ইদানিং আব্বার খোঁজখবর একটু বেশি নেই। আব্বা-মা আমাকে নিয়ে রাজ্যের চিন্তাভাবনা করেন। এখন অব্দি নিজের চলার মত কোন কর্ম করি না। বিয়ের বয়স তো হলোই প্রায়। আমি টিউশনি করে মাসে যে কটা টাকা পাই তা দিয়ে কোনো রকম টেনেটুনে চলি। আবার নির্লজ্জের মত আদা বয়স্ক আমার হাতটা শৈশবের ছোট্ট হাত বানিয়ে আব্বার কাছে সাদ সকালে গিয়ে হাত পাতি। আর কত? নিজের কাছেই এখন অনেক খারাপ লাগে। না বুঝি তাদের কাছে কত খারাপ লাগে!
আব্বার কি মন চায় না, তার সন্তানের উপার্জনের টাকায় কেনা একটা পাঞ্জাবী পড়ে এলাকা দিয়ে শান্তির নিশ্বাস ফেলে হাঁটতে, চলতে, ফিরতে। আম্মার কি মন চায় না, সন্তানের কামানো টাকায় কেনা শাড়ি পড়ে পাশের বাড়ির আন্টিকে গিয়ে গর্ব করে জোর গলায় বলতে, "এইডা আমার পোলার টাকায় কেনা। খুব টেকসই শাড়িটা।" স্বপ্নগুলো এখন স্বপ্ন হয়েই রয়ে গেছে।
একটা চাকুরীর জন্য কতনা ঘুরছি। বেলাশেষে আমি এক কৃষকের ছেলে। এই শহরের ডালে ভাতে বড় হওয়া মানুষদের কদর নেই। এই শহর তো তাদের দাম দেয় যারা জীবিত প্রাণীকে হিংস জানোয়ারের মতো চিবিয়ে চিবিয়ে খায়।
মা হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়ল। ওষুধ কেনার মত সামর্থ্য নেই আমার। আব্বা আর কত চালাবেন। তার বয়স তো আর কম হলো না। এখন সবটুকু আশা যা তাদের আমাকে নিয়ে। কিন্তু আমি নিজেই নিরাশা হয়ে বেঁচে রয়েছি। মধ্যরাতে মায়ের ব্যথায় কাতরানো দেখে আর ভাললাগেনা। ভাললাগেনা আব্বার চিন্তিত ঐ মুখ খানা দেখে।
ছোটবেলায় শাহবাগের মোড়ে লাল বেলুন দেখে আব্বাকে কিনে দেওয়ার জন্য বায়না করেছিলাম। আব্বা কিনে না দেওয়ায় আমি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ছিলাম। আমি আব্বার কোল থেকে অভিমান করে নেমে গিয়েছিলাম। মনে মনে অভিমানী গলায় বলতেছিলাম, কিসের আব্বা সে, সামান্য একটা যে বেলুন কিনে দিতে পারেনা সে আবার আব্বা হয় কি করে। সেদিন রাতে না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ করে আব্বা এসে আমার ঘুম ভাঙ্গে আমাকে অবাক করে দিয়ে চারটা লাল-নীল রংয়ের বেলুন আমার হাতে গুজে দিল। পৃথিবীর সকল বাবাই তার সন্তানের সুখ দেখতে চায়। নিজেরা কিনে হলেও এনে দিতে চায়। যদিও সুখ স্বর্গীয়। আজ বড় হয়েছি। আব্বা কী এখন আমার ওপর অভিমান করে থাকতে পারেনা? কই আম্মা-আব্বা তো অভিমান করে না! নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অযোগ্য আর পাপী মনে হচ্ছিল। রাস্তার পাশে ল্যাম্পপোস্ট একই জায়গায় সব সময় দাঁড়িয়ে থাকলেও বিশেষ সময়ে এসে আলো দিয়ে মানুষকে সাহায্য করে। কিন্তু আমি যে ল্যামপোস্টের চাইতেও অধম এক দেহ বিশেষ পরিপূর্ণ যুবক।
এক বিকেলে আমার গায়ে একটু আধা ধোঁয়া ময়লা টি শাট দেখে সাথে সাথে ঘর থেকে নতুন টি-শার্ট নিয়ে এসে আমাকে পরিয়ে দেয়। কিন্তু আজ সে নিজেই আধা-ময়লা শার্ট পরে এলাকা ঘুরে বেড়ায়। কই আমিতো আজ কিছুই করতে পারছিনা!
কিছুদিন আগে একটা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকুরীর জন্য আবেদন করেছিলাম। সেখান থেকে একটু আগে মুঠোফোনে জানালো তারা চাকুরী টা আমার হয়েছে। আকাশ থেকে যেন মেঘহীন বৃষ্টি ঝরলো।খুশিতে আমার বন্ধু তপনকে ফোন দিয়ে কিছু টাকা ধার নিলাম। বাজার থেকে এক কেজি রসগোল্লা তাড়াহুড়া করে কিনে নিয়ে বাসায় গেলাম। মাকে জড়িয়ে ধরে প্রশান্তির একটা শ্বাস ফেলে বললাম," চাকরি হয়েছে আমার মা। চাকুরীটা আমি পেয়ে গেছি। প্যাকেট থেকে মিষ্টি তুলে মায়ের মুখে দেবার সময় দেখি মায়ের চোখের কোণায়় জল জমেছে। আমি আমার বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে জল টুকু মুছে দিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে সুখের কান্না কাঁদলাম কিছুক্ষণ। আব্বা চাকুরীর কথা শুনে মহা খুশি। আব্বাকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন,এই পৃথিবীতে আর কিছু চাওয়ার নেই তার। একটা কর্মহীন যুবককে এই জায়গায় দেখার জন্যই হয়তো এতদিন বেঁচে রয়েছে সে। আব্বাকে জড়িয়ে ধরে, আব্বা, আব্বা বলে হাউমাউ করে কাঁদলেন শিশুদের মতো। আব্বার চোখে জল নেই। এবার আব্বাকে আর ময়লা শার্ট পরে বাহিরে যেতে দিবো না।মাকে ওষুধ কিনে দিবো।
অফিস করছি কিছুদিন হলো। মা অসুস্থ হয়েও সুস্থ এখন।আব্বার মুখে প্রশান্তির হাসি। মাস শেষ হবার প্রহর আর ফুরোচ্ছে না আমার। কবে বেতন তুলবো,কবে মায়ের জন্য আর আব্বার জন্য নিজের টাকায় কিছু কিনে উপহার দিবো।
রাতে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির সাথে কথা বলছিলাম। শুনেছি প্রকৃতি মানুষকে সঠিক পথ দেখায়। আকাশে ফুটফুটে চাঁদ উঠেছে। আমি মুগ্ধ হয়ে চাঁদের দিকে তাকিয়ে রয়েছি। চাঁদের বুড়িকে মিছিমিছি একটা সুতি কাপড় দিয়ে পাঞ্জাবি বানানোর জন্য বায়না দিলাম। আব্বাকে দিবো বলে। আব্বা পিছন থেকে আমার ঘাড়ের মধ্যে হাত রাখল। "আব্বা' বলে ডাক দিয়ে বলল, অনেক রাত হয়েছে এবার ঘুমা।
আজ বেতন পেয়েছি। একটা অকর্মক আজ একটা কর্ম করে কিছু টাকা উপার্জন করেছে। বেতন পেয়ে সোজা মার্কেটে চলে যাই। বাবার জন্য সুন্দর দেখে একটা সাদা পাঞ্জাবি কিনে মায়ের জন্য একটা বেনারসি শাড়ি কিনি। নিজেকে অনেক বড় বড় মনে হচ্ছে আজ। আবার অনেক ছোটও। প্যাকেট হাতে ফুটপাত ধরে ছোট মানুষী হাঁটা হাঁটছিলাম। মাঝেসাজে মুখ দিয়ে শিষ বাজিয়ে শহরটাকে জানিয়ে দিচ্ছিলাম যে, মধ্যবিত্ত পরিবারে একটি সুখ অনেক সুখ। কিন্তু এতটুকুর জন্য তাদের হাজার সংগ্রাম করতে হয়। রাস্তার পাগল, আধা-পাগল, নেড়ি কুকুর, ভদ্র সমাজের মুখোশ পরা অভদ্র সমাজসেবক আজ আমাকে দেখে বলে দিতে পারবে, আজকে আমি খুশি। অনেক খুশি। মহাখুশি। এক পৃথিবী খুশি।
বাসায় এসে আব্বা, আব্বা বলে ডাক শুরু করলাম। আমি আবার ছোট্টবেলা থেকেই কায়দা করে আব্বা বলে ডাকতাম। আব্বা ডাকটা আমার খুব ভালোলাগে। আব্বা ডাকটা প্রশান্তির ডাক। সুখের ডাক। আব্বা আমার সামনে আসতেই তার গায়ে নতুন পাঞ্জাবীটা ধরে বললাম, আব্বা পাঞ্জাবী কেমন হয়েছে? আব্বা ভেজা চোখে উত্তর দিলো, বেশ ভালো, খুব ভালো, অনেক সুন্দর। এক পৃথিবীতে এত সুন্দর জিনিস বা উপহার আমি আগে কখনো পায়নি আর কখনো পাবোনা। মাকে জড়িয়ে ধরে মা, মা বলে ডাক দিলাম। মা আমাকে কপালে আদর মাখা চুমু দিয়ে বলল, বাবা আমার বড় হয়েছে। এবার ঠেকাবে কে আমাকে। আব্বা, মা ও আমি তিনজনেই সুখের হাসি হাসলাম কিছুক্ষন। মধ্যবিত্ত পরিবারে টুকিটাকি সুখের অভাব নেই। শুধু চাই ছোট্ট একটা সুযোগ, বড় না। শুধু চাই ডাল-ভাত খেয়ে বাঁচতে। চিকেন ফ্রাই না।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে মে, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:০৫