somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পতিপ্রাণা (ছোটগল্প)

০২ রা মার্চ, ২০১৫ রাত ১২:১০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দুপচিনি গাঁয়ের মাওলা বাড়ির মৃত সায়েজুদ্দিন মাওলার একমাত্র সন্তান সায়েফুদ্দিন মাওলা যখন সৌদি আরব যাওয়ার সব কিছু পাকা করে ঢাকা থেকে ফিরলো, তার মা শরীফুন্নেছার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। একমাত্র ছেলে বিদেশ-বিভূঁইয়ে চলে যাবে এই চিন্তার চেয়ে বড় হয়ে দাঁড়ালো ছেলের সৌদিতে গিয়ে ‘আরোবী মাইয়া’ বিয়ে করার আশঙ্কা। সায়েফুদ্দিন যতই মা’কে বুঝায় সে কাজ করতে যাচ্ছে, বিয়ে করতে নয়, শরীফুন্নেছা ততোধিক জোর দিয়ে বলেন বিয়ে না করলে তিনি কিছুতেই তাকে যেতে দেবেন না। ছেলের মত ঘুরাতে তিনি দুইদিন কিছু খেলেন না, তিন রাত বকবক করলেন, না ঘুমিয়ে (সেটা অবশ্য ইচ্ছা করে নয়, ঘুম তার এমনিই আসছিলোনা)। তৃতীয় দিন সকালে ছেলে হার মানলো। শরীফুন্নেছার পাত্রী পেতে দেরি হলো না কারণ মেয়ে তিনি আগেই ঠিক করে রেখেছিলেন – সায়েজুদ্দিন মাওলার দোস্ত এখলাছ শেখের ছোট মেয়ে লুত্‌ফা। পরদিন সন্ধ্যায় সায়েফুদ্দিন আর লুত্‌ফার বিবাহ দিয়ে শরীফুন্নেছা নিশ্চিন্তে ঘুমাতে গেলেন। ঘুম আসলোনা সায়েফুদ্দিন আর লুত্‌ফার চোখে। তারা নতুন পৃথিবী আবিষ্কারের নেশায় রাত পার করলো।

পরদিন যখন অনেক বেলায় ছেলে ও ছেলের বউ ঘরের বাইরে আসলো এবং নির্লজ্জের মতো প্রায় সারাটা দিন দরজা বন্ধ করে ঘরে থাকলো, শরীফুন্নেছা মাগরিবের নামাজ পড়ে অত্যন্ত প্রসন্ন মনে চেমনবাহার দিয়ে দু’খানা পান মুখে পুরে প্রতিবেশিনী আকলিমা বেগমের সাথে ছেলে ও ছেলে-বউয়ের বেহায়াপনার আলাপ করতে গেলেন। ফিরে এসে শুনলেন তারা খেয়ে ‘ঘুমিয়ে’ পড়েছে। শরীফুন্নেছা ‘বেশরম জমানার বেশরম পোলাপাইন’ বলে মিছা রাগে গজগজ করতে লাগলেন।

লুত্‌ফা স্বামীকে ছাড়তে চায়না। বলে, ‘তুমার যাওনের দরকার নাই.........তুমার কি কম আছে! এক বাপের এক পোলা তুমি, তুমার অবাব কিসের? কি ঠেকা পরছে সউদি যাওয়ার!’ এইট পাশ সায়েফুদ্দিন ফাইভ ফেল লুত্‌ফাকে আত্মমর্যাদার শিক্ষা দেয়। বুঝায় বাপেরটা বসে বসে খাওয়াতে কোন গৌরব নেই, বুঝায় জীবনে নিজে কিছু না করতে পারলে জন্মই বৃথা। লুত্‌ফা এসব বুঝতে চায়না, সে সায়েফুদ্দিনকে কিছুতেই ছাড়বে না।

তারপর যখন বুঝতে পারলো সায়েফুদ্দিন যাবেই, তখন সে স্বামীকে ধরে রাখার হাল ছেড়ে দিয়ে স্বামীর স্মৃতি ধরে রাখার আশা বাঁধল। বলল, ‘আমাকে একটা বাচ্চা দিয়া যাও’। সায়েফুদ্দিন আবার বউকে বুঝায়। এত তাড়াতাড়ি সন্তান নেয়ার বিপক্ষে হাজারো যুক্তি খাড়া করে। তারপর বলে, ‘আমি তো একবছর বাদেই আইতাছি। তহন আমরা বাচ্চা নিমু। এক বছর দেকতে দেকতে যাইব গা’।

এক বছর দেখতে দেখতে যায়না। পলে পলে তার স্বামীর কথা মনে হয়। মানসিক যাতনা আর শারীরিক তাড়নায় একেকটা দিন একেক বছরের মতো লাগে। শরীফুন্নেছা বউকে বলে ‘বাপের বাড়িত্‌ তে গুইরা আসো, বালা লাগবো’। দু’দিন পরেই ফিরে আসে লুত্‌ফা। এখানে তার স্বামীর স্পর্শ আছে, বালিশে এখনো গন্ধ আছে – সে অন্য কোথাও গিয়ে থাকতে পারবেনা। শরীফুন্নেছা মনে মনে প্রীত হয়, ‘বেটি তাইলে প্রেমে মইজাছে!’

মৃত সায়েজুদ্দিন মাওলার একটা ভাই ছিলো, তার আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো ছিলোনা। তার বড় ছেলেটিকে শরীফুন্নেছা নিজের বাড়িতে এনে রেখেছিলেন, তার সব দায়িত্ব নিয়েছিলেন। বাড়ির বাইরের সব কাজ সে-ই করতো – গেরস্তি, বাজার-সদাই, যখন যেটা লাগে। তার নাম রইছুদ্দিন। সম্পর্কে ছোট হলেও বয়সে সে লুত্‌ফার কিছু বড়ই ছিলো। শরীফুন্নেছা লম্বা, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী এই ছেলেটিকে নিজের ছেলের মতই দেখতেন।

কখন কিভাবে শুরু হলো কেউ জানেনা, তবে শরীফুন্নেছার চোখকে ফাঁকি দিয়ে, কাক-পক্ষীটিকেও বুঝতে না দিয়ে, লুত্‌ফাও রইছুদ্দিনকে সায়েফুদ্দিনের জায়গায় বসিয়ে দিলো। বেচারা সায়েফুদ্দিন বিয়ের সাড়ে চার মাসের মাথায় সবার আড়ালে বউকে হারালো!

এক বছর চলে যায়। সায়েফুদ্দিন জানায় এইবার তার ছুটি মিলে নাই, পরের বছর আসবে। লুত্‌ফা শাশুড়ীর সামনে অনেক রাগ দেখায়, দুই বেলা না খেয়ে থাকে। বউয়ের চাতুরী ধরতে ব্যর্থ শাশুড়ী খুশি মনে তার রাগ ভাঙ্গায়। মনে মনে ভাবে, ‘বেটি প্রেমে মইজাছে!’

আরেকটা বছর চলে যায়। সায়েফুদ্দিন বলে এইবার সে টিকিট কেটেছে, বাড়ি আসবে। লুত্‌ফা শাশুড়ীকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে। শরীফুন্নেছা আদর করে বলে, ‘পাগলী’। সেদিন রাতে রইছুদ্দিনকে সে একটু বেশিই ভালোবাসলো। রইছুদ্দিন গর্ভপ্রতিরোধক ব্যবহার না করতে চাইলে সে কেবল একটু অমত করেছিলো।‘কিছু অইবোনা.........আর অইলেই কি? তুমার জামাই আয়া পরতাছে কয়দিন পরেই’ রইছুদ্দিনের এ কথাতেই তার নারাজি উড়ে গিয়েছিলো।

সপ্তাহখানেকের মাথায় যখন হালকা রক্তক্ষরণ হলো, শঙ্কায় লুত্‌ফার পৃথিবী অন্ধকার হয়ে আসলো। রইছুদ্দিনকে জানালে সে তাকে চিন্তা করতে না করলো। আর তো এক সপ্তাহ, সায়েফুদ্দিন দেশে আসলে সব ঠিক হয়ে যাবে, কেউ টের পাবেনা। একথা বলে লুত্‌ফাকে আশ্বস্ত করে রইছুদ্দিন তাকে এড়িয়ে চলতে লাগলো। অনেক কষ্টে লুত্‌ফা যখন তার সাথে কথা বলার সুযোগ পেলো, রইছুদ্দিন সাফ জানিয়ে দিলো যে এই ‘কেলেঙ্কারির’ দায় সে নেবেনা। লুত্‌ফা বুঝলো সব দিয়েও সে কেবল শরীরটা পেয়েছে, মনটা নয়। তার আফসোসের সীমা রইলো না।

মাওলা বাড়িতে পুরো গ্রাম ভেংগে পড়েছে। মৃত সায়েজুদ্দিন মাওলার একমাত্র সন্তান ছায়েফুদ্দিন মাওলা সৌদি আরবে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে। লুত্‌ফার মাথায় কিছু আসছেনা। কি করবে সে? সে মাওলা বাড়ির বউ, শেখ বাড়ির মেয়ে – এতবড় অপবাদ মাথায় নিয়ে কিভাবে বাঁচবে সে! লুত্‌ফা অনেক কাঁদলো, খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিলো। সবাই তাকে নানানভাবে সান্তনা দিতে লাগলো। কিন্তু ভুল উপলক্ষে দেয়া সেসব সান্তনায় তার কষ্ট বিন্দুমাত্র কমলো না। সায়েফুদ্দিনের লাশ আসার দিন ঘনালো। লুত্‌ফার শরীরের আরো ছোটখাট উপসর্গ তাকে ক্রমাগত জানান দিতে লাগলো যে তার ভেতরে নতুন জীবনের বিকাশ শুরু হয়েছে।

মঙ্গলবার দুপুরে সায়েফুদ্দিনের কফিনবন্দী লাশ বাড়ি আসলো। লুত্‌ফা সে লাশ দেখেনি। সেদিন ভোরেই ঘরের ধর্নার সাথে দড়ি বেঁধে সে আত্মহত্যা করেছে। স্বামীর মৃত্যুশোকে স্ত্রীর আত্মহত্যা – এই বিরল ঘটনায় চারপাশের গ্রামগুলো জনশূণ্য হয়ে পড়লো। শরীফুন্নেছা কাঁদতে কাঁদতে তার ছেলে আর ছেলে-বউয়ের গভীর ভালোবাসার কথা বার বার বলতে বলতে পেরেশান হয়ে গেলো।

বিকেলে জানাজা শেষে পাশাপাশি কবরে তাদের সমাহিত করা হলো। তাদের ভালোবাসার কাহিনী রুপকথা হয়ে মানুষের সাথে ঘরে ঘরে ফিরে গেলো। একটি জাতীয় দৈনিকও বক্স করে নিউজ ছাপালো। সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লো স্বামীভক্তির এই বেমিসাল বৃত্তান্ত। সবাই এই মহিয়সী নারীর জন্য শোক করতে লাগলো। কেবল রইছুদ্দিনই জানলো লুত্‌ফা মরে কতটা বেঁচেছে এবং তাকে কতটা বাঁচিয়ে দিয়ে গেছে।

১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৫
ঢাকা।
[১৯৯৮-৯৯ সময়কালে লেখা মূল গল্পটি হারিয়ে গেছে। এটি মূল ভাবনা থেকে পুনর্লিখিত]


অন্যান্য গল্পঃ

ক্যামেরা (ছোটগল্প)

মায়ামৃগ (ছোটগল্প)

বাসুনী (ছোটগল্প)

মান ভাঙানোর গপ্পো (রম্যগল্প)

বারোটার ট্রেন (ছোটগল্প)

ফইন্নির পুত (ছোটগল্প)

লামিয়ানা (ছোটগল্প)
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা আগস্ট, ২০১৫ রাত ৩:৩৭
২৩টি মন্তব্য ২৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×