somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে

০৫ ই জুলাই, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সিগারেটে কয়েকটা বড় বড় টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে অনিন্দ্য ভাবতে লাগল কিছুক্ষন আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা। মাত্র কয়েকটা টাকা চেয়েছিল বাবার কাছে বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যাবে বলে আর বাবা কিনা ওকে উল্টাপাল্টা কতগুলো কথা শুনিয়ে দিল!!!মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল বাবার কথা শুনে। তাই হাতের কাছে যা পেয়েছে সব ভেঙ্গে বাসা থেকে বেরিয়ে এসেছে। “অবাক কান্ড!! মা একটা কথাও বলল না বাবাকে। ধূর!! থাকব না আর এ বাসায়- মনে মনে ভাবতে লাগল এ কথাগুলো। আবার পরক্ষনেই ওর মনে পড়ল, “মা তো কথা বলতে পারেনা। শোনা আর দেখা ছাড়া মার এখন কিছু করার নাই”।



মায়ের কথা ভাবতেই রাগটা মরে গিয়ে এক ধরনের কষ্ট বোধ হতে লাগল। গত ছ’মাস ধরে ব্রেন স্ট্রোক করে মা প্যারালাইসড হয়ে বিছানায় পড়ে আছে। তাকে দেখাশোনা করার জন্য একজন নার্স রাখা হয়েছে। চিকিৎসা করেও তেমন লাভ হচ্ছেনা। কিন্তু একদিক দিয়ে নার্স আর বাবার খুব লাভ হচ্ছে। যতদিন মা এ অবস্থায় থাকবেন ততদিন তাদের দু’জনের লাভ হতেই থাকবে। এসব ভাবতে ভাবতে গা ঘিন ঘিন করে উঠল। নিজের বাবাকে চিনতে ভুল করল এটা ভাবতেই নিজের উপর খুব রাগ হল।



“মামা চা দিমু?” দোকানদারের প্রশ্ন শুনে ভাবনাটা কেটে গেল। "না মামা"- বলে সিগারেটের দাম মিটিয়ে দিয়ে বাসার দিকে রওনা দিল। বাসায় ফিরেই অনিন্দ্য সোজা ঢুকল মায়ের ঘরে। মা ঘুমুচ্ছে। নার্স ঘরে নেই। হয়তো বাবার সেবায় ব্যস্ত। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মায়ের পাশে বসল। মায়ের কপালে হাত রাখতেই চোখ মেলে তাকাল। তার মানে মা ঘুমায়নি। কিছু একটা বলতে চাইছিল কিন্তু বলতে পারছিল না। তাই চোখ দিয়ে ইশারা করে দেখাল ঘরের কোনায় রাখা আলমারিটা। অনিন্দ্য উঠে গিয়ে আলমারিটা খুলল। তারপর মায়ের দিকে তাকাতেই কি যেন ইশারা করল। অনিন্দ্য বুঝতে পারল না। বিভিন্ন জায়গায় হাত রেখে রেখে জানতে চাইল এটা কিনা? মা মুখ দিয়ে কেমন শব্দ করে না করল। তারপর একটা ড্রয়ারে হাত দিতেই মায়ের মুখটা কেমন যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ড্রয়ারটা খুলতেই অনিন্দ্য দেখল কিছু টাকা রাখা। মা ইশারা দিল টাকাগুলো নেয়ার জন্য। টাকাগুলো হাতে নিতেই অনিন্দ্যর মনে পড়ল সেই ছোটবেলার কথা। যখন রাস্তায় আইসক্রীমওয়ালা আসত তখন আইসক্রীম কেনার টাকার জন্য মায়ের পিছন পিছন ঘুরত। তখন মা আলমারির ড্রয়ার থেকে টাকা বের করে দিতেন। আর টাকা পেয়ে খুশিতে মাকে জড়িয়ে ধরে আইসক্রীম কিনতে ছুটত। এসব ভাবতে ভাবতে চোখে জল চলে এল অনিন্দ্যর। ছুটে এসে মাকে জড়িয়ে ধরল। মাও খুশিতে একটু হাসার চেষ্টা করল।

“মা তুমি চিন্তা করোনা, আমি লেখাপড়া শেষ করে চাকরী পেলেই তোমাকে এখান থেকে নিয়ে যাব। তোমাকে আরো ভাল ডাক্তার দেখাব। তুমি আবার ভাল হয়ে উঠবে। তখন তুমি আমাকে আবার খাইয়ে দিবে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিবে, জড়িয়ে ধরে আদর দিবে। আমার লক্ষ্মী মা।“- এসব বলতে বলতে মায়ের কপালে একটা চুমু খেলো অনিন্দ্য যেমনটি সে ছোট বেলায় করত।



শীতের ছুটি শেষ। সামনে মাষ্টার্সের ফাইনাল পরীক্ষা। হলে ফিরেই পড়াশুনায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল অনিন্দ্য। মাঝেমাঝে ফোন করে মায়ের খবর নেয়। পড়তে বসলেই মায়ের মুখটা ভেসে আসে তখন চাকরী, মায়ের চিকিৎসার কথা মনে করে পড়ায় জোর দেয়। শেষ পরীক্ষার দিন ভোরবেলা মাকে নিয়ে একটা দুঃস্বপ্ন দেখল অনিন্দ্য। ঠিক করল পরীক্ষা শেষ করেই সোজা বাড়ি চলে যাবে। পরীক্ষা শেষে এক মুহুর্ত দেরী না করে রুমে ঢুকে তাড়াতাড়ি করে ব্যাগ গুছিয়ে রেল ষ্টেশনের দিকে রওনা হল। ট্রেনের জানালার পাশে বসে বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে মাকে নিয়ে কত কল্পনা করে ফেলল।



বাড়ির ভিতর ঢুকতেই দেখন কেমন যেন থমথমে পরিবেশ আর লোকজন ভর্তি। অনিন্দ্য কে দেখতে পেয়ে ওর মামা ছুটে এলো। “কিরে তোর মোবাইল বন্ধ কেন? বাবারে, দিদি তো নাই'’- বলেই অনিন্দ্যকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠল। "কি বলে মামা !!নাহ এটা হতেই পারেনা।"ভাবতে ভাবতে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে পাগলের মত ছুটল মায়ের ঘরের দিকে। ঢুকতেই দেখতে পেল মামী, কাকী আরো অনেক আত্মীয়া মায়ের পাশে বসে কাঁদছে। আরে এরা কাঁদছে কেন? মা তো ঘুমাচ্ছে। মায়ের ঘুমের অসুবিধা হচ্ছেনা ??



“এই আপনারা বাইরে যান, মাকে ঘুমাতে দিন” বলেই সবাইকে তাড়িয়ে দেয়ার ভঙ্গি করল অনিন্দ্য। ছোট মামী কিছু বলতে যাবে অমনি অনিন্দ্য তাকে থামাল। সবাই ঘর থেকে বের হয়ে গেলে অনিন্দ্য মায়ের পাশে এসে বসে কপালে হাত রাখল। আশ্চর্য ! মা চোখ খোলে না কেন ?? আরে, মা দেখি তার প্রিয় লাল পেরে সাদা শাড়ি পড়েছে। কপালে টিপ, সিঁথি ভর্তি সিদুর ,গলায় ফুলের মালা দেয়াতে মাকে পুরো দূর্গা প্রতিমা লাগছে। কতদিন পর মাকে এই সাজে দেখল সে। ছোটবেলায় এ সাজে মা সাজত আর অনিন্দ্যকে নিয়ে মন্দিরে যেত।আচ্ছা, আজ মা যাবেনা ওকে নিয়ে মন্দিরে? ভাবতে ভাবতে “মা” বলে একটা চিৎকার দিয়ে উঠল। কিছুই সে করতে পারল না মায়ের জন্য। ছোট মামা এসে বলল, “বাবা দিদিকে শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার সময় হয়েছে। শব এতক্ষন রাখতে আত্মা কষ্ট পায়। তোর জন্যই দেরী”।



এই প্রথম অনিন্দ্য ছোট মামাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। চারজন লোক এর মাঝে একজন অনিন্দ্যর বাবা শব সহ বাঁশের মাচাটা ধরে নিয়ে যেতেই অনিন্দ্য দৌড়ে এসে ওর বাবাকে ধাক্কা দিয়ে নিজে কাধে নিয়ে শব যাত্রায় রওনা হলো। ছোটবেলায় মাকে বসিয়ে তার চারপাশে একটা লাঠিকে তরবারী বানিয়ে রবিঠাকুরের “বীরপুরুষ" কবিতাটা আবৃত্তি করত আর বলত একদিন সেও মাকে নিয়ে যাবে অনেক দূরে। কিন্তু একি? আজ সে মাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? অনেক দূরে? যেখান থেকে লড়াই করেও মাকে আর ফেরাতে পারবেনা !!!
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জুলাই, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:১১
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার কিছু ভুল!

লিখেছেন মোঃ খালিদ সাইফুল্লাহ্‌, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮

১। ফ্লাস্কে চা থাকে। চা খেতে টেবিলে চলে গেলাম। কাপে দুধ-চিনি নিয়ে পাশে থাকা ফ্লাস্ক না নিয়ে জগ নিয়ে পানি ঢেলে দিলাম। ভাবছিলাম এখন কি করতে হবে? হুঁশ ফিরে এল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×