আজকাল কেউ কেউ শুধুই নিরামিষভোজী, আবার কেউ অতিরিক্ত আমিষপ্রিয় হয়ে যাচ্ছেন। শুধু তাই নয়, ভেগানরা প্রাণীজ খাদ্যের বিরুদ্ধে যেন ভুখ হরতাল শুরু করে দিয়েছেন। রোগের হাত থেকে রক্ষা পাবার আশায় অতি সাবধানতা বশত অনেকে তাদের দিকে ঝুঁকেও পড়ছেন। সুস্থ-সবল মানুষও প্রাণীজ প্রোটিন (Animal protein) গ্রহণ করাকে যেন হারাম সাব্যস্ত করে নিয়েছেন। অপরদিকে আবার আমিষপ্রিয়রা সুযোগ পেলেই পেট ভরে হরদম কালিয়া-কোপ্তা, কাচ্চি-বিরিয়ানি, কাবাব, রোস্ট ইত্যাদি মাংসজাত খাদ্যে আসক্ত হয়ে পড়ছেন। নিরামিষের (Vegetable) গন্ধ পেলে রুমাল দিয়ে নাক ঢেকে দূরে পালাতে পারলে যেন তারা হাফ ছেড়ে বাঁচেন। বিশেষ করে স্কুল-কলেজের ছাত্র ছাত্রিরা ফাস্টফুড খাওয়ায় যেন কম্পিটিশনে নেমে পড়েছে। ফলে কম বয়সেই মুটিয়ে যাচ্ছে। কেউ আবার পেটের পিড়া ও নানা রকম উপসর্গে ভুগছে। সবজি খাওয়ারও যে প্রয়োজন রয়েছে, তা জানা সত্বেও মানার প্রতি তারা উদাসীনই থেকে যাচ্ছে। কাজটা কি আদৌ ঠিক হচ্ছে?
পানির পরে প্রোটিন জীবের জন্য অতি প্রয়োজনীয় একটি উপাদান। দেহের মাংসপেশী, হৃৎপিণ্ড, মস্তিষ্ক, রক্ত, চামড়া, চুল, নখ ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ও তন্ত্র গঠনের প্রাথমিক উপাদান হলো এই প্রোটিন। মূলত সকল দেহ কোষই প্রোটিনের উপর নির্ভরশীল। প্রোটিনের অভাবে রক্ত জমাট বাধতে পারে না এবং ক্ষত শুকাতে সময় লাগে। দৈহিক ও জনন-তন্ত্রের স্বাভাবিক গঠন ও বিপাকের মত গুরুত্বপূর্ণ কাজ নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রোটিন এবং এর মূল উপাদান এমাইনো এসিডগুলো উৎসেচকের ভূমিকা পালন করে থাকে। তাছাড়া রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট এনজাইমগুলো গঠনের জন্যও প্রোটিন প্রয়োজন। বিশেষ করে শিশুদের শরীরে প্রোটিনের ঘাটতি হলে নানা রকম অস্বাভাবিকতা দেখা দিতে পারে। সুতরাং প্রোটিনের ঘাটতি হলে আমাদেরকে কিরূপ বিরূপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে তা সহজেই অনুমেয়।
বর্তমান গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষের শরীরের জন্য প্রত্যহ ০.৮ গ্রাম/কেজি প্রোটিন খাওয়া প্রয়োজন। প্রোটিনের গুরুত্ব সম্পর্কে আগেই বলেছি। এই প্রোটিন সরবরাহের জন্য শুধুমাত্র প্রাণীজ খাদ্যের উপর নির্ভর করা শরীরের জন্য ভাল নয়, আবার একবোরে বর্জন করাও স্বাস্থ সম্মত নয়। শিশুদের বাড়ন্ত বয়সে প্রোটিন জাতীয় খাদ্যের পরিমাণ একটু বেশি লাগে। প্রতিদিনকার প্রোটিনের চাহিদা মেটানোর জন্য অপ্রাপ্ত বয়সের জন্য ১/২ প্রাণীজ এবং ১/২ উদ্ভিজ্জ এবং প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য ১/৩ প্রাণীজ ও ২/৩ উদ্ভিজ্জ সোর্স থেকে হলে ভাল হয়। কোন কোন রোগের চিকিৎসা ও তৎপরবর্তী সময় প্রোটিন একটু বেশি পরিমাণে খাবার প্রয়োজন পড়ে। আবার কিছু কিছু রোগে প্রোটিন সমৃদ্ধ খাদ্য নিয়ন্ত্রিতভাবে খেতে হয়। শারীরিক অবস্থা ভেদে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী খাদ্য গ্রহণ করা উচিত।
আমাদের শরীরে প্রোটিন তৈরির ব্যবস্থা নেই। কারন প্রোটিন তৈরির জন্য অতি প্রয়োজনীয় এমাইনো এসিডগুলো (essential amino acid) মানুষের শরীরে থাকে না বা তৈরি হয়না। তাই অন্যান্য 'তৃণভোজী পশু', মাছ ও উদ্ভিদ থেকে আমাদেরকে এগুলো সংগ্রহ করতে হয়।
মজার ব্যপার হলো, মহান আল্লাহতায়ালা তৃণভোজী প্রাণীদের দেহকে আমাদের জন্য প্রয়োজনীয় প্রোটিন তৈরির কারখানা বানিয়ে রেখেছেন। তৃণভোজী প্রাণী যেমন গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, হরিণ, উট ইত্যাদি বিশেষপ্রকার পরিপাকতন্ত্রের অধিকারী। এদের চার প্রকোষ্ঠ (রুমেন, রেটিকুলাম, ওমেসাম, এবোমেসাম) বিশিষ্ট পাকস্থলির 'রুমেন ও রেটিকুলামে' প্রচুর পরিমাণে 'সিমবায়োটিক এনারোবিক ব্যাকটেরিয়া' থাকে এবং এগুলো এনজাইম 'সেলুলেজ' ধারন করে।
রুমেন ও রেটিকুলামের কার্যকারিতা ও নিয়মতান্ত্রিক সংকোচনের কারনে পশু খাদ্য উত্তমরূপে সংমিশ্রিত হয়। ফলে পরবর্তীতে সঠিক মাত্রায় পরিপাক ও পরিশোষিত হওয়ায় তা থেকে প্রয়োজনীয় মাংস, দুধ ও পশম তৈরি হতে পারে। 'তৃণভোজী প্রাণী' সেলুলোজ সমৃদ্ধ খাদ্য যেমন ঘাস খেলে তাদের রেটিকুলোরুমেনে অবস্থিত এই ব্যাকটেরিয়াগুলো ফার্মেন্টেশন প্রক্রিয়ায় তা হজম এবং খাদ্য উপাদান নিঃসরণে সহায়তা করে। ফলে তৃণজাতীয় খাদ্য তারা প্রচুর পরিমাণে গ্রহণ ও পরিপাক করতে সক্ষম এবং তা থেকে তাদের দেহে প্রয়োজনীয় essential amino acid সমূহ পর্যাপ্ত পরিমাণে গঠিত হয়। এভাবেই তারা বাঁচার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি উৎপাদনে সক্ষম। তাই সবজির পাশাপাশি আলাদা ভাবে মাংস খাবার প্রয়োজন পড়ে না। অপরদিকে মাংসাশী প্রাণীদের পরিপাকতন্ত্রে উদ্ভিদের সেলুলোজ পরিপাকের জন্য কোন এনজাইম থাকে না এবং তাদের লালায় 'আলফা এমাইলেজ' না থাকায় তারা কার্বহাইড্রেটও (শর্করা ও শ্বেতসার) ঠিকমত হজম করতে পারেনা। তাই সবজি বা তৃণজাতীয় খাবার খেলে পরিপাকে সমস্যা দেখা দেয়। বরং তাদের পরিপাকতন্ত্র সহজেই প্রাণীজ খাদ্যের প্রোটিন ও চর্বি হজম এবং অতিদ্রুত নিষ্কাশন করতে পারে এবং এর মাধ্যমেই তারা বাঁচার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি উৎপাদনে সক্ষম।
আমরা সবাই কম-বেশি জানি যে, আমদের দেহ গঠন ও সুস্থ-সবল থাকার জন্য সুষম খাদ্যের প্রয়োজন। আর এই 'ব্যালেন্স ডায়েট' খেতে হলে 'প্রাণীজ ও উদ্ভিজ্জ'- উভয় সোর্স থেকেই খাদ্য তালিকা তৈরি করা উচিত। মানুষের পরিপাকতন্ত্রে এমন কিছু এনজাইম আছে যা 'আমিষ', 'চর্বি' ও 'শর্করা'- এই তিনটি খাদ্যের উপাদানকেই ভেঙ্গে সরল গাঠনিক এককে রূপান্তরিত করতে পারে। দানাদার শস্য যেমন: ধান, গম, ভুট্টা ইত্যাদি এবং মাটির নিচের সবজি যেমন আলুতে যে শর্করা থাকে তা পরিপাকের জন্য প্রয়োজনীয় এনজাইম 'আলফা এমাইলেজ' মানুষের লালায় আছে। উদ্ভিজ্জ খাদ্যে মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় ভিটামিন থাকলেও বিভিন্ন ধরনের এমাইনো এসিড যথাযথ মাত্রায় থাকে না। তাই শুধু নিরামিষভোজী হলে এই ঘাটতি পুরোনের জন্য প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণে নানা ধরনের সবজি ও ফল-মূল খাবার দরকার হয়। কিন্তু সমস্যা হলো, উদ্ভিদের কোষ আবরণের মূল উপাদান 'সেলুলোজ' হজমের জন্য প্রয়োজনীয় এনজাইমের ঘাটতি থাকায় এগুলো হজম করা মানুষের পক্ষে কঠিন। তাই শুধুমাত্র এই ধরনের খাদ্যের উপর নির্ভর করলে মানুষের শরীরের জন্য প্রয়োজনিয় উপাদানের ঘাটতি জনিত সমস্যা দেখা দিতে পারে। আর সেদিকে লক্ষ্য রেখেই এই ঘাটতি পুরোনের জন্য নিরামিষভোজীরা খাদ্য তালিকায় উদ্ভিজ্জ খাদ্যের পাশাপাশি প্রাণিজ খাদ্যও রাখেন। যেমন নিরামিষভোজিদের মধ্যে- *লেক্টো-ভেজিটারিয়ানরা= নিরামিষ + দুধ খান। *ওভো-ভেজিটারিয়ানরা= নিরামিষ + ডিম খান। *লেক্টো-ওভো-ভেজিটারিয়ানরা= নিরামিষ + দুধ ও ডিম খান। *পোলো-ভেজিটারিয়ানরা= নিরামিষ + মুরগি ও সামূদ্রিক মাছও খান।
মানুষের পরিপাকতন্ত্রে খাদ্যের প্রোটিন পরিপাকের জন্য পেপসিন, ট্রিপসিন, কাইমোট্রিপসিনোজেন, কার্বোপেপটাইডেজ, ইলাসটেজ নামক এনজাইম থাকে। প্রাণীজ আমিষে আমাদের শরীরের জন্য অতি প্রয়োজনীয় সকল ধরনের এমাইনো এসিড পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যায়, তাই অল্প খেলেই চলে এবং মানুষের জন্য সেটাই উত্তম। কারন প্রয়োজনের অতিরিক্ত প্রাণীজ খাদ্য থেলে আমিষের সাথে সাথে চর্বির মাত্রা বেড়ে যায়। তাছাড়া রক্তের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের লিপিডের অসামঞ্জস্যতা দেখা দেয়। এর ফলে হৃদরোগ, লিভার ও কিডনীরোগ, রক্তনালীতে চর্বি জমে যাওয়া, উচ্চরক্তচাপ এবং এর ফলশ্রুতিতে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ, হাড়ের ক্ষয়রোগ ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়। প্রস্রাবের মাধ্যমে ক্যালসিয়াম ও অন্যান্য খনিজ লবন দহে থেকে বের হয়ে যায়, ফলে এক ধরনের ক্যান্সার হতে পারে, কিডনীতে পাথর, চোখ ছানি ও গেঁটে-বাত হতে পারে, রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থাকে উত্তেজিত করে রাখে। তাছাড়া শরীরের ওজন বেড়ে গিয়ে অস্বাভাবিক দেহাবয়বের কারনে দৈনন্দিন চলাফেরা ও কর্মক্ষেত্রে ব্যাঘাত ঘটতে পারে।
ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে বিচার করলে আমার দেখি যে, প্রধান প্রধান ধর্মগ্রন্থগুলোতে উভয় প্রকার খাদ্য গ্রহণের উপদেশ দেয়া হয়েছে। একজন মুসলিম হিসেবে ধর্মগ্রন্থ আল-কোরআন থেকে আমি এ বিষয়ে সংক্ষেপে তুলে ধরছি।
প্রয়োজন আছে বলেই সর্বজ্ঞ স্রষ্টা আল্লাহতায়ালা তাঁর কিতাব আল-কোরআনে মানুষকে প্রাণীজ ও উদ্ভিজ্জ- এই উভয় সোর্স থেকে প্রাপ্ত খাদ্য গ্রহণের বিষয়ে জানিয়ে দিয়েছেন। স্থলজ প্রাণীর মধ্যে তৃণভোজী প্রাণীর কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। সেই সাথে সমূদ্রের সকল প্রকার প্রাণীর মাংস খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করা বৈধ করেছেন। শুধু তাই নয়, সামুদ্রিক প্রাণীর মধ্যে মানুষের জন্য বিশেষ উপকারী উপাদান রয়েছে বলে ইংগিতও দিয়েছেন। লতা জাতীয় উদ্ভিদ ও উদ্ভিদ থেকে প্রাপ্ত পরিপক্ক শস্য ও ফল আহার করতে বলেছেন।
আল-কোরআন-
৬) সূরা আল আন-আম (মক্কায় অবতীর্ণ)
১৪১) তিনিই উদ্যান সমূহ সৃষ্টি করেছেন, যা মাচার উপর তুলে দেয়া হয় (লতানো বিরুৎ জাতীয় উদ্ভিদ), এবং যা মাচার উপর তোলা হয় না (লতানো নয় এমন বিরুৎ, গুল্ম এবং বৃক্ষ জাতীয় উদ্ভিদ) এবং খেজুর গাছ ও বিভিন্ন স্বাদবিশিষ্ট ফসল, জয়তুন ও ডালিম গাছ সৃষ্টি করেছেন- একে অন্যের সদৃশ এবং বিসদৃশও। এগুলোর ফল খাও, যখন ফলবান হয় এবং হক (ওশর) দান কর ফসল কর্তন ও ঘরে তোলার সময় এবং অপচয় করো না। নিশ্চয় তিনি অপচয়কারীকে পছন্দ করেন না।
১৪২) গৃহপালিত চতুষ্পদ জন্তুর মধ্যে কতক ভার বহনের জন্য এবং কতক গোশতের জন্য; আল্লাহ তোমাদেরকে জীবিকারূপে যা দিয়েছেন, তা থেকে আহার কর এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিশ্চয়, সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।
ḥamūlatan- (are some for) burden
wafarshan- and (some for) meat
১৪৩) আট জোড়া (নর ও মাদী)- মেষ হতে দুটি ও ছাগল হতে দুটি। বল, 'নর দুটি নাকি মাদী দুটিই তিনি হারাম করেছেন, কিংবা মাদী দুটির গর্ভে যা ধারন করে তা হারাম করেছেন? আমাকে প্রমাণসহ বল, যদি তোমরা সত্যবাদী হও।'
১৪৪) এবং উট হতে দুটি এবং গরু হতে দুটি। বল, 'নর দুটি নাকি মাদী দুটিই তিনি হারাম করেছেন, কিংবা মাদী দুটির গর্ভে যা ধারন করে তা হারাম করেছেন? এবং তোমরা কি সাক্ষি ছিলে- যখন আল্লাহ তোমাদেরকে এ নির্দেশ দিয়েছিলেন?' অতএব তার চেয়ে বড় অত্যাচারী কে আছে যে আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যা ধারণা পোষণ করে, যাতে করে মানুষকে বিনা প্রমাণে পথভ্রষ্ট করতে পারে? নিশ্চয় আল্লাহ অত্যাচারী সম্প্রদায়কে সৎপথে পরিচালিত করেন না।
সূরা নাহল (মক্কায় অবতীর্ণ)
(১৬:৬৬) অর্থ- নিশ্চয় গবাদি পশুর মধ্যে তোমাদের জন্য শিক্ষনীয় বিষয় রয়েছে। আমরা তোমাদেরকে পান করার জন্য দেই তাদের (উদরে) ভেতরের অংশে যা আছে- গোবর ও রক্তের মধ্যভাগ হতে খাঁটি দুগ্ধ, পানকারীদের কাছে যা সুস্বাদু।
[গোবরও নয় রক্তও নয়, বরং (bayni-] between) এই দুয়ের (গোবর ও রক্তের) মধ্যবর্তী অংশ হতে খাদ্যের সারবস্তু হিসেবে নিঃসৃত দুগ্ধ
৫) সূরা আল মায়েদাহ (মদীনায় অবতীর্ণ)
১) মুমিনগণ, তোমরা অঙ্গীকারসমূহ পূর্ন কর। তোমাদের জন্য গবাদি চতুষ্পদ জন্তু হালাল করা হয়েছে, যা তোমাদের কাছে বিবৃত হবে তা ব্যতীত। কিন্তু এহরাম বাধাঁ অবস্থায় শিকারকে হালাল মনে করো না! নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলা যা ইচ্ছা করেন, নির্দেশ দেন।
৯৬) সমুদ্রের শিকার ও সুমুদ্রের খাদ্য হালাল করা হয়েছে তোমাদের এবং ভ্রমণকারীদের জন্য; এবং তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে স্থল শিকার যতক্ষণ এহরাম অবস্থায় থাক। আল্লাহকে ভয় কর, যার কাছে তোমরা একত্রিত হবে।
১৬) সূরা নাহল (মক্কায় অবতীর্ণ)
১৪) তিনিই অধীন করে দিয়েছেন সমুদ্রকে, যাতে তা থেকে তোমরা তাজা মাংস (মাছ) খেতে পার এবং তা থেকে বের করতে পার পরিধেয় অলঙ্কার। ওতে বুক চিরে জলযান সমূহ চলাচল করে এবং এটা এজন্যে যেন তোমরা আল্লাহর কৃপা অন্বেষণ কর এবং যাতে তার অনুগ্রহ স্বীকার কর।
৩৬) সূরা ইয়াসীন (মক্কায় অবতীর্ণ)
৩৩) তাদের জন্যে একটি নিদর্শন মৃত পৃথিবী। আমি একে সঞ্জীবিত করি এবং তা থেকে উৎপন্ন করি শস্যকণা, তারা তা থেকে আহার করে।
গবেষণায় দেখা গেছে, লতা জাতীয় উদ্ভিদ থেকে উৎপাদিত আঁশ সমৃদ্ধ খাদ্য খুব বেশি পরিমাণে খেতে না পারলেও তা আমাদের শরীরকে সুস্থ রাখার জন্য অতি প্রয়োজনীয়। প্রত্যহ প্রয়োজন মত আঁশ জাতীয় খাবার খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়। রক্তের কোলেস্টেরল ও গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে এবং দেহ থেকে দুষিত পদার্থ নিঃসরণে আঁশ সমৃদ্ধ সবজি ও ফল গুরুত্বপূর্ন ভুমিকা রাখে। হৃদরোগ, স্তন ও কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেক কমে যায়। মুটিয়ে যাবার হাত থেকে রক্ষা করে। প্রতিদিন প্রাপ্তবয়স্ক মহিলার জন্য ২৫ - ৩০ গ্রাম এবং পুরুষের জন্য ৩০ - ৪০ গ্রাম আঁশযুক্ত খাবার খাওয়া প্রয়োজন। দ্রবণীয় আঁশযুক্ত খাবারের পরিমাণ মোট আঁশযুক্ত (দ্রবণীয় ও অদ্রবণীয়) খাবারের ২০ - ৩০% হলে ভাল হয়।
আঁশ/তন্তু জাতীয় খাবার বলতে 'সেলুলোজ' সমৃদ্ধ উদ্ভিজ্জ খাদ্যকে বোঝান হয়। নিচে এর কয়েকটি উদাহরণ দেয়া হলো-
১/ ডুমুর ফল ২/ শিমের বিচি, মটরশুঁটি, কড়াইশুঁটি ইত্যাদি ৩/ কলাই বা মসুর ডাল ৪/ ভুট্টা, গম, যব বা এই জাতীয় শস্য-কণা ৫/ সবুজ লতা ও শাক-সবজি ৬/ স্ট্র-বেরি (ক্ষুদ্র রসাল এক ধরনের ফল) ৭/ আলু (ছাল সহ) ৮/ খাদ্যশস্যের ভুষি বা তুষ সমেত প্রস্তুতকৃত আটার রুটি বা পিঠা ৯/ ফুলকপি, বাঁধাকপি বা এই জাতীয় উদ্ভিদ ১০/ জই বা যবের গুড়া দিয়ে তৈরি পিঠা বা পরিজ ১১/ চিনা বাদাম ১২/ আপেল, আলুবোখারা, পেয়ারা, আনারস ইত্যাদি ১৩/ গাজর, টমেটো, শশা ইত্যাদি।
মাছ থেকে আমরা যে মাংস পাই তাতে প্রচুর প্রোটিন থাকলেও আমাদের জন্য ক্ষতিকর চর্বি থাকে না বললেই চলে। বিশেষ করে সামুদ্রিক মাছ খেতে পারলে সবচেয়ে ভাল হয়। কিন্তু তা সবার পক্ষে যোগাড় করা কষ্টসাধ্য। আবার মরু অঞ্চলে উদ্ভিদের স্বল্পতা থাকায় সেখানে সব ধরনের উদ্ভিজ্জ খাদ্য বেশ দুষ্প্রাপ্য ও দুর্মূল্য। তাই মানুষকে প্রাণীজ প্রোটিনের জন্য মাছের পাশাপাশি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তৃণভোজী পশুর উপরে নির্ভর করতে হয়। তাই তো মহান স্রষ্টা পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বসবাসরত মানুষের জীবনকে সহজ করার জন্য সামান্য কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সব ধরনের খাদ্য গ্রহণের পারমিশন দিয়েছেন। এসব খাদ্যের মধ্য থেকে যাদের জন্য যতটুকু খাওয়া প্রয়োজন তারা যেন প্রাপ্যতা অনুসারে পরিমিতভাবে খেতে পারেন, সেই অপশনও রেখেছেন। তাই যারা জানে তারা অন্যকে জানাবে এবং যারা জানেনা তাদেরকে জানার জন্য সচেতন হবার ইংগিতও এখানে রয়েছে। বিভিন্ন গবেষণা ও মানুষের দাঁতের গঠনপ্রকৃতি ও সংখ্যার অনুপাত থেকে বোঝা যায়, প্রোটিনের চাহিদা পুরোন এবং পাশাপাশি ক্ষুধা নিবারণের জন্য প্রাণীজ খাদ্যের অনুপাতে উদ্ভিজ্জ খাদ্য একটু বেশি পরিমাণে গ্রহণ করাই আমাদের জন্য শ্রেয়। তাই শুধু প্রাণীজ কিংবা উদ্ভিজ্জ নয়, বরং উভয় প্রকার খাদ্যই প্রয়োজন অনুসারে কম-বেশি আমাদের খাবারের তালিকায় রাখতে হবে।
নির্বাচিত খাদ্য সামগ্রীতে বিদ্যমান যথাযথ প্রায় প্রোটিনের পরিমাণ-
প্রাণীজ খাদ্য-
গোস্ত = ছাগল ও মেষ/ভেড়া – ৭ - ৭.৫ গ্রাম/ আউন্স। গরু – ৮ – ৮.৫ গ্রাম/ আউন্স। মুরগি - ৭.৫ - ৮.৫ গ্রাম/ আউন্স। উটপাখি – ৯.৫ – ১০ গ্রাম/ আউন্স। মাছ - ৭ - ৭.৫ গ্রাম/ আউন্স।
দুধ = (গরু) - ৮ গ্রাম/ আউন্স ও (ছাগল) - ৯ গ্রাম/ আউন্স। পনির - ৭ গ্রাম/ আউন্স।
ডিম = মুরগী (বড়) - ১০ গ্রাম/ ডিম ও (মাঝারি)- ৬ গ্রাম/ ডিম (সাদা অংশে প্রায় ৩.৬ গ্রাম প্রোটিন থাকে)। হাঁস - ১৫ গ্রাম/ ডিম। কোয়েল - ০২ গ্রাম/ ডিম।
উদ্ভিজ্জ খাদ্য-
সবজি - .৮ গ্রাম/ আউন্স। বিভিন্ন খাদ্যশস্য - ১.৬ গ্রাম/ আউন্স। রুটি - ৪ গ্রাম/ চওড়া ফালি। মসুরি ডাল - ৬.৫ গ্রাম/ আউন্স। শিম, কড়াইশুঁটি, মটরশুঁটি ইত্যাদি - ৬ গ্রাম/ আউন্স। কাজুবাদাম - ৫ গ্রাম/ আউন্স। চীনাবাদাম - ৭.৫ গ্রাম/ আউন্স। সূর্যমুখির বিচি - ৭.৫ গ্রাম/ আউন্স। আখরোট - ৩.৫ গ্রাম/ আউন্স।
সবচেয়ে বড় কথা হলো, মহান স্রষ্টা মানুষকে শুধুই নিরামিষভোজী কিংবা আমিষভুক্ নয়, বরং প্রাণীজ ও উদ্ভিজ্জ- উভয় প্রকার খাদ্য গ্রহণের উপযোগী করে সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু তাই বলে কারো সাধ্য থাকলেই ভোগ বিলাসিতায় মেতে (০৭:৩১) উদরপূর্তি করে প্রয়োজনের (৪৭:১২) অতিরিক্ত খেতে ও অপচয় করতে আল- কোরআনে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে।
সূরা আল আ’রাফ (মক্কায় অবতীর্ণ)
(০৭:৩১) অর্থ- হে আদম সন্তানেরা! তোমরা প্রত্যেক নামাজের সময় পরিচ্ছন্ন পরিচ্ছদ পরিধান করে নাও; খাও ও পান কর, কিন্তু অপচয় করো না। নিঃসন্দেহে তিনি অমিতব্যয়ীদের পছন্দ করেন না।
সূরা মুহাম্মদ (মদীনায় অবতীর্ণ)
(৪৭:১২) অর্থ- যারা বিশ্বাস করে ও সৎকর্ম করে, আল্লাহ তাদেরকে জান্নাতে দাখিল করবেন, যার নিম্নদেশে নির্ঝরিণীসমূহ প্রবাহিত হয়। আর যারা অবিশ্বাসী, তারা কেবলই ভোগ-বিলাসে মত্ত থাকে এবং চতুস্পদ জন্তুর মত আহার করে। তাদের বাসস্থান জাহান্নাম।
সুতরাং এ থেকে বোঝা যায় যে, কোন ধরনের খাদ্য কি পরিমাণে খেতে হবে তা নির্ণয়ের দায়িত্বও মানুষের উপরেই বর্তায়। শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক ধর্ম পালনই নয়, পরিচ্ছন্ন পোষাক পরিধান, পরিমিত আহার করা এবং অহেতুক বিলাসিতা ও অপচয় না করাও বিশ্বাসী মানুষের পরিচয় বহন করে। সুস্থ এবং অসুস্থ কারো জন্যই এ বিষয়ে অবহেলা করা ঠিক নয়। অসুস্থদের ক্ষেত্রে নিয়মিত ওষুধ সেবনের পাশাপাশি খাদ্য গ্রহণ ও বর্জনের ব্যাপারে তাদের নিজেদের স্বার্থেই অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। রোগের ধরন ও প্রকপ অনুসারে খাদ্য নির্বাচন ও তার পরিমাণ নির্ধারণ এবং ক্ষেত্র বিশেষে নির্দিষ্ট কিছু খাদ্য পরিহারের ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলা অত্যন্ত জরুরী।
তাই শুধু প্রাণীজ কিংবা উদ্ভিজ্জ নয়, বরং উভয় প্রকার খাদ্যই প্রয়োজন অনুসারে কম-বেশি আমাদের খাবারের তালিকায় রাখতে হবে। রাসূল (সাঃ) পেট পুরে না খেয়ে বরং পেটের একভাগ আহার করা, একভাগ খালি রাখা এবং বাকি একভাগ পানি পান করার পরামর্শ দিয়েছেন। বিষয়টি যে কতটা বৈজ্ঞানিক তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সমগ্র জ্ঞানের আধার মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশ বিশ্বাস করা ও মেনে চলাই মুসলিমদের কর্তব্য।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মে, ২০১২ বিকাল ৪:৩৪