(পূর্বাপর)
‘আল্লাহ আকাশে থাকেন’ কথাটার অর্থ দাঁড়ায়: আল্লাহ সসীম, সৃষ্ট কোন ব্যক্তিত্ব, বস্তু, পদার্থ বা গ্যাস জাতিয় এমন কিছু; যিনি পৃথিবীতে থাকেন না। আর আকাশ অসীম, যার কোন এক নির্র্দিষ্ট বা সীমিত স্থানে আল্লাহর বসত বাড়ি! পক্ষান্তরে, আল্লাহ কি! কোথায় বাস করেন! তার প্রকৃতি কি! ইত্যাদি সকল পরিচয় তিনি কোরানে পরিস্কারভাবে বলে দিয়েছেন।
মূলতঃ মে’রাজ অর্থ ‘উর্দ্ধারোহণ’, সন্দেহ নেই; কিন্তু তা ব্যক্তি বা বস্তুর সিঁড়ি বেয়ে উর্দ্ধারোহণ নয়। বরং জ্ঞান, গুণ ও ক্ষমতার উর্দ্ধারোহণ। একজন ছাত্র উর্দ্ধারোহণ করতে করতে যেমন শিক্ষক, অধ্যাপক, অধ্যক্ষ হয়; একজন কেরানী যেমন ম্যানেজার, ডাইরেক্টর, জেনারেল ম্যানেজার হয়; ব্যাঙ যেমন লালা-মানিক প্রাপ্ত হয়; মৃগী কস্তুরী প্রাপ্ত হয়; তদ্রুপ আদিতত্ত্ব ভিত্তিক আধ্যাত্বিক তথা স্রষ্টা-সৃষ্টি জ্ঞানে মুছল্লী, মোসলেম, মমিন, মোত্তাক্বীন, পীর, বোজর্গ দরবেশ, রাছুল-নবিত্ব প্রাপ্ত বা জ্যোতিদেহ প্রাপ্ত/প্রেরণা প্রাপ্ত হওয়ার নামই মে’রাজ। নবি হওয়ার প্রধান ও চূড়ান্ত শর্তই জ্ঞানের উর্দ্ধারোহণ বা জ্ঞানের পরিপূর্ণতা। রাছুল-নবি হওয়ার ইহাই যোগ্যতা বা শর্ত। হযরত ইব্রাহিম, মূছা ও ঈছার মে’রাজের ইঙ্গিত নিম্ন আয়াতে পাওয়া যায়: হযরত ইব্রাহিমের [ ৬: ৭৫] হযরত মুছার [ ৭: ১৪৩, ১৪৪] হযরত ঈসার জন্ম লগ্নেই [৩: ৫৯]।
নবি-রাছুল হওয়ার অর্থই মে’রাজ প্রাপ্ত (পূর্ণ জ্ঞানপ্রাপ্ত) ব্যক্তি।
মে’রাজ সম্বন্ধে কোরানের আয়াতটি লক্ষণীয়:
ছুবহানা ল্লাজী-বাছির। [১৭: ১] অর্থ: পবিত্র ও মহিমময় তিনি যিনি তাঁর বান্দাকে রজনীযোগে ভ্রমণ করিয়ে ছিলেন মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসায়, যার পরিবেশ করেছিলাম বরকতময়, তাকে আমার নিদর্শন দেখাইবার জন্য-।
ভাববাদী অনুবাদ:[/sb
নিক্ষুত তত্ত্বজ্ঞানই ‘উপাস্য’, (আল্লাহ); সেই অন্ধকার, বর্বর, অজ্ঞানতার যুগে (রজনীযোগে) তার বান্দাকে নূরালোকে (বিদ্যুত/বোরাক) আপন স্বত্ত্বার (স্রষ্টা-সৃষ্টির রহস্য) প্রত্যক্ষ প্রমাণের জন্য (নিদর্শন দেখাবার জন্য) দূর-নিকট (মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আক্সা; আক্সা অর্থই দূরবর্তি) সব কিছুই বর্তমান (বরকতময়) করে দিয়ে ছিলেন।
কল্পিত মে’রাজ সম্বন্ধে এখানেই শুরু, এখানেই শেষ। অতঃপর মসজিদুল আক্সা থেকে মহানবির দুধ, মদ, পানি, শরবৎ ইত্যাদি আপ্যায়ণ; নবিদের সংবদ্ধ নামাজের ইমামতি; অতঃপর ১ম আসমান থেকে ৭ম আসমানে ধাপে ধাপে নবিদের সাক্ষাত, ৫০ ওয়াক্ত নামাজ, হযরত মুছা কর্তৃক ৯ বার ফেরৎ পাঠিয়ে ৯x৫= ৪৫ ওয়াক্ত নামাজ মাফ; মুছার কান্নাকাটি, আদমের বাঁয়ে তাকিয়ে কান্নাকাটি, ডানে তাকিয়ে হাসা-হাসি।
বেহেস্তের বিবরণ:
সেখানে মুক্তার মালা, রঙে ঢাকা, মাটি কস্তুরী, দুধের মত পানি। নীল নদ ও ফোরাত নদীর উৎস বেহেস্ত থেকে! (বেহেস্তের তাজ্জব বিবরণ বটে!)
দোযখের বিবরণ:
দোযখবাসীদের আর্ত চীৎকার, রক্তের নদী ইত্যাদি ইত্যাদি। [দ্র: বোখারী, ৫ম খন্ড, ৫ম মুদ্রণ,আ. হক; পৃ: ৩৫৩]
বোরাক:
দেখতে ঘোড়া নয়, গাধা নয়, খচ্চর নয়, লেজটি ময়ুরের, মাথাটি লাস্যময়ী নারীর। ছেদ্রাতুল মোন্তাহা অর্থাৎ আল্লাহর বাড়ীর আসে-পাশে বা উপরে-নীচে বরই বাগান! মটকির মত বরই! [উপরোক্ত হাদিছ ও সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ, ২য় খ. ২য় সংস্করণ, ‘মি’রাজ’ অধ্যায়, পৃ: ১৯২; ই. ফা] ইত্যাদি উদ্ভট, কাল্পনিক রচনা সম্ভারের সঙ্গে কোরানে তিল পরিমাণও ইঙ্গিত, ইশারা নেই।
মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত বিষয়টি আল্লাহ অহি করতে পারলেন আর সেখান থেকে ৭ম আসমান ও তদুর্ধের দূর্ভেদ্য বিষয়গুলো অহি করতে পারলেন না; অথচ সেটাই ছিল অত্যাধিক গুরুত্বপূর্ণ! আল্লাহর ঐ ব্যর্থতার (?) সুযোগে সালমান রূশদিগণ, আল্লাহ-রাছুলের অবমূল্যায়নের মহা সুযোগ করে নিলেন!
ছেহাছেত্তায় বর্ণিত মে’রাজ ও বেহেস্তের বিবরণগুলি যেকোন পাঠক পড়লেই বুঝতে পারবেন যে ঐগুলোর রচয়িতাগণ আমার চেয়েও অধিক মূর্খ ছিলেন।
উল্লিখিত কোরানের আয়াতগুলি স্মরণ রেখে নিম্ন বর্ণিত ধারাগুলি বিবেচনার বিষয়:
১. মহানবি পূর্ণ কোরান জিব্রাইলের মারফত প্রাপ্ত হয়েছেন। কিন্তু মে’রাজে আল্লাহর সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ, কথা-বার্তা, ৯ বার ফেরৎ পাঠিয়ে ৫ ওয়াক্ত করে মোট ৪৫ ওয়াক্ত কমিয়ে অর্থাৎ আল্লাহ বলেন, “৫ ওয়াক্ত, এটিই ৫০ ওয়াক্ত, আমার কথার পরিবর্তন হয় না”; এ আয়াতটি জিব্রাইল বিহীণ সরাসরি আল্লাহ ও রাছুলের পরস্পর প্রত্যক্ষ সাক্ষাত অহি। এ অহিটি মহানবির জীবনের সকল অহি অর্থাৎ ৩০ পারা কোরানের উর্ধে শ্রেষ্ঠতম ও পবিত্রতম অহি হওয়া সত্বেও তা কোরানে না লেখার কারণ কি!!!
২. উল্লিখিত অহিটি এক দুই বার নয়; বরং ৯ বার রদ-বদল করার পরেও আল্লাহর ঘোষণা: “আমার কথার রদ-বদল হয় না, ৫ ওয়াক্তই ৫০ ওয়াক্ত।” কি করে রদ-বদল হলো না! এ প্রশ্নবোধক চিহ্নটি পৃথিবী থেকে ৭ম আসমান পর্যন্ত দীর্ঘ বটে!
৩. নবিগণ আল্লাহর আদেশের তিল পরিমাণ সংযোজন, সংকোচন; অস্বীকার বা প্রতিবাদ করেন না বা করেন নি; করলে তাদের ঘাড়ের শিরা কেটে ফেলতেন বলে কোরানে ঘোষিত আছে [দ্র: ৬৯: ৪৪, ৪৫, ৪৬]। পক্ষান্তরে হাদিছ মতে মুছার পরামর্শে মহানবি আল্লাহর বিরুদ্ধে ৯ বার প্রতিবাদ/অনুরোধ করে ৫ ওয়াক্তে এনেছেন তবুও তাঁর ঘাড়ের শিরা কাটা হয়নি!
৪. পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের ঘোষণা কোরানের কোথাও নেই। যা আছে তা এরূপ: সকাল-সন্ধ্যা, সূর্য হেলে গেলে, রাতের কিছুটা অন্ধকার হলে, দিনের দুই প্রান্তে, সূর্য উদয়ের পূর্বে, অস্ত যাওয়ার পরে, রাতের দুই প্রান্তে, গভীর রাতে ইত্যাদি (দ্র: নামাজের ওয়াক্ত প্রতিবেদন); সুতরাং মে’রাজে গিয়ে ৫ ওয়াক্ত নামাজ এনেছেন বিশ্বাসটির কোনই যুক্তি-ভিত্তি নেই।
৫. হাদিছ মতে হযরত মোহম্মদ শ্রেষ্ঠ নবি, এমন কি নবিদের নবি। আল্লাহ-রাছুল কোরানে তা স্বীকারও করেন নি, সমর্থনও করেন নি; বরং তীব্র প্রতিবাদ করেছেন এই বলে যে, ‘নবি-রাছুলদের মধ্যে কারো সঙ্গে কারো পার্থক্য করিও না; যারা পার্থক্য করে তারা পথভ্রষ্ট, কাফের’ [ ৪: ১৫০, ১৫১, ১৫২]। পক্ষান্তরে ঐ একই হাদিছে হযরত মুছা হযরত মুহম্মদকে ৯ বার তার উম্মতের জন্য অদূরদর্শী ও অযোগ্য প্রমাণ করেছেন। এখানেই শেষ নয়! প্রারম্ভে উল্লিখিত আয়াতের বিপরিতে ৫০ ওয়াক্ত নামাজের ঘোষনা দিয়ে স্বয়ং আল্লাহকেই অবিবেচক ও কান্ড-জ্ঞানহীন, সুন্নাতের রদ-বদল, এমনকি ওয়াদা ভঙ্গকারী বলেই সাব্যস্ত করেছেন!!
৬. কথিত ‘বোরাক’ নামক সেই অদ্ভূত কুদরতী বাহনটি মসজিদুল আকসার (তৎকালে আকসা নামে কোন মসজিদ ছিল না) পাশে কোন পাথরের সঙ্গে রশি দিয়ে বেঁধে রেখেছিলেন, অদ্যবধি সেখানে নাকি দাগ আছে! কিন্তু ৭ম আসমানে, ছিদ্রাতুল মোন্তাহায় সেটিকে কিসের সঙ্গে বেঁধে রেখেছিলেন তার কোন হাদিছ রচিত হয় নি। রফ রফের আকার-আকৃতিরও কোন বর্ণনা হাদিছে লিখিত হয়নি! তাছাড়া কোন্ বাহনে চড়ে তিনি ৯ বার আসা-যাওয়া এবং পৃথিবীতে ফেরৎ এসেছিলেন! সে সম্বন্ধেও কোন হাদিছ রচনা করতে পারেননি।
৭. প্রকাশ থাকে যে, মহানবি মে’রাজে যাওয়ার পূর্বেই তিনি ও ছাহাবাগণ নামাজ করতেন, এমনকি পূর্বের সকল নবি-রাছুল ও তাঁদের উম্মতগণ নিয়মিত নামাজ করতেন, কোরানে তার ভুরি ভুরি প্রমাণসহ অন্য ধর্মেও তার বেশি-কম সাক্ষি-প্রমান আছে। কল্পিত হাদিছগুলিতেও সাক্ষ্য দেয় যে, ‘ঘটনাটি ঘটে এশার নামাজের পরে যখন তিনি ঘুমাতে যান এবং স্ত্রীর কাছে বর্ণনা করেন ফজরের নামাজের পরে।’
৮. কোরানের ১১৪টি ছুরার মধ্যে ৮৬টি ছুরাই মক্বায় অবতীর্ণ হয়েছে, যার অধিকাংশ ছুরাতেই নামাজের কথা উল্লেখ আছে। শুধু তাইই নয়: ইসলামি ঐতিহাসিক ও হাদিছবিদদের মতে: ওয়াক্ত সংক্রান্ত আয়াতগুলির অধিকাংশই কথিত মে’রাজের পূর্বে অর্থাৎ নুবুয়াতের ৩ থেকে ৮ বৎসরের মধ্যে অবতীর্ণ হয়েছে। [ আরবি- ইংরাজী কোরান; মুহাম্মদ এম. পিকথল]।
৯. গাধা-খচ্চর, নারী সাদৃশ কথিত বোরাকের জিনটি দুনিয়ার পাথরের তৈরী কেন? দুনিয়ায় পড়ে থাকলো কেন? ক্যামনে ভাংলো! কে রিপেয়ার করলো! কে! কখন! কিভাবে সেটি জেরুযালেমের আস সাখরাঃ মসজিদে ফেলে গেলো! জিনহীণ ভাংগা বোরাকে রাছুল কিভাবে ভ্রমণ করলেন! ইত্যাদি হাজার হাজার প্রশ্নে উত্তর দেয়ার জন্য জিন্ন ও ইনছান একত্র হয়ে চেষ্টা করলেও তা সম্ভব নয়।
১০. মে’রাজ-মে’রাজ করে দুনিয়াব্যপী চীৎকার করলেও কোরানে উল্লিখিত আয়াতে ইহার তিল পরিমাণ অস্তিত্ত্ব নেই কেন!
১১. রক্ত-মাংসের স্থুল দেহধারী মানুষের পক্ষে আল্লাহ দর্শন অবাস্তব এবং মিথ্যা কল্পনা মাত্র। [দ্র: উপরে বর্ণিত ঙ নং ধারা]।
১২. কোরান ও আল্লাহ সম্বন্ধে ইমামদের তিল পরিমাণ ধর্ম জ্ঞান থাকলে আল্লাহকে মানবিয় ব্যক্তিত্ব হিসাবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করে শেরেকী অপরাধের আসামী হ’তেন না! সমগ্র মুসলিম জাতিতে বিভ্রান্তও করতেন না।
(চলবে-৪/৬ পর্ব)