somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

"যে দেশে কোনো মানুষ ছিল না" গ্রন্থালোচনা, পাঠ প্রতিক্রিয়া ও লেখকের কৈফিয়ত

২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ রাত ৯:২৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গ্রন্থঃ যে দেশে কোনো মানুষ ছিল না
বিষয়বস্তুঃ ছোটগল্প (২১ টি), রম্য নাটক ১ টি
লেখকঃ মোকাম্মেল করিম
প্রকাশকঃ এ কে নাছির আহমেদ সেলিম, কাকলী প্রকাশনী, ঢাকা
প্রথম প্রকাশঃ বইমেলা ২০১৬
প্রচ্ছদঃ অনন্ত আকাশ

গত বইমেলায় প্রকাশিত বইটি পড়ে অনেকেই মন্তব্য করেছেন, প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। প্রথম বই হিসেবে সবার কাছেই আমার নিবেদন ছিল 'সৎ' প্রতিক্রিয়া জানাতে এবং অনেক ক্ষেত্রেই সেটা পেয়েছি। সকালদা বইটি নিয়ে লিখেছেন একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে, কাবুল ভাই রিভিউ লিখেছেন জলছবি বাতায়ন -এর ই-ম্যাগাজিনের প্রথম সংখ্যায়। এছাড়া আরো অনেকেই পাঠ-প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। এখানে কেবল লিখিত পাঠ-প্রতিক্রিয়াগুলো থেকে কয়েকটি তুলে দেয়া হল। সেই সাথে থাকছে আমার বক্তব্য।


সকাল রয়
কবি ও গল্পকার


দুই হাজার ষোল’র একুশে বই মেলায় প্রকাশিত হয়েছিলো মোকাম্মেল করিম এর গল্পগ্রন্থ “যে দেশে কোন মানুষ ছিল না”। কাকলী প্রকাশনী প্রকাশ করেছে এই গ্রন্থ। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন-অনন্ত আকাশ। গাজীপুর জন্ম নেয়া এই লেখকের প্রথম গ্রন্থ এটি। মূলত সরল আঙ্গিকের কথামালায় তিনি ফুটিয়ে তুলেন সমাজ ও পরিবার মিশ্রিত বিষয়গুলো। লেখকের লেখনিতে অতিআশ্চর্য্য কিছু না থাকলেও নিজস্ব একটা ধারা বয়ে চলে শুরু থেকে শেষ অবধি। এই গল্পগ্রন্থে সংকলিত বাইশ গল্প নিয়ে কথা-গল্পের গল্পকথায় তুলে ধরেছি কিছু কথা।

পুরো গল্পগ্রন্থটি পাঠ করার পর দেখতে পাই, লেখক সরল রেখাচিত্র অঙ্কনের মতো দৃশ্যকল্প নিয়ে কোন রকম বাহুল্য ছাড়াই কথাকল্পগুলোর গল্পের রূপ দিয়েছেন এই গ্রন্থে। যে গল্পগুলো সেজেছে বিভিন্ন রঙ-রস ও ভাবনার সমন্বয়ে। মোকাম্মেল করিম এর গল্প দীর্ঘ হয় না। এখানে লিপিবদ্ধ প্রায় সব গল্পই আয়তনে ছোট। গল্পের শুরুতেই চমক না থাকলেও এর মধ্যাহে ও শেষ পর্যায়ে চমক থেকে যায়। গল্পের অতি প্রচলিত ধারাকে ধারণ করেই তিনি লেখেন এবং চিত্রিত করেন সাবলীল এবং মেদহীন ভাবে।

‘ক্যামেরা’ নামক গল্প দিয়েই গ্রন্থটির প্রারম্ভিকা। যে গল্পটি পাঠ সমাপ্তের পর মনে হবে একটি অনুবাদ গল্প। বঙ্গানুবাদ রূপে লিখিত এই গল্পটি লেখকের মৌলিক রচনা হলেও এর ধারাটি অনুবাদ রূপের আকর থেকে বের হতে পারেনি। একজন পুরুষের প্রতারণা পূর্বক নারী ভোগের চিত্রই এতে প্রকাশ পেয়েছে, তবে শেষটায় একটা চমক গল্পটিকে নতুন রূপ দিয়েছে। এরকম আরও একটি গল্প রয়েছে এই গ্রন্থে- গল্পটির শিরোনাম ‘মায়ামৃগ’। খুবপরিচিত এক সুরে সুরে এর কথা সাজানো। এক-একটি দৃশ্যপট পরপর ঘটে গেছে। ক্যাফে হলো দেখা, পিছুপিছু পথ চলার পর খুলে গেল মুখোশের দ্বার! দেখা গেল এ যেন এক দেহচারিনী। গল্পটি ঠিক গল্প হয়ে উঠতে ব্যর্থ হয়েছে। দৃশ্যকল্পনা আরও গল্প হবার দাবি রাখে।

পরবর্তী গল্পটি গ্রামের ধনাঢ্য ব্যক্তি মুৎসুদ্দি সওদাগরের একমাত্র মেয়ের ঘটকালি নিয়ে লেখা। গল্পটির নাম ‘ঘটক’। কৃষকায়, খাটো এবং মর্জন মেয়ে রোদসী’র পছন্দসই পাত্রের খোঁজ নিয়ে লেখা গল্পটিতে সমাজের অতি পরিচিত ঘটকালি দৃশ্যটিকে বেশ সহজ ভাবেই ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক। গল্পের উল্লেখযোগ্য চরিত্র ‘ঘটক লিটন নন্দী’ যার বদৌলতে অনেক চড়াই উৎরাই এর বিয়ে ঠিক হয় রোদসীর কিন্তু সেখানেই লেখক ঢেলেছেন চরম নাটকীয়তা।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের এক দুঃখজনক ঘটনা থেকে ছিটকে পড়া দুটো মানুষের তীর বেয়ে বেড়ে ওঠার কাহিনীকে খুব যত্ন করে তুলে এনেছেন ‘চিরকুট’ গল্পে। আল-আমিন ও সিদ্দিক এই দু’বন্ধুর শিক্ষা জীবনের গল্প এটা। গল্পের এক পর্যায়ে এসে ছিটকে পড়েন এবং জীবনের অন্য এক পর্যায়ে এসে দেখা হয় দু’জনার কিন্তু সেখানেও বিস্ময়!

পৃথিবীতে একটা ফুল আছে যার নাম ‘অভাব’। এই ফুলটা সবার জীবনে দেখা দেয়। কেউ বাদ পড়ে না। সেই ফুলকে নিয়ে সাবলীল বর্ণনায় একজন দুঃখী মায়ের অভাবী স্মৃতিকে ভর করে গল্প সাজিয়েছেন লেখক। গল্পটির মাঝে মাঝে ময়মনসিংহের আঞ্চলিক ভাষা গল্পটাকে অতি প্রাকৃত বাস্তবের সাথে নিজেকে দাঁড় করিয়েছে। এতিম রহমত কসাইয়ের হারিয়ে যাওয়া মা’র কাহিনী নিয়ে লেখা এই গল্পটির নাম ‘‘ফইন্নির পুত’’।

এছাড়াও প্রিয় মানুষের শেষ বিদায়ের চেয়ে সাময়িক বিদায় যে অনেক বেদনাদায়ক, সে কথাকে কেন্দ্র করে জীবন থেকে পালিয়ে বেড়ানো পরাজিত প্রেমিক রাফি’র প্রেম হারানো গল্পটির শিরোনাম ‘‘বারটার ট্রেন’’। ট্রেনে চলতি পথে পুরোনো প্রেমিকার সাথে দেখা হওয়া এবং তার পরবর্তী কথামালার অপূর্ব বর্ণনায় রচিত এ গল্পটি।

গল্পগ্রন্থের চতুর্থ গল্পটির নাম- “নাগরিক ‘ক’ এর স্বাভাবিক মৃত্যু”। একজন সনদহীন সৎ, মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যু পূর্ববর্তী অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের মুখরা আলোচনা এবং সামাজিক মূল্যবোধের অবস্থানের একটা পূর্ণাঙ্গ রূপ দিয়েছেন লেখক। এছাড়াও গল্পের আড়ালে গল্পের মতো করে গল্প বলে দেয়া কল্পচিত্র ‘‘পতিপ্রাণা’’। পরকীয়া ও শরীরী বিষয়ক এই গল্পে দেখতে পাই। একটা নষ্ট পুরুষের ফাউ বেঁধে যাওয়ার কথা।

জীবন থেকেই গল্পের জন্ম হয়। কিন্তু যে গল্পটা একটা জীবনকে তৈরী করে তোলে কিংবা গল্প থেকে বাস্তব জীবন হয়ে দাঁড়ায় তখন সে গল্পটা আর গল্প থাকে না, তখন সেটা জীবন। তেমনি জীবন-জীবিকা, সংসার ও সমাজ মিলিয়ে একটা জাগ্রত ও নন্দিত গল্পের জন্ম দিয়েছেন লেখক। গল্পটার নাম ‘‘বাসুনি’’। খুব সাধারণ দুটো মানুষকে নিয়ে এই গল্প। গ্রাম থেকে আসা স্বামী-স্ত্রীর সংসার কিভাবে অভাবের প্রজাপ্রতিতে পরিণত হয় এবং পৃথিবীর খোলা আকাশের নিচে প্রসাধনীর আড়ালে শরীরের মূল্য দিয়ে কিভাবে স্বামীকে ভালোবাসা যায় তারই একটি বাস্তব চিত্র এঁকেছেন লেখক।

মনের সংশয় প্রতিনিয়তই চলে কারো জীবনের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায়। কেউ কেউ আবার দুঃখের অবসান ঘটাতে প্রিয় কিছুর বিসর্জন দিয়ে দেয়। নিজ পুত্রকে অনিশ্চয়তার দুনিয়াতে রাখার চেয়ে বিসর্জন দিয়ে দেবার দুঃসাহসিক গল্পেরও জন্ম দিয়েছেন এই লেখক। গল্পের নাম ‘মায়াবৃত্ত’। মায়াময় এই গল্পে দেখতে পাই স্বামীর অসৎ উপার্জনের অভিশাপ বয়ে বেড়ানোর ভয় সারাটি জীবন ধরে তাড়া করে যায় বেগম আজিমুন্নেসাকে নিজের প্রতিবন্ধী পুত্রের জন্ম এবং তাকে ঘিরে এই গল্পের জল্পনা অনেক দূর গড়িয়ে যায় পরিেেশষে গল্পটির সমাপ্তি ঘটে।

এমনি বিসর্জনের আরও এক গল্প রয়েছে এই গ্রন্থে। গল্পের নাম-“যে দেশে কোনো মানুষ ছিল না”। গফুর মিয়ার একমাত্র সন্তান রফিককে নিয়ে ঢাকা যাওয়ার পথে পেট্রোল বোমায় বাসে অগ্নিদগ্ধ হয় এবং এই সন্তানকে নিয়ে পর-পর ঘটে যায় অনেক কান্ড। এক সময় জানা যায় এক বিরল অসুখে ভুগছে তার সন্তান। বিস্ময় পরিণতিতে নিজের ছেলেকে কালঘুমের দেশে পাঠিয়ে দেয় তার পাপিষ্ঠ বাবা।

ভালবাসায় যে আছে অদম্য শক্তি, এবং সেই ভালবাসাই যে অনেকের বেঁচে থাকার প্রেরণা। সেটুকু নিয়ে একটি গল্প গেঁথেছেন লেখক। যেখানে ভালবাসা-বিরহ এবং উম্মাদনা যুক্ত হয়েছে একই সাথে। এরকম এক উম্মাদ প্রেমিকে নিয়ে রচিত গল্প ‘রিয়াসানা’। যে গল্পটিতে উঠে এসেছে। একজন শিক্ষিত প্রেমিকের কথা, এবং ভালবাসার কথা বলতে না পারায় দীর্ঘযন্ত্রনায় দগ্ধ হয়ে জীবনের শেষ দিন পযন্ত যিনি উম্মাদ থাকেন।

এই গল্পগ্রন্থের সর্বশেষের গল্পের আগের গল্পটির নাম হস্তরেখা। একজন সরকারি চাকুরিজীবির অবসর যাপনের পরবর্তী সময়ের কথা উঠে এসেছে এখানে। জ্যোতিষবিদ্যা চর্চা করার ঘটনা এবং একটি জীবনের অনেকখানি সময়কে কেন্দ্র করে এই গল্পের বেড়ে উঠা। পরিশেষে গল্প সমাপ্তিতে দেখতে পাই নমনীয়তার অভ্যাস।

মূল লেখার লিঙ্ক


লুলু আম্মানসুরা
শিক্ষিকা


একটানে পড়ে শেষ করার মতন বই। মোট একুশটা গল্প ও একটা রম্য নাটক। প্রত্যেকটা গল্পের প্লট ভিন্ন। আমি অভিভুত লেখক এর চিন্তার বিচিত্রতা দেখে! প্রকৃতির প্রতিশোধ, সাধারন মানুষের অসাধারন নিষ্পাপ নির্লোভ প্রেম, নিত্য দিনের টুকি টাকি, প্রেম, পরকীয়া, ন্যায়- অন্যায়, লোভ, কুটিলতা, অজ্ঞতা ও বিজ্ঞতা,,,,, প্রভৃতি বিষয় নিয়ে একেকটা ছোট গল্প সাজানো হয়েছে। প্রত্যেকটা গল্প পড়েই আরাম পেয়েছি। কোনটা পড়ে হেসেছি আবার কোনটা পড়ে মন খারাপ হয়েছে। কোন কোন চরিত্রের প্রেমে পড়ে গিয়েছি। 'মান ভাংগানোর গপপো' পড়ে মজা পেয়েছি আর ভেবেছি, হ্যা স্বামী দের তো এমনি হতে হয়! পতিতা ও মায়েদের আকা হয়েছে খুব দরদ ও নিখুত পর্যবেক্ষন দিয়ে। টুইস্ট গুলোও ছিল দারুন। এককথায় দারুন সুখপাঠ্য! ধন্যবাদ মোকাম্মেল করিম- আপনার চমতকার বই এর জন্য। আমি আপনার লেখার ভক্ত হয়ে গেলাম। এরপরের বইমেলায় আমি অবশ্যই আপনার বই খুজব।


শামসুল আরেফিন
ব্যাঙ্কার, প্রবাসী


বইটা খুবই চমৎকার হয়েছে ... বাংলা সাহিত্যের নতুন মোঁপাসার আগমন ঘটতে যাচ্ছে। বিষয় বস্তুর বিচিত্রতা দেখে চমৎকৃত হতে হয়। অসম্ভব ভালো। কিছুটা গায়ে পড়া উপদেশ দিতে চাই .... আমার কাছে মনে হয়েছে নারীর শরীর বিক্রীর বিষয়টা আরেকটু কম থাকলে ভালো হত .... তাহলে মনে হয় বৈচিত্রতা আরো বেশী ফুটে উঠত। আমার একটা জিনিষ চোখে পড়েছে তা হল ছোট ছোট বাক্যের ব্যবহার ... অনেক সময় আমার কাছে এতে গতি ব্যাহত হয় বলে মনে হয়। আমি ব্যাক্তিগতভাবে যৌগিক বাক্য প্রয়োগে অভ্যস্ত, হয়ত এজন্যে একথা বলছি ....।
এই বই টার জন্য রইল ৯.৫ /১০।
নতুন বই এর অপেক্ষাতে রইলাম ... এরকম একটি চমৎকার বই এর জন্য অনেক অভিনন্দন।

লেখকের বক্তব্যঃ মোপাঁসা-র আগমণ ঘটবে কিনা জানি না, লেখায় তার প্রভাব আমি সানন্দে স্বীকার করে নিচ্ছি। যৌগিক বাক্য ব্যবহার করলে সরলভাবে গল্প বলাটা হয়ে উঠত না। তবে, অন্য সব পরামর্শের মতো এটাও মাথায় থাকবে।


শামীম আহমেদ

প্রতিটা গল্পে দুর্দান্ত টুইস্ট আছে। যেমনটা মনে হয় গল্পের ধারা বুঝে গেলাম তেমন না।সবচেয়ে ভাল লেগেছে ভাষা সাবলীল, আর সারমর্ম করে গল্পটাতেই ফোকাস করা। বর্ণণা পড়ার ক্লান্তি নেই। লেখাগুলো রেফারেন্স করে করে মানুষকে উপদেশ দেয়া যায়।
Mother In Manville এর কথা মনে পড়ে, Marjorie Kinnan Rawlings এর শেষ যে ডায়ালগটা Jerry এর ব্যাপারে হোস্টেল সুপার গিয়ে রাইটারকে বলে - He has no mother, He has no roller skate. ওই কথাটা তখন আমাকে অনেক কাঁদিয়েছিল। পুরা গল্পের এটাই সেরা টুইস্ট। এখনোও চোখে পানি এসে পড়ে। দারুণ উপস্থাপন হয়েছে। অনেক উঁচুদরের লেখা হয়েছে।

লেখকের বক্তব্যঃ ধন্যবাদ। তবে, বিশদ বর্ণণা না থাকায় কিছু অভিযোগ পেয়েছি। সোজাসুজি গল্প বলতে গিয়েই বর্ণণা এড়াতে হয়েছে, ততটাই এসেছে যতটা না এলে গল্পগুলো বলা যেত না।

নাসির আহমেদ কাবুল
লেখক, প্রকাশক ও সাংবাদিক (বাসস) এবং সম্পাদক, জলছবি বাতায়ন


'যে দেশে কোনো মানুষ ছিলো না’ ছোটগল্প গ্রন্থটির লেখক মোকাম্মেল করিম। মোট ২২টি গল্প স্থান পেয়েছে বইটিতে। প্রতিটি গল্প সুপাঠ্য। গল্পগুলোর নামকরণ যথার্থ বলা যায়। প্রতিটি গল্পের ঘটনা আমাদের প্রত্যাহিত জীবনের জলছাপ। উল্লেখযোগ্য গল্পের মধ্যে রয়েছে ঘটক, চিরকুট, ভ্রাতৃবন্ধন, মান ভাঙানোর গল্প, মায়াবৃত্ত, মায়ামৃগ ও যে দেশে কোনো মানুষ ছিলো না। গল্প ছাড়াও রয়েছে একটি চিত্রনাট্য কাপাসগোলার শিল্পী। ক্ষুদ্র চিত্রনাট্যটির সংলাপ অত্যন্ত আধুনিক ও জীবনঘনিষ্ঠ।

ছোটগল্পের সংজ্ঞা অনুযায়ী গল্পের সমাপ্তিতে লেখক অত্যন্ত মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। লেখকের গল্প বলার কৌশল, শব্দচয়ন, বাক্য বিন্যাস চমৎকার। ‘ক্যামেরা’ গল্পটি বইটিতে প্রথম গল্প হিসাবে স্থান পেয়েছে। এটি জানুয়ারি, ২০০২-তে লেখা। পরের গল্প ‘ঘটক’ লেখা হয়েছে ২০১৫ সালের আগস্ট মাসে। দুটি গল্পের রচনাকালের দীর্ঘ ব্যবধান লেখকের দিনে দিনে উত্তোরণের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়। প্রশ্ন জাগে লেখক কি দীর্ঘ সময়ে নিজের উত্তোরণ কতটুকু তা বোঝাতে পুরানোদিনের গল্পটি প্রথম গল্প হিসাবে স্থান দিয়েছেন? তা-না হলে এই গল্পটির কাহিনী ও লেখার মান হিসাবে বইয়ে প্রকাশিত অন্যান্য গল্পের সঙ্গে কিছুতেই ছাপার যোগ্যতা রাখে না। ‘ক্যামেরা’ গল্পটির কাহিনীও আধুনিক নয় বলা চলে। ঠিক একই ধরনের একটি গল্প ইংরেজী ভাষায় কোন এক লেখক লিখেছেন যতোদূর মনে পড়ে।

বই পাঠকপ্রিয়তা পাবার জন্য লেখক তার সবটুকু ঢেলে দিয়েছেন। কিন্তু প্রকাশক ঠিক তার দায়িত্ব পালন করেছেন বলে মনে হয়নি। লেখক লেখার সময় শব্দের ব্যবহার, বানান ইত্যাদি বিষয়ে অনেক ভুল করতেই পারেন, বড় বড় লেখকরাও সে ধরনের ভুল করেন হরহামেশা। সেগুলোর শুদ্ধ রূপটি দেয়ার জন্য প্রকাশককে মুন্সিয়ানার পরিচয় দিতে হয়। না হলে সম্পাদনাহীন পান্ডুলিপিটি কিছুটা হলেও মানক্ষুন্ন হয়, ‘যা হয়েছে যে দেশে কোনো মানুষ ছিলো না’ বইটির ক্ষেত্রে।

চার রঙা প্রচ্ছদ, ১৫০ গ্রাম জেলজ্যাকেটে বোর্ড বাঁধাইয়ের প্রায় ৯ ফর্মার বইটিতে একশ’ গ্রাম অবসেট ব্যবহার করা হয়েছে। প্রচ্ছদে বই ও লেখকের নাম ম্যাটের সঙ্গে গ্লু করলে এটি আরও আকর্ষণীয় হতো। বইটির বহুল প্রচার কাম্য।

লেখকের বক্তব্যঃ 'ক্যামেরা' গল্পটি মৌলিক রচনা, এখন পর্যন্ত অন্য কোনো গল্প পাইনি যেটাকে 'আদিরূপ' হিসেবে দাবী করা যায়। বিদেশী গল্পটির নাম বা লেখকের নাম জানালে উপকৃত হতাম। একটা হতে পারে গল্পটির সময়কাল পুরনো এবং প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ নয়। 'মায়ামৃগ' গল্পটিও বিদেশী প্রেক্ষাপটে লেখা। বানানের ব্যাপারে আমি খুব পরিপক্ক নই, সেজন্য প্রুফরীডার নিযুক্ত ছিল। পান্ডুলিপিটি তিনবার ফেরত পাঠিয়েছি তথাপি বেশ কিছু ভুল রয়ে গেছে। প্রচ্ছদের ব্যাপারে এটুকু বলতে পারি যে, ২০১৭'র বইমেলায় আনা কপিগুলোতে প্রচ্ছদের মান উন্নত হয়েছে, সেজন্য প্রকাশককে ধন্যবাদ।



নাফিস রাজ্জাক
ক্যামেরাঃ লঘু ধরনের মনে হল প্রথমবার পড়ার সময়। হয়তো বা মনের অজান্তে প্রিয় শহর ঢাকাতে এই ধরনের বাস্তবতা অস্বীকার করতে চাইছি।
ঘটকঃ ভাল লেগেছে, বিশেষ করে লিটন নন্দীর চরিত্রটা মনে ধরল।
চিরকুটঃ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এর বর্তমান বাস্তবতায় প্রাসঙ্গিক।
নাগরিক 'ক' এর স্বাভাবিক মৃত্যুঃ নাগরিক ব্যস্ত জীবনে নানামুখী চাপ ও সংকটে মানুষ যে ক্রমাগত আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে একদিকে যেমন সেই চিত্রটা ফুটে উঠেছে অন্যদিকে ঠিক ততটাই সুন্দরভাবে বর্ণণা করা হয়েছে একজন সহায়সম্পদহীন মধ্যবিত্ত প্রৌঢ় ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবনের অসহায়ত্ব। অসাধারণ!
পতিপ্রাণাঃ প্রবাসী শ্রমিকদের দেশে ফেলে যাওয়া স্ত্রীদের জীবন ও যৌবনের চাহিদা এবং প্রাসঙ্গিক সমস্যাগুলো সুন্দরভাবে উঠে আছে।
ফইন্নির পুতঃ অসাধারণ, হৃদয়স্পর্শী একটা গল্প। পরিবার-বন্ধন-আত্মীয়তা মধ্যবিত্ত ও ধনীদের বেলায় যেমন বাস্তবতা দরিদ্র-নিম্নবিত্তের বেলায় ততটা বাই ডিফল্ট আসেনা বা থাকে না। এই ধ্রুব সত্যটা এই সুন্দর গল্পটির মাধ্যমে লেখক তুলে ধরেছেন।
বারোটার ট্রেনঃ কিছু গল্প পাঠককে ভাবায়, অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। এই গল্পটা ঠিক সেরকম।
বাসুনীঃ মধ্যবিত্ত পাঠকের পক্ষে সমাজের নিম্নবিত্ত হতদরিদ্র মানুষের দুঃখ কষ্ট উপলব্ধি করা সহজসাধ্য নয়য়। গল্পটা নিসন্দেহে হৃদয়গ্রাহী।
বিয়ের পরে প্রেমঃ গল্পটা শেষদিকে এসে মনে হল হঠাত শেষ হয়ে গেল এবং কিছুটা দুর্বলভাবে। ভিসি'র চোখে পড়লে সেটা ওনার এড়িয়ে যাবার কথা।
বেদনানন্দ বিড়ম্বনাঃ বাংলা ভাষায় এ ধরনের এডাল্ট সিচুয়েশন কোনো গল্পে পড়িনি। বিষয়বস্তুর ভিন্নতার জন্য ভাল লাগল।
ভ্রাতৃবন্ধনঃ বাংলার গ্রামীণ সমাজে যে সো কল্ড ভিলেজ পলিটিক্স এবং প্রতিহিংসা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে, এই গল্প সেই বিষয়টি আবার তুলে ধরেছে।
মান ভাঙ্গানোর গপ্পোঃ ভাল লাগল, শিক্ষনীয় গল্প বলে। গল্পের ছলে অনেক কিছুই লেসন হিসেবে নেয়া সম্ভব।
মায়া ও প্রতিবন্ধকঃ খুবই সংক্ষিপ্ত একটা গল্প যা জীবনের জৈবিক চাহিদা যে যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণই বাস্তব সেটাই মনে করিয়ে দিল।
মায়াবৃত্তঃ জীবনের রূঢ় বাস্তবতা গল্পে উঠে এলেও মানতে কষ্ট হয়। আবার মনে হয় আজিজুন্নেসা হয়ত সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছিল যা আপাতদৃষ্টিতে নিষ্ঠুরতা মনে হলেও যথেষ্ট বাস্তবসম্মত। ভিন্নস্বাদের একটা গল্প।
মায়ামৃগঃ বইয়ের সম্ভবত এই গল্পটার প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণই বাংলাদেশের বাইরের। একদম শেষ পর্যন্ত না পড়া পর্যন্ত বুঝতে পারিনি কি হতে যাচ্ছে, সম্ভবত এটাই ছোটগল্পের অন্যতম সৌন্দর্য।
যে দেশে কোনো মানুষ ছিল নাঃ গল্পটার প্রেক্ষাপট বাস্তবধর্মী। কিন্তু গল্পের শেষটায় বাবার নিষ্ঠুরতা যা সন্তানকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিল তা কতটা বাস্তব জীবনে দেখা যায় বা দেখা যাবে সে ব্যাপারে সন্দেহ রয়ে গেল।
রাতুলের মাঃ জীবন সবার জন্য একরকম হয় না। এই গল্প বা এই ধরনের গল্প সেই সব পাঠকদের এপ্রিশিয়েট করা শেখায় - তাদের নিজেদের সরলরেখার মত জীবনকে এবং অন্যদের জীবনে নানা রকমের কষ্ট কে।
রিয়ার উইন্ডোঃ অনুবাদ ছিল কি? এই বইটির সবচেয়ে কঠিন গল্প মনে হল।
রিয়াসানাঃ অসাধারণ, চমৎকার! একটা নাটকের জন্য চমৎকার কাহিনী হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব।
শেষ রাত, প্রথম ভোরের আগেঃ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি শক্তধর্মী, কঠিন গল্প। গল্পই মনে হল। কতটা বাস্তবে এই ঘটনা ঘটতে পারে সে ব্যাপারে একটু সন্দেহ রয়ে গেল।
হস্তরেখাবিদঃ শিক্ষনীয় গল্প। কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস যে কতটা ভয়ঙ্কর ও ঠুনকো হতে পারে সেটাই সুন্দর করে উঠে এসেছে।
কাপাসগোলার শিল্পীঃ ব্যাক্তিগতভাবে সংলাপ নির্ভর গল্পের খুব একটা অনুরাগী নই। তারপরও হাস্যরস নির্ভর গল্পটি মন্দ লাগল না।

একেকটা গল্প একেক রকমের, ভিন্নধর্মী, সাহসী ও ভিন্নস্বাদের। শুরুটা কখনোই শেষটার ধারণা দিয়ে দেয় না, যাতে প্রমাণিত হয় যে কোনো গল্পই গতানুগতিক হয় নাই। লেখক হিসাবে আপনার আরো সাফল্য কামনা করি এবং পাঠক হিসেবে অপেক্ষায় থাকব।

লেখকের বক্তব্যঃ আমার এই পাঠক প্রতিটি গল্পের পাঠ-প্রতিক্রিয়া বইয়ের পাতায় লিখে স্ক্যান করে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এরকমের পাঠ-প্রতিক্রিয়া একজন লেখকের পরিশ্রমকে স্বার্থক করে দেবার জন্য যথেষ্ট। ক্যামেরা ও মায়ামৃগ গল্পদু'টোর প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ নয়। 'রিয়ার উইন্ডো' নামের হিচককের সিনেমার একটি সিকোয়েন্স থেকে গল্পটি মাথায় আসে, সে ডায়ালগগুলো গল্পের নিচে জুড়ে দেয়া হয়েছে। সিনেমার কাহিনীর সাথে গল্পের কোনো সম্পর্ক নেই বা এটি বিদেশী গল্পের অনুবাদ নয়।

সবশেষে, সবাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ আমার প্রথম বইটিকে এতখানি সময় দেবার জন্য। ইনশাল্লাহ, সামনের বইমেলায় দেখা হবে 'বিষাক্ত ভালোবাসা' নামের একটি ক্রাইম নভেল নিয়ে (ওয়ার্কিং টাইটল, লেখা শেষ হয়নি)।

যোগাযোগ
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ রাত ১০:৩৮
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহমিকা পাগলা

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


এক আবেগ অনুভূতি আর
উপলব্ধির গন্ধ নিলো না
কি পাষাণ ধর্মলয় মানুষ;
আশপাশ কবর দেখে না
কি মাটির প্রণয় ভাবে না-
এই হলো বাস্তবতা আর
আবেগ, তাই না শুধু বাতাস
গায়ে লাগে না, মন জুড়ায় না;
বলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩




তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×