somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

(নাটিকা) ত্রিঘাত সমীকরণের অভিশাপ

২৩ শে জুন, ২০১২ রাত ৩:০১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

চরিত্রসমূহ
নিকোলো ফোনতানা
জুয়ান্নে দ্য কই
জুয়ান আন্তনিও
আন্তনিও মারিয়া ফিওর
হিয়েরোনিমো কারদানো
লুদোভিকো ফেরারি

প্রথম দৃশ্য
নিকোলো: [স্বগোতোক্তি] উন্মোচিত হয়েছে রহস্য তার অবশেষে, যুগযুগান্তের আলেয়া—আহ্‌! উদ্ভাসিত হয়নি সে প্রাচীন গ্রিসে, ধরা দেয়নি মুসার পুত্র মুহম্মদের হস্তে, পাঁচশ বছর! আহ্‌, পাঁচশ বছর পর আবিষ্কার করেছি আমি, নিকোলো ফোনতানা, ত্রিঘাত সমীকরণের সমাধান আজকে।

কিন্তু না, প্রকাশ করব না এ সমাধান আমি এখনই জনসমক্ষে। গুপ্ত থাকবে সে সিন্ধুকে আমার, হ্দয়ের কোঠরে, ঐশ্বর্য্য আর খ্যাতির জাদুদণ্ড হয়ে। অব্যর্থ সুনিপুণ অস্ত্র হবে আমার, গণিতের প্রতিযোগিতার ময়দানে, ইতালির নগরে বন্দরে।

গণিতের হিসেব-নিকেশের কাগজগুলো সাবধানে সিন্ধুকে তুলে রাখেন নিকোলো। জুয়ান্নের প্রবেশ।

জুয়ান্নে: জনাব নিকোলো, আপনার কাছে একটি প্রার্থনা নিয়ে এসেছি, যদি অনুমতি দেন।
নিকোলো: আপনার পরিচয়?
জুয়ান্নে: আমার নাম জুয়ান্নে, কই অঞ্চলের অধিবাসী আমি। বর্তমানে আপনাদের ব্রেশা অঞ্চলের একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার কাজে নিয়োজিত আছি। গণিতের সমস্যা সমাধানে আপনার অতীব দক্ষতার কথা অত্র এলাকায় সুবিদিত। আপনার সুনামের উপর ভরসা করে গণিতের দুটি সমস্যা পেশ করতে চাই আপনার কাছে। এদের সমাধান জানিয়ে বাধিত করবেন, মনে বড় আশা।
নিকোলো: আচ্ছা, বলুন দেখি।
জুয়ান্নে: (এক) এমন একটি সংখ্যা বের করতে হবে যাকে তার বর্গমূল তিন দ্বারা বৃদ্ধি করে গুণন করলে ফলাফল দাঁড়ায় পাঁচ। (দুই) এমন তিনটি সংখ্যা বের করতে হবে যাদের দ্বিতীয়টি প্রথমটি থেকে ২ বেশি, তৃতীয়টিও দ্বিতীয়টি থেকে ২ বেশি, এবং তাদের সম্মিলিতি গুণফল ১০০০।

সমস্যা দুটি নিয়ে দ্রুত ভাবেন নিকোলো, মুহূর্তে সতর্ক হয়ে উঠে তাঁর চেহারা।

নিকোলো: জনাব জুয়ান্নে, আপনি আমার কাছে দুটি এমন সমস্যা উপস্থাপন করেছেন যেন তাদের সমাধান করা অসম্ভব হয়, কিংবা অন্ততঃপক্ষে সমাধান আমার জানা না থাকে। কারণ বীজগণিতের সাহায্যে অগ্রসর হয়ে আমি উপলব্ধি করলাম, প্রথমটির জন্য এক ঘন ও ৩ সেনসি সমান ৫—এ সম্পর্কের উপর কাজ করতে হয়, আর দ্বিতীয়টির জন্য করতে হয়, এক ঘন, ৬ সেনসি ও ৮ কোসা সমান ১০০০—এর উপর।


নিকোলো ফোনতানা

(প্রিয় পাঠক, যে যুগের পটভূমিতে রচিত আমাদের নাটিকা, বীজগণিতে তখনও প্রতীকচিহ্নের সমন্বয়ে সমীকরণ প্রকাশ করার প্রচলন ঘটেনি। সে যুগে সমীকরণ প্রকাশ করা হতো বাক্যের সাহায্যে, কথা বর্ণনার মাধ্যমে। জুয়ান্নের সমস্যা দুটিকে আধুনিক বীজগণিতের সাহায্যে আমরা প্রকাশ করতে পারি এভাবে:

প্রথমটিতে, বর্গমূল সংখ্যাটি x হলে, আলোচ্য সংখ্যাটি হবে x^2, এবং সমাধানের জন্য সমীকরণটি দাঁড়ায়
x^(x+3) = 5
বা, x^3 + 3x^2 = 5, যাকে নিকোলো বলেছেন, এক ঘন ও ৩ সেনসি সমান ৫।

দ্বিতীয়টিতে, প্রথম সংখ্যাটি x হলে, দ্বিতীয় সংখ্যাটি (x+2) আর তৃতীয় সংখ্যাটি (x+4), এবং সমীকরণটি দাঁড়ায়
x(x+2)(x+4) = 1000
বা, x^3 + 6x^2 + 8x = 1000, যাকে নিকোলো বলেছেন, এক ঘন, ৬ সেনসি ও ৮ কোসা সমান ১০০০।

রেনেঁসার যুগে, যখন এখনকার মতো বীজগাণিতিক চিহ্নের প্রচলন ঘটেনি, অজানা কোনো রাশিকে (x) ইতালির ভাষায় বলা হতো কোসা, তার বর্গকে (x^২) বলা হতো সেনসি।)

জুয়ান্নে: [অপ্রস্তুত বোধ করে] ছি ছি, মাফ করবেন, আপনাকে পরীক্ষা করার কোনো অভিপ্রায় নেই আমার, মহাশয়।
নিকোলো: [জুয়ান্নের কথায় কান না দিয়ে] স্বর্গত যাজক-ভ্রাতা লুকা প্যাসিওলি তাঁর "সুম্মা দি অ্যারিথমেটিকা জিওমেত্রিয়া প্রোপোর্তিওনি ইত প্রোপর্তিওনালিতা গ্রন্থে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে গেছেন"—এ ধরণের সমীকরণ সমাধানের সাধারণ নিয়ম বের করা অসম্ভব, যেরকম অসম্ভব বৃত্তের বর্গকরণ; অন্যদেরও একই অভিমত। আসলে, জনাব, আপনার ধারণা, এরূপ প্রশ্ন করে আপনি নিজেকে আমার চেয়ে জ্ঞানী প্রমাণ করতে পারবেন, সবাই মনে করবে আপনি খুব উঁচু মাপের গণিতবিদ। আমি শুনেছি ব্রেশা অঞ্চলের বিজ্ঞানের সকল শিক্ষকের সাথে আপনি এ ধরণের আচরণ করে থাকেন, যাতে তাঁরা আপনার প্রশ্নে ভীত হয়ে কোনো কথা বলার সাহস না পায়; প্রকৃতপক্ষে হয়তো তাঁরা আপনার চেয়ে বেশিই জানেন।
জুয়ান্নে: আমার ব্যাপারে কানকথায় যারপরনাই ব্যথিত হলাম, মহোদয়, এবং তা যথাযথ যাচাই করার বিনীত অনুরোধ রাখছি আপনার বিবেচনায়। আর সমীকরণের বিষয়ে আপনার উত্তরখানি আমি ততটুকুই বুঝতে পেরেছি, ঠিক যতটুকু আপনি আমাকে বলেছেন—আপনি মনে করেন ত্রিঘাত সমীকরণের সমাধান অসম্ভব।
নিকোলো: আমি বলছি না এদের সমাধান অসম্ভব। সত্যি বলতে কী, এক নম্বর সমস্যাটির ক্ষেত্রে, যেখানে ঘন ও সেনসি মিলে সংখ্যা হয়, আমি দৃঢ়ভাবে বলতে পারি যে, সাধারণ সূত্রটি আমি সম্প্রতি আবিষ্কার করে ফেলেছি। তবে সমাধানটি আপাতত গোপন রাখাই আমার অভিপ্রায়।

দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে, যেখানে ঘন, সেনসি ও কোসা মিলে সংখ্যা হয়, আমি স্বীকার করছি, এখন পর্যন্ত সাধারণ কোনো নিয়ম বের করতে পারিনি; কিন্তু সেসঙ্গে আমি এটি বলতে চাই না যে, এখন পর্যন্ত কোনো নিয়ম আবিষ্কার না হওয়ার মানে এটি একেবারেই অসম্ভব।

যা হোক, আপনার সাথে ৫ ডুকাটের বিপরীতে আমি ১০ ডুকাট বাজি রেখে বলতে পারি, আপনার প্রদত্ত সমস্যা দুটির একটিও সাধারণ কোনো নিয়মে আপনি সমাধান করতে পারবেন না। এবং এটি এমন একটি গর্হিত ব্যাপার যার জন্য লজ্জিত হওয়া উচিত আপনার—নিজে যা জানেন না অন্যেকে তা প্রশ্ন করে বেড়ান আর ভান করেন যে জানেন, যাতে সবাই আপনাকে বড় ভাবে।
বাজিতে অংশগ্রহণ না করে জুয়ান্নের প্রস্থান।

(আধুনিক বীজগণিতের ভাষায় বলতে গেলে, নিকোলো দাবি করছেন যেসব ত্রিঘাত সমীকরণ x^3+px^2=q আকৃতির, তাদের সমাধান তিনি ইতোমধ্যে করে ফেলেছেন। তাঁর মতে, x^3+px^2+qx=r আকৃতির সমীকরণের সমাধানও অসম্ভব নয়।

ঋণাত্মক সংখ্যার ধারণা বিকশিত না হওয়ার দরুণ সে যুগে সমীকরণের সকল সহগ অর্থাৎ p, q, r প্রভৃতি ছিল সর্বদাই ধনাত্মক এবং সমীকরণের উভয় পাশে বিভিন্ন পদকে যোগের মাধ্যমে প্রকাশ করতেন গণিতবিদগণ। একই কারণে x^3+px=q এবং x^3=px+q আকৃতির সমীকরণ দুটি ভিন্ন ধরণের সমীকরণ বিবেচিত হতো তাঁদের কাছে, এবং একটির সমাধান জানা মানেই অন্যটিরও সমাধান জানা, এরূপ ছিল না বিষয়টি। ফলে একটি সাধারণ সমীকরণের পরিবর্তে বিভিন্ন সমীকরণের তালিকা নিয়ে কাজ করতেন তাঁরা। পারস্যের গণিতবিদ ওমর খৈয়াম ত্রিঘাত সমীকরণের এরূপ একটি সুসংহত তালিকা তৈরি করেন এবং সমাধানের চেষ্টা করেন। জ্যামিতিক সমাধান পেলেও বীজগাণিতিক সমাধান পাননি খৈয়াম, কিন্তু তাঁর কাজ বিশাল প্রেরণা যুগিয়েছে পরবর্তী গণিতবিদদের।)

দ্বিতীয় দৃশ্য

আন্তনিও মারিয়া ফিওরের আগমন, চেহারায় প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ ভাব তাঁর।

ফিওর: জনাব নিকোলো, লোকমুখে জানতে পারলাম, আপনি নাকি জনে জনে বলে বেড়াচ্ছেন যে ত্রিঘাত সমীকরণের সমাধান পৃথিবীতে আপনিই প্রথম আবিষ্কার করেছেন?
নিকোলো: আপনি যথার্থ শুনেছেন, জনাব ফিওর।
ফিওর: যত আনন্দ-আস্ফালনই করুন, আপনি জেনে রাখুন, এ সমীকরণের সমাধান বার বছর পূর্বে আমার শিক্ষক স্বর্গত শিপিওনে দেল ফেররো আর আমি মিলে করে রেখেছি। এক যুগ ধরে সমাধানটি সযত্নে আগলে রাখছি, আর আপনি কোত্থেকে এসে দুম করে দাবি করে বসলেন আপনি তার আবিষ্কারক! আমি অবশ্য ঠিকই খবর রাখি, লোকজন আপনার কথায় কান দিচ্ছে না, বরং হাসাহাসি করছে তা নিয়ে। চালবাজির প্রতি মানুষের আচরণ এরূপ হওয়ারই কথা। আপনি যদি প্রতারক মিথ্যাবাদী চালিয়াৎ না হন, তাহলে জনসমক্ষে সমীকরণ সমাধানের প্রতিযোগিতায় নামতে আহ্বান করলাম আপনাকে; আশা করি, লেজ গুটিয়ে পালাবেন না।
নিকোলো: [তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে] বার বছর পর্যন্ত এত গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার চেপে রেখেছেন, আর এখন কি না আমার কথা শুনে তা রাষ্ট্র করার সময় হলো আপনার, আশ্চর্য বিষয়ই বটে! এছাড়া যতদূর জানি, পাটিগণিতের মানুষ আপনি, বীজগণিত আপনার বিষয় নয়। জীবনে অবশ্য জিঘাংসাপূর্ণ মানুষের কম দেখা পাইনি আমি, যাদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে অন্যের অবদানকে নিজের বলে চালিয়ে দেয়া। আপনার চ্যালেঞ্জ আমি গ্রহণ করলাম, সিনিওরে, ভেনিসের মাটিতেই ফয়সালা হবে কে সেরা আর কার মর্যাদা মাটিতে লুটায়। বলুন, কীভাবে প্রতিযোগিতায় নামতে চান।
ফিওর: আপনি লেজ গুটিয়ে পালাননি দেখে খুশি হলাম, যদিও এটিই হতো আপনার জন্য মঙ্গলজনক। যা হোক, আমাদের প্রতিযোগিতা এরূপ হবে যে, ভেনিসের ময়দানে আমি আপনাকে গণিতের ত্রিশটি সমস্যা দেব, অনুরূপভাবে আপনিও আমাকে ত্রিশটি সমস্যা দিবেন। ত্রিশ দিন সময়কালে আমাদের মধ্যে যে বেশি সংখ্যক সমস্যা সমাধান করতে পারবেন, অপরজন অবনত মস্তকে তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে নেবেন আর প্রতি সমস্যায় ব্যর্থতার জন্য কিছু আর্থিক দণ্ডও প্রদান করবেন।
নিকোলো: তাই হবে।

তৃতীয় দৃশ্য
জুয়ান আন্তনিওর প্রবেশ

জুয়ান আন্তনিও: জনাব নিকোলো, আপনার কাছে আমার আগমন বিশিষ্ট এক ভদ্রলোকের তরফ হতে। তিনি মিলান শহরের অতিশয় সজ্জন চিকিৎসক জনাব হিয়েরোনিমো কারদানো। তিনি বিখ্যাত গণিতবিদও বটে, মিলান শহরে ইউক্লিডের উপর জনসমক্ষে ভাষণ প্রদান করে থাকেন। বর্তমানে ছাপাখানায় তাঁর একটি পুস্তকের মুদ্রণকার্য চলতেছে—পাটিগণিত, বীজগণিত ও জ্যামিতির কলাকৌশলের উপর রচিত গ্রন্থখানি চমৎকার দৃষ্টিনন্দন কাজ হবে বলেই বিশিষ্টজনেরা মনে করছেন।
নিকোলো: হুমম, তা আমি কী করতে পারি এ ব্যাপারে?
জুয়ান আন্তনিও: জনাব আন্তনিও মারিয়া ফিওরের সঙ্গে আপনার প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা তিনি সবিশেষ অবগত আছেন, কীভাবে জনাব ফিওরকে ত্রিশটি গাণিতিক সমস্যা দিয়েছিলেন আপনি, ভেনিস শহরের সরকারী উকিল জনাব পার ইয়াকোমো ডি জামবেল্লির উপস্থিতি ও তত্ত্বাবধানে। মহাশয় এ-ও জ্ঞাত আছেন যে, জনাব ফিওরের প্রদত্ত ত্রিশটি সমস্যার সমাধানে আপনি বীজগণিতের উপর অগ্রসর হয়ে এমন এক সমীকরণে উপনীত হয়েছিলেন যার সমাধান যথাসময়ে আবিষ্কার করে ফেলেন আপনি, যার সাহায্যে দু ঘন্টার মধ্যেই সকল সমস্যার উত্তর বের করে ফেলেন, ঠিক যেন চোখের পলকে। এ এক অবিশ্বাস্য ঘটনা! অন্যদিকে ফিওর আপনার প্রদত্ত একটি সমস্যা কেবল কোনোমতে সমাধান করতে পেরেছিলেন। ব্রেশা অঞ্চলের এক বন্ধুর নিকট এরূপই শুনেছি আমরা।
নিকোলো: আপনি যেসব কথা শ্রবণ করেছেন কিংবা যেসব প্রতিবেদন আপনার গোচরীভূত হয়েছে, তা সবই সত্যি। জনাব ফিওরের সবকটি সমস্যা ছিল ঘন ও কোসা মিলে সংখ্যা হয় এরূপ, এবং এ কাজটি তিনি করেছিলেন এ ভেবে যে আমি তাদের একটিও সমাধান করতে সক্ষম হব না, কারণ ভাই লুকা প্যাসিওলি তাঁর গ্রন্থে দৃঢ়কণ্ঠে বলেছিলেন, এ ধরণের সমস্যার সমাধান সাধারণ কোনো নিয়মে অসম্ভব। কিন্তু সৌভাগ্যবশতঃ প্রতিযোগিতার আট দিন পূর্বেই সাধারণ নিয়মটি আমি আবিষ্কার করে ফেলি।
আর আমি যে সমস্যাগুলো তাঁকে দিয়েছিলাম, প্রত্যেকটি ছিল ভিন্ন ভিন্ন নিয়মের, যাতে তিনি হৃদয়ঙ্গম করেন আমার দক্ষতার ব্যাপ্তি, উপলব্ধি করেন আমার ভিত্তি নিছক একটি কিংবা দুটি ব্যক্তিগত আবিষ্কারের উপর দণ্ডায়মান নয়। বস্তুতঃপক্ষে আমি তাঁকে বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিলাম যে, আমি তাঁকে অকিঞ্চিৎকরই গণ্য করি এবং তাঁকে ভয় পাওয়ারও কিছু নেই।
জুয়ান আন্তনিও: হ্যাঁ, ইতালির শহরে-বন্দরে গণিতে আপনার সুনামের পাশাপাশি আপনার মহানুভবতার কথাও আমরা শুনি, আপনি ফিওরকে পরাজয়ের দণ্ড থেকে অব্যাহতি দিয়েছিলেন।
নিকোলো: আমার কাছে জয়ের মুকুটই যথেষ্ট ছিল, বিশেষতঃ এ কারণে যে বাকি জীবন মাথা হেঁটে করেই পথ চলবেন জনাব ফিওর।
জুয়ান আন্তনিও: সে তো বটেই, আর তা উচিত শিক্ষাই হয়েছে বলতে হয়।
নিকোলো: [কিছুটা অস্থিরভাবে] কিন্তু এর সঙ্গে আপনার কিংবা মহোদয় কারদানোর সম্পর্ক কী?
জুয়ান আন্তনিও: জ্বী, যে কারণে মহাশয়ের সমীপে আমার আগমন—আমার প্রভু সদাশয় কারদানো আপনাকে অনুরোধ করেছেন, আপনি যদি দয়া করে তাঁকে সমীকরণ সমাধানের নিয়মটি জানাতেন, তিনি তাঁর পরবর্তী গ্রন্থে আপনার নামে সমাধানটি ছাপিয়ে বাধিত হবেন।
নিকোলো: [স্বগতোক্তি] ওহ্‌, এ-ই তাহলে আপনার আগমনের কারণ! [প্রকাশ্যে] আপনার প্রভুকে বলবেন তিনি যেন আমাকে মার্জনা করেন। আমার আবিষ্কার যদি জনসমক্ষে প্রকাশ করতেই হয়, তা হবে আমার নিজের রচনায়, অন্য কারও গ্রন্থে নয়। জনাব কারদানো নিশ্চয়ই আমাকে মাফ করবেন।
জুয়ান আন্তনিও: আপনার নিয়মটি যদি মহোদয়ের নিকট প্রকাশ করতে আপনার আপত্তি থাকে, তিনি আমাকে আদেশ করেছেন আপনাকে জিজ্ঞাসা করতে, সমস্যা ত্রিশটি ও নিছক তাদের ফলাফলগুলো অন্ততঃ আমাকে প্রদান করতে পারবেন কি না।
নিকোলো: না, তাও সম্ভব নয়। কারণ মহোদয় যখনই একটি সমস্যা ও তার সমাধানটি দেখে ফেলবেন, সমাধানের সমুদয় নিয়মটি তিনি উপলব্ধি করে ফেলতে পারেন। আর একটি নিয়মের উপর ভর করে তিনি এ সংক্রান্ত অনেক বিষয় সমাধান করে ফেলবেন।
জুয়ান আন্তনিও: আমি তাহলে আপনার সম্মুখে সাতটি সমস্যা পেশ করছি, আপনি অন্ততঃ এটুকু নিশ্চিত করতে পারবেন কি যে এদের আদৌ কোনো সমাধান রয়েছে কি না?

জুয়ান আন্তনিও কাগজে সমস্যাগুলো লিখে দেন; নিকোলো তাদের সমীকরণ তৈরি করে ক্রোধে ফেটে পড়েন।

নিকোলো: এ সমস্যাগুলো এসেছে জুয়ান্নের নিকট হতে, অন্য কারও নয়, কারণ শেষের সমস্যা দুটো আমি চিনতে পেরেছি। দু বছর পূর্বে তিনি আমার কাছে ছয় নম্বরটির ন্যায় একটি সমস্যা পাঠিয়েছিলেন, এবং আমি প্রমাণ করে দিয়েছিলাম তিনি সমস্যাটি বুঝতেও পারেননি, সমাধানটিও জানেন না। তিনি শেষেরটির মতোও একটি সমস্যা পাঠিয়েছিলেন, যদিও দয়াপরবশ হয়ে আমি এ সমাধানটি পাঠিয়েছিলাম। এ ধরণের সমস্যার জন্যও আমি বিশেষ আরেকটি নিয়ম আবিষ্কার করেছি।
জুয়ান আন্তনিও: জুয়ান্নের ব্যাপারে আমি অবগত নই, মহাশয়। আমি কেবল দৃঢ়কণ্ঠে বলতে পারি, এগুলো জনাব কারদানোর সমস্যা।
নিকোলো: তাহলে বলতে হয়, জনাব জুয়ান্নে মিলান শহরে গমন করেছেন এবং জনাব কারদানোর কাছে সমস্যাগুলো উত্থাপন করেছেন। আপনার মহোদয় সমাধান করতে না পেরে সেগুলো আবার আমার কাছেই প্রেরণ করেছেন। এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত কারণ এক বছর পূর্বে জুয়ান্নে আমার কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তিনি আবার ভেনিসে আসবেন, কিন্তু তাঁকে আর এ অঞ্চলে দেখা যায়নি। আমার ধারণা, তিনি অনুশোচনায় ভুগছিলেন, ফলে ভেনিসে না এসে মিলানের শরণাপন্ন হয়েছেন।
জুয়ান আন্তনিও: আপনার যা খুশি ভাবতে পারেন, জনাব নিকোলো। তবে মনে রাখবেন, মহোদয় কারদানো গণিতে সুদক্ষ অতি, মিলানের সমাজে অত্যন্ত গণ্যমান্য, এবং তাঁর বন্ধুদের মধ্যে রয়েছেন মিলান শহরের স্বয়ং গভর্নর মারকুইস দেল ভাস্তোর মতো ব্যক্তিত্ব, যিনি মহোদয়ের গ্রন্থের পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকেন।

মিলানের গভর্নরের কথায় নরম হয়ে উঠে কারদানোর কণ্ঠ।

নিকোলো: আমি বলি না যে তিনি সুপণ্ডিত এবং দক্ষ ব্যক্তিত্ব নন। কিন্তু আমি এ কথা বলতে পারি, বিশেষ নিয়মের মাধ্যমে সমাধানযোগ্য যে সাতটি সমস্যা তিনি আমার নিকট প্রেরণ করেছেন, তার একটিও তিনি সমাধান করতে সক্ষম নন। যা হোক, আপনাকে সমস্যা ত্রিশটি দিয়ে দিচ্ছি, আপনি এবার আসুন।
গাণিতিক সমস্যাগুলো নিয়ে জুয়ান অ্যান্তনিওর প্রস্থান।

চতুর্থ দৃশ্য
হিয়রোনিমো কারদানোর আগমন।


কারদানো: এত বড় ধৃষ্টতা আপনার, জনাব নিকোলো! পর্বতচূড়ায় তো অবস্থান নয় আপনার, বরং নিছক তার পাদদেশে, সমতলের ধূলোবালিতেই বসবাস আপনার। এ বড়ই অদ্ভুত যে সমস্যা সাতটিকে আপনি জুয়ান্নের বলে দাবী করছেন, ভাবখানা এমন যেন মিলান অঞ্চলে এরকম কার্য সম্পাদন করতে পারে না কেউ। জুয়ান্নে ততটুকুই নাবালক যতটুকু সে বলে থাকে; সে দশ পর্যন্ত গুনতে শেখার পূর্ব থেকেই তাকে আমি চিনি।

আপনি বলেছেন, সমস্যাগুলোর একটিও সমাধান করতে পারলে বাকিগুলো সমাধান করে ফেলা যাবে। পুরোপুরি ভ্রান্ত দাবি এটি। আমি ১০০ ডুকাট বাজি রাখছি, সমস্যাগুলোকে একটি, দুটি, এমনকি তিনটি সমীকরণেও আপনি প্রকাশ করতে পারবেন না।

যা হোক, আপনি যদি গণিতশাস্ত্রে এতই দক্ষ হন, আপনার কাছে আরও দুটি সমস্যা উপস্থাপন করছি। প্রথমটি আমি নিয়েছি লুকা প্যাসিওলির কাছ থেকে—এমন সংখ্যাচতুষ্টয় নির্ণয় করতে হবে যারা জ্যামিতিক প্রগমনে বিন্যস্ত, যাদের সমষ্টি ১০ এবং বর্গসমষ্টি ৬০। দ্বিতীয়টি হচ্ছে ব্যবসায়ী দুজন অংশীদারের যার তাদের বিভিন্ন মূলধনের ঘনের এক দশমাংশ লাভ করে থাকে।

কারদানোর সমস্যা দুটি মনোযোগ দিয়ে পড়ে শুধু প্রথমটির সমাধান করে দেন নিকোলো।
নিকোলো: এই যে নিন, প্রথমটির ফল। নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন, দৃষ্টিনন্দন হয়েছে সমাধানটি। তবে মাফ করবেন, দ্বিতীয়টির সমাধান আমি ভাঙতে পারব না কারণ এটিও ত্রিঘাত সমীকরণ সংক্রান্ত। এর বেশি কিছু বলতে আমি অপারগ।
কারদানোর প্রস্থান।

পঞ্চম দৃশ্য
কারদানোর পুনরায় আগমন।

কারদানো: আমার প্রিয় জনাব নিকোলো, আমার পূর্বোক্ত বক্তব্যকে খারাপ হিসেবে নেবেন না। আসলে বেয়াদব জুয়ান্নে আপনার ব্যাপারে ভুল ধারণা দিয়েছিল আমাকে। তবে অকৃতজ্ঞ দুরাশয় ইতোমধ্যেই অপমানজনকভাবে মিলান থেকে বহিষ্কৃত হয়েছে, সেসঙ্গে হারিয়েছে তার ষাটজন শিক্ষার্থী যা আমি জোগাড় করে দিয়েছিলাম। আর মিলান ভ্রমণের জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছি আপনাকে, বিশেষতঃ এ কারণে যে মারকুইস দেল ভাস্তো আপনার সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য উদগ্রীব। অতএব আপনার নিকট সনির্বন্ধ অনুরোধ, সত্বর চলুন মিলানে, দেরি করবেন না একদম। কারণ আমাদের মারকুইস সকল শিল্পীর পৃষ্ঠপোষক, এত উদার এবং মহানুভব তিনি যে, যারাই কাজ করেছেন তাঁর জন্য, সকলেই পূর্ণহস্তে ফিরেছেন তাঁর গৃহ থেকে। নির্দ্বিধায় চলে আসুন, বাস করুন আমার বাসগৃহে, অন্য কোথাও নয়। স্রষ্টা আপনার সহায় হোন।

মিলান শহরে কারদানোর বাড়িতে নিকোলোর আগমন।
কারদানো: ইসস, খানিক আগেই ভিজেবানোর পথে যাত্রা করে ফেলেছেন মারকুইস মহোদয়। তবে ভালোই হলো, তিনি প্রত্যাবর্তন করার পূর্বে এ ফাঁকে আমাদের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা সেরে ফেলা যাক। ঘন ও কোসা মিলে যাতে সংখ্যা হয় এরূপ সমস্যার সমাধান পাওয়ার জন্য আপনাকে যে সনির্বন্ধ অনুরোধ আমি করেছি, বলতেই হয় আপনি তাতে সদয় হননি।
নিকোলো: স্বীকার করছি, এ বিষয়ে হীন আচরণ করেছি আমি। তবে তা আমি করেছি, সরল সমীকরণটি এবং তার দ্বারা আর যেসব জিনিস আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছি, কেবল সেসবের স্বার্থে নয়, বরং ভবিষ্যতে তার সাহায্যে আরও যেসব জিনিস আবিষ্কার করতে পারব, তাদের কথা মাথায় রেখে। কারণ অনেক বিখ্যাত সমীকরণের চাবিকাঠি এটি। আমি যদি ইউক্লিড অনুবাদের কাজে ব্যস্ত না থাকতাম এখন, তাহলে ইতোমধ্যে আরও অনেক সমীকরণ সমাধান করে ফেলতাম। এমতাবস্থায় কোনো অনুসন্ধিৎসু মনের নিকট সমাধানটি যদি প্রকাশ করি, যেমন আপনার মতো, তাহলে সহজেই তিনি বাকি সমাধান বের করে ফেলবেন। তারপর নিজের নামে প্রকাশ করে ফেলবেন, যা আমার পরিশ্রমকে বিনষ্ট করে ফেলবে। এই হচ্ছে সে কারণ যা মহোদয়ের প্রতি আমাকে অশিষ্ট আচরণ করতে বাধ্য করেছে ; অধিকন্তু এ কারণে যে একই বিষয়ের উপর একটি গ্রন্থ রচনা করছেন আপনি, এবং যাতে, আপনি লিখেছিলেন, আমার নামে আমার আবিষ্কারটি প্রকাশ করবেন।
কারদানো: কিন্তু আমি তো লিখেছিলাম, প্রকাশের ব্যাপারে অনুমতি না দিলে আমি গোপনই রাখব বিষয়টি।
নিকোলো: দুঃখিত, এ ব্যাপারেও আপনার উপর ঠিক ভরসা করতে পারছি না।
কারদানো: সদাপ্রভুর সুসমাচারের শপথ, সত্যিকারের একজন মানী লোকের দাবি নিয়ে বলছি, আমি এটি প্রকাশ করব তো নাই-ই, নিজের জন্যও এটি লিখে রাখব গুপ্তিকরণলীপিতে, যাতে আমার মৃত্যুর পরও কেউ তার মর্মোদ্ধার করতে না পারে। এখন যদি আপনার বিশ্বাস হয়, বিশ্বাস করুন; তা না হলে ব্যাপারটি বাদ দেই আমরা।
নিকোলো: এরকম শপথকেও যদি বিশ্বাস না করি, তাহলে একজন অবিশ্বাসী মানুষ হিসেবই পরিগণিত হব আমি। কিন্তু প্রথমেই মহোদয় মারকুইসের সন্ধানে ভিজেবানো গমন করতে ইচ্ছুক আমি, কারণ ইতোমধ্যে তিন দিন অতিবাহিত হয়েছে এবং অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। আমি কথা দিলাম ফেরার পথে সমাধানটি পুরো প্রকাশ করে যাব আপনার কাছে।
কারদানো: আপনি যদি জনাব মারকুইসের সাক্ষাত করতে চান, তাহলে আপনার জন্য একটি সুপারিশপত্র লিখে দেব যাতে তিনি জানতে পারেন আপনি কে। কিন্তু যাবার পূর্বে, আমার আশা, নিয়মটি জানিয়ে যাবেন যার প্রতিশ্রুতি প্রদান করেছেন আপনি।
নিকোলো: [কারদানোর পীড়াপীড়িতে অবশেষে একটি কবিতা উচ্চারণ করতে থাকেন]
ঘন আর কোসা যখন বসে পাশাপাশি
মিলেমিশে হয় তারা পূর্ণ এক রাশি,
খুঁজে দেখো আরও দুটি, রাশি তাদের ব্যবধান।
তারপর সদা তুমি প্রথামতো রাখিবে মনে
গুণন হবে রাশি দুই পরস্পরের সনে,
ফলাফল হবে ঠিক কোসা পরিমাণের তৃতীয়াংশের ঘনের সমান।
...
কারদানোর চিঠি নিয়ে প্রস্থান করেন নিকোলো, কিন্তু সমাধানটি প্রকাশ করে ফেলার পর থেকেই অনুশোচনা বোধ করতে থাকেন তিনি। যা হয় হোক, ভেনিসেই ফিরে যাই, এ ভেবে মারকুইসের খোঁজে না গিয়েই ফিরে আসেন তিনি। কারদানো বহু চেষ্টা করেন যোগাযোগের, কিন্তু নিকোলো কোনো সাড়া দেন না পরবর্তী পাঁচ বছর।

ষষ্ঠ দৃশ্য
কারদানোর শিষ্য লুদোভিকো ফেরারির আগমন
ফেরারি: জনাব নিকোলো তার্তালিয়া, সম্প্রতি আপনার লিখিত একটি গ্রন্থ আমার হস্তগত হয়েছে যার নাম "কুয়েসিতি এড ইনভেন্তিওনি নুওভি"। এর শেষ অভিসন্দর্ভে আপনি উল্লেখ করেছেন মহানুভব হিয়েরোনিমো কারদানোর কথা, যিনি মিলান শহরের একজন খ্যাতনামা চিকিৎসক, বর্তমানে পাভিয়া শহরে চিকিৎসাশাস্ত্রের প্রভাষক। আপনার একথা বলতে একটুও লজ্জা হচ্ছে না যে তিনি গণিত বিষয়ে অজ্ঞ, যে তিনি এমনই একজন স্থুলবুদ্ধির লোক, কই অঞ্চলের জুয়ান্নেকেও আপনি তাঁর পূর্বে স্থান দিয়ে থাকেন।

আমার ধারণা এ কাজটি আপনি করেছেন একথা অবগত হয়ে যে, জনাব হিয়েরোনিমোর বিশাল পাণ্ডিত্য কেবল চিকিৎসাশাস্ত্রেই নয়, বরং গণিতেও ব্যাপক বিস্তৃত, যদিও বিষয়টি তিনি নিয়েছিলেন মাঝামেঝে খেলার ছলে নিছক আনন্দ বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে। আর এতেই তিনি এত বেশি সফল হয়েছেন যে বাগাড়ম্বর না করেও বলা যায় বিখ্যাত গণিতবিদদের অন্যতম তিনি, আর তাতেই আঁতে ঘা লেগেছে আপনার মতো পরশ্রীকাতর মানুষের মনে, ফলে অন্যায়ভাবে দোষারোপ করছেন মহান কারদানোকে; বস্তুতঃপক্ষে কারদানোর নাম উচ্চারণ করারও যোগ্য নন আপনি।

আমি আপনাকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছি গণিতের যেকোনো শাখায় প্রকাশ্য বিতর্কে অবতীর্ণ হতে। আর বিষয়টি যাতে একান্ত ব্যক্তিগত পর্যায়ে আবদ্ধ না থাকে, তাই চ্যালেঞ্জের একটি করে লিখিত অনুলপিও আমি ইতোমধ্যে পাঠিয়ে দিয়েছি ইতালির বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের নিকট।

নিকোলো: ঠিক আছে, আমিও আমার জবাবের এক সহস্র অনুলিপি বিতরণ করব, তবে তা ইতালির জনসাধারণের মধ্যে, কারণ আমার অভিজ্ঞতা ও পরিচিতির গণ্ডি ক্ষুদ্র বিধায় আমার পক্ষে জ্ঞানীগুণী মানুষের বন্ধুত্ব ও জ্ঞান ক্রয় করা সম্ভব নয়।
আর প্রকাশ্য বিতর্কের যে কথা বললেন, তাতে আপনার বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হতে আমি অপারগ। আমার হিসেব মেটানোর ব্যাপার জনাব কারদানোর সঙ্গে, আপনার সঙ্গে নয়। সুসমাচারের শপথ করার পরও তিনি ত্রিঘাত সমীকরণের সমাধানটি ছাপিয়ে দিয়েছেন তাঁর বইয়ে, কত বড় হীন আচরণ। শুধু তাই নয়, এমনকি চিঠির কোনো জবাবও দিচ্ছেন না তিনি।
ফেরারি: তিনি তো সমাধানটি আপনার নামেই ছাপিয়েছেন।
নিকোলো: হ্যাঁ, কিন্তু আমার ঠিক পূর্বে তিনি উল্লেখ করেছেন, সমাধানটি প্রথমে আবিষ্কার করেন শিপিওনে দেল ফেররো, যদিও দেল ফেররো পরলোকগমন করেছেন বহু বছর পূর্বেই।
ফেরারি: এখানে মিথ্যা কিছুই নেই। পাঁচ বছর পূর্বে বোলোনিয়া শহরে দেল ফেররোর জামাতা আন্নিবালের সঙ্গে ঘটনাক্রমে দেখা হয় জনাব কারদানো এবং আমার; আন্নিবালে আমাদেরকে দেল ফেররো-লিখিত গ্রন্থসমূহ প্রদর্শন করেছেন যাতে সমাধানটি ছিল। আন্নিবালে এখনও জীবিত আছেন, আপনি ইচ্ছে করলে যেকোনো সময় সাক্ষী হিসেবে তাঁকে ডাকা যায়।

নিকোলো: তাঁরা যদি কোনোকিছু আবিষ্কার করেও থাকেন, তাতে হয়তো বড়জোর এক ধরণের ত্রিঘাত সমীকরণ সমাধান করা যেতে পারে। কিন্তু আমি আবিষ্কার করেছি আরও বিস্তৃত নিয়ম, যার সাহায্যে সকল ত্রিঘাত সমাধান সম্ভব। তবে এ বড় বিষয় নয়, বড় হচ্ছে কারদানো প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছেন। গ্রন্থ প্রকাশের পূর্বে আমার সঙ্গে একটি বারও কথা বলেননি, আর ঐদিকে তাঁর গ্রন্থে আমার নিয়মের উপর ভিত্তি করে আরও দশটি অধ্যায় লিখে ফেলেছেন, যার মধ্যে আপনার নিজের চতুর্ঘাতী সমীকরণের সমাধানও রয়েছে।

যা হোক, কথায় কথা বাড়ে, জনাব। আপনার সঙ্গে আমার শত্রুতা নেই, আমার দেনাপাওনা আপনার গুরুর সঙ্গে। তিনি যখন আমার মুখোমুখি হতে প্রস্তুত থাকবেন, আমাকে জানাবেন; অথবা আপনাদের দুজনের সঙ্গে আমি একা লড়াই করতে রাজী আছি।

(যবনিকা)
__________________
"না, না, এভাবে শেষ হতে পারে না", ক্ষুব্ধ দর্শকবৃন্দ ঘিরে ধরে বৃদ্ধ নাট্যকারকে। "কী হয়েছিল শেষ পর্যন্ত!"

অদ্ভুত বিষাদমাখা কণ্ঠে বলেন নাট্যকার, "একের পর এক অপমানের তীর ছুঁড়ে যান ফেরারি, প্রকাশ্য বিতর্কের আহ্বানে, কিন্তু অনড় নিকোলো তার্তালিয়া—তাঁর বিবাদ কারদানোর সঙ্গে। কেটে যায় দিনের পর দিন। তারপর হঠাৎ একদিন, কী হয় নিকোলোর, রাজী হয়ে যান ফেরারির প্রস্তাবে, ভাইকে নিয়ে উপস্থিত হন মিলান শহরে। ১৫৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১০ই অগাস্ট, জোকোলান্তে চার্চের জনাকীর্ণ কক্ষে কী হয়েছিল ঠিক জানা যায় না, বিজয়ী ঘোষণা করা হয় ফেরারির নাম। নিকোলো ফোনতানা, দারিদ্র্যের কষাঘাতে বিপর্যস্ত শৈশবে একদা ফরাসি সৈনিকের তলোয়ার দুভাগ করে ফেলেছিল যাঁর চোয়াল, ফলে সারাজীবনের জন্য তোতলা হয়ে গিয়েছিলেন আর মানুষের কাছে হয়েছিলেন উপহাসের পাত্র, নিকোলো তার্তালিয়া বা তোতলানো নিকোলো উপনামে, চেষ্টা করেছিলেন ফেরারির সমাধানের ভুলগুলো ধরিয়ে দিতে, কিন্তু তুমুল হট্টগোলে স্তব্ধ হয়ে যায় তোতলানো কণ্ঠ তাঁর, সারাজীবনের জন্য।
"মানে!"
"প্রাণভয়ে মিলান ছেড়ে পালিয়ে বাঁচেন তিনি, কিন্তু হারান সুনাম, হারান চাকরি। কপর্দকহীন করুণ মৃত্যু হয় তাঁর।"
"আর ফেরারির কী হয়েছিল?"
"আকাশছোঁয়া সুনাম হয় তাঁর। অল্প সময়ে ইতালির ধনাঢ্য এক ব্যক্তিতে পরিণত হন তিনি। কিন্তু ঐশ্বর্য ভোগ করা হয়ে উঠে না তাঁর, মাত্র তেতাল্লিশ বছর বয়সে হঠাৎ মারা যান তিনি। সন্দেহ করা হয়, সম্পদের লোভে তাঁর বিধবা ভগ্নি বিষ খাইয়েছিলেন তাঁকে।"
"আর কারদানোর?"
"কারদানোর খ্যাতিও জ্বলজ্বল করে ইতালির আকাশে, দীর্ঘজীবনই পেয়েছিলেন তিনি, কিন্তু সুখ হয়নি তাঁরও। স্ত্রী তাঁর মারা গিয়েছিলেন পূর্বেই, জ্যেষ্ঠ পুত্রের শিরশ্ছেদ হয় পত্নীহত্যার দায়ে, কনিষ্ঠ পুত্র উচ্ছন্নে যায় জুয়ার নেশায়। একসময় মানসিক ভারসাম্য হারান তিনি, জেলও খাটতে হয় কিছুদিনের জন্য। মৃত্যুর আগে নিজের জীবনের শেষদিনটির কথা ভবিষ্যদ্বাণী করে যান তিনি, যদিও ধারণা করা হয়, ভবিষ্যদ্বাণীকে প্রমাণ করতে আত্মহত্যা করেন তিনি।"

এ-ই হচ্ছে ত্রিঘাত সমীকরণের অভিশাপের কাহিনী, হিংসা-জিঘাংসাপূর্ণ দুঃখী মানুষের গল্প। কিন্তু আজ আর নেই কোনো ক্ষোভ আমাদের, মরণ পরিশুদ্ধ করেছে আত্মা তাঁদের, শান্তিতে ঘুমান তাঁরা এ পৃথিবীর পরে।"
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জুলাই, ২০১২ রাত ৮:১৯
৩৯টি মন্তব্য ৩৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

প্রতি মাসে সামু-ব্লগে ভিজিটর কত? মার্চ ২০২৪ Update

লিখেছেন জে.এস. সাব্বির, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৮

মার্চ ২০২৪ সালে আমাদের প্রিয় সামু ব্লগে ভিজিটর সংখ্যা কত ছিল? জানতে হলে চোখ রাখুন-

গত ৬ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভিউ ছিল জানুয়ারি মাসে। ওই মাসে সর্বমোট ভিজিট ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রোএক্টিভিটি এবং কম্পাউন্ড ইফেক্ট: আমার গুরুত্বপূর্ণ দুইটি শিক্ষা

লিখেছেন মাহদী হাসান শিহাব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১১



আমার গুরুত্বপূর্ন দুইটা লার্নিং শেয়ার করি। এই দুইটা টুল মাথায় রাখলে দৈনন্দিন কাজ করা অনেক সহজ হয়। টুল দুইটা কাজ করতে ও কাজ শেষ করতে ম্যাজিক হিসাবে কাজ করে।

এক.

স্টিফেন কোভের... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রসঙ্গ রূপান্তরঃ ট্রান্সজেন্ডার, সমকামিতা এবং যৌনতা বিষয়ক কিছু আবশ্যিক আলাপ

লিখেছেন সায়েমার ব্লগ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৩

প্রসঙ্গ রূপান্তরঃ
ট্রান্সজেন্ডার, সমকামিতা এবং যৌনতা বিষয়ক কিছু আবশ্যিক আলাপ

১।
যৌন প্রাকৃতিক, জেন্ডার নয়।জেন্ডার মানুষের সৃষ্টি (social, cultural construction)। যৌনকে বিভিন্ন সমাজ বিভিন্ন সময়ে যেভাবে ডিল করে, তাঁকে ঘিরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্মৃতির ঝলক: প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনুভূতি এবং মনের শান্তির খোঁজে

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২০ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০১



সরল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সংমিশ্রণে একটি ঘূর্ণায়মান পথ জুড়ে ঘুরে বেড়ানোর অবস্থানে আমি খুব শান্তি অনুভব করি। নদীর জল ছুঁয়ে পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে নৈসর্গিক সৌন্দর্যের সঙ্গে এক আন্তরিক সংযোগ অনুভব... ...বাকিটুকু পড়ুন

×