এক অকর্মক গরীব আমি। আমার জীবনটা নদীর ঘোলা পানিতে ভেসে বেড়ানো কচুরিপানার মতো। নদীর স্রোতে ইচ্ছা না থাকা সত্বেও অনিচ্ছায় ভেসে বেড়াই। আশীর্বাদের জীবন আমার। খুব বেশি সুখি হতে চাইনি কখনো। শুধু ফাঁকা মাঠে ঘামা গায়ে তার সাথে বসে পানি ভাতের সাথে কাঁচা মরিচে একটু কামড় দেবার স্বপ্ন দেখতাম।
কই বেশি কিছু তো চাইনি! গরিবের তোষক পাতা নরম বিছানা লাগেনা, লাগেনা জাদুর শহর ঘুরতে চারদেয়ালে আটকানো কালো ফ্রেমের চার চাকার গাড়ি। মাঝে-মধ্যে মন চাইলে যাদুর শহর ঘুরতাম ফাকা পকেটে বাদাম ফেলে চিবুতে চিবুতে। পায়ের নিচে থাকা পাতার মর্মর শব্দের সাথে তাল মিলিয়ে বাদাম চিবুতে ভালোই লাগতো। গরিবের টুকিটাকি সুখের অভাব নেই। অভাব শুধু ভালো ভাতের সাথে একটু খানি তরকারির!
দু'বছর আগেও জাদুর শহরে জীবন তাগিদে রিকশা চালাতাম মনের আনন্দে। ছোটবেলা থেকেই বাবা-মা না থাকায় বড় হয়েছি এই জাদুর শহরের অলিতে গলিতে। যাকে আমরা দূর থেকে উঁচু গলায় নিচু মতন টোকাই বলে গর্ববোধ করি। তবে, আমি প্রতিষ্ঠিত টোকাই নই। প্রতিষ্ঠিত বলতে, ঘামের সাথে পলিথিন মিশিয়ে যে একমনে টানে। এটা একটা ছোট্ট উদাহরণ। আমি সব টোকাইদের থেকে একেবারে ভিন্ন। তাই আমি প্রতিষ্ঠিত টোকাই নই।
খেয়ে না খেয়ে টাকা জমিয়ে একখানা তিন চাকার মান্নার ছবি ওয়ালা রিক্সা কিনেছিলাম। রিকশার চাকার সাথে পাল্লা দিয়ে চলছিল জীবন! আস্তে আস্তে ডালে-ভাতে খেয়ে ফাঁকা পকেটে অল্প কিছু টাকার ভার। শহরের আট-দশটা টোকাইদের চেয়ে জীবন ভালোই চলছিল। ফাঁকা পকেটের অল্প ভারে একজন পূর্ণবয়স্ক পুরুষের মনে জাগতে শুরু করলো বাবা হবার স্বপ্ন। একটু-আধটু করে ভবিষ্যৎ সংসারের জন্য জাদুকরী মাটির ব্যাংকে রাখা শুরু করলাম গুটিকয়েক করে টাকা। ভালোই ছিল মাটির ব্যাংকে রাখা দু'টাকার স্বপ্ন।
বছর দুয়েক আগে চার চাকা ওয়ালা দামি কালো গাড়ি আমার কমদামী স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরে শেষ করে দিয়ে যায়। তারপর পা দুটো হারায়। এখন হাটার মাঝে আর পায়ের নিচে পড়ে থাকা পাতার মড়মড় শব্দ শুনতে পাইনা। পাইনা এক বুক ছোট্ট স্বপ্ন দেখতে। যেখানে শুধুই চাওয়া ছিল একটুখানি পানি ভাতের সাথে কাঁচা মরিচে কামুড় দেবার স্বপ্ন।
এখন আমি স্বয়ংসম্পূর্ণ নই বলে শহরের মানুষ আমাকে দেখে নাক কুঁচকায়। ল্যাম্পপোস্টের নিচে থাকা কুকুরগুলো আমাকে দেখে পা উঁচু করে তুলে মুতে। তারা তো আর বুঝে না, এই শহরের অপ্রতিষ্ঠিত এক টোকাইয়ের বুক ভরা কষ্ট। নিজের তিন চাকার প্রিয় রিকশাটা বিক্রি করে চলেছিলাম মাস তিনেক। তারপর থেকে মানুষের লাথি গুড়ি খেয়ে খেয়ে মাসের দশ দিনের আহার জুটাই। বাকী বিশ দিন পেট বুঝে, নাক বুঝে সূর্যের আলো মাথায় নিয়ে শুয়ে থাকি।
আমার কী সেই প্রেমটা করতে ইচ্ছে করেনা? আমার কি বাবা হতে ইচ্ছে করেনা? ইচ্ছে করেনা শাহবাগে গিয়ে তার জন্য লাল চুড়ি কিনতে।যে কিনা বিয়ের আগেই মনবিধবা। তবুও দিনশেষে এক অপ্রতিষ্ঠিত টোকাই সূর্যের আলো চাঁদের আলো শরীরে মেখে পড়ে থাকে জাদুর শহরের এক কোনায়। যে কিনা কাউকে স্বপ্ন দেখাইনি, স্বপ্ন দেখেছিল।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জুলাই, ২০১৮ বিকাল ৪:৪৬