somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একজন অপন্যাসিকের জন্য ভালোবাসা

২১ শে জুলাই, ২০১২ ভোর ৪:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমাদের ছোটবেলায় সময় ছিল খুব অদ্ভুত।মোবাইল ফোন, ফেসবুক, স্যাটেলাইট চ্যানেল ছিল না।সময় কাটাবার জন্য ভালো কিছু বলতে গল্পের বই।সেই নেশাটাই পেয়ে বসেছিল ভীষন।চোখের সামনে যা পেতাম, পড়তাম।আমার প্রথম পড়া সত্যিকারের গল্পের বইটা ছিল দস্যু বনহুর সিরিজের, যখন পড়ি কিছুই বুঝিনি।সে ছিল পরোপকারী দস্যু, বাঙলার রবিনহুড।এরপর বিভিন্ন কমিকস, টিন টিন, ফ্যান্টম, চাচা চৌধুরী, তিন গোয়েন্দা, অনুবাদ, কিশোর পত্রিকা, কিশোর তারকালোক আর মাঝে মাঝে লুকিয়ে মাসুদ রানা।ক্লাশ এইট পর্যন্ত আমার পড়া বই ছিল এগুলোই। মিরপুর বাস স্ট্যান্ডের আর নীলক্ষেত পুরান বইওয়ালার আমি তখন নিয়মিত খদ্দের।তিন গোয়েন্দার ভীষন ভক্ত।আমি ঘুমের মধ্যেও আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চল চষে বেড়াই, প্রশান্ত মহাসাগরের রত্ন দ্বীপে আমি অভিযানে নামি।তিন গোয়েন্দাদের বন্ধু জিনা কে ভালোবেসে কত নির্ঘুম রাত কাটিয়েছি।তখন ও আমি হুমায়ূন আহমেদ এর একটা বইও পড়িনি।তবে তার নাম শুনেছি, বইগুলোর মলাট দেখেছি, বই উল্টে পাল্টে দেখেছি, কেন জানি ভালো লাগেনি তেমন।

একদিন বইওয়ালার কাছে দেখি নতুন একটা হুমায়ূন আহমেদের বই।নামটা ভারী ভালো লেগে যায় আয়নাঘর।ওখানে দাড়িয়েই প্রথম পৃষ্ঠা পড়ে ফেলি।বাংলাদেশী তরুনের বিদেশী বউ নিয়ে দেশে ফেরার গল্প।রোমাঞ্চকর, অবিশ্বাস্য গল্পের গতি।অসাধারন সংলাপ, এত সহজ করে পরানের গহীন ভেতরের কথা বলে দেয়া, প্রত্যকটা লাইন আমাকে অভিভুত করল, মুগ্ধ করলো।ভিষন আফশোস হলো হায় কেন আমি এতদিন পড়িনি! সেই বইটা আমার বয়সটা খানিক বাড়িয়ে দিল।সেই আমার শুরু হল, আমার আর ফেরা হলনা।

আমাদের মনের ভেতরে যে চোরাগলি, বিভিন্ন রকম অনুভুতি, রাগ, ভালোবাসা, ক্রোধ, বিভিন্ন গানের সুর যেগুলি ঘুমিয়ে থাকে, যার কোন হদিশ পাওয়া যায়না যে গুলি বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন পরিস্থিতিতে মানুষের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে। কিছু কিছু বোধ, অভিব্যক্তি আছে যেগুলি হয়তো কোনদিন আমাদের ব্যবহার করাই হয়নি।হুমায়ূন আহমেদ সেই অদৃশ্য অনুভুতি গুলো আমাদের কাছ থেকে বের করে এনেছিলেন, আমরা জানতামই না এই অনুভুতিগুলোর মালিক ছিলাম আমরাই!

আমি চাঁদের আলোয় কয়েকজন যুবক পড়ে ছোট্র ধর্ষিতা মেয়েটার জন্য অচেনা একটা ক্রোধের দেখা পেয়েছিলাম, আমি জানতাম না এই ক্রোধ আমার ভেতরে ছিল।অমানুষ গল্পেটার কথা আপনাদের মনে পড়ে?

একটা কথা ভেবে কি দারুন কষ্ট হচ্ছে, মেঘ বলেছে যাবো যাবো, একজন ক্রীতদাস(ছোট গল্প), আমার আছে জল, কবি, এই সব দিন রাত্রি, আকাশ জোড়া মেঘ এর মত আর ভালোবাসার, অনুভুতির গল্প আর লেখা হবেনা।

আর লেখা হবেনা ভেতরে পোকা,পারুল এবং তিনটি কুকুর,দুই দুয়ারী,আয়নাঘর, বাসর, নি,কুটু মিয়ার মত ফ্যান্টাসী।

তার সায়েন্স ফিকশন শূন্য, কুহক, ফিহা সমীকরন,ওমেগা পয়েন্ট, ইরিনা, ইমা তারা তিনজন, অনন্ত নক্ষত্র বিথি বাংলা সাহিত্যের সর্ব শ্রেষ্ঠ সায়েন্স ফিকশন।

মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস জোছনা ও জননীর গল্প, ১৯৭১!

কি সুন্দর উপন্যাসের নাম গুলো । দরজার ওপাশে, শঙ্খনীল কারাগার, জল জোছনা,নন্দিত নরকে, আমার আপন আধার, জলকন্যা, এই মেঘ রৌদ্র ছায়া, অনন্ত অম্বরে, জনম জনম, পাখি আমার একেলা পাখি, আজ আমি কোথাও যাবনা।

হুমায়ূন আহমেদ আরো কিছু গান লিখে গেলে নি:সন্দেহে রবীন্দ্র, নজরুল, লালনের পাশাপাশি তার আলাদা শাখা খোলা যেতে পারতো।

১.
আমার ভাঙা ঘরে ভাঙা চালা ভাঙা বেড়ার ফাঁকে
অবাক জোছনা ঢুইকা পরে হাত বাড়াইয়া ডাকে
হাত ইশারায় ডাকে কিন্তু মূখে বলে না
আমার কাছে আইলে বন্ধু আমারে পাইবা না
তুমি আমায় ডাকলা নাতো তুমি রইলা দূরে
তোমার হইয়া অবাক জোছনা ডাকলো আপন সূরে.......

২.
ও আমার উড়াল পঙ্খীরে
তুই যা যা যা
উড়াল দিয়া যা।

আমি থাকব মাটির ঘরে,
আমার চোক্ষে বৃষ্টি পড়ে,
তোর হইবে মেঘের উপ্‌রে বাসা
তুই যা যা যা
উড়াল দিয়া যা।

৩.
চাঁদনী পসরে কে আমারে স্মরণ করে
কে আইসা দাড়াইছে গো আমার দুয়ারে
তাহারে চিনিনা আমি সে আমারে চিনে...
বাহিরে চাঁন্দের আলো, ঘর অন্ধকার
খুলিয়া দিয়াছি ঘরের সকল দুয়ার
তবু কেন সে আমার ঘরে আসেনা
সে আমারে চিনে কিন্তু আমি চিনিনা

সে আমারে ঠারে ঠারে ইশারায় কয়
এই চাঁদের রাইতে তোমার হইছে গো সময়
ঘর ছাড়িয়া বাহির হও ধরো আমার হাত
তোমার জন্য আনছি গো আইজ চাঁন্দেরও দাওয়াত

হুমায়ুন আহমেদ কবিতা লেখা শুরু করলে বাংলাদেশের প্রধানতম কবি হতে পারতেন, যারা কবি উপন্যাস পড়েছেন তারা এটা জানেন।

"প্রতি পূর্নিমার মধ্যরাতে একবার আকাশের দিকে তাকাই
গৃহত্যাগী হবার মত জোছনা কি উঠেছে ?
বালিকা ভুলানো জোছনা নয়।
যে জোছনায় বালিকারা ছাদের রেলিং ধরে ছুটাছুটি করতে করতে বলবে-
ও মাগো, কি সুন্দর চাঁদ !
নবদম্পতির জোছনাও নয়।
যে জোছনা দেখে স্বামী গাঢ় স্বরে স্ত্রীকে বলবেন-
দেখ দেখ নীতু চাঁদটা তোমার মুখের মতই সুন্দর !
কাজলা দিদির স্যাঁতস্যাতে জোছনা নয়।
যে জোছনা বাসি স্মৃতিপূর্ন ডাস্টবিন উল্টে দেয় আকাশে।
কবির জোছনা নয়। যে জোছনা দেখে কবি বলবেন-
কি আশ্চর্য রূপার থালার মত চাঁদ !
আমি সিদ্ধার্থের মত গৃহত্যাগী জোছনার জন্য বসে আছি।
যে জোছনা দেখামাত্র গৃহের সমস্ত দরজা খুলে যাবে-
ঘরের ভেতরে ঢুকে পরবে বিস্তৃত প্রান্তর।
প্রান্তরে হাঁটব, হাঁটব আর হাঁটব-
পূর্নিমার চাঁদ স্থির হয়ে থাকবে মধ্য আকাশে।
চারদিক থেকে বিবিধ কন্ঠ ডাকবে- আয় আয় আয়"

এই লোকটা খুব জোছনা পাগল ছিল, বর্ষা প্রিয় ছিল।তবে সেই বর্ষা আর জোছনা বাঙলাদেশি হতে হবে।কি প্রচন্ড অসুস্থ্য অবস্থায় দেশ থেকে ঘুরে গেলেন, শেষবারের মত দেখে গেলেন।

হুমায়ূন আহমেদ তরুন দের কে রবীন্দ্রনাথ,জীবনানন্দ দাশ, কবিতা পড়া চিনিয়েছেন। চিনিয়েছেন বর্ষা আর জোছনা।বাঙালি তরুনরা হুমায়ূন আহমেদ পড়ে, নাটক দেখে স্মার্টনেশ শিখেছে, কথা বলা শিখেছে।কোথাও কেউ নেই, বহুব্রীহি, আজ রবিবার এ ধরনের নাটক আর কোনদিন তৈরী হবেনা, হবেনা শঙ্খনীল কারাগার , আগুনের পরশমনির মত ছবি।তার উপন্যাসের প্রথম উৎসর্গ থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত উপভোগ্য ছিল।

তিনি ইচ্ছে করলে দাঁত ভাঙা তথাকথিত আধুনিক সাহিত্য লিখতে পারতেন, তিনি গল্প লিখেছেন মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য ।তাই তার গল্পের নায়কের নাম, আলতাফ, রফিক, আনিস নায়িকার নাম নীতু, পারুল, তিথি।আমাদের চেনা জানা চারপাশ, বাড়ির উঠোন তার উপন্যাসের গন্ডি।

আজকে ব্লগে, ফেসবুকে অনেকের এই কথিত অপন্যাসিক, সস্তা সাহিত্যের ভাড় কে নিয়ে মাতম দেখছি তাদের, যারা তার ভয়ঙ্কর ক্যান্সারে মৃত্যু কামনা করেছে, তাকে রাজাকারদের কাতারে দাড় করিয়েছে। হুমায়ূন আহমেদের অপরাধ কি ছিল? সে নাকি শেষ বয়সে ধার্মিক হয়েছে! সচয়লাতন ও সামহয়ারইন, মুক্ত মনায় সেই পোষ্ট গুলো আছে কিনা জানি না তবে হাটু পানির জলদস্যুদের জন্য, প্রগতিশীল দের জন্য, আরজ আলি মাতুব্বরের মাজারের খাদেম দের জন্য এবার একটা সুযোগ। দেখি তারা বাঙালি জাতি কে ভবিষ্যতে অপন্যাসের গন্ডির বাইরে নিয়ে যেতে পারে কিনা।পরের বই মেলা থেকেই শুরু হোক।

তাদের জন্য শুভ কামনা।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জুলাই, ২০১২ দুপুর ২:১৭
৭টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ডালাসবাসীর নিউ ইয়র্ক ভ্রমণ

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:৪৪

গত পাঁচ ছয় বছর ধরেই নানান কারণে প্রতিবছর আমার নিউইয়র্ক যাওয়া হয়। বিশ্ব অর্থনীতির রাজধানী, ব্রডওয়ে থিয়েটারের রাজধানী ইত্যাদি নানান পরিচয় থাকলেও আমার কাছে নিউইয়র্ককে আমার মত করেই ভাল ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×