খেলা ছিল রাশিয়া বনাম মিশরের। গত ১৯ তারিখে বাংলাদেশ সময় রাত ১২ টায় যে খেলা টি হয়ে ছিল তার কথা বলছি।
খেলার ফলাফল রাশিয়া ৩-১ এ ম্যাচ নিজেদের করে নিয়েছে। সেই সাথে এখন অব্দি সর্বোচ্চ গোল নিয়ে প্রথম দল হিসেবে ২য় রাউন্ড নিশ্চিত করেছে। খেলা ছিল রাশিয়ান সময় বিকেল ন’টায়।
আমাদের ডিউটি শুরু হয়েছিল সকাল ১২ টায় আর শেষ রাত ০১ টায়। আগের দিনই আমাদের ভলান্টিয়ার সেন্টার থেকে জানিয়ে দেয়া হয়েছিল আগামীকাল বৃষ্টি হতে পারে। প্রস্তুতি নিয়ে যেতে।
আমার দায়িত্ব পরেছিল গেইট নং ০৩ এ। আগত দর্শকদের টিকেট চেক করে ভেতরে ডুকানো ছিল আমার কাজ। সেন্ট পিটার্সবার্গ এর গ্যালারিতে দর্শক আটে পুরা ৬৮ হাজার। আমরা গেট খুলেছি বিকেল ০৬ টায়।অর্থাৎ খেলা শুরুর ০৩ ঘন্টা আগে। হাজার হাজার দর্শকের লাইন গেইট খোলার আগেই পরে গিয়েছিল।
মিশরের মানুষেরা নানান রঙ্গের পোষাক পরিধান করে যেমন এসেছিল তেমনে অনেকের হাতেই ছিল মোঃ সালাহ এর ছবি আর নামের ব্যানার। রাশিয়ানদের কথা তো না বললে ও বোঝা যায়। নিজ দেশে নিজ দলের খেলা। তাদের আগ্রহ আর ভিড় যে একটু বেশী ছিল সেটা বুঝাই যাচ্ছে।
সকাল থেকেই আকাশে প্রচুর মেঘ ছিল। তবে শীতল বাতাসটা সত্যিই মন জুড়িয়ে দিয়েছিল। ক্ষনে ক্ষনে যে প্রিয়জনের কথা মনে পরে নাই, তা কিন্তু নয়। সেন্ট পিটার্সবার্গ স্টাডিয়মটি সাগরের পাশে। তাই রোমাঞ্চেরও কোন কমতি ছিল না মনে।
তবে রোমাঞ্চের মাঝে প্রেমিকার বড় ভাইয়ের হানা দেয়ার মত কয়েক পশলা বৃষ্টি গেইট খোলার আগেই হয়েছে। আমাদের রেইনকোর্ট দেয়া হল। নিজেদের উপরের দিক অনেকটা রক্ষা করা গেলেও মোজা জুতা পুরোটা পানিতে চপচপ করছিল।
সময় ৬টা। এবার গেট খুলে দেয়া হল। ২ টা জ্যাকেট পরিধান করেছিলাম, তবুও খুব ঠান্ডা লাগছিল। কয়েক হাজার দর্শকের লাইনে টিকেট দেখার জন্য আমি আর একটি রাশিয়ান মেয়ে। তাকে বললাম তুমি লাইন ঠিক কর। আমি টিকেট দেখছি। আবার শুরু হল বৃষ্টি। এবারের বৃষ্টিটা যে আগেই রাশিয়ার জয় আর মিশরের পরাজয়ের টের পেয়েছিল। তাই কখনও মুষল ধারে আবার কখন নতুন জুটির বাসরের অনুভুতি পূর্ন টিনের চালায় বইয়ে যাওয়ার মত বইছিল। পুরো ৩ ঘন্টা। আমাদের সাথে দর্শকও ভিজলেন। খেলা শুরুর ৪৫ মিনিট পড়ে আমরা গেইট বন্ধ করে দেই। এবার ব্রেকে নাস্তা শেষ করে চলে গেলাম গেইট নং ৫ এ। বের করার পালা। অপেক্ষা করছি। এর মাঝে রাশিয়া গোল পেল। ভেতরের সাথে সাথে বাহিরেরও দৃশ্য পালটে গেল। উৎসব বেড়ে গেল। ১-২ এবং রাশিয়া ৩ টি গোল পেল। আর মিশর একটি।
লোকেরা বের হওয়া শুরু করল। এ যেন এক মানুষের এক মহাস্রোত। আসার সমইয় দেখছিল টানা ১২ টা থেকে মানুষের বিশাল মিছিল আর এখন বের হওয়ার সমইয়। টানা ৩ ঘন্টা মানুষ বের হল। ৫ টি গেইট থেকে। আমার মানুষ দেখতে খুব ভাল লাগে। তার্কিতে আমার অফিস থেকে হোস্টেলের দুরত্ব বেশ অনেক। তবুও আমি মাঝে মাঝে শুধু মানুষ দেখার জন্য হেটে হেটে হোস্টেলে যাই। এটা আমার শখ বলা যায়। আজও আমি খুব আনন্দ পাচ্ছিলাম। তাদের বিদায়ের বাক্য আর সাথে অভিনন্দন জানানো ছিল এবারের কাজ। রাশিয়ানদের উল্লাসে কমতি ছিল না। রাশিয়ানরা মুডি হয়। আনন্দ করতে জানে না। এই সব কথাকে মিথ্যা প্রমান করে দিয়ে তারা মেতেছিল উল্লাসের চুড়ান্তে।
তাদের বের করে দিতে দিরে রাত প্রায় ১ টা। সেই সকাল ১২ টা থেকে রাত ১ টা দাঁড়িয়ে আছি। আর যে পারছি না। টিম মিটিং শেষ করে সোজা মেট্রো নিয়ে বাসায়।
দুপুরের দিকের ঘটনা। এক মিশরিয়ান তার ৪ সন্তানকে নিয়ে খেলা দেখতে এসেছেন। সব থেকে ছোট ছেলের বয়স ২ বছর এর নিচে। অন্য গেইট দিয়ে ডুকতে যাচ্ছিল। ৩ ছেলে ডুকে যাওয়ার পরেও ছোট ছেলের টিকেট না থাকায় বাবা ছেলেকে নিয়ে ডুকতে পারছিলেন না। এদিকে অন্য ছেলেরাও বেশী বড় না। এত লোকের মাঝে তারা ভেতরে ডুকে গিয়েছে। আসলে ফিফার নিয়ম অনুযায়ী ২ বছরের ছোট বাচ্চাদের টিকেট লাগে না। এই বাবা তাই টিকেট করে নাই। কিন্তু এই বাচ্চার কথা আগে থেকে ফিফাকে জানানো দরকার। এই বাবা সেটি করেন নাই। রাশিয়ান পুলিশ সাহায্য করতে চেষ্টা করছিল কিন্তু ভাষা সমস্যার কারনে পেরে উঠছিল না। আমি যে গেইটে এবার সেখানে নিয়ে এলো তাকে। সব শুনে তাকে কি কি করতে হবে সেটা বলে দিলাম। আর দেখছিলাম তার চোখ দুটো ভিজে উঠছিল। আমাকে বলতেছিল; আমার অন্য ছেলেরা ভেতরে। ওরা হারিয়ে যাবে। আমি বলেছি সমস্যা নেই আমরা খুজে বের করব। আপনি আগে এই কাজ সেরে আসেন। অনেক সময় পর উনি আসলেন। হাসি মুখে। সমস্যার সমাধান। এবার তিনি ভেতরে গেলেন।
ওহ! এদিকে গত পর্বে যে ইন্ডিয়ান বাঙ্গালী এর ব্যাগ হারানোর কথা বলছিল; তার সেই ব্যাগ ২ দিন পরে আমারা খুজে পেয়েছি। এখন স্টোরেজ রুমে আছে। পাঠিয়ে দেব ইন্ডিয়াতে। ।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জুন, ২০১৮ বিকাল ৫:২৪