আমার মত বাউন্ডুলের জীবনে এমন মেয়ে আসবে কে জানত। মেয়েটা প্রথম দেখায় আমার নাক, কান টিপে আদুরে গলায় মুচকি হেসে বলেছিল, এমন আধাভোলা অগোছালো ছোট গল্পের মত তুমি খুজছিলাম এতদিন। আমার তো রীতিমতো ঘাম বের হলো তোড়জোড় করে শরীর থেকে। ওর শ্যামলা হাতের ছোঁয়া পেয়ে তারপর তিনদিন ভুল করেও মুখে পানি ছুয়াইনি। ওর হাতের গন্ধটাকে বিশুদ্ধ বোকা বালকের মত আমার হাতে, হৃদয়ে,নাকে রেখে দেই।
সারাদিন সেইতো পোষা খরগোশটার মতো এঁকেবেঁকে কবিতা লিখে যাই। তবুও মাধবীলতার জন্য কিছু একটা করতে মন চাইছিলো। তাকে কিছু দিতে মন চাইছিল। তিন মাসের না-কামানো দাড়ি, গোঁফ ওয়ালা মানুষটাকে যে এত ভালবাসে তার জন্য তো কিছু একটা উপহার কিনতেই হবে।
বাজার থেকে নীল রঙের গুটিকয়েক চুড়ি আর চুমু খেয়ে নষ্ট করা লাল লিপিস্টিক কিনলাম তার জন্য।
পরদিন গোধূলি লগনে যখন আমার পাশে বসে নীল চুড়ি হাতে পড়ল সাথে কালচে ঠোটে লাল রঙের লিপস্টিক। কি যে ভাল লাগছিল তাকে। পুরো গোধূলি লগনের টক টক করা লাল সূর্যের মতো জ্বলছিল। ও ছেলেমানুষি করে হাত নাড়ালে নীল চুড়ি থেকে মুহুমুহু টুংটাং সুনীলের কবিতার শব্দ কানে আসছিলো ভেসে ভেসে। হঠাৎ করে মাধবীলতা আমার হাতে হাত রেখে অন্য হাত দিয়ে আমার না-কামানো দাড়ি,গোঁফ নিয়ে খেলা শুরু করে দিল। আমার দাড়ি, গোঁফ দিয়ে নাকি সুগন্ধ ছড়ায়। এটা নাকি ভালোবাসার গন্ধ।যেখানে আমার দাড়ি,গোঁফ দেখলে সবাই পালায়। বিচ্ছিরি বলে আমার পাশ থেকে সরে যায়।
বাসায় এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে না-কামানো দাড়ি, গোঁফের দিকে এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকি। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করি দাড়ি-গোঁফ না কাটার। ওতে যে তার ছোয়া আছে। মাধবীলতা তার মনের সকল রস মিশিয়ে আমাকে চিঠি লিখতো। আমি সেই চিঠি বিছানায় এপাশ ওপাশ হয়ে শুয়ে শুয়ে পড়তাম। চিঠিতে তার গন্ধ আছে বলে।
কিছুটা ছিটগ্রস্ত পাগলের মতো তার কথা ভাবতে ভাবতে মাঝরাতে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়তাম। ল্যাম্পপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা কুকুরের সাথে হামাগুড়ি দিতাম। বাতাসে তার গন্ধ পেতাম। চাঁদের আলোয় তাকে খুঁজে পেতাম। খালি রাস্তায়, জনশূন্য নগরীতে একা অথবা কল্পনায় মাধবীলতাকে সাথে নিয়ে ভালবাসার লাল গালিচা বিছানো রাস্তায় হাঁটতে আমার ভাল লাগে।
লোকে এতক্ষণে কি ভেবেছে কে জানে,মাধবীলতার কবরে মাথা রেখে একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অন্য জগতে চলে গিয়েছিলাম। মাটি অথবা মাধবীলতার বুকে আমার মাথা রাখা ছিল। পকেট পুষে রাখা কবেকার তার গন্ধ মেশানো গুটি কয়েক চিঠি নিয়ে। খুব খারাপ লাগছিলো।
সে হয়তো ওই পারে আত্মাদের ভরা মজলিসে বসে শেষ বিকেলে দাবা খেলতে খেলতে আমার গোঁফ,দাড়ির কথা মনে করে হাসছে। আবার মাঝে মাঝে মন খারাপ করে বসে থাকে না পাওয়ার ব্যথায়। নিজের হৃদয় ছোঁয়াবার কালে কখনো ওর শেষ স্মৃতিগুলো এভাবে শেষ হতে দিতে চাইনি। আমার বুক থেকে ঝরে পড়া অব্যক্ত রক্তগুলো মাধবীলতার কান্নার সাথে মিশে যাচ্ছিলো। শরতের আকাশটা স্বাভাবিকের চেয়ে কালো দেখাচ্ছিলো বেশি সে সময়টা। এদিকে মৃতদের ময়দানে বিষন্ন বাতাসের তোড়জোড়। মাধবীলতা প্রকৃতি হয়ে গেছে। বাউন্ডুলে তার পুষে রাখা খরগোশটার জন্য, তাকে বলে যেতে না পারা এক আকাশ সমান কথাগুলোর জন্য আজ প্রাণভরে কাঁদবে সে।