মেয়ের কষ্ট বড় বাজে বাবার হৃদয়ে। আত্মজার কষ্ট দূর করতে তিনি তাকে সন্ধান দেন এক বিশুদ্ধ অনুভূতির, মহান এক সৌন্দর্যের, বঞ্চনা আর হতাশার ঊর্ধ্বে প্রজ্ঞাময় জগতের সুশৃঙ্খল নিয়মের—মেয়েকে শিক্ষা দেন গণিত। আর মেয়ের নাম অমর করে রাখার জন্য রচনা করেন এক মহাকাব্য, মেয়ের নামে যার নাম।
সময়টা ১১৫০ সাল। বিশ্ব ইতিহাসে এক থমথমে শান্ত অধ্যায়, শক্তিশালী ঝড়ের পূর্বে প্রকৃতির সমাহিত রূপের মতো। উনিশ বছর আগে জন্মভূমি পারস্যের (Iran) নিশাপুরে রেশম পথের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হন ওমর খৈয়াম (Omar Khayyam)। মঙ্গোলিয়ার অনন নদীর অববাহিকায় দুর্ধর্ষ ঘেঙ্গিস খানের (Ghengis Khan) জন্ম আর মাত্র এক যুগ দূরে। ওদিকে ইউরোপে তখনও অন্ধকার—মুসলিম বিজ্ঞানী ও গণিতবিদদের আরবীয় পাণ্ডুলিপি লাতিন ভাষায় অনুবাদের মধ্য দিয়ে ইউরোপ অবলোকন করছে জ্ঞানের বিস্ময়কর এক জগত, সে সাথে আবার নতুন করে পরিচিত হচ্ছে ইউক্লিড এরিষ্টোটলের সাথে; দার্শনিক আদেলার্দ (Adelard of Bath) ও তাঁর ছাত্রদের শামদেশে (Syria) আহরিত প্রাচ্যের এই জ্ঞানপ্রবাহ পরে জন্ম দেবে ইউরোপীয় রেনেসাঁর। এবং আর তিন যুগ পরে পবিত্রভূমি জেরুজালেম আবারও প্রকম্পিত হবে ক্রুসেডারদের পদভারে, যদিও সিংহহৃদয় রাজা রিচার্ড (Richard the Lionheart), পরাক্রমশালী ফিলিপ, ধূর্ত লিউপল্ড এবং বয়স্য বারবারোসার সম্মিলিত প্রয়াস ব্যর্থ হবে সালাদীন (Ṣalaḥ ad-Din Yusuf ibn Ayyub) নামে এক বেদুঈন সুলতানের মহত্ত্ব আর বীরত্ত্বের কাছে।
ইতিহাসের সেই শান্ত ক্ষণে পিতার মমতায় অনন্য হয়ে উঠা কিশোরীর নাম লীলাবতী (Lilavati), এবং লীলাবতী নামের মহাকাব্যটির রচয়িতা মেয়েটির পিতা এই উপমহাদেশেরই প্রাচীন অবন্তী তথা উজ্জ্বয়নী মানমন্দিরের প্রধান আচার্য ভাস্কর (Bhaskara Acharya), যিনি বরাহমিহির (Varahmihira) ও ব্রহ্মগুপ্তের (Brahmagupta) গণিতের ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যান বহুদূর এবং যাঁকে বলা হয় দ্বাদশ শতকের গণিত ও মহাকাশ বিজ্ঞানের শীর্ষবিন্দু। ক্যালকুলাস, মহাকাশ বিজ্ঞান, সংখ্যাতত্ত্ব এবং সমীকরণ সমাধানে তাঁর জ্ঞানের সমকক্ষতা অর্জন করতে পৃ্থিবীতে কেটে যাবে আরও কয়েকশ বছর। এবং পৃ্থিবীর মানুষ বিস্ময়ে জানবে উইলিয়াম ব্রাউংকার, পিয়েরে দ্য ফামা (Pierre de Fermat), লিউনার্দো অয়লার (Leonhard Paul Euler) ও রলি’র মত মহান গণিতজ্ঞদের অনেক অবদান আসলে একেবারে নতুন কিছু নয়, বহু পূর্বেই পৃ্থিবীকে তা দিয়ে গিয়েছেন আচার্য ভাস্কর।
লীলাবতী একটি কাব্যময় গণিতের বই—ভাস্করাচার্যের “সিদ্ধান্ত শিরোমনি” গ্রন্থচতুষ্টয়ের প্রথম গ্রন্থ। তেরটি অধ্যায়ে রচিত পাটিগণিতের এই বইটিতে আলোচনা করা হয় আটটি গাণিতিক প্রক্রিয়া (পরিকর্মষ্টক): যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ, বর্গ, ঘন, বর্গমূল এবং ঘনমূল। তারপর আসে
• শূন্যপরিকর্মণ: শূন্যের ব্যবহার
• ব্যস্তবিধি: ব্যস্ততার নিয়ম
• ইষ্টকর্ম: ঐকিকনিয়ম
• সংক্রমণ: (ক+খ) এবং (ক-খ) থেকে অপনয়ন পদ্ধতিতে ক ও খ-এর মান নির্ণয়
• বর্গসংক্রমণ: (ক+খ) এবং (ক^২-খ^২) থেকে অপনয়ন পদ্ধতিতে ক ও খ-এর মান নির্ণয়
• বর্গকর্ম: ক ও খ-এর এরূপ মান নির্ণয় যাতে (ক^২+খ^২-১) এবং (ক^২-খ^২-১) পূর্ণবর্গ হয়
• মূলগুণক: বর্গমূল ও দ্বিঘাত সমীকরণ সংক্রান্ত সমস্যা
• ত্রৈরাশিকা: তিন-এর নিয়ম
• বন্দপ্রতিবন্দক: বিনিময় ব্যবস্থা
• মিশ্রব্যবহার: মিশ্রণের নিয়ম
• শ্রেণীব্যবহার: ধারার ব্যবহার
• অঙ্কপাশা বিন্যাস ও সমাবেশ
• কুত্তক: অনির্ণেয় সমীকরণের সমাধান
• ক্ষেত্রগণিত: জ্যামিতি
বইটির অধিকাংশ সমস্যা ছন্দোময় কবিতার শ্লোকের মত হৃদয়গ্রাহী প্রাঞ্জল করে বর্ণনা করা হয়েছে, সাজানো হয়েছে রাজা, হাতি, পদ্মফুলের মত পরিচিত জিনিস দিয়ে যাতে শিক্ষার্থীদের বুঝতে সুবিধা হয়। আর সেগুলো উপস্থাপন করা হয়েছে লীলাবতীকে সম্বোধন করার মধ্য দিয়ে। যেমন:
মৃগনয়না লীলাবতী
বল দেখি পার যদি
১৩৫ গুণন ১২ কত হয়
যদি তোমার জানা রয়
গুণন প্রক্রিয়া-পৃথক অংশে আর পৃথক অংকে?
সুবিন্যাস, উন্নততর পদ্ধতি এবং নতুন বিষয়বস্তু লীলাবতীকে করেছে চিরায়্ত—যুগ যুগ ধরে লীলাবতীর সৌন্দর্যে বিষ্ময়াবিষ্ট আনন্দে আপ্লুত হয়েছে গণিতানুরাগীদের হৃদয়। গত নয়শো বছরে পৃথিবীতে পরিবর্তন হয়েছে বহু: একদা পৃথিবীর সর্ববৃহৎ অখন্ড সাম্রাজ্য মঙ্গোল বিভক্ত হয়েছে শতধা, কলম্বাসের দেখানো পথ ধরে আসা সোনাখেকোদের হাতে বিলুপ্ত হয়েছে তিন হাজার বছরের আ্যজটেক সভ্যতা (Aztec Civilization), আটলান্টিকের এক তীর থেকে দলে দলে দাসদের তাড়িয়ে নেওয়া হয়েছে পৃ্থিবীজুড়ে, পত্রঝরার চন্দ্রকলায় নিজভূমে হারিয়ে গেছে কত আদি অধিবাসী, এবং মাত্র চৌষট্টি বছর পূর্বে লিটল বয় নামের আণবিক বোমার আঘাতে হিরোশিমা নামের একটি শহরে মারা যায় ১৪০০০০ মানুষ।
কিন্তু ভালোবাসাহীন এইসব কাহিনী সভ্যতার শাশ্বত গল্প নয়, শাশ্বত হচ্ছে সেই সব গত নয়শো বছর ধরে লীলাবতী নামের গ্রন্থটি যা দিয়েছে: পরিশুদ্ধ সৌন্দর্য; উন্মোচিত হয়েছে তাদের সামনে সৃষ্টিজগতের মমতাময় নিয়মের মধ্যে কাব্যময়তা খুঁজে পাবার ক্ষমতা রাখে যাদের হৃদয়, যাতে নেই কোন হতাশা, কোন গ্লানি—ঠিক যেমনটি বলে যবনিকা টেনেছেন মহর্ষি ভাস্কর লীলাবতী উপাখ্যানের:
আনন্দ এবং সুখে প্রকৃতই উদ্ভাসিত হচ্ছে জগত, তাদের জন্য যাদের গলা জড়িয়ে আছে লীলাবতী–ভগ্নাংশ, গুণন এবং সূচকের সুশৃঙ্খল সরলীকরণে সুসজ্জিত, সমাধানের মত বিশুদ্ধ ও সঠিক, আর বচনামৃতের মতই মনোহর।
আগ্রহীদের জন্য লীলাবতীর ইংরেজি অনুবাদ থেকে দুটি সমস্যা বাংলায় কবিতাকারে অনুবাদ করে দিলাম:
__________________________________
সমস্যা এক:সারস আর হংসপূর্ণ সরোবরে
জলতলের অর্ধহস্ত উপরে
পদ্মকলি এক ঋজু সুঠাম দাঁড়িয়ে।
অপরাহ্নের সমীরণ
দেহে জাগায় কম্পন
আদি অবস্থানের দুই হস্ত দূরে
পরশে পদ্মকলি জলকে যায় নাড়িয়ে।
শুনলে এই বর্ণনা
করো এবার গণনা
জলের গভীরতা আর পদ্মের উচ্চতা।
সমস্যা দুই:
তিক্ত, অম্লীয়, ঝাঁঝালো, মিষ্টি, টক আর লোনা
ছয়টি স্বাদ তুমি ভিন্ন ভিন্ন পাত্রে দেবে ভরে
একটি একটি করে এবং মিশিয়ে মিশিয়ে-
কয়টি পাত্র লাগবে তোমার এই কাজটির তরে?
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে অক্টোবর, ২০১২ বিকাল ৩:২৮