আমার বন্ধু কাইকর, এলাকার সবচেয়ে সুদর্শন এবং সব বিষয়ে পটু। এলাকার সব মেয়েদের পিছন পিছন ঘুরায়। শহরের নামি-দামি পার্লারে গিয়ে হেয়ারস্টাইল বদলায়। ঘুম থেকে বেলা বারোটা বাজে উঠে চায়ের কাপে মুখ দেয়। সমাজের প্রভাবশালী হিসেবেই পরিচিত তাঁরা। বাসা থেকে বের হবার আগে শরীরের এপাশে-ওপাশে নামিদামি ব্র্যান্ডের সুগন্ধি ঢেলে বের হয়। কাইকরের সাথে আমার বন্ধুত্ব ছোটবেলা থেকেই। একই এলাকায় বড় হয়েছি।আমি বাস্তবতার শিকার হয়ে এখন ছোটখাটো একটা চাকরি করি।প্রতিদিন সকালে অফিসের জন্য বাসা থেকে বের হয়ে যায়। ফেরার কোন ঠিক নেই!
চার মাসেক পর। হঠাৎ করে আমার বন্ধু কাইকর কথা নেই বার্তা নেই হুট করে পাগল হয়ে গেল! সারাদিন মনে মনে কবিতা বিড়বিড় করে! আমি অফিস শেষে বাসায় ফেরার পথে দেখি, কাইকর শাহবাগের মোড়ে দাঁড়িয়ে পাগলামি করছে। আমি সামনে যেতেই আমার শার্টের কলার ধরে বললো," এই ফকিন্নিরপুত, তুই এখানে কি করিস? যা আবাসিকে গিয়ে শুয়ে থাক। আমি শুনে গম্ভীর হতে গিয়েও ফিক করে দাঁত বের করে হেসে দিলাম। গা দিয়ে প্রচুর পরিমাণে গন্ধ!হয়তো ওর জীবনের অভিধান থেকে গোসল নামের শব্দটা উঠে গেছে! প্রতিদিন এভাবে অফিস থেকে ফেরার পথে ওর খবর নিতাম।
একদিন অফিস শেষে বাসায় ফেরার পথে বাসের জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি, পুরো নগ্ন হয়ে রোদের সাথে খেলা করছে কাইকর।সবাই দেখে বেশ মজা নিচ্ছে। আমি বাস থেকে তাড়াহুড়া করে নেমে কাইকরের কাছে গেলাম। কাইকরকে পাশের টং দোকানে যত্ন করে বসিয়ে চা,বিস্কুট কিনে খাওয়ালাম।শেষে একটা বাংলাদেশি বেনসন সিগারেট ধরিয়ে দিলাম।কাইকর খুশিমনে সিগারেটে সুখটান দিতে দিতে বলল, মামা তুমি অনেক ভালা। দোয়া করি সানিলিওনের মত একটা ভবিষ্যতে বউ পাও। শুনে আমার চোখে জল জমে এলো। পাড়ার সবচাইতে সুদর্শন আর পটু ছেলেটা আজ রাস্তার পাগল!
এককালে কাইকর ভালোবাসতো অপ্সরাকে! দুজন মিলে কতনা আড্ডা জমিয়েছে রমনার পার্কে। এক পূর্ণিমার রাতে ফুটফুটে চাঁদ ও তার আলো গায়ে মেখে অপ্সরা তাকে কথা দিয়েছিল, হাজার ঝড় আসলেও তাকে ছেড়ে যাবে না কোনদিন। শুনে প্রশান্তির এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছিল কাইকর।অপ্সরার ভালোবাসা পেয়ে ফ্লাটিং করা ছেলেটা কোন মেয়ের দিকে তাকাতো না।কারণ -এখন সে এক পৃথিবী ভালোবাসে অপ্সরাকে। হঠাৎ কাইকরকে না জানিয়েই প্রবাসী সুমুনের গলায় সুরক্ষা মালা পরিয়ে দিয়ে এখন সিডনিতে সুখে-পরিতৃপ্তিতে ঘর সংসার করছে অপ্সরা। অপ্সরা এখন মহাসুখে। মাঝেমাঝে সিডনির বড় বড় অভিজাত রেস্টুরেন্টে বসে বার্গার চিবুতে চিবুতে বর্তমান স্বামী সাথে মহাসুখে দিন কাটাচ্ছে।
কাইকর এসবের খবর রাখেনা। রোজ রাতে নেড়ি কুকুর টাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমায়। ফুটপাতের পাশে পড়ে থাকা ময়লা গন্ধযুক্ত রুটি খেয়ে থাকে। রাতে ড্রেনের দুপাশে দুই পা ছড়িয়ে আরাম করে বসে প্রাকৃতিক কাজটা সারে। ড্রেনের পানিতে চাঁদের আলো আরো চিরযৌবনা দেখায়। অপ্সরার নাম উচ্চারন করতে করতে চাঁদকে চুমু খেতে গিয়ে নোংরা পানিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে কাইকর।খুব কাঁদতে থাকে।পাশ দিয়ে যাওয়া দুই তিনজন পথচারী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখে। কেউ কেউ তো আগবাড়িয়ে সেলফি তুলে ফেলে গোটা কয়েক। তারা তো আর জানে না আমার বন্ধু কাইকর পাগল হয়ে গেছে!
রাতে নর্দমার পাশে আধা ময়লা গন্ধযুক্ত জায়গায় প্রশান্তির ঘুম দেয় নাক ডেকে। তার সঙ্গী সাথী এখন ফুটপাতের নেড়ি কুকুর গুলো আর মশা-মাছি। ভোরের আলো তার গায়ে এসেই প্রথমে পরে। সে সূর্যমামার সাথে খেলা করতে করতে হাই তুলে। পকেট থেকে কমদামি একটা আকিজ বিড়ি বের করে ধরিয়ে মহাসুখে টানে। আমার বন্ধু কাইকর শহরের আট-দশটা ধান্দাবাজদের থেকে ভালই আছে। সুখে আছে, মহাসুখে আছে।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে মে, ২০১৮ দুপুর ২:৫৩