রাশিয়া থেকে ফিরেছিলাম জুলাই মাসের ১৭ তারিখ। রাতে ইস্তানবুলে নেমে আবার পরের দিন বিকেলে বাংলাদেশের যাওয়ার জন্য বিমানে চেপে বসি। প্রায় ৪ বছর পর দেশে যাচ্ছিলাম।
এই ৪ বছরে ১৬/১৭ টি দেশে সফর হয়েছিল। তবে বাংলাদেশে যাওয়া হয় নাই।
খুব স্বাভাবিক ভাবেই দেশের প্রতি টান আর আবেগের যায়গাটি একটু বেশীই ছিল। কাতারের দোহাতে মধ্য বিরতি সহ প্রায় ১৮ ঘন্টা পরে, ১৯ তারিখ বিকেল ৫ঃ২০ মিনিটে বাংলাদেশে নেমেছিলাম।
বিমানবন্দরে এসেছিল আবু তারেক আর তার সাথে আরো ২ জন পরিচিতজন। যেহেতু আমাদের বাসা এখন চট্টগ্রামে, তাই আগেই ট্রেনের টিকেট করে রেখেছিলাম। রাত ৯ঃ৩০, বিমানবন্দর ষ্টেশন থেকে মহানগর এক্সপ্রেস এ উঠে প্রথমবারের মত আমি চট্টগ্রাম যাচ্ছি। আগেই বলে রাখি, আপনাদের অনেকের মনে থাকবে যে ১৯ জুলাই বাংলাদেশে কি পরিমান গরম ছিল। শুনেছিলাম সেদিন নাকি বাংলাদেশে বছরের সব থেকে বেশী গরম হয়েছিল।
শীতের দেশ থেকে গিয়ে হঠাৎ এত গরম মানিয়ে নেয়াটা একটু কঠিনই ছিল।
ট্রেনে একটি এসি টিকেট করেছিলাম, আরো বেশ আগে। কেবিন পাই নাই। " ঙ" বগিতে সিট ছিল আমার। ট্রেনে উঠা সেতো এক মহা যুদ্ধ। আমার হাতে ৩ টা ব্যাগ। একটি প্রায় ৪০ কেজি। অন্য দুটি ১০ আর ৭ কেজি প্রায়। আমি লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। পেছন থেকে আবু তারেক এসে বলল, "তুমি এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে আজ যেতে পারবে না। দেখ না কিভাবে মারামারি করে উঠছে মানুষ"।
আমি পুলিশের সাহায্য চাইলাম। বেচারা সাহায্য করেছিল। অনেক কষ্টে লাগেজ গুলো উঠিয়ে নিলাম। কিন্তু এমা, এখানে তো বড় লাগেজ রাখার কোন যায়গাই নেই।
বলে রাখি আমি এর আগে ট্রেনে দূরপাল্লার যাত্রা করি নাই। যতটুকু করেছি সেই বিমান বন্দর থেকে কমলাপুর আর সেখান থেকে গেন্ডারিয়া। লাগেজ কি করব সেটা ভেবে পাচ্ছিলাম না। একজন সিটের মাঝে সরু গলি পথেই এটে দিলেন বড়টি। আর বাকিগুলো মাথার উপরে।
এসি সিট। আমার জন্য একটি সিটও বরাদ্দ থাকার কথা। কিন্তু না। ফাকা পেলাম না একটিও। সিট এবং মানুষ মিলিয়ে পুরো বগিতে আঙ্গুল ফেলার যায়গা নেই। দাঁড়ানো মানুষেরা নাকি ঢাকার আশে পাশের জেলায় নেমে যাবে। আমার গরম আর এই মানুষের ভীরে নিঃশ্বাস নিতে খুব কষ্ট হয়েছিল সেদিন। এসি বগিতে, এসি নামক কিছুর বাতাস ছিল না। মাথার উপরে কিছু ফ্যান গড-গড সব ভয়ানক আওয়াজ করে যাচ্ছিলেন। অনেক কষ্টে সিট খুজে পেলাম। কিন্তু কাউকে উঠিয়ে দিয়ে আমি বসব সেটা কেন যেন পারছিলাম না। তাই তার সামনেই দাঁড়িয়ে রইলাম। উনি পরের একটি ষ্টেশনে নেমে গেলেন। আমি কোন ভাবে চেপে বললাম।
মাথায় উপরেই ফ্যান ছিল। পেছন থেকে একজন মানুষ কাঁধে টোকা দিল। "আমার বাচ্চাটা খুব ছোট। গরমে অসুস্থ হইয়ে যাচ্ছে আপনি কি আপনার সিট আমাকে দিতে পারেন আর আপনি আমার এখানে আসেন?"
আচ্ছা আসেন।
আমার মনে আছে আমার চারপাশে সব মানুষের ভীড় ছিল। আমি সারারাত ঘেমেছিলাম। নিজেকে চিড়িয়া মনে হচ্ছিল।
কয়েক ষ্টেশন পরে কিছু ভীড় কমেছিল। রেল পুলিশ এসে বার বার আমাদের বগি থেকে লোক বের করে দিচ্ছিল। কিন্তু কে কার কথা শুনে। বিশ্বাস করেন মেজেতে লেটকে পান খাওয়া থেকে শুরু করে সারা রাত দাঁড়িয়ে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম অব্দি যাওয়া মানুষ দেখেছি আমি সেদিন।
আমার বাবাও সেদিন আমার জন্য সারারাত চট্টগ্রাম পাহাড়তলী ষ্টেশনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। বড় ছেলে আসছেন। ৪ বছর পরে। ভোর ৫ টায় ট্রেন থামল। নামতেও কষ্ট কম ছিল না। আব্বু সারা একটা হাফ হাতের গেঞ্জি আর ট্রাউজার পরে দাঁড়িয়ে ছিল। আগের থেকে অনেক শুকিয়ে গিয়েছে। রাতে ঘুমাতে পারেন নাই। চোখ দুটি লাল টকটক করছিল। দীর্ঘ ৪ বছর বাবাকে বুকে জড়িয়ে নেয়ার যে আবেগ লালন করেছিলাম সেটা পূর্ন হল।
বাপ-বেটা বাসায় চলে গেলাম।
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৮ সকাল ১০:৫০