এসি নিয়ে বাড়িওয়ালীর সাথে শেষ পর্যন্ত আমার বেশ ভালোরকমই বচসা হলো। ঠিক করলাম অনেক হয়েছে আর না। নি:সঙ্গ বুড়িগুলো একটু খিটখিটে হয় জানি কিন্তু এর মাত্রাটা বাড়াবাড়ি রকমের বেশি। আরো আগেই চলে যাওয়া উচিত ছিলো। যাইনি কারণ লোকেশনটা ভালো - মেট্রো কয়েক কদম আর শপিং মল এক দৌড়। কিন্তু এবার আর থাকছি না। আমি ক্রেইগলিস্টে এড দিলাম, বন্ধুদের বললাম - একই সাথে নতুন বাসার এবং পুরনো বাসায় আমার রিপ্লেসমেন্টের জন্য। লীজের এখনো কয়েকমাস বাকী। কপাল ভালো, সপ্তাহখানেকের মধ্যেই সব পাকাপাকি করে ফেললাম। আগেরটা ছিলো পেনসিলভেনিয়া এভিনিউতে, এটা ম্যাডিসন ড্রাইভে, দশ মিনিটের হাঁটা দূরত্বে।
খিটখিটে-শুকনো-নি:সঙ্গ বুড়ির সাথে সব হিসাব চুকিয়ে ইউ-হোল এ মালপত্র নিয়ে নতুন অ্যাপার্টমেন্টে উঠলাম। দু' ইউনিটের দোতলা বাড়ি, কাঠের মেঝে, পুরো ফ্লোর অফ-হোয়াইট কার্পেটে ঢাকা। এক তলায় ডানপাশে আমার অ্যাপার্টমেন্ট, পেছনে ছোট পাহাড়, সামনে বাঁকানো, ঢালু রাস্তা। লিভিংরুমের জানালা দিয়ে ডাউনটাউনের খুবি চমৎকার একটা ভিউ পাওয়া যায়, বিশেষ করে সন্ধ্যায়। বাড়ির মালিক এখানে থাকেনা। এরকম আরো কয়েকটা বাড়ী আছে ওর। সেগুলোও ভাড়া দিয়ে রেখেছে। সে থাকে কাছের একটা ইন এ। গত দুবছর ধরে সেখানেই একটা ডিলাক্স সুয়ীট ভাড়া নিয়ে থাকছে। কথায় কথায় এটুকুই জেনেছি, এর বেশি জানা হয়নি। ফোন আছে, নম্বর সে ভাড়াটেদের দেয় না, ইমেইলে যোগাযোগ করতে বলে। আমার খারাপ লাগেনি লোকটাকে, উৎপাতহীন ভদ্র বলেই তো মনে হলো।
নতুন বাসায় এসেছি সপ্তাহখানেক হয়ে গেছে। এর মধ্যে বাড়ির অন্যান্য ভাড়াটেদের সবার সাথেই দেখা হয়েছে, যদিও সেটা হাই হ্যালো পর্যন্ত। এর বেশি দরকার নেই। একা থাকতে ভালো লাগে, একলা বোধ করিনা। আপাতত কোন সম্পর্কের জালে নেই, তবে উপোষ করছি না। আমি দেখতে মন্দ নই। ফ্রাইডে নাইটে বারগুলোতে ঢু মারি, কাউকে না কাউকে নিয়েই বাসায় ফিরি। অনেক দিন পর আজকেই ফ্রাইডে নাইটে বেরুলাম না। শুয়ে শুয়ে একটা বই পড়ছি, তখনি শব্দটা কানে এলো।
প্রথমে ঠিক বুঝতে পারিনি, কিন্তু ধীরে ধীরে শব্দটা যখন আরো জোরে আসতে লাগলো মনে হলো কেউ কাতরাচ্ছে। কোন কথা শোনা যাচ্ছে না, কেবল নিগৃহীতার একটানা অসহায় কান্না। হ্যা, আমি নিশ্চিত শব্দটা একটা মেয়ের, আর সেটা আসছে আমার সোজা উপরের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে। অনেকক্ষণ পর, আমি ঘড়ি দেখিনি তবে মনে হলো, চল্লিশ মিনিট বা একঘন্টা পর শব্দটা থামলো। অস্বস্তি আর ক্ষোভ মেশা বিরক্তিতে সে রাতে ভালো ঘুম হলো না আমার।
পরদিন অফিসে এক সহকর্মীকে জানালাম ঘটনাটা। ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের সম্ভাবনা সে একেবারে উড়িয়ে দিলনা, তারপর যোগ করল, 'এমনো তো হতে পারে ওরা সেক্স করছিলো'। আমি খুব খুশি হলাম না ওর কথা শুনে। আমি কী এতই বোকা, এই পার্থক্যটুকু বুঝবো না! কাজে মন দিলাম।
এরপরের কয়েকদিন সেরকম কিছু না ঘটলেও বলার মতো একটা ঘটনা ঘটলো। উপরের বাসিন্দাদের সাথে আমার পরিচয় হল। ছেলেটির নাম জিম, গড়পড়তা উচ্চতার খুব ডিসেন্ট একটা ছেলে। মেয়েটি স্টেলা, সোনালী চুলের ছোটখাট গড়নের প্রাণবন্তু এক প্রজাপতি যেন। জিম একটা অ্যাডভোকেসি ফার্মে কাজ করছে আর স্টেলা মাস্টার্স করছে সোস্যাল ওয়ার্কে। একজন মিনেসোটার, আরেকজন টেক্সান।
তার ক’দিন বাদেই ব্যাপারটা আবার ঘটলো। এবার ভরদুপুরে, রোববারে লাঞ্চ সেরে সিয়েস্তায় প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। তখনি শুনতে পেলাম, সেই কাতরানোর শব্দ, আবারো। স্পষ্ট বুঝতে পারলাম স্টেলার গলা। আজকে নিপীড়নের মাত্রাটা মনে হচ্ছে বেশি। আওয়াজটা অনেক জোরে আসছে। একটু পর তার সাথে নতুন একটা শব্দ যোগ হলো। জিম ওকে মারছে, ক্রমাগত। স্টেলার কণ্ঠও শুনতে পেলাম আমি, 'আর মেরো না, এবার ছেড়ে দাও আমাকে, প্লীজ। তোমার পায়ে পড়ছি।' নির্দয় জিমের কোন কথা শোনা যাচ্ছেনা, ক্রমাগত মেরেই যাচ্ছে আর স্টেলা চিৎকার করছে। অনেকক্ষণ ক্ষীণকণ্ঠে আহাজারি করলো স্টেলা । তারপর একসময় আর কিছু শুনতে পেলাম না। রাগে আমার গা জ্বলছে, জিম কী করে পারে পরীর মতো মেয়েটার উপর এত নির্মম অত্যাচার করতে!
পরদিন অফিসে কয়েকজন সহকর্মীর সাথে শেয়ার করলাম ব্যাপারটা। যার মন্তব্যে আগেরবার আমার মনীষা আহত হয়েছিল, সেও এবার একটু কঠোর।'এটাতো যৌন নির্যাতন!' মনে মনে তার জাজমেন্টের উপর আমার আস্থাটা বেশি ছিলো, আমি প্রীত হলাম। অন্যরাও তার কথায় সায় দিলো। সবাই পরামর্শ দিলো 'তোমার এটা পুলিশে রিপোর্ট করা দরকার।' সিদ্ধান্ত নিলাম এরপর যেদিন ঘটবে, পুলিশ ডাকব আমি, মানুষ হিসেবে এ আমার বাঁধা দায়িত্ব।
বেশিদিন অপেক্ষা করতে হলো না আমাকে। আগের দুটো ঘটনা উইকএন্ডে ঘটেছে, তাই কেন জানি মনে হচ্ছিল এবারো সেটাই হবে। হয়তো আমার উৎসাহ বেশি ছিল বলেই। সিদ্ধান্ত নিলাম এই উইকএন্ডে যতটা সম্ভব বাসায় থাকব, জিম ব্যাটাকে হাতেনাতে ধরতে হবে। ইচ্ছে করেই তাই পরের ফ্রাইডে নাইটে বেরুলাম না। কিন্তু হতাশ হলাম, কিছুই ঘটলো না। ঘটলো ট্যুসডে নাইটে। শুরু হবার সাথে সাথে আমি ফোন হাতে নিয়ে বসে আছি। ঘড়ি দেখছি, দশ মিনিট - পনেরো মিনিট - বিশ মিনিট - তেইশ মিনিট - স্টেলার কাতর অনুনয়, 'প্লীজ থামো', তখনি জিম ওকে মারতে শুরু করেছে। আমি ৯১১ এ ডায়াল করলাম, পাঁচ মিনিটের মধ্যে পুলিশ চলে এলো। অ্যাপার্টমেন্টের দরজা খুলে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি। মধ্য পঞ্চাশের মোছওয়ালা অফিসারকে উত্তেজিত স্বরে বললাম, 'উপরের তলায়, এপাশে। এসব লোকের কঠিন শাস্তি হওয়া দরকার।' অফিসার নিরুত্তাপ কন্ঠে আশ্বস্ত করলো আমাকে, 'তুমি ভেতরে যাও, আমি দেখছি।'
আমি লিভিংরুমে বসে রইলাম, নজর জানালো দিয়ে বাইরে, অফিসারের গাড়ির দিকে। অপেক্ষা করছি কখন অফিসার ভালোমানুষ চেহারার ধূর্ত শয়তান জিমকে ঘাড় ধরে গাড়িতে তুলবে। নির্ঘাৎ ব্যাটার কয়েক বছরের জেল হবে। এত বড় একটা উপকারের জন্য স্টেলা নিশ্চয় আমার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে। এমন যদি হয় যে সেটা অনুরাগে রূপ নেয়! মন্দ হবে না, মেয়েটাকে আমার ভালোই লাগে।
বারবার ঘড়িতে চোখ যাচ্ছে । এত সময় নিচ্ছে কেন অফিসার! বিকৃতরুচি বদমাশটাকে ধরে আনতে এত সময় লাগে! প্রায় বিশ মিনিট হতে চলল। নাহ্, কোন শুভ কাজই তাড়াতাড়ি হয়না! এমন সময় আমার দরজায় নক করলো কেউ। খুলে দেখি অফিসার।
'রিপোর্ট করার জন্য ধন্যবাদ, কিন্তু কোন অপরাধ হচ্ছিলো না ওখানে।'
'কী বলছো তুমি! ' বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেলাম আমি।
'দে ওয়ার মেইকিং লাভ, কনসেনসুয়ালি'
'ওয়াট! '
'ইয়েস মাই ফ্রেন্ড'
'কিন্তু স্টেলা মানে মেয়েটা বার বার অনুরোধ করছিলো ওকে না মারার জন্য।'
'সেটা আসলে ছিলো আরো বেশি আঘাতের আহ্বান।'
'কীভাবে! ' আমার বিস্ময়ের ঘোর এখনো কাটেনি
'ওরা ম্যাসোকিস্ট', অফিসার জবাব দিলো।
ব্যাপারটা হজম করতে কষ্ট হচ্ছিলো আমার। 'ম্যাসোকিস্ট হলে তো ছেলেটারও নির্যাতিত হবার কথা। আমি ওর আর্তনাদ কখনো শুনিনি। ও সবসময় নীরবে ওর গার্লফ্রেন্ডকে পিটিয়েছে।' অফিসার হাত তুলে আমাকে থামালো, 'মেয়েটা ম্যাসোকিস্ট, ছেলেটা স্যাডিস্ট। আই এপ্রিশীএইট ইয়োর কনসার্ন, বাট ইট ওয়াজ জাস্ট আ সেক্স প্লে। বাড়িওয়ালাকে বল উপরের মেঝেটা ফিক্স করতে। যন্ত্রণাতেও আনন্দ আছে', বলে হেসে বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে চলে গেলো। আমি দরোজা বন্ধ করে প্রথমে হতবাক এবং পরে লজ্জিত হয়ে বসে রইলাম।
এর মধ্যে দু'সপ্তাহ চলে গেছে। বাসা থেকে বের হতে গেলে বা বাসায় আসতে গেলে সবসময় একটা উইশ করি, 'জিম আর স্টেলার সাথে যেন দেখা না হয়।' সব ইচ্ছা পূরণ হয়না, একদিন দেখা হয়ে গেলো। মনে হলো দুপক্ষই বিব্রত হলাম, হঠাৎ চোখাচোখি হতেই আমরা দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলাম। ব্যাপারটা নিয়ে যত ভাবছি, আমার মধ্যে অপরাধবোধ ততই বাড়ছে। সামনে দাঁড়িয়ে সরি বলতে পারবোনা, সে চেষ্টা করে লাভ নেই। বিকল্প পন্থা হিসেবে ছোট্ট একটা উপহার কিনে, র্যাপিং পেপারে মুড়িয়ে, সাথে একটা অ্যাপোলোজি নোট েসঁটে ওদের দোরগোড়ায় রেখে এলাম। নোটে ছোট্ট করে লিখলাম,
'প্রিয় জিম ও স্টেলা, আমার বোকামির জন্য তোমাদের ভয়ানক অপ্রতিভ হতে হয়েছে, সেজন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত ও ক্ষমাপ্রার্থী। ভালোবাসার যে অনেক রং, অনেক বহি:প্রকাশ সেটা আমি ভুলে বসেছিলাম। সেই উপলব্ধিটুকু তোমরা ফিরিয়ে দিলে, তাই চিরকৃতজ্ঞতা। আমি সর্বান্তঃকরণে চাইবো, আমার বুদ্ধিহীনতা যেন তোমাদের প্রেমানুভূতি প্রকাশে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়। তোমাদের ক্ষমা পাবার আশায় রইলাম। শুভেচ্ছা।'
ওরা আমাকে নিরাশ করেনি।
ঢাকা, ৮ আগস্ট ২০১৫।
[Submitted to the 7th Bangla Blog Contest. Written for my upcoming short-story book. ]
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১:৫১