প্রাচীন পৃথিবীর বিখ্যাত এক জ্ঞানী মানুষ—এরিস্টোটল তাঁর নাম—বৈজ্ঞানিক যুক্তিতর্কের সাহায্যে একদা প্রমাণ করেছিলেন, উপর থেকে দুটি বস্তু ছেড়ে দিলে ভারী বস্তুটি সর্বদা হালকা বস্তুর চেয়ে আগে মাটিতে পড়বে। ৩২২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মারা যান এরিস্টোটল, কেটে যায় প্রায় ২০০০ বছর। আর এই সুদীর্ঘকাল টিকে থাকে এরিস্টোটলের পড়ন্ত বস্তুর মতবাদ।
কিন্তু ১৫৮৯ খ্রিস্টাব্দে হঠাৎ ক্ষেপে উঠেন ইটালির একজন বিজ্ঞানী, গ্যালিলিও গ্যালিলি: ভুল করেছেন এরিস্টোটল!
"তাই নাকি?" আঁতকে উঠেন তাবৎ বিজ্ঞানী। "আচ্ছা, প্রমাণ করে দেখান তাহলে!"
"ঠিক আছে।" গ্যালিলিও তরতর করে উঠে যান পিসা শহরের হেলানো মন্দিরের চূড়ায়। সেখান থেকে নিরাক পড়া এক দিনে, ভিন্ন ওজনের দুটি গোলা একই সাথে ছেড়ে দেন নিচে—একটি মাস্কেটের গোলা, অন্যটি কামানের। গোলা দুটি এক সাথে মাটিতে পড়ে, তাদের পতনের একটি মাত্র শব্দ শোনা যায়।
স্তম্ভিত হলেও পরীক্ষালব্ধ ফলাফল মেনে নেয় বিজ্ঞান জগত: হ্যাঁ, এরিস্টোটল ভুল। মুক্তভাবে পড়ন্ত বস্তুর ক্ষেত্রে হালকা ভারী কোনো ব্যাপার না, সব একই গতিতে নীচে পড়ে।
পড়ন্ত বস্তু নিয়ে আরো নানা পরীক্ষা করেন গ্যালিলিও। এ সকল পরীক্ষার কারণে কেউ কেউ গ্যালিলিওকে প্রথম বিজ্ঞানী হিসেবে আখ্যায়িত করেন, কারণ নিচের সুশৃংখল বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিটি অবলম্বন করেছেন তিনি:
ইতিহাসের সময়রেখা ধরে এগুলে আমরা দেখি পৃথিবীর বহু প্রান্তে বহু মানুষ প্রকৃতির উপর গবেষণা করে গেছেন, কোনোরূপ নিয়মতান্ত্রিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন না করেই। প্রথম দিককার এরূপ কিছু মানুষ ছিলেন প্রাচীন গ্রিকরা। এরিস্টোটলের মতো পণ্ডিতগণ প্রাকৃতিক স্বতঃসিদ্ধ ঘটনা (phenomena) পর্যবেক্ষণ করেছিলেন, কিন্তু তাঁরা তাঁদের ধ্যান-ধারণাকে সুশৃঙ্খল গবেষণার মাধ্যমে পরীক্ষা করে দেখেননি। তাঁরা চেয়েছিলেন যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে তাঁদের ফলাফলকে সমর্থন করতে। এর ফলে প্রায়ই তাঁরা ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হতেন, যা ধরা পড়ে শত শত বছর পর, বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে।
অবশ্য বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পাদনের ক্ষেত্রে গ্যালিলিও গ্যালিলি প্রথম ব্যক্তি ছিলেন না। ত্রয়োদশ শতকে, রজার বেকন (Roger Bacon) নামের ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত একজন ফ্রান্সিসকান সন্যাসী বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি সমর্থন করে যাওয়ার পরবর্তী ৩০০ বছর ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন ইউরোপীয় বিজ্ঞানীগণ। বেকন আলোক তত্ত্বের (Optics) উপর তাঁর একটি গ্রন্থ পারস্পেকটিভা (Perspectiva)-তে দর্শনের (vision) ব্যাপারে গ্রিক বিশ্বাসকে চ্যালেঞ্জ করে বেশ কয়েকটি পরীক্ষা সম্পন্ন করেন এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ৭টি ধাপ অবলম্বন করেন।
বেকনের পারস্পেকটিভা অবশ্য মৌলিক কোনো গ্রন্থ নয়, এটি ত্রয়োদশ শতকে স্পেনে প্রকাশিত দি এসপেক্টিবাস (De aspectibus, the Optics) নামের বিশাল একটি গ্রন্থের সংক্ষিপ্ত রূপ। পারস্পেকটিভা গ্রন্থটি দি এসপেক্টিবাস এর আদলেই সাজানো, এর পরীক্ষা সমূহ ধাপে ধাপে মূল গ্রন্থ থেকে পুনরাবৃত্তি করে, কখনো কখনো একেবারে আক্ষরিকভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
কিন্তু দি এসপেক্টিবাসও মৌলিক কোনো গ্রন্থ নয়, এটি আরবী ভাষায় রচিত কিতাব-আল-মানাজির (Kitāb al-Manāzir, Book of Optics) নামক একটি গ্রন্থের অনুবাদ। যুগান্তকারী গ্রন্থ কিতাব-আল-মানাজির, রচনা করা হয়েছে ১০১১ থেকে ১০২১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময় ধরে। পদার্থবিদ্যার ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাব সৃষ্টিকারী গ্রন্থ হিসেবে আইজাক নিউটনের Philosophiae Naturalis Principia Mathematica এর সমান্তরালে উচ্চারিত হয় এর নাম। লেখক একজন আরব পণ্ডিত, নাম আবু আলী আল-হাসান ইবনে আল-হাতেম (Abū ʿAlī al-Ḥasan ibn al-Ḥasan ibn al-Haytham)। গ্রন্থটিতে তিনি আলোকসংক্রান্ত অনেক যুগান্তকারী তত্ত্ব দেন এবং প্রাচীন ভ্রান্ত ধারণার নিরসন করেন, তাই তাঁকে বলা হয় আধুনিক আলোকবিজ্ঞানের জনক (father of modern optics)।
বর্তমান ইরাকের বসরা নগরীতে ৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন ইবনে আল-হাতেম। কেউ তাঁকে বলেন আল-বসরী 'বসরা থেকে আগত ব্যক্তি', কেউ বা বলেন আল-মিসরী 'মিসর থেকে আগত ব্যক্তি'। আর পশ্চিমে তাঁকে বলা হয় আল হাজেন, তাঁর নাম আল-হাসানের লাতিনীয় অনুবাদের কারণে ঘটেছিল এমনটি। তিনি লিখে গেছেন ২০০'র উপর গ্রন্থ এবং অভিসন্দর্ভ, নানা বিষয়ের উপর। জ্যামিতিতে বীজগণিত প্রয়োগের প্রচলন তিনিই প্রথম করেন, এর ফলে সূচনা হয় নতুন গাণিতিক ধারা: বিশ্লেষণধর্মী জ্যামিতি (analytic geometry), রেনে ডেকার্তের জ্যামিতিক বিশ্লেষণ এবং নিউটনের ক্যালকুলাসে এর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।
ইবনে আল-হাতেমের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগের পেছনে কাজ করেছে মূলত তাঁর ধর্মীয় বিশ্বাস এবং তাঁর অনুসন্ধিৎসু, সন্দেহবাদী মন। তিনি বিশ্বাস করতেন মানুষ খুঁতপূর্ণ, কেবলমাত্র স্রষ্টা নিখুঁত। প্রকৃতির ব্যাপারে সত্য আবিষ্কার করতে, তিনি বলতেন, প্রকৃতিকেই তার নিজের হয়ে কথা বলতে দিতে হবে। টলেমির উপর সংশয় পোষণ করতে গিয়ে তিনি বলেন,
"একজন সত্য-সন্ধানী তিনি নন যিনি প্রাচীন মানুষের লেখা পড়েন, এবং নিজের প্রবৃত্তির দ্বারা পরিচালিত হয়ে সেগুলির উপর বিশ্বাস স্থাপন করেন, বরং তিনিই সত্য-সন্ধানী যিনি সেগুলির উপর নিজের বিশ্বাসকে সন্দেহ করেন এবং সেখান থেকে যা আহরণ করেন তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন—তিনি এমন একজন মানুষ যিনি যুক্তি ও নিরীক্ষার আশ্রয় নেন।"
'আলো এবং বর্ণ বায়ুতে মিশ্রিত হয় না' এ হাইপোথিসিসকে পরীক্ষা করতে গিয়ে আল-হাতেম পৃথিবীর প্রথম ক্যামেরা, অবস্কিউরা (Obscura) উদ্ভাবন করেন, পর্যবেক্ষণ করেন আলো সূক্ষ্ম ছিদ্রের ভেতর দিয়ে গমন করার পর কী ঘটে, এবং ফলাফল লিপিবদ্ধ করেন। এমনিভাবে আরো ডজন ডজন 'সত্যিকারের গবেষণালব্ধ ফলাফল' কিতাব-আল-মানাজিরে তিনি লিপিবদ্ধ করেন।
আর গবেষণালব্ধ ফলাফলের উপর জোর দিয়ে এভাবেই ইবনে আল-হাতেম জ্ঞান-বিজ্ঞানে নতুন এক "অনুসন্ধানের" দ্বার খুলে দেন এবং ইতিহাসে সত্যিকারের প্রথম বিজ্ঞানীর স্থান অলংকৃত করেন।
___________________________________
সত্য ও জ্ঞান অনুসন্ধানে ইবনে আল-হাতেমের উক্তিঃ আমি নিরন্তর জ্ঞান ও সত্য খুঁজে বেড়িয়েছি, এবং আমার উপলব্ধি হলো, স্রষ্টার দ্যুতি ও নৈকট্যলাভের জন্য জ্ঞান ও সত্যানুসন্ধানের চেয়ে উত্তম কোনো পথ নেই
প্রধান গবেষণা ক্ষেত্রঃ
অঙ্গব্যবচ্ছেদ-বিদ্যা (Anatomy)
জ্যোতির্বিদ্যা (Astronomy)
প্রকৌশলবিদ্যা (Engineering)
গণিত (Mathematics)
বলবিদ্যা (Mechanics)
চিকিৎসাবিদ্যা (Medicine)
আলোকবিদ্যা (Optics)
চক্ষুবিদ্যা (Ophthalmology)
দর্শন (Philosophy)
পদার্থবিদ্যা (Physics)
মনোবিদ্যা (Psychology)
বিজ্ঞান (Science)
কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ অবদান/উদ্ভাবনঃ
1. বৈজ্ঞানিক পরীক্ষণ পদ্ধতি
2. আলোর ন্যূনতম সময়ের সূত্র, যা পিয়েরে দ্য ফামা সাধারণ আকারে বর্ধিত করেন
3. স্নেল এর সাইন সূত্র—ফলাফলগতভাবে, সূত্রাকারে নয়
4. ক্যামেরা অবস্কিউরা ও পিনহোল ক্যামেরার সর্বপ্রথম সুষ্পষ্ট বর্ণনা ও বিশ্লেষণ
5. দর্শন প্রক্রিয়া, চোখের গঠন, চোখে প্রতিবিম্ব গঠন, দর্শন ব্যবস্থা, মুন ইলিউঝন
6. আল-হাজেনের সমস্যা
7. বস্তুসমূহের পারস্পরিক আকর্ষণ, অভিকর্ষের প্রভাবে ত্বরণ, ভারকেন্দ্র, বস্তুর ওজনের পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে দূরত্বের উপর প্রভাব
8. সূর্যালোকের কারণে চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে আলোর নির্গমন, যা প্রতিফলন হিসেবে ব্যাপকভাবে ভুলক্রমে বিশ্বাস করা হত
9. জড়তার সূত্র—হাইপোথিসিস আকারে, যা নিউটনের প্রথম সূত্র হিসেবে বিকাশ লাভ করে
10. ভরবেগের ধারণা—তাঁর সমসাময়িক ইবনে সীনার সাথে, এটি বর্তমানে নিউটনের দ্বিতীয় সূত্রের অন্তর্গত
11. বিশ্লেষণধর্মী জ্যামিতির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন—রেনে ডেকার্তের জ্যামিতিক বিশ্লেষণ এবং নিউটনের ক্যালকুলাসে এর প্রভাব রয়েছে
12. প্রথম ১০০ টি স্বাভাবিক সংখ্যার যোগফল নির্ণয়ের সূত্র, জ্যামিতিক প্রমাণ
13. ল্যাম্বার্ট চতুর্ভুজ, যা এখন ইবনে-হাতেম-ল্যাম্বার্ট চতুর্ভুজ নামে পরিচিত
14. উপবৃত্তীয় ও অধিবৃত্তীয় জ্যামিতির প্রথম থিওরেমসমূহ
15. নন-ইউক্লিডিয়ান জ্যামিতির সূচনা
16. প্রত্যেক জোড় নিখুঁত সংখ্যা 2^(n−1)*(2^n − 1) আকারের, যেখানে (2^n − 1) একটি মৌলিক সংখ্যা। আল-হাতেম এটি সফলভাবে প্রমাণ করতে পারেননি, লিউনার্দো অয়লার পরে এটি প্রমাণ করেন।
17. সদৃশতা সংক্রান্ত সূত্র—বর্তমানে উইলসনের সূত্র নামে পরিচিত
18. প্রাণীর গতি, আচরণ, মনস্তত্ত্বের উপর সঙ্গীতের প্রভাব। ১৯ শতক পর্যন্তও অনেক পণ্ডিতের অভিমত ছিল, সঙ্গীত কেবল মানবিক ব্যাপার।
19. জ্যোতিষীশাস্ত্র থেকে জ্যোতির্বিদ্যাকে পৃথকীকরণ
সূত্রঃ
http://en.wikipedia.org/wiki/Ibn_al-Haytham
Click This Link
http://www.ibnalhaytham.net/
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই অক্টোবর, ২০০৯ সকাল ১১:১০