somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নর্দমার কীট

১৩ ই আগস্ট, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:৩৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :





জীর্নশীর্ণ পাশের ঐ বস্তিটা।যেখানে সকালের ঘুম ভাঙ্গে আবর্জার স্তুপে কাক আর কুকুড়ের ঝগড়ার শব্দে।খাদ্য খুঁজে নেবার ওদের রয়েছে একটা বিশেষ শিল্পাদর্শ।তীব্র কটু গন্ধে নাক বন্ধ হয়ে আসে কিন্তু ঘুমের তীব্রতাও চোখ বন্ধ করে দেয়।অবসন্ন তনু ছেঁড়া আর নোংরা বিছানা-বালিশে গা এলিয়ে দিতে সময় নেয় না।একসময় ঘুম আসে, খুব করে ঘুম আসে।বৃষ্টির জলে কখনো কখনো ভাঙ্গা খাটের নীচ অবধি নদী হয়ে যায় তবুও ঘুমের নিখাদ টানে চোখদুটো বন্ধ না হয়ে পারে না।খুব ভোর সকালে আমি উঠি।হাতে কোন থালা নিয়ে ভালো সেচক হয়ে যাই।পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা এখানে খুবই খারাপ।রোজ রোজ আমি এটা করে যাই।এরপরে দিনের সমস্ত অধ্যায়গুলো একটা একটা করে সামাল দেয়া শুরু করি।আমি পত্রিকা বাজারে যাই।শতাধিক পত্রিকা নিয়ে কখনো বাস, কখনো ট্রেন আবার কখনো কখনো প্রাইভেট কারে বসা ভদ্রলোক অথবা ভদ্রমহিলাকে বিরুক্ত করতে ছাড়িনা।নতুন নতুন খবর এর শিরোনাম ধরে গলা ফাটাই, “সাহেব সাহেব! আজকের গরম খবর- রাজধানীতে আবারও ধর্ষণের শিকার হলো চার কলেজ তরুণী”।কোন পত্রিকার কি শিরোনাম, কেন এমন দূর্ঘটনা ঘটেছে অথবা বিনোদনের পাতায় কেন দুই মিডিয়া ব্যক্তিদের ছাড়াছাড়ি এসব নিয়ে আমি খুব একটা ভাবার সময় পাই না।সারাদিন দৌড়াদৌড়ি শেষে রাত দশটায় আমি যখন আমার ঐ ছোট্ট কুঠিরে ফিরে যাই তখন একবার খুব করে ইচ্ছে করে যে, পত্রিকাগুলো থেকে কোন এক পত্রিকার অন্তত একপাতা আমিও পড়ে নেই।রাতের খাবার কখনো কখনো মিলে তো কখনো কখনো মিলে না।কিন্তু রাত হলে অদ্ভূত একটা স্বপ্ন দেখি, আমার মা কে দেখতে পাই, আমি আমার বাবা কে দেখতে পাই।স্বপ্নের মধ্যে এই দুজনার হাত খুব শক্ত করে আঁকড়ে ধরে থাকি যাতে সকালের বাস্তবতায় ওরা মিলিয়ে না যায়।কিন্তু ওরা থাকে না আমার পাশে।


আজ থেকে বাইশ বছর আগে পাশের বাড়ির এক পিসি একদিন ঐ আবর্জনার স্তুপে আমাকে কুড়িয়ে পেয়েছিলেন।তিনি আমার মায়ের মতন।কিন্তু মা তো নন, তবুও মা ডাক ডাকার মাঝে যে একটা প্রশান্তি আছে, আত্মার শান্তি আছে সেটাই বা আমি ছাড়ি কি করে? আমি উনাকে মা বলে ডাকি।আমি জানিনা মায়ের সম্মান কীভাবে করতে হয়, কিন্তু আমি তাকে যথেষ্ট সম্মান করি।বাস্তবতায় তিনিই আমার মা।অবশ্য গত কয়েক মাস হলো তিনি ইহজগত থেকে বিদায় নিয়েছেন।
আমার বয়েস এখন তেইশ।এই দেশের হাজারটা অনিয়ম আর বিশৃঙ্খল পরিস্থিতর মধ্যে দিয়েও যে, আমি-আপনি বড় হতে পারছি।নীচতলা ডিঙিয়ে একসাথে একই কাতারে আসতে পারছি সেটাই বা কোন অংশে কম? আমি এখন কলেজে পড়ি।একটা এন.জি.ও সংস্থা দরিদ্র এবং বস্তিবাসীর জন্য এ ব্যবস্থা করেছেন।কিন্তু আমাদের মতো মানুষদের জন্য সেটাই স্বর্গ সমান।সময় মিললে সবগুলো ক্লাস করতাম কিন্তু পেটের দায়িত্ব তো আর কেউ নিবে না।
সবাই বলছে দেশ চলছেনা-চলছেনা, কিন্তু কেমন চললে দেশ চলতো সেটাও আমি বুঝিনা।এই দেশের চলার আগে তো এ দেশের মানুষগুলোকে খেয়ে পড়ে বাঁচা উচিত।নতুবা সব আয়োজন অনর্থক।
যাইহোক এতকিছুর মাঝেও আজ পর্যন্ত আমার সাথে শুধু একটা ঘটনা ঘটে চলেছে যা আমার মনে রাখবার মতো।প্রতিদিন ফার্মগেট থেকে একটা চমৎকার বাস ছেড়ে যায়।ওতে রয়েছে দারুণ সব সুযোগ-সুবিধা।শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত, ভীড়ে আটকা পড়লে এই বাস কোম্পানীর ওয়াই-ফাই আছে যেটা দিয়ে এই বাসে বসে থাকা যাত্রীরা ইন্টারনেটে যেতে পারেন।এসব লোকে বলে।খুব সম্ভবত বাসটি কোন এক নামকরা কলেজের।এটা ছাত্রীদের জন্য।


কোন এক বিকেলে খুব ক্লান্তিকতার মাঝে বাসের জানালাটা খুলে দেয় এক মেয়ে।তারপর লম্বা চুলের ঢেউ নিয়ে বাহিরে তাকায়।সূর্যকিরণ লাগে তার চোখে মুখে।মেয়েটার দিকে তাকাতেই আমার চোখটা তো রীতিমত ঝলছে যাবার মতো অবস্থা হয়।ঠিক যেন হাজার ওয়াটের বাল্ব আমার চোখে তাক করে ধরা হয়েছে।কিন্তু দেখাটাও প্রতিদিন হয় না, সময় সময় হয় আবার সময় সময় হয় না।হাতের অচল ঘড়িটা ঠিক করেছি।ঠিক বিকেল চারটায় যদি একবার দেখা হয়ে যায় তো।হঠাৎ একদিন,
“হ্যালো! এই যে মামা! শুনতে পাচ্ছেন? আমার একটা ইংরেজী পত্রিকা লাগতো?”
“জ্বী! শুনতে পাচ্ছি।এই নিন আপনার পত্রিকা।”
“কয় টাকা?”
চোখ তুলে আমি তার দিকে তাকাতেই সেদিন ভূত দেখার মতো ভয় পেয়ে গেছিলাম।কাকে দেখছি আমি।সময় সময় স্বর্গ থেকে তাহলে আজকাল পরীরাও মর্তে আসে।নতুবা আজ আমার ঘড়ির কাঁটা উল্টো চলছে।
“হা… করে তাকিয়ে আছেন কেন? আমি ভূত নই মানুষ।”
“ইয়ে মানে ম্যাডাম আপনার বিল দশ টাকা হয়েছে।”
এরপর আমি ওর নেশায় চুর হয়ে গেলাম।আজকাল খাটের নীচের নদীতেই সাঁতার কাটতে মন চায়।অদ্ভূত সব অনুভূতির ঊর্ণাজাল বুনা আরম্ভ করে দিয়েছিলাম।কাজে-কর্মেও দারুণ জোশ পাই।আর দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলেই আমি ফার্মগেট বাসষ্ট্যান্ডে ওকে একবার দেখার চেষ্টা করি।প্রচন্ড ভীড় আর মানুষের অসহনীয় কোলাহল আমার কাছে এখন রোমান্টিক কোন আবহ সংগীত বলে মনে হয়।পত্রিকার বেচা-কেনাও এখন বেশ জমজমাট।কিন্তু জীবনটা একটা নিখুঁত খেলা।এই খেলা শিখতে শিখতে কখন জানি আমরা নিজেরাও এই খেলার একেকটা খেলোয়াড় হয়ে যাই।আর আমার মতো মানুষগুলো থেকে যায় শুধু দর্শক হয়ে।


কয়েকদিন হলো আমি আর আমার পরীটাকে দেখতে পাই না।ঠিক ঐ সময়ে একই জায়গায় আর বাসটাও আসে না।কিন্তু মনটা আমার আজ খুব ভালো।আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চ্যান্স পেয়েছি।কিন্তু এই আনন্দের অনুভূতিটা আমি ওর সাথে ভাগাভাগি করতে চাই।আমি আমার একটা পরিচয় পেয়েছি আজ।সেটা আমি গর্ব করে ওকে জানাতে চাই।হাতে একটা গোলাপ আছে আমার।আজ আমি এটা ওকে দিয়ে বলবো-“আমি আপনার বন্ধু হতে চাই।একজন পত্রিকাওয়ালার সাথে বন্ধুত্ব করবেন আপনি?” জানিনা কি বলবে সে।এসব চিন্তা-ভাবনা করতেই আমার অবস্থা বেহাল।শীতের এই সময়টায় আমি যেন রীতিমত ঘেমে যাচ্ছি।জানিনা কি উত্তর দিবে সে?


পাশে একটা যাত্রী ছাউনী পেলাম।মনে হচ্ছে বাসটা আজ আসতে দেরি করবে।তাই সব পত্রিকা একত্রে একপাশে রেখে তার মাঝ থেকে একটা পত্রিকা তুলে নিলাম।সেদিনের সেই পত্রিকার হেডলাইন আমি আজও ভুলিনি।“অপূর্ণা তুমি ফিরে এসো?”-দেখে মনে হচ্ছিলো কোন ছায়াছবির নাম হবে হয়তো।কিন্তু সেখানে একটা বড় করে রক্তাত্ত মুখের ছবি দেয়া ছিলো।ছবিটা দেখে আমি চমকে উঠেছিলাম।এক নিমিষের মধ্যে মনে হয় সব শেষ হয়ে গেল।কি ছিন্ন-ভিন্ন করে মেয়েটাকে মনে হয় কোন বুনো রাক্ষুসে খামচিয়েছে।আরো লেখা ছিলো-“এক সপ্তাহ ধরে মেয়েটাকে একটা আবদ্ধ ঘরে বন্ধ রেখে বেশ কয়েকজন ধর্ষণকারীরা মিলে প্রতিদিন তাকে ধর্ষণ করতো”।আমার আর পরের লাইনগুলো পড়ার সাহস হয়নি।ঐ দিকে রাত হয়ে যাচ্ছে।অন্তত পাঁচটা পত্রিকা বিক্রি করতে পারলে আমার রাতের খাবারটা জুটে যাবে।নতুবা না খেয়ে থাকতে হবে।গোলাপ ফুল আস্তে করে হাত থেকে কখন জানি পড়ে গেল।এবার পত্রিকাগুলো নিয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করা শুরু করলাম, “স্যার! স্যার! আজকের গরম খবর- অপূর্ণা কি আর ফিরে আসবে?”
অন্যদিকে চোখ দিয়ে শুধু অশ্রুজল ঝড়ছিলো।গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে করতে কখন জানি কান্নাকাটি আর আহাজারি করা শুরু করে দিয়েছিলাম।বাসের সমস্ত যাত্রী আমার দিকে হা… করে তাকিয়ে আছে।
নর্দমার কীট হয়ে শুধু অলীক স্বপ্নে ভাসা যায় কিন্তু বাস্তবতায় নয়।চোখের জল মুছতে মুছতে সেদিন শুধু নিজেকে বলেছিলাম-“হকারদের কাঁদতে নেই, আরো একটা পত্রিকা বিক্রি করতে হবে”।


সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই আগস্ট, ২০১৭ রাত ১:৩০
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। কালবৈশাখী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:২৪



গত পরশু এমনটি ঘটেছিল , আজও ঘটলো । ৩৮ / ৩৯ সে, গরমে পুড়ে বিকেলে হটাৎ কালবৈশাখী রুদ্র বেশে হানা দিল । খুশি হলাম বেদম । রূপনগর... ...বাকিটুকু পড়ুন

একজন খাঁটি ব্যবসায়ী ও তার গ্রাহক ভিক্ষুকের গল্প!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৪


ভারতের রাজস্থানী ও মাড়ওয়ার সম্প্রদায়ের লোকজনকে মূলত মাড়ওয়ারি বলে আমরা জানি। এরা মূলত ভারতবর্ষের সবচাইতে সফল ব্যবসায়িক সম্প্রদায়- মাড়ওয়ারি ব্যবসায়ীরা ঐতিহাসিকভাবে অভ্যাসগতভাবে পরিযায়ী। বাংলাদেশ-ভারত নেপাল পাকিস্তান থেকে শুরু করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল যুদ্ধ

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৮

আমরা সবাই জানি, ইরানের সাথে ইজরায়েলের সম্পর্ক সাপে নেউলে বললেও কম বলা হবে। ইরান ইজরায়েলকে দুচোখে দেখতে পারেনা, এবং ওর ক্ষমতা থাকলে সে আজই এর অস্তিত্ব বিলীন করে দেয়।
ইজরায়েল ভাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

নগ্ন রাজা কর্তৃক LGBTQ নামক লজ্জা নিবারনকারী গাছের পাতা আবিষ্কার

লিখেছেন মুহাম্মদ মামুনূর রশীদ, ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪০

LGBTQ কমিউনিটি নিয়ে বা এর নরমালাইজেশনের বিরুদ্ধে শোরগোল যারা তুলছেন, তারা যে হিপোক্রেট নন, তার কি নিশ্চয়তা? কয়েক দশক ধরে গোটা সমাজটাই তো অধঃপতনে। পরিস্থিতি এখন এরকম যে "সর্বাঙ্গে ব্যথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×