(পূর্বাপর)
অতঃপর (আমার সৃষ্টিগত স্বভাবের স্বচ্ছতা ও নির্মলতা প্রকাশ করিয়া দেখাইবার উদ্দেশ্যে পরীক্ষার জন্য) আমার সম্মুখে তিনটি পাত্র উপস্থিত করা হইল-একটিতে ছিল সুরা বা মদ, অপরটিতে ছিল দুগ্ধ আর একটিতে ছিল মধু। আমি দুগ্ধের পাত্রটি গ্রহণ করিলাম। জিব্রাইল বলিলেন, দুগ্ধ সত্য ও খাঁটি স্বভাগত ধর্ম ইসলামের স্বরূপ; (সুতরাং আপনি দুগ্ধের পাত্র গ্রহণ করিয়া ইহাই প্রমাণ করিয়াছেন যে) আপনি সত্য ও স্বভাবগত ধর্ম ইসলেেমর উপর প্রতিষ্ঠিত আছেন এবং আপনার উছিলায় আপনার উম্মতও তাহার উপর থাবিবে।
তারপর আমার শরীয়তে প্রত্যেক দিন পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায ফরয হওয়ার বিধান করা হইল। আমি ফিরিবার পথে মূসা (আঃ)-এর নিকটবর্তী পথ অতিক্রম করাকালে তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, বিশেষ আদেশ কি লাভ করিয়াছেন? আমি বলিলাম, পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায। মূসা (আঃ) বলিলেন, আপনার উম্মত প্রতিদিন পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায আদায় করিয়া যাইতে সক্ষম হইবে না। আমি সাধারণ মানুষের স্বভাব সম্পর্কে অনেক অভিজ্ঞতা লাভ করিয়াছি; এবং বনি ইস্রাঈলগণকে বিশেষভাবে পরীক্ষা করিয়াছি; সুতরাং আপনি পরওয়ারদেগারের দরবারে আপনার উম্মতের জন্য এই আদেশ আরও সহজ করার আবেদন করুন।
হযরত (সা) বলেন, আমি পরওয়ারদেগারের খাস দরবারে ফিরিয়া গেলাম। পরওয়ারদেগার (দুইবার যাওয়াতে পাঁচ পাঁচ করিয়া) দশ ওয়াক্ত কম করিয়া দিলেন। অতপর আমি আবার মূসার নিকট পৌছিলাম, তিনি পূর্বের ন্যায় পরামর্শই আমাকে দিলেন। আমি পরওয়ারদেগারের দরবারে ফিরিয়া গেলাম এইবারও (ঐরূপে) দশ ওয়াক্ত কম করিয়া দিলেন। পুনরায় মূসার নিকট পৌছিলে তিনি আমাকে এবারও সেই পরামর্শই দিলেন। আমি পরওয়ারদেগারের দরবারে ফিরিয়া গেলাম এবং (পূর্বের ন্যায়) দশ ওয়াক্ত কম করিয়া দিলেন। এইবারও মূসার নিকট পৌছিলে পর তিনি আমাকে পূর্বের ন্যায় পরামর্শ দিলেন। আমি পরওয়ারদেগারের দরবারে ফিরিয়া গেলাম, এইবার আমার জন্য প্রাতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নির্দিষ্ট করিয়া দেওয়া হইল। এইবারও মূসার নিকট পৌছিলে পর আমাকে তিনি জিজ্ঞাস করিলেন, কি আদেশ লাভ করিয়াছেন? আমি বলিলাম, প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের আদেশ প্রদান করা হইয়াছে।
মূসা (আঃ) বলিলেন. আপনার উম্মত প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাযেরও পাবন্দী করিতে পারিবে না। আমি আপনার পূর্বেই সাধারণ মানুষের স্বভাব সম্পর্কে অভিজ্ঞতা লাভ করিয়াছি এবং বনি-ইস্রাঈলগণকে অনেক পরীক্ষা করিয়াছি। আপনি আবার পরওয়ারদেগারের দরবারে ফিরিয়া আরও কম করার আবেদন জানান।
হযরত (সা) বলেন, আমি মূসাকে বলিলাম, পরওয়ারদেগারের দরবারে অনেক বার (মোট ৯ বার) আসা-যাওয়া করিয়াছি; এখন আবার যাইতে লজ্জাবোধ হয়, আর যাইব না বরং পাঁচ ওয়াক্তের উপরই সন্তুষ্ট রহিলাম এবং তাহা বরণ করিয়া নিলাম। হযরত (সঃ) বলেন, অতপর যখন আমি ফিরিবার পথে অগ্রসর হইলাম তখন আল্লাহ তাআলার তরফ হইতে একটি ঘোষণা জারি করা হইল-(বান্দাদের প্রাপ্য সওয়াবের দিক দিয়া)“আমার নির্ধারিত সংখ্যা (পঞ্চাশ) বাকি রাখিলাম, (আমার পক্ষে আমার বাক্য অপরিবর্তিতই থাকিবে। ৪১৭ ও ৪৫৫ পৃষ্ঠার হাদিছ দ্রষ্টব্য) অবশ্য কর্মক্ষেত্রে বান্দাদের পক্ষে সহজ ও কম করিয়া দিলাম। (অর্থাৎ কর্মক্ষেত্রে পাঁচ ওয়াক্ত রহিল, কিন্তু সওয়াবের দিক দিয়া পাঁচই পঞ্চাশ পরিগণিত হইবে।) প্রতিটি নেক আমলে দশ গুণ সওয়াব দান করিব। [দ্র: বোখারী ৫ম খ.৫ম সংস্করণ, আ. হক; পৃ: ৩৫১-৩৫৪]
২. “- হযরত ইব্রাহিম মক্বায় নির্বাসিত তদীয় পুত্র ইসমাঈলকে দর্শন করার উদ্দেশ্যে যে কয়েকবার সফর করেছিলেন সেই সময়ও ‘বুরাক’ ব্যবহৃত হয়েছিল। তীর্থ যাত্রীদের জেরুযালেমের আস-সাখরাঃ মসজিদে একটি অদ্ভুত অথচ চমৎকার সুন্দর প্রস্তর দেখান হয় এবং উহা বুরাকের জিন বলে উল্লেখ করা হয়। [দ্র: সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ, ২য় খ. ২য় সংস্করণ, পৃ: ৭০; ই. ফা.]”
সংক্ষিপ্ত সমালোচনা
মে’রাজ সম্বন্ধে ছেহাছেত্তার প্রত্যেকটি গ্রন্থে আরও বেশ কিছু হাদিছ আছে। সকলেই কয়েক শতাব্দি পরে ছাহাবা ও মহানবিকে কাল্পনিক সাক্ষি করে হাদিছগুলি রচনা করেছেন। তাদের মধ্যে মে’রাজের সময়, স্থান-কাল, অবস্থান ইত্যাদি নিয়ে ঘোর মতভেদ। শরিয়তের মতে ঐ মতভেদগুলি নাকি সাধারণ ও স্বাভাবিক! যেমন: মতান্তরে ১ ও ২ বার মে’রাজ হয়েছিল (দ্র: ই. ফাউন্ডেন অনুদিত কোরান, ৯ম. মুদ্রণ; ৫৩: নজম; ফুটনোট নং-৩১১); কারো মতে হিজরতের ১২ মাস পূর্বে, কারো মতে ১৬ মাস, ১৭ মাস, ১৮ মাস; আবার কারো মতে নুবুয়াতের ১২ বৎসর পরে! অর্থাৎ কিনা মদিনায়! কারণ হিযরতের সন মতান্তরে ১০/১৩ বৎসর)।
তারিখ সম্বন্ধে কারো মতে ১৭ই রবিউল-আউয়াল, ১৭ই রমজান, ২৭ শা রজব; আবার কারো মতে ২৭ শা রমজান।
কারো মতে বিবি উম্মেহানির ঘর থেকে কারো মতে কাবাঘর থেকে; কারো মতে স্ব-শরীরে কারো মতে স্বপ্নে হয়েছিল; জীবিত-মৃত সকল নবি-রাছুলদের জামাতবদ্ধ নামাজের ইমামতি করেছিলেন: কারো মতে মসজিদুল আকসায়, কারো মতে আসমানে; কারো মতে রওয়ানা হওয়ার পূর্বে কারো মতে ফিরে এসে, কারো মতে ১ বার কারো মতে ২বার; কেউ বলেন মহানবি আল্লাহকে সাক্ষাৎ দেখেছেন, মতান্তরে দেখেন নি ইত্যাদি। (দ্র: বোখারী ৫ম. খ. ৫ম মুদ্রণ, আ. হক; পৃ: ৩৫০-৩৫৯)
বলাবাহুল্য সকল হাদিছগুলিই অসংখ্য ছাহাবাদের নাম সাক্ষি রেখে রচিত হয়েছে। অতএব, শরিয়তের পরিভাষায় সবই সত্য-মহা সত্য এবং নির্ভুল (?)! অগত্যা এর একটিও অস্বীকার করার সকল পথ ও মত্ শরিয়তের পরিভাষায় রুদ্ধ!
শরিয়তের মতে মে’রাজ অর্থ উর্দ্ধারোহণ। অর্থাৎ পৃথিবী থেকে আকাশের কোন এক গ্রহ বা নক্ষত্রে ভ্রমণ; যেখানে বরই বাগান, সাগর-মহাসাগর, ৮টি পাঠার বাস। কিসে চড়ে ভ্রমণ, কোথা থেকে কোথায়; কোন কোন ঘাটে বিরতি; আল্লাহর দরবারে রাছুলকে নাস্তা-পানি, দুধ-মদ, আদর-আপ্যায়ন ইত্যাদি সকল বিষয় বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে হাদিছে।
জনৈক স্কুল ছাত্রের অভিমত
”বিজ্ঞান মতে পৃথিবীটা চন্দ্র-সূর্য ও গ্রহ-নক্ষত্রের মতই উর্দ্ধাকাশে অর্থাৎ শুন্যাকাশে। পৃথিবী থেকে মানুষ মাথা উচিয়ে চন্দ্র-সূর্য, আকাশ যেভাবে দর্শন করে; চন্দ্র বা অন্য কোন গ্রহ থেকেও অনুরূপ মাথা উঁচিয়ে উর্দ্ধাকাশের দিকে তাকিয়েই পৃথিবীকে দেখতে হয়। অর্থাৎ পৃথিবী থেকে রকেটে চড়ে উর্দ্ধাকাশে ছুটে যেমন চাঁদে পৌছতে হয় তদ্রুপ চাঁদ থেকে অবিকল উর্দ্ধাকাশে ছুটেই পৃথিবীতে ফিরে আসতে হয়; চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র যেমন শুন্যাকাশে, পৃথিবীও তেমন শুন্যাকাশে; অর্থাৎ শুন্যাকাশ বা আকাশ-পাতালের কোন উর্দ্ধ-নিম্ন নেই। কোন গ্রহ উপরে বা নীচে এ অবান্তর প্রশ্ন বটে। এতে যাদের সন্দেহ হয়, তারা স্ব-স্ব সন্তানদের কাছে সৌর মানচিত্র সামনে রেখে বাস্তবের মতই বিষয়টি স্ব-চক্ষে একিন করতে পারেন। উত্তর মেরুর গ্রীনল্যান্ড, সুইডেন বা কানাডা, আমেরিকার মাটি খুড়ে দক্ষিণ মেরু ভেদ করে অষ্ট্রেলিয়া, সাউথ আফ্রিকা বা এন্টারটিকা মহাদেশের আকাশে উঁকি দিলে দেখা যায় আমাদেরই চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র ও একই আকাশ। এমন উদাহরণটি প্রকৃত আলেম-আল্লামাদের জন্য নয়।
আরবি ‘ছামা’ অর্থ আকাশ, আকাশ অর্থ শুণ্য, শুণ্য অর্থ অদৃশ্য। ‘আর্দ্ব’ অর্থ বস্তু, বস্তু অর্থ দৃশ্য, দৃশ্য অর্থ চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্রসহ যাইই দৃষ্ট ও আবিষ্কৃত তাই আর্দ্ব; এমনকি আজকের পরমাণুও আর্দ্ব। ‘ছামাওয়াতে অল আর্দ্ব’, অর্থ: দৃশ্য-অদৃশ্য বা জানা -অজানা।
শরিয়তের বিশ্বাস যে, আল্লাহ নামক অকল্পনীয় আজব ব্যক্তিত্বটি (?) পৃথিবীতে বাস করেন না; সপ্তম আসমানের উর্দ্ধে ছেদ্রাতুল মোন্তাহা মটকীর মত বরই বাগানের পাশে/উর্দ্ধে (ছেদ্রাতুন=বরই, মোন্তাহা=প্রান্তে, কাছে বা সীমানা) তার আরশ/বাসা-বাড়ি। বৎসরে ১/২ বার মতান্তরে ১/২/৪র্থ আসমানে ৪ ফেরেস্তার কাধে চড়ে ভ্রমনে এসে চীৎকার করে মোসলমানদের ছোয়াব ফেরী করেন।
মতান্তরে আল্লাহর আরশ/বাসা বাড়ী
হাদিছটি অন্য কোথাও বর্ণিত আছে। ‘হযরত আব্বাস ইবনে আব্দুল মুতালিব (রা) থেকে বর্ণিত: -রাছুল বলেন যে, এক আসমান থেকে আর এক আসমানের দূরত্ব ৭১, ৭২ বা ৭৩ বৎসরের দুরত্ব। এভাবে সপ্তম আসমান পর্যন্ত গুণলেন; তার পর বললেন, সপ্তম আসমানের উপর রয়েছে একটি সমুদ্র, উহার গভীরতা ২ আসমানের দূরত্বের সমান; অতঃপর সেই সমুদ্রের উপরে আছে ৮টি বিরাটকায় পাঠা (ছাগল) এবং তাদের পায়ের খুর ও কোমরের মাঝখানের ব্যবধান দুই আসমানের মধ্যবর্তি দূরত্বের সমান। অতঃপর উহাদের পিঠের উপর রয়েছে আরশ-। [দ্র: মেশকাত, ১০ম খন্ড, হাদিছ নং-৫৪৮১, পৃ: ১৮৯, ১৯০; (১৯৯০)।
ছেদ্রতুল মোন্তাহা বা বরই বাগানের আসে-পাশে বা উর্দ্ধে [দ্র: সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ, ২য় খ. ২য় মুদ্রণ, পৃ: ১৯৩, ই. ফাউন্ডেসন]
একদা মহানবিকে আল্লাহর সেই বাড়িতে দাওয়াত করেছিলেন (মে’রাজ)। আল্লাহ দুধ, মধু ও মদ দ্বারা তাঁকে আদর সোহাগ করেছিলেন-।
(চলবে-৩/৬ পর্ব)