ভোরেই রওয়ানা দিলাম, ‘লিখিত গিরিখাত’ বা Written Canyon (Yazili Kanyon) এর উদ্দেশ্যে।
আলো তখনো পুরোপুরি ফুটে উঠেনি।
শহর থেকে বের হওয়ার সময় যখন আঁকাবাঁকা পথ ধরে যখন আমাদের গাড়ী ক্রমান্বয়ে পাহাড়ের শীর্ষের দিকে উঠছিল, কয়েকবারই মনে হয়েছে, এই বুঝি গাড়ী থেমে গেল, এই বার গাড়ী আর উঠতে পারবে না।
প্রায় মাঝামাঝি উঠে নিচে লেকের নীল পানির উপর বিশালের আকাশের মাঝে এঈরদীর শহরটিকে চিকণ একটা রেখার মত মনে হচ্ছিল। বেশিক্ষন এই সৌন্দর্য উপভোগ করা সুযোগ ছিল না, কারণ গন্তব্যে যেতে এখনো প্রায় পুরো পথটাই বাকী রয়েছে। আগের দিনে ঘুরেছিলাম বলে, না হলে বুঝতেই পারতাম না ঐ চিকণ রেখার মধ্যে কতগুলো বড় বড় বিল্ডিংসহ আস্ত একটা শহর রয়েছে।
বেশ খানিক্ষন পড়ে সমতলে যখন আপেল ক্ষেতের পাশ দিয়ে গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছিল, তখন গতকালের ছেলেমানুষীর কথা ভেবে লজ্জা পেলাম। এখন এত্ত কাছে, আর কত আপেল! কি দরকার ছিল, বাসের জানালা দিয়ে দুরের আপেল বাগানের ছবি তোলার!
কিছুক্ষন পরেই আমাদের গাড়ি আবার পাহাড়ের মধ্যে ঢুকে গেল। তবে, এবার পাহাড়ের উচ্চতা কম, কিন্তু রাস্তার বাঁক গুলো অত্যন্ত বিপদজনক, আর রাস্তার পাশেই অনেক নিচে পাহাড়ী ঝরনা। গাড়ি চালানোর সময় রাস্তা থেকে এক মুহূর্তের জন্যেও যদি চালক চোখ সরায়, কি হবে তা ভাবতেই গা শিউড়ে উঠল। আমি ভেবে বের করতে পারলাম না, উল্টো দিক থেকে গাড়ী আসলে, এখানে কিভাবে ক্রস করবে!
ভেলি বসেছে পিছনে, আমি সামনের ডানে বসা, গাড়ী চালাচ্ছে মুরতেজা।
দুই একবার ভয়ে তাকে আস্তে চালাতে বললাম। এক পর্যায়ে সে বলেই ফেলল যে, আমি তাকে সতর্ক করছি বলে তার সমস্যা হচ্ছে। সে এই রাস্তায় এর আগেও গাড়ী চালিয়েছে, সুতরাং আমি নিশ্চিন্তে আশে পাশের দৃশ্য উপভোগ করতে পারি। এরপর আর কিছু বলার সাহস পাইনি, তবে দৃশ্যও উপভোগ করার সাহস হয়নি।
সমতল মত একটা সাধারণ জায়গায় হঠাৎ গাড়ি থামিয়ে মুরতেজা জিজ্ঞেস করল,
- আমি কখনো ডুমুর ফল খেয়েছি কিনা?
আমার উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে, ভেলি আর মুরতেজা দুজনেই রাস্তার পাশে একটা গাছের কাছে গিয়ে খুঁজে খুঁজে পাঁকা ডুমুর ফল পেড়ে আমার হাতে দিল। খাবো কি খাবো না, চিন্তা করতে করতেই দেখি, তারা দুজনেই ইতোমধ্যে খাওয়া শুরু করে দিয়েছে।
আমিও আর দেরী না করে মুখে দিলাম, অনেক মিষ্টি আর সুস্বাদু।
আরো কয়েকটা খেয়ে ফেল্লাম।
খেতে খেতে ভাবছিলাম আমাদের দেশের ডুমুর ফলগুলো অবশ্য এগুলোর মত এত লাল নয়, বরং কিছুটা হলুদ; সেগুলো কি এত মিষ্টি হবে ?
লিখিত গিরিখাত’ এ যখন পৌঁছলাম, তখনো কেউ আসেনি এখানে। টিকেট কাউন্টারের লোকজনও ততক্ষণে এসে পৌঁছায়নি। এমন কি দোকানো খুলেনি, কেউ। দোকানের সব কিছুই সাজানো, বেশ কিছু জিনিস বাইরেই রয়েছে, খোলা জায়গায়; যে কেউ চাইলেই হাত বাড়িয়ে নিতে পারবে। আমরা দেরী না করে, ভিতরের দিকে পা বাড়ালাম।
ইস্পারটা থেকে প্রায় ৮০ কিঃমিঃ দক্ষিনে পাহাড় আর অরন্যের মধ্যে এই গিরিখাত। পাথরের গায়ে প্রাচীন আমলের কিছু লেখা আবিষ্কৃত হওয়ার পড়ে এটি ‘লিখিত গিরিখাত’ নামে পরিচিত হয়ে উঠে।
যতটুকু জানা গেছে, প্রায় ২৮০০ বছরের পুরনো একটা ট্রেইল এই গিরিখাতের ভিতর দিয়ে চলে গেছে, যা এক সময় রোমান জনগণ ব্যবহার করত। পাথরের উপরের যে লেখাগুলোর কারণে, এই জায়গাটিকে ‘লিখিত গিরিখাত’ নামকরন করা হয়েছে, সেগুলো গ্রীক ভাষায় লিখিত। দুঃখজনক হল, এই লেখগুলোর কিছু কিছু গুপ্তধন শিকারীরা নস্ট করে ফেলেছে।
গ্রীক দার্শনিক এপিক্টেটস এর স্মরনে একটি কবিতা লেখা আছে, পাথরের দেয়ালে। অনেকটা এরকম অর্থ হবে,
ওহে দুরের পথের যাত্রী,
পথ তৈরি করে, যাত্রাপথে পা বাড়াও।
জেনে রেখো,
একজন মানুষ তখনই মুক্ত,
যখন সে তার চরিত্রে মুক্ত।
এপিক্টেটস এর মতে, মানুষের সুখ নিজের ব্যক্তিগত চরিত্রের উপর নির্ভর করে। রোমের ক্রীতদাসদের উদাহরণ টেনে তিনি বুঝিয়েছেন যে, তাদের মনের সুখ বা বেদনা নির্ভর করত পারিপার্শ্বিকতার ব্যাপারে তার নিজের চিন্তা ধারার উপর। অনেকটা এরকম যে, একজন ক্রীতদাসের পক্ষেও নিজেকে সুখী মনে করা সম্ভব। ক্রীতদাসের কথা উঠতেই কেন জানি না, স্পারটাকাস টিভি সিরিজের কথা মনে পড়ে গেল। গ্ল্যাডিয়েটররা জানতো যে পরের দিনই সে মারা পড়তে পারে, আজ রাতটাই হয়ত জীবনের শেষ রাত । কিন্তু তারপরেও তারা জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করত একদম নিশ্চিন্তে।
টিকেট কাউন্টার পেরিয়ে একটু সামনে এগুলেই সুন্দর একটা পিকনিকের জায়গা, অনেকগুলো কাঠের টেবিল দেয়া। পাশ দিয়েই বয়ে যাচ্ছে পাহাড়ি নদী, পানি কাচের মত স্বচ্ছ। এই পানি খুব ঠাণ্ডা হয় জেনেই আমি হাত দিয়ে দেখলাম প্রায় বরফের মতই ঠাণ্ডা। আমার মনে পড়ল, এর আগে যখন এই রকম এক পাহাড়ী অঞ্চলে লাঞ্চে বসেছিলাম, লোকজনকে দেখেছি কোল্ড ড্রিঙ্কসের বোতল প্লাস্টিকের ঝুড়িতে করে পানিতে চুবিয়ে রাখতে। যখন প্রয়োজন হয়, রশি টেনে ঝুড়ি উপরে তুলে কোল্ড ড্রিঙ্কসের বোতল বের করে নেয়।
পিকনিকের জায়গাটা পার হওয়ার পড়ে মূল ট্রেইল শুরু হয়, তবে গাছপালার আড়ালে থাকায় সহসা ট্রেইল চোখে পড়ে না। কিছুটা এগিয়ে গিয়ে, একটা ছোট সাঁকো পার হয়ে ডানে যেতে হয়। মূল ট্রেইলটা পাহাড়ি নদীর ডান দিয়ে চলে গেছে। যা ধরে একদম নদীর উৎসমুখ পর্যন্ত যাওয়া যাবে।
তবে যারা এডভেঞ্চারপ্রিয়, তাদের অনেকেই নদীর বাম পাশ দিয়ে প্রায় ৩০০ গজের মত পাথুরে ট্র্যাক ধরে এগুনোর পড়ে চিকণ একটা পায়ে চলা সাঁকো পেরিয়ে ডানে গিয়ে তুলনামুলক ভাবে চওড়া মূল ট্রেইলে যায়।
ট্রেইল ধরে এগুতে এগুতে আমি চারপাশের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। খাড়া উঁচু পাহাড়ের নিচেই টলটলে পানির ধারা, চার পাশে ঘন ঘন গাছ, যার বেশিরভাগই আমি চিনি না, পায়ের নিচে পাথুরে রাস্তা। গাছের আড়াল দিয়ে নদীর অপরপাশের উঁচু পাহাড়ের গায়ে সূর্যের আলো পড়ে কয়েকটা জায়গায় সোনালী আভা চকচক করছিল। আমার মনে হচ্ছিল, পাহাড়ের পাথরগুলো স্বর্ণ মিশ্রিত হতে পারে – যদিও আমি জানি এখানে এমন কিছুই নেই। এগুলো দেখে হাটতে হাটতে, বেশ কয়েকবারই নিজেকে হেনরি রাইডার হ্যাগার্ডের উপন্যাসের কোন অভিযাত্রী দলের সদস্য মনে হচ্ছিল।
আরো প্রায় আধা ঘণ্টা পড়ে, একটা খোলা জায়গা পাওয়া গেল। এর পড়ে ট্রেইল চিকণ আর রুক্ষ হয়ে সামনে এগিয়ে গেছে। আমরা এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। প্রায় ১৫ মিনিট এগুনোর পড়ে, একটা ছোট গুহা পেরিয়ে ট্রেইলটা নিচের দিকে নেমে গেছে। এখন আর একে ট্রেইল বলা যাবে না। বরং পাথর আর জংগলের মধ্যে দিয়ে সতর্কতার সাথে পথ খুঁজে নামতে হচ্ছে। নামতে নামতে আমরা সেই নদীটা পেয়ে গেলাম, তবে এখানে পানি পানি অগভীর, স্রোতও অনেক কম।
মুরতেজা’র দেখাদেখি জুতা খুলে পানিতে নেমে পড়লাম। আজলা ভরে মুখ ধুয়ে নিলাম, ঠান্ডা পানির ছোঁয়া পেয়ে শরীরে হালকা শিহরণ বয়ে গেল। দেখি ভেলি আর মুরতেজা দুজনেই দুহাত দিয়ে পানি খাচ্ছে। আমি আর কিছু জিজ্ঞেস না করে, আজলা ভরে পানি খাওয়া শুরু করলাম। বর্ণহীন, গন্ধহীন কিন্তু স্বাদহীন নয়, কেমন যেন একটা স্বাদ আছে- যা শরীর জুড়িয়ে দেয়। কে জানে, পুরোটাই মানসিক ব্যাপার হতে পারে।
কখনো নদীর পাড় ধরে, কখনো অগভীর পানিতে নুড়ি পাথরের উপরে, আবার কখনো নদীতে থাকা বড় বড় পাথরের উপর দিয়ে আরো কিছুদুর এগিয়ে থামতে হল। অত্যধিক খাড়া দুই পাহাড়ের মধ্য দিয়ে চিকন এক পানির ধারা অনেক দূর পর্যন্ত চলে গেছে যার শেষ কোথায় পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে না।
সামনে যেতে হলে আবার পাহাড়ে উঠতে হবে, তবে অনেক খাড়া পথ দিয়ে। তাও আবার কোন নির্দিষ্ট পথ না, পাথর থেকে পাথরের মধ্য দিয়ে সুবিধেমত খুঁজে খুঁজে এগুতে হবে। আসলে, পথ না বলে বরং ন্যাশনাল জিওগ্রাফির মাউন্টেন ক্লাইম্বিং টাইপের কিছু একটা বলা ভাল। এরই মধ্যে, মুরতেজা তরতর করে এগিয়ে গিয়ে, কিছুটা উঠে এক জায়গায় বসে আমাদের ডাকল।
আমি দ্বিধার মধ্যে পড়ে গেলাম, কি করব। ভেলি, একটা বড় পাথরের উপর তার ব্যাকপ্যাক রেখে বলল যে , সে আগে নাস্তা করবে। নাস্তা খেতে খেতে সিদ্ধান্ত নিবে, উপরে উঠে নদীর উৎস মুখে যাবে কিনা। আমিও চট করে তার পাশে বসে পড়লাম। আসলে উপরে উঠার সাহস পাচ্ছিলাম না। আবার বলতেও চাচ্ছিলাম না যে আমি ভয় পাচ্ছি।
নাস্তার আয়োজন সাধারণ। বড় টার্কিশ ব্রেড, সাথে রসালো টমেটো, ঘরে বানানো চিজ আর কিছু জলপাই। মুরতেজা নেমে এসে পকেট নাইফ বের করে টমেটো চাক চাক করে কাটতে শুরু করল, ভেলি ব্রেডটা কেটে কেটে পিস বানিয়ে, প্রতি দুই পিসের মধ্যে টমেটো আর চিজ ভরে দিল। তার উপর হালকা লবন ছিটিয়ে, আমার দিকে এগিয়ে দিল। আমি ততক্ষণে হাত ধুয়ে এসেছি।
অনেকক্ষণ ধরে হেটেছি, তাই ক্ষুধার কারণে কিনা জানি না, খুব সুস্বাদু লাগলো। নাস্তা শেষে আবার আজলা ভরে পাশের ঝর্ণা থেকে পানি খেয়ে নিলাম। ততক্ষণে, ভোটাভুটিতে মুরতেজা পরাজয় মেনে নিয়েছে, আমি আর ভেলি ফেরার পক্ষে। তাই, খাওয়া শেষ করে, আরো কিছুক্ষন অপেক্ষা করে ফিরতে শুরু করলাম।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জুন, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:১৭