠান হইয়াছিল? জিব্রাইল বলিলেন, হাঁ। তারপর আমাদের প্রতি মোবারকবাদ জানাইয়া দরজা খোলা হইল। গেটের ভিতরে প্রবেশ করিয়া তথায় আদম (আঃ)-কে দেখিতে পাইলাম। জিব্রাইল আমাকে তাঁহার পরিচয় করাইয়া বলিলেন, তিনি আপনার আদি পিতা আদম (আঃ), তাঁহাকে সালাম করুন। আমি তাঁহাকে সালাম করিলাম। আমার সালামের উত্তর দানে তিনি আমাকে “সুযোগ্য পুত্র ও সুযোগ্য নবি’ আখ্যায়িত করিলেন এবং খোশ আমদেদ জানাইলেন।
অতঃপর জিব্রাইল আমাকে লইয়া দ্বিতীয় আসমানের দ্বারে পৌছিলেন এবং দরজা খুলিতে বলিলেন। এখানেও পূর্বের ন্যায় কথোপকথন হইল এবং শুভেচ্ছা মোবারকবাদ জানাইয়া দরজা খোলা হইল। ভিতরে প্রবেশ করিয়া তথায় ইয়াহইয়া (আঃ) ও ঈসা (আঃ)-এর সাক্ষাত পাইলাম তাঁহাদের উভয়ের নানী পরস্পর ভগ্নী ছিলেন। জিব্রাইল আমাকে তাঁহাদের পরিচয় দানে সালাম করিতে বলিলেন, আমি তাঁহাদিগকে সালাম করিলাম। তাঁহারা আমার সালামের উত্তর প্রদানে “সুযোগ্য নবি” বলিয়া আমাকে খোশ আমদেদ জানাইলেন।
অতপর জিব্রাইল (আঃ) আমাকে লইয়া তৃতীয় আসমানের দ্বারে পৌছিলেন এবং দরজা খুলিতে বলিলেন। তথায়ও পূর্বের ন্যায় কথোপকথনের পর শুভেচ্ছা-স্বাগত জানাইয়া দরজা খোলা হইল। ভিতরে প্রবেশ করিয়া ইউসুফ (আঃ)-এর সাক্ষাত পাইলাম। জিব্রাইল (আঃ) আমাকে তাঁহার পরিচয় করাইয়া সালাম করিতে বলিলেন; আমি তাঁহাকে সালাম করিলাম। তিনি সালামের উত্তর দান করতঃ আমাকে “সুযোগ্য ভ্রাতা ও সুযোগ্য নবি” বলিয়া মোবারকবাদ জানাইলেন।
অতঃপর আমাকে লইয়া জিব্রাইল চতুর্থ আসমানের নিকটে পৌছিলেন এবং গেট খুলিতে বলিলেন। সেখানেও পূর্বের ন্যায় প্রশ্নোত্তরের পর শুভেচ্ছা স্বাগত জানাইয়া দরজা খোলা হইল। ভিতরে প্রবেশ করিয়া আমরা তথায় ইদ্রীস (আঃ)-এর সাক্ষাত পাইলাম। জিব্রাইল আমাকে তাঁহার পরিচয় করাইয়া সালাম করিতে বলিলেন। আমি তাঁহাকে সালাম করিলাম। তিনি সালামের উত্তর দিলেন এবং সুযোগ্য ভ্রাতা ও সুযোগ্য নবি বলিয়া আমাকে মারহাবা জানাইলেন।
অতঃপর জিব্রাইল আমাকে লইয়া পঞ্চম আসমানে পৌছিলেন এবং গেট খুলিতে বলিলেন। এই স্থানেও পূর্বের নায় প্রশ্নোত্তর চলার পর শুভেচ্ছা ও মোবরকবাদ দানের সহিত দরজা খোলা হইল। আমি ভিতরে পৌছিয়া হারুন (আঃ)-এর সাক্ষত পাইলাম। জিব্রাইল আমাকে তাঁহার পরিচয় দানে সালাম করিতে বলিলেন। আমি সালাম করিলাম। তিনি আমার সালামের উত্তর দিলেন এবং সুযোগ্য ভ্রাতা ও সুযোগ্য নবি বলিয়া আমাকে খোশ আমদেদ জানাইলেন।
তারপর জিব্রাইল আমাকে লইয়া ষষ্ঠ আসমানের গেটে পৌঁছিলেন এবং গেট খুলিতে বলিলেন। এস্থানেও পরিচয় জিজ্ঞাসা করা হইলে জিব্রাইল স্বীয় পরিচয় দান করিলেন, অতপর তাঁহার সঙ্গে কে আছে জিজ্ঞাসা করা হইল। তিনি বলিলেন, মুহাম্মদ (সঃ) বলা হইল, তাঁহাকে ত নিয়া আসিবার জন্য আপনাকে পাঠান হইয়াছিল? জিব্রাইল বলিলেন, হাঁ! তৎক্ষণাত শুভেচ্ছা ও মোবারকবাদ জানাইয়া দরজা খোলা হইল। তথায় প্রবেশ করিয়া মূসা (আঃ)-এর সাক্ষাত পাইলাম। জিব্রাইল আমাকে তাঁহার পরিচয় জ্ঞাত করিয়া সালাম করিতে বলিলেন। আমি তাঁহাকে সালাম করিলাম। তিনি সালামের উত্তর প্রদান করিলেন। এবং সুযোগ্য ভ্রাতা ও সুযোগ্য নবি বলিয়া আমাকে মোবারকবাদ জানাইলেন।
যখন আমি এই এলাকা ত্যাগ করিয়া যাইতে লাগিলাম তখন মূসা (আঃ) কাঁদিতেছিলেন। তাঁহাকে কাঁদিবার কারণ জিজ্ঞাসা করা হইলে তিনি বলিলেন, আমি কাঁদিতেছি এই কারণে যে, আমার উম্মতে বেহেশত লাভকারীর সংখ্যা এই নবির উম্মতের বেহেশত লাভকারীর সংখ্যা অপেক্ষা কম হইবে, অথচ তিনি বয়সের দিক দিয়া যুবক এবং দুনিয়াতে প্রেরিত হইয়াছেন আমার পরে।
তারপর জিব্রাইল আমাকে লইয়া সপ্তম আসমানের প্রতি আরোহণ করিলেন এবং তাঁহার দ্বারে পৌছিয়া গেট খুলিতে বলিলেন। এস্থানেও পূর্বের ন্যায় সকল প্রশ্নোত্তরই হইল এবং দরজা খুলিয়া শুভেচ্ছা ও স্বাগত জানান হইল। আমি ভিতরে প্রবেশ করিলাম। তথায় ইব্রাহিম (আঃ)-এর সাক্ষাত লাভ হইল। জিব্রাইল আমাকে বলিলেন, তিনি আপনার (বংশের আদি) পিতা, তাঁহাকে সালাম করুন। আমি তাঁহাকে সালাম করিলাম। তিনি আমার সালামের উত্তর দিলেন এবং সুগোগ্য পুত্র, সুযোগ্য নবি বলিয়া মারহাবা ও মোবারকবাদ জানাইলেন।
অতঃপর আমি সিদরাতুল মোন্তাহার নিকট উপনীত হইলাম। (তাহা এক বড় প্রকান্ড কুল বৃক্ষ বিশেষ) তাহার এক একটা কুল “হজর” অঞ্চলে তৈয়ারী (বড় বড়) মটকার ন্য্যয় এবং তাহার পাতা হাতীর কানের ন্যায়। জিব্রাইল আমাকে বলিলেন, এই বৃক্ষটির নাম “সিদাতুল মোন্তাহা”। তথায় চারিটি প্রবাহমান নদী দেখিতে পাইলাম-দুইটি ভিতরের দিকে প্রবাহিত এবং দুইটি বাহিরের দিকে। নদীগুলি সম্পর্কে আমি জিব্রাইলকে জিজ্ঞাসা করিলাম। তিনি বলিলেন, ভিতরের দুইটি বেহেশতে প্রবাহমান (সাল্সাবীল ও কাওসার নামক) দুইটি নদী। আর বাহিরের দিকে প্রবাহমান দুইটি হইল (ভূ পৃষ্ঠের মিসরে প্রবাহিত) নীল ও (ইরাকে প্রবাহিত) ফোরাত (নদী বা তাহাদের নামের মূল উৎস)।
তারপর আমাকে “বায়তুল মা’মুর’ পরিদর্শন করান হইল। তথায় প্রতিদিন (এবাদতের জন্য) সত্তর হাজার ফেরেশতা উপস্থিত হইয়া থাকেন (যে দল একদিন সুযোগ পায় সেই দল চিরকালের জন্য দ্বিতীয় দিন সুয়োগ প্রাপ্ত হয় না)।
চলবে-২/৬