দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (১৯ জুলাই, ১৮৬৩ - ১৭ মে, ১৯১৩) ছিলেন একজন বিশিষ্ট বাঙালি কবি, নাট্যকার ও সংগীতস্রষ্টা। তিনি ডি. এল. রায় নামেও পরিচিত ছিলেন। আজ দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ১৫৬তম জন্মবার্ষিকী। তিনি প্রায় ৫০০ গান রচনা করেন।এই গানগুলি বাংলা সংগীত জগতে দ্বিজেন্দ্রগীতি নামে পরিচিত। তাঁর বিখ্যাত গান "ধনধান্যে পুষ্পে ভরা", "বঙ্গ আমার! জননী আমার! ধাত্রী আমার! আমার দেশ" ইত্যাদি আজও সমান জনপ্রিয়। তিনি অনেকগুলি নাটক রচনা করেন। তাঁর নাটকগুলি চার শ্রেণীতে বিন্যস্ত - প্রহসন, কাব্যনাট্য, ঐতিহাসিক নাটক ও সামাজিক নাটক। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের বিখ্যাত নাটকগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য একঘরে, কল্কি-অবতার, বিরহ, সীতা, তারাবাঈ, দুর্গাদাস, রাণা প্রতাপসিংহ, মেবার-পতন, নূরজাহান, সাজাহান, চন্দ্রগুপ্ত, সিংহল-বিজয় ইত্যাদি।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের বিখ্যাত কবিতা
নন্দলাল
নন্দলাল তো একদা একটা করিল ভীষণ পণ –
স্বদেশের তরে, যা করেই হোক, রাখিবেই সে জীবন।
সকলে বলিল, ‘আ-হা-হা কর কি, কর কি, নন্দলাল?’
নন্দ বলিল, ‘বসিয়া বসিয়া রহিব কি চিরকাল?
আমি না করিলে কে করিবে আর উদ্ধার এই দেশ?’
তখন সকলে বলিল- ‘বাহবা বাহবা বাহবা বেশ।’
... ... ...
... ... ...
নন্দ বাড়ির হ’ত না বাহির, কোথা কি ঘটে কি জানি;
চড়িত না গাড়ি, কি জানি কখন উল্টায় গাড়িখানি,
নৌকা ফি-সন ডুবিছে ভীষণ, রেলে ‘কলিসন’ হয়;
হাঁটতে সর্প, কুকুর আর গাড়ি-চাপা পড়া ভয়,
তাই শুয়ে শুয়ে, কষ্টে বাঁচিয়ে রহিল নন্দলাল
সকলে বলিল- ‘ভ্যালা রে নন্দ, বেঁচে থাক্ চিরকাল।’
দ্বিজেন্দ্রলাল রচিত জনপ্রিয় গান
ধন্যধান্য পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা;
তাহার মাঝে আছে দেশ এক- সকল দেশের সেরা;
ওসে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে দেশ স্মৃতি তিয়ে ঘেরা;
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি,
সকল দেশের রানী সে যে- আমার জন্মভূমি।
চন্দ্র-সূর্য গ্রহ তারা, কোথায় উজল এমন ধারা!
কোথায় এমন খেলে তড়িৎ এমন কালো মেঘে!
তারা পাখির ডাকে ঘুমিয়ে, ওঠে পাখির ডাকে জেগে,
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি
সকল দেশের রানী সে যে- আমার জন্মভূমি।
এমন স্নিগ্ধ নদী কাহার, কোথায় এমন ধুম্র পাহাড়;
কোথায় এমন হরিৎক্ষেত্র আকাশ তলে মেশে।
এমন ধানের ওপর ঢেউ খেলে যায় বাতাস কাহার দেশে।
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি
সকল দেশের রানী সে যে- আমার জন্মভূমি।
পুষ্পে পুষ্পে ভরা শাখী; কুঞ্জে কুঞ্জে গাহে পাখি
গুঞ্জরিয়া আসে অলি পুঞ্জে পুঞ্জে ধেয়ে-
তারা ফুলের ওপর ঘুমিয়ে পড়ে ফুলের মধু খেয়ে।
ভায়ের মায়ের এমন স্নেহ কোথায় গেলে পাবে কেহ?
– ওমা তোমার চরণ দুটি বক্ষে আমার ধরি,
আমার এই দেশেতে জন্ম যেন এই দেশেতে মরি-
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি
সকল দেশের রানী সে যে- আমার জন্মভূমি।
বঙ্গ আমার জননী
বঙ্গ আমার জননী আমার
ধাত্রী আমার, আমার দেশ
কেন গো মা তোর শুষ্ক নয়ন?
কেন গো মা তোর রুক্ষ কেশ?
কেন গো মা তোর ধূলায় আসন?
কেন গো মা তোর মলিন বেশ?
শত কোটি সন্তান যার
ডাকে উপচে আমার দেশ।
কিসের দুঃখ, কিসের দৈন্য,
কিসের লজ্জা, কিসের ক্লেশ?
শত কোটি মিলিত কন্ঠে
ডাকে যখন আমার দেশ।।
উদিল যেখানে বৌদ্ধ আত্মা
মুক্ত করিতে মোক্ষ দ্বার,
আজিও জুড়িয়া অর্ধ জগৎ
ভক্তি প্রণতঃ চরণে যার।
অশোক যাহার কীর্তি ছায়িল
গান্ধার হতে জলধি শেষ
তুই কিনা মা গো তাদের জননী?
তুই কিনা মা গো তাদের দেশ।।
একদা যাহার বিজয় সেনানী
হেলায় লঙ্কা করিল জয়
একদা যাহার অর্ণবপোত
ভ্রমিল ভারত সাগরময়।
সন্তান যার ত্বিব্বততীর
জাপানে গঠিল উপনীদেশ
তার কি না ধুলায় আসন,
তার কি না এই চ্ছিন বেশ?
উদিল যেখানে মোরজ মন্ত্রে
নিমাই কন্ঠে মধুর ও তান
ন্যায়ের বিধান দিল রঘুমনি,
চন্ডীদাস ও গাইল গান
যুদ্ধ করিল প্রতাপাদিত্য
তুই কিনা সেই ধন্য দেশ,
ধন্য আমরা যদি এ শিরায়
রহে যদি তাদের রক্ত লেশ।।
যদিও মা তোর দিব্য আলোকে
ঘিরে আছে আজ আঁধার ঘোর
কেটে যাবে মেঘ নবীন গরিমা
মাতিবে আবার ললাটে তোর।
আমরা ঘুচাবো মা তোর কালিমা
মানুষ আমরা, নহি তো মেষ
দেবী আমার, সাধনা আমার
স্বর্গ আমার, আমার দেশ।।
ঐ মহাসিন্ধুর ওপার থেকে
কন্ঠঃ কৃষ্ণচন্দ্র দে
গীতিকারঃ দ্বিজেন্দ্র লাল রায়
গানের লিংকঃ https://www.youtube.com/watch?v=6Hq0Plth-Eg
ঐ মহাসিন্ধুর ওপার থেকে কি সঙ্গীত ভেসে আসে
ঐ মহাসিন্ধুর ওপার থেকে কি সঙ্গীত ভেসে আসে
কে ডাকে কাতর প্রাণে, মধুর তানে
আয় চলে আয়
ওরে আয় চলে আয় আমার পাশে
মহা সিন্ধুর ওপার থেকে
কি সঙ্গীত ভেসে আসে।
বলে আয়রে ছুটে, আয়রে ত্বরা
হেথা নাইকো মৃত্যু, নাইকো জরা
বলে আয়রে ছুটে, আয়রে ত্বরা
হেথা নাইকো মৃত্যু, নাইকো জরা
হেথা বাতাস গীতি-গন্ধভরা
চির- স্নিগ্ধ মধুমাসে
হেথা চির-শ্যামল বসুন্ধরা
চির- জ্যোৎস্না নীল আকাশে
মহা সিন্ধুর ওপার থেকে
কি সঙ্গীত ভেসে আসে।
কেন ভূতের বোঝা বহিস পিছে
ভূতের বেগার খেটে মরিস মিছে
দেখ ঐ সুধাসিন্ধু উথলিছে
পূর্ণ ইন্দু পরকাশে
ভূতের বোঝা ফেলে
ঘরের ছেলে আয় চলে আয় আমার পাশে
ঐ মহা সিন্ধুর ওপার থেকে
কি সঙ্গীত ভেসে আসে।
কেন কারা গৃহে আছিস বন্ধ
ওরে, ওরে মূঢ়, ওরে অন্ধ
কেন কারা গৃহে আছিস বন্ধ
ওরে, ওরে মূঢ়, ওরে অন্ধ
ভবে সেই সে পরমানন্দ, যে আমারে ভালবাসে
কেন ঘরের ছেলে পরের কাছে পড়ে আছিস পরবাসে
মহাসিন্ধুর ওপার থেকে
কি সঙ্গীত ভেসে আসে।
ঐ মহাসিন্ধুর ওপার থেকে।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জুলাই, ২০১৯ ভোর ৫:৪২