তখন বয়স কত আর হবে?
ক্লাস সেভেন এ পড়ি, তার মানে বারো বা তেরো।
প্রতিদিন সকালে মসজিদের মক্তবে যেতাম আরবি পড়ার জন্যে - বাড়ির কাছেই, যদিও পাশেই না।
বাবা রোজ মসজিদ থেকে ফজরের নামাজ শেষে ফিরে আমাকে ডেকে তুলতেন।
তখন আমি, আমার ছোট ভাই আর আমাদের কাছাকাছি বয়সের কয়েকজন, পাশাপাশি কয়েকটি ঘর থেকে এই প্রায় আট-দশ মিনিটের পথ হেটে মসজিদে যেতাম।
ততক্ষণে মুসুল্লিরা ফজরের নামাজ শেষ করে বের হয়ে গেছে। মসজিদের বারান্দায় বসে আমরা আরবি পড়তাম; ছেলেমেয়ে মিলিয়ে সর্বসাকুল্যে বিশ জনের মত। আমরা ছেলেরা বসতাম বারান্দার দক্ষিনে, আর মেয়েরা উত্তর দিকে। কোন এক অজ্ঞাত কারণে হুজুর মেয়েদেরকে বারন্দার পাকা বেঞ্চে বসতে দিতেন; কিন্তু, ছেলেদের এই সুযোগ ছিল না, বসতে হত ফ্লোরের উপর ।
এ নিয়ে আমাদের মনে কিছুটা ক্ষোভ কাজ করত।
হুজুরের বেতের ভয়ে, বলার সাহসও পেতাম না। ক্ষোভ প্রকাশের অন্য কোন উপায়ও খুঁজে পাইনি - বরং এই অবিচারের সমালোচনা এবং মেয়েদের সামনে আমাদেরকে ছোট করার নিন্দা প্রকাশ নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।
তবে, এই বাড়তি সুবিধা নেয়ার কারণে মেয়েদের উপরও কিছুটা রাগ হত।
আমার সমবয়সী কয়েকজন মেয়ে আবার এই সুবিধাটা একটু দেখিয়ে দেখিয়েই উপভোগ করতো, যা দেখে প্রায়ই উপায় খুঁজতাম – কিভাবে এদেরকে কিছুটা হলেও শিক্ষা দেয়া যায় যে, আমরা ফ্লোরে আর তারা বেঞ্চের উপর বসলেও আসলে আমরাই তাদের চেয়ে বেশী মর্যাদার দাবীদার এবং তারা যে মাঝে মাঝে বেঞ্চে বসে অনেকটা তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে আমাদের দিকে তাকায়, সেটা রীতিমত শাস্তিযোগ্য অপরাধের পর্যায়ে পড়ে।
একদিন বিকেলে বাড়ির পিছনের ঝোপঝাড়ের মধ্যে খেলতে গিয়ে রোকনের গায়ে এক জংলী ফলের ঘষা লেগে যায়।
কিছুক্ষন পরেই, শুরু হয় চুলকানি এবং চুলকাতে চুলকাতেই বেচারা কান্না শুরু করে দেয়। রোকনের চামড়া ফুলে যাওয়া দেখে এবং তার কান্নার ভয়াবহতায় আমরা খেলা বাদ দিয়ে ছুটলাম তার বাড়ির দিকে।
পরের কয়েকদিনের মধ্যেই আমরা বান্দর হোলা কি জিনিস – তা বুঝে ফেলেছি। এতদিন আমরা শুধু চুতরা পাতা চিনতাম।
এবার চিনলাম নতুন এক ফল – যা চুতরা পাতার চেয়েও ভয়াবহ। এক প্রিয় খেলার সাথীর যন্ত্রণার মাধ্যমে হলেও বান্দর হোলার কারিশমায় আমরা মুগ্ধ। সবচেয়ে চমৎকার ব্যাপারটা হল, এই ফলের গায়ে যে ছোট ছোট লোম থাকে, সেই লোম বা হুলগুলো চাইলেই একটু সতর্কতার সাথে আলাদা করা যায় এবং লুকানোও সম্ভব।
কার উর্বর মাথা থেকে উৎপত্তি হয়েছিল মনে নেই, তবে আমরা আমাদের এই নব্য অর্জিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বাস্তবে প্রয়োগের জন্যে কিছু হুল কাগজের ঠোঙ্গায় ভরে লুকিয়ে রাখলাম। পরের দিন সকাল সকাল মসজিদে গিয়ে মেয়েরা যে বেঞ্চের উপরে বসে সেখানেই এক পাশে ছিটিয়ে দিলাম। হুলগুলো এমনই যে, খুব ভালো করে খেয়াল করলেও সিমেন্টের বেঞ্চে সহসা চোখে পড়ার সম্ভাবনা নেই।
অন্যদিন মেয়েদের দিকে তাকানোর চেষ্টা কিছুটা কম করতাম কারণ তারা হুজুরকে পড়া দেয়ার পরে বেঞ্চের উপর বসে আমরা যারা ফ্লোরে বসে আছি তাদের দিকে একটু ভাব নিয়ে তাকাতো – যা দেখে রীতিমত অপমানিত বোধ করতাম। কিন্তু, আজ একটু পর পর তাকাচ্ছি, মেয়েরা কে কোথায় বসছে দেখার জন্যে।
যথারীতি পড়া শুরু হল। হুজুর একজন একজন করে পড়া নিচ্ছেন, আর যার পড়া দেয়া শেষ, সে ফিরে গিয়ে নিজের জায়গায় বসছে। মেয়েদের মধ্যে থেকে দুইজন হুজুরের কাছে পড়া দিয়ে গিয়ে বসলো বেঞ্চের হুল ছড়িয়ে দেয়া অংশের উপর। ভাব নিয়ে তাকানোর মধ্যেই প্রথমে হালকা অস্বস্তি চোখে মুখে ফুটে উঠতে দেখলাম। এতগুলো ছেলের সামনে যতটুকু সম্ভব শালীনতার সাথে হালকাভাবে চুলকানি শুরু করলো, কিন্তু একটু পরেই এটা আর নিয়ন্ত্রনের মধ্যে থাকলো না। ছটফট করতে করতে চুলকানি আর তারপরেই শুরু হল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না।
পড়া নেয়ায় মশগুল থাকায়, হুজুর এতক্ষন খেয়াল করেননি।
কান্নার শব্দে চোখ তুলে তাকালেন, কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলেন না।
আমরা যারা এর সাথে জড়িত, আমাদের চোখ মুখ ততক্ষণে শুকিয়ে গেছে।
দুষ্টামি করার নিয়তে করলেও কাজটা যে রীতিমত বোকামি এবং ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে মোড় নিচ্ছে – সেটা অনুধাবন করে ফেলেছি। মেয়ে দুইজন কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বাসায় ফেরার আরজি জানালে, সাথে সাথেই তা মঞ্জুর করা হয়।
তারা চলে যাওয়ার পর, হুজুর কি যেন চিন্তা করলেন, তারপর আমাদেরও ছুটি দিয়ে দিলেন।
ঐদিন বিকেলের মধ্যেই খবর পেয়ে গেলাম যে, আমাদের পুরো কুকীর্তি ফাঁস হয়ে গেছে।পরের দিন মসজিদে গেলাম ভয়ে ভয়ে। মেয়ে দুজনের কেউ আসেনি। তবে অন্যরা জানাল যে, তারা আগামী কয়েকদিন আসতে পারবে না। আর, হুজুর হাতে কিছু বেতের বাড়ি মেরে তারপর জানালেন যে, হুজুরকে গতকালই তাদের বাসা থেকে ডেকে পাঠিয়েছিল। হুজুরের কাছ থেকে বিস্তারিত জানার পরে, হুজুরকে বলা হয়েছে যে, আমাদেরকে কোন শাস্তি দেয়ার প্রয়োজন নেই। অবশ্য, আমরা যেন শাস্তি পেলেই বরং বেশি স্বস্তি পেতাম।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মে, ২০১৮ দুপুর ১:১২