somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শুভ্রর ডায়েরী

১৩ ই অক্টোবর, ২০১৭ বিকাল ৫:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :





শুভ্রর ডায়েরী
শব্দ সংখ্যাঃ ৩৪৮৫ টি।

আমি শুভ্র।
ট্রেনে ভ্রমণ করার অভিজ্ঞতা আমার খুব কম।খুব ভয় করে।কারণ আমি সময়ানুবর্তিতাকে বড্ড বেশি ভয় পাই।আর ট্রেন আমাদের সাথে সেই খেলাটা খেলে যায় প্রতিদিন প্রতিনিয়ত।নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট স্টেশনে পৌঁছাবার একটা তাড়া থাকে সবসময়।কিন্তু আমি কোন কিছুকে একদম মিস করতে চাই না।কোন কিছু হারানোর একটা ব্যাথা থাকে।আর আমি সেই ব্যাথাকে নিজের করে অনেক আপন করে কখনো মেনে নিতে পারবোনা।

সন্ধ্যে ছয়টা।আমার হাতে আর মাত্র একঘন্টা সময় আছে।আমার নিজের বাড়ি থেকে সবচেয়ে কাছের রেলওয়ে স্টেশনের দুরত্ব প্রায় বিশ কিলোমিটার।হাতে বেশি সময় নেই।আমাকে এখন রওনা দিতে হবে।আমার পরিবারের লোকজন আমার সাথে আজ খুব বেয়াড়াপূর্ণ আচরণ করছে।কেউ কথা বলছে না।নিজেকে আজ বড্ড বেশি একা লাগছে।এটা সত্য চারপাশে অনেক মানুষজন আছে।মা-বাবা সবাই যে যার কাজে মাত্রাতিরিক্ত ব্যস্ত।আমার কাজ বা আমার চিন্তা-ভাবনাগুলোর দাম ওদের কাছে নেহাতই কম।কখনো দাম ছিলোও না।নতুন করে দাম প্রত্যাশা করা বৃথা।তাই সব ছেড়ে দূরে কোথাও পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে।এজন্য ল্যাপটপটা ব্যাগের মধ্যে গুছিয়ে নিলাম।ম্যানিব্যাগ নিয়ে খেলা করছিলাম আর ভাবছিলাম আজ হয়তো কারো কাছে থেকে অল্প কিছু ঋণও পাওয়া যাবে না।হিসাব করে দেখলাম সবমিলিয়ে আমার কাছে মোটমাট দশ টাকা আছে।কিন্তু রেলওয়ে স্টেশন যেতে আর আসতে ভাড়া দিতেই এই টাকা শেষ হয়ে যাবে।তাহলে ট্রেনের টিকিট কাটতে আমি একদম আজ পারবোনা।যদি আবার ফেরার ইচ্ছে পোষণ করি তো।আমি আজ যাবো, আমাকে আজ যেতেই হবে।আমি যথেষ্ট জেদি।আজ যদি সেটা আমি পূরণ করতে না পারি তাহলে আর দরকার নেই।আমি সম্ভবত এই বিষয়টি নিয়ে আজকের পর আর নতুন করে ভাববো না।একটা শার্ট গায়ে জড়িয়ে তাই বেড়িয়ে পড়লাম।যাবার রাস্তায় পরিবারের বিভিন্ন সদস্য কর্তৃক বাঁধা পেলাম।বিশেষ করে মা খুব করে বাঁধা দিলেন।শুনলাম সন্ধ্যা রাতের ট্রেন ভ্রমণের অভিজ্ঞতা কি ভয়াবহই না হতে পারে।কিন্তু আজ আমি আচরণে যথেষ্ট নিষ্ঠুর ছিলাম।এসব কথাকে একদম কানে তুললাম না।শাঁ…শাঁ… করে রাস্তা ধরে এগিয়ে গিয়ে সন্ধ্যাকালীন একটা বাস ধরলাম।

অদ্ভূত একটি বাসে যাত্রা আরম্ভ হলো আমার।সিট অনেকগুলো কিন্তু কোন মানুষ নেই।একজন ড্রাইভার আছেন।তিনি বেশ বৃদ্ধ।লম্বা-লম্বা কোঁকড়ানো চুল তার।পিছনে একবার তাকানোর প্রয়োজনও বোধ করলেন না।অবশেষে ছয়টা বেজে পঞ্চান্ন মিনিটে আমার কাঙ্খিত স্টেশনে পৌঁছালাম।ব্যাগটা রেখে চারদিকে একটু নজর আন্দাজ করে নিলাম।টিকিট কাউন্টারে কোন টিকিট মাস্টার নেই।সন্ধ্যায় নিস্তব্ধ চারদিক জনমানবশূন্য।জোনাকিপোকার ঝিঁঝিঁ শব্দ কানে এসে খুব করে বাজছে।পাশে বিশাল বড় পুরনো জঙধরা লাল বিল্ডিঙ এ একটা ইলেক্ট্রিক বাতি মরি বাঁচি করে কোনরকম জ্বলে আছে।চারদিকটা হালকা মৃদ মন্দ বাতাসে হু…হু… করে যেন উঠছে।এরপর একটা ট্রেন আসতে দেখলাম।খুব দ্রুত এসে পাশ কেটে চলে গেলো।এর গতিবেগ নির্ণয় করা কারো জন্য রীতিমত অসম্ভব ছিলো।আমি প্লাটফর্মে একা একা দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলছি আর অপেক্ষা করছি সন্ধ্যা সাতটার ট্রেনের জন্য।পুরো আধাঘন্টা দেরিতে ট্রেনটি আসলো।খুব রাগ হচ্ছিলো।ভাবছিলাম আধা-ঘন্টাকে এরা কি কোন সময় মনে করে না? সত্যিই এটাই আমার সোনার বাংলাদেশ।এখানে সব সম্ভব।তাই এসব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলায় শ্রেয়।

ট্রেনে উঠতেই সমস্ত দরজা বন্ধ হয়ে গেল।হালকা লাল লাইট আছে ভিতরে তাই স্পষ্ট করে সবকিছু বোঝার কোনরকম কোন জো নেই।বিভিন্ন ধরণের অদ্ভূত শব্দ কানে প্রবেশ করা শুরু করতে লাগলো।কখনো হাসির শব্দ, কখনো চিৎকার বা চ্যাঁচামেচির শব্দ, কখনো কান্নার শব্দ, কখনো পুরনো কিছু রেকর্ডিং গানের শব্দ আবার কখনো কখনো মনে হচ্ছে কেউ কোন বিশেষ অনুষ্ঠান উদযাপন করতে এসেছে তার শব্দ।যতদূর মনে পড়ে আমি মাঝের কম্পার্টমেন্টে উঠেছি।আর যেহেতু আমি টিকিট কাটিনি সেহেতু আমার এখানে কোন সিট নেই।সামনে এগিয়ে যাচ্ছিলাম ফাঁকা সিটের সন্ধানে।সবগুলো সিটেই দুজন-দুজন করে বসে আছেন।আমার মনে হয় এই কামরায় সব দম্পতি উঠেছেন।আরো একটু সামনে এগিয়ে গেলাম।একদম কর্ণারে একটা সিট ফাঁকা পেলাম।তাই ব্যাগটা কোনমতে গুছিয়ে রেখে বসে পড়লাম।সামনে একজন ভদ্রলোক বসেছেন।চার সিটের এই ছোট্ট বিভাজিত অঞ্চলে শুধু এক ভদ্রলোক আর আমি থেকে গেলাম।বাকি দুজন হঠাৎ করে কখন জানি উধাও হয়ে গেল।হাতঘড়ির দিকে তাকাতেই সোডিয়াম মেশানো কাঁটাগুলো বলে উঠলো, এখন সময় রাত এগারোটা বেজে পঞ্চান্ন মিনিট।কিন্তু আমি অনুধাবন করতে পারছি এটা অদৌ সম্ভব হতে পারে না।খুব বেশি হলে আমাদের যাত্রা দশমিনিটের মতো হয়েছে।

সামনের সিটের ভদ্রলোকটি এতক্ষণ ঘুমাচ্ছিলেন।হঠাৎ ধড়মড় করে উঠে পড়লেন, আর চিৎকার করতে লাগলেন, “ওয়ান পেগ ওয়াইন প্লিজ!” খানিকবাদে একজন মহিলা এসে তাকে সার্ভ করলেন।আমি শুধু ভদ্রলোকটিকে লক্ষ্য করে চলেছি।দানব আকৃতির তার দেহ।তার কাছে পাঁচফুট পাঁচ ইঞ্চি কোন উচ্চতা নয়, এটা তার হাঁটুর সমান।যেটা কি না আমার নিজের উচ্চতা।গায়ের রঙ কালো।পরনে কোর্ট-টাই।আমার মনে হলো ভদ্রলোকটির সাথে কথা বলা উচিত।যাতে করে আমাদের মধ্যে কোন ঝামেলা যেন না হয়।কিন্তু একি! ইনি মদ কোথায় ঢালছেন? পেটে? না কি ফ্লোরে!

ভদ্রলোকটি এরপর আরো একটি কান্ড ঘটালেন যার জন্য নিজেকে সামলে রাখার চিন্তা মাথায় কাজ করতে শুরু করে দিলো।আমার দিকে তিনি বড় বড় চোখ চুলে তাকালেন।বুঝতে পারছিনা পরমূহুর্তে কি হতে চলেছে।এবার আমার দিকে কটমট করে তাকালেন আর পানের পিক ফেলতে ফেলতে খষ-খষ আওয়াজে মুখে শব্দ ভেসে আসলো তার, ‘এই যে ছোকরা? কোথায় যাবার প্ল্যান নিয়েছো?’
‘এই ট্রেনটি ঠিক যতদুর যায় ঠিক ততদূর পর্যন্ত।কেন বলুন তো?’-ভয়ে ভয়ে উত্তর দিলাম আমি।
‘আজকাল মানুষ মাত্র পাঁচ টাকা পকেটে নিয়ে বিশ্ব ভ্রমণ করার চেষ্টা করছে! তার উপর ভুলভাল ট্রেনে উঠেছে।সৃষ্টিকর্তা জানেন এই বান্দা জীবিত হয়ে এখান থেকে ফিরে যেতে পারবে কি না।’-আমার দিকে তাকিয়ে মুখ ভেংচালেন ভদ্রলোকটি।
‘আমার পকেটে মাত্র পাঁচ টাকা আছে এটা আপনি জানেন কি করে?’-আমার কৌতুহল।
কিন্তু আমি এই প্রশ্নের কোন জবাব তার কাছে থেকে পেলাম না।ভিতরে ভিতরে ভীষণ ভয় কাজ করছে।ঘড়ির দিকে আবার তাকালাম।কিন্তু একি! সময়টা এখনো এগারোটা বেজে পঞ্চান্ন মিনিট।হঠাৎ করে একটা অদ্ভূত তীক্ষ্ণ বাজে শব্দ হওয়া আরম্ভ করলো।শব্দটি থেকে বাঁচার জন্য কোনরকম মাথাটা ধরে নিচু হলাম।কিন্তু শব্দটি ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।একসময় জ্ঞান হারালাম।

জ্ঞান ফিরতেই আমি দেখতে পেলাম আমার সামনে বসে আছে আমার ভালোবাসার মানুষটি।ওর নাম “হৃদিতা আহম্মেদ”।আজ থেকে প্রায় একবছর হলো মেয়েটি আত্মহত্যা করেছে।শুনেছি আত্মহত্যার আগে সে অনেক কষ্ট দিয়েছে নিজেকে।প্রথমে বাম এবং ডান দুই হাতের রগগুলো তীক্ষ্ণ ধারালো ব্লেড দিয়ে কেটেছে।এরপর ইচ্ছে করে উচ্চ ভোল্টেজের বিদ্যুৎ তাড়িত তার দিয়ে নিজেকে পেচিয়ে নিয়ে বৈদ্যুতিক সুইচটি অন করে দিয়েছিলো।মৃত্যুর পর ওর লাশটা শনাক্ত করতে ওর নিজের মা পর্যন্ত হিমশিম খেয়েছিলো।তার মতে, এটা তার মেয়ে হতে পারে না, তার মেয়ে এত দূর্বল নয় যে, কোন কষ্ট মেনে নিতে না পেরে আত্মহত্যা করবে।
যাইহোক, কথা বলতে শুরু করলো হৃদিতা।
‘শুভ্র! আমি তোমাকে খুব মিস করি জানো।ভীষন মিস করি।দেখ আমার দুই হাত? এখনো এখান থেকে রক্ত ঝরছে।এটা আমাদের ভালোবাসার এক স্বরণীয় প্রতিক না বলো?’-করুণস্বরে বললো হৃদিতা।
‘কিন্তু হৃদিতা! তুমি এই ট্রেনে কি করছো? কোথায় যাচ্ছো? আমি তো শুনেছিলাম তুমি আত্মহত্যা করেছিলে?’-অবাক হয়ে কথাগুল বললাম আমি।
‘জানো।আমার কবরে থাকতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।আমার শরীরটায় কোন উইপোকা ধরছেনা।পচে গলে নষ্টও হচ্ছে না।তীব্র জ্বালায় আমাকে সর্বক্ষণ পুড়তে হচ্ছে।আমার মৃত্যুর পর তুমি অন্তত একবারও আসলেনা আমাকে দেখতে।’-কান্নার সুরে কথাগুলো বললো সে।
‘দেখ হৃদিতা! আমাদের ব্রেক-আপের পর আমি সব ভুলে গেছিলাম।ভেবেছিলাম তুমি ব্যাপারটা সহজ ভাবে নিবে।তাছাড়া, লাইফ ইজ অল অ্যাবাউট মুভিং অন! আবেগ দিয়ে কি দুনিয়া চলে?’-বললাম আমি।
‘আবেগ দিয়ে হয়তো দুনিয়া চলেনা শুভ্র।কিন্তু কাঠখোটা কোন রোবট দিয়েই বা কয়দিন এই দুনিয়া চলতে পারে আমাকে বলতে পারো? তুমি জানো আমি তখন অন্তঃসত্তা ছিলাম।‘-বলল সে।
‘ওহ্ নো! কই! তুমি তো আমাকে কখনো এসব জানাওনি! যাইহোক, আমি দুঃখিত হৃদিতা!’-কথাটা বলতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিলো।

এরপর আমি যা দেখলাম তা নিজের চোখকে বিশ্বাস করাতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিলো।আস্তে আস্তে হৃদিতার হাত পায়ে আগুন ধরতে লাগলো।একসময় ঐ আগুনটি ছেয়ে গেল তার পুরো শরীর জুড়ে।বিলাপ করতে লাগলো সে, ‘শুভ্র! আমাকে ওই নরকে যেতে দিয়ো না, ওরা আমাকে ভালো থাকতে দিচ্ছে না’।একসময় সে আস্ত একটা কঙ্কালে রুপান্তরিত হলো।এরপর হুমড়ি খেয়ে পরে গেল ফ্লোরে।কিছু বিষাক্ত কালো ধোঁয়া আমাকে ছেয়ে নেয়া শুরু করলো।আমি রীতিমত কাশতে আরম্ভ করলাম।ফুসফুসটা জ্যাম হয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে।মনে হচ্ছে আর বেশিক্ষন আমি আর বাঁচবোনা।আমি জানি আমি হৃদিতার সাথে যা করেছি তা ঠিক করিনি।আমি অনেক ভুল করেছি ওর সাথে।একসময় চোখদুটো বন্ধ হয়ে গেল আমার।হৃদপিন্ডের আওয়াজ শুধু শুনতে পাচ্ছিলাম।একটু পর পর ধাক্কা দিচ্ছে।একসময় সব অনুভূতি কোথায় যেন হারিয়ে গেল।

‘এই যে ছোকরা? ঘুমাচ্ছো না কি?’-কথাটি আমার কানে একবার এসে বাজলো।এরপর আরো একবার।আমি অনুধাবন করতে পারছি যে কেউ একজন আমাকে ডাকছে।আস্তে আস্তে চোখ মেলতেই বুঝতে পারলাম আমার সামনে সেই ভদ্রলোকটি।
‘ওহ! আপনি?’
‘কেন? অন্য কাউকে আশা করছিলে বুঝি?’
‘না, ঠিক তা নয়।’
‘সিগারেট চলবে?’
‘হুম।চলতেই পারে।’
‘স্পেশ্যাল ব্রান্ড, হুম।’
এরপর ভদ্রলোকটি একটা সিগারেট আমার দিকে এগিয়ে দিলেন।সিগারেটে টান দিতেই বুঝতে পারলাম আমি সচরাচর যে ব্রান্ডের সিগারেট পান করি এটা তা নয়।এরপর ভদ্রলোকটি কিছু কথা বললেন যা আমার ছোট্ট মস্তিস্ক নিতে একদম সক্ষম ছিলো না।
‘শুনছি।দেশে বাংলা ছায়াছবি সামনে আসতে যাচ্ছে? কি যেন নাম! মুখ ও মুখোশ! কি যে অদ্ভুত নাম।ভাবছি বেশ স্পেশ্যাল হবে?’-কটুক্তির স্বরে কথাগুলো বললো ভদ্রলোকটি।আর আমার গায়ে তেলে বেগুনে আগুন জ্বলা শুরু করলো।
‘হুম, স্পেশ্যাল তো অবশ্যই হবে।অন্তত আপনার এই স্পেশ্যাল ব্রান্ডের সিগারেটের চেয়ে বেশি স্পেশ্যাল হবে।’-রেগে গিয়ে প্রতুত্ত্যর দিলাম আমি।
কিন্তু আসলে আমার সাথে হচ্ছেটা কি! আমি ঠিক কোন সময়ে অবস্থান করছি! ম্যানিব্যাগ হাতালাম।বের হয়ে আসলো গত সপ্তাহের দেখা বাংলা সিনেমা “ঢাকা অ্যাটাক” হলে গিয়ে দেখার টিকেট।

এরপর হঠাৎ একসময় একটা কান্নাকাটির সুর ভেসে আসা শুরু করলো।মনে হচ্ছে কেউ একজন খুব করে বিলাপ করছে।এদিকে ভদ্রলোকটি একটা বাসি পাউরুটি বের করে নিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছেন।বিশ্রী গন্ধে নাক বন্ধ হবার উপক্রম হচ্ছে।উঠে দাঁড়ালাম, এরপর সোজা সামনের দিকে হাঁটতে আরম্ভ করলাম।বেশ কয়েকটা প্যাসেঞ্জার সিট পাড় হবার পর লক্ষ্য করলাম একজন মহিলা মাথা নিচু করে বসে আছেন।কিন্তু আমি এই কম্পার্টমেন্টে প্রবেশ করার আগে দেখেছিলাম সবাই জোড়ায়-জোড়ায় বসে ছিলেন।একজন ভদ্রলোক এবং তার সাথে একজন ভদ্রমহিলা।তাই হিসেবটা মিলাতে পারছিলাম না।একটু পরে বুঝতে পারছিলাম এটা তারই কান্নার সুর ছিলো।এখনো সময় সময় খুব নিঃশব্দে দীর্ঘশ্বাস নিচ্ছেন।ভাবলাম হয়তো উনার স্বামী উনাকে ছেড়ে কোথাও চলে গিয়েছেন।কিন্তু কোথায় যাবে? ট্রেনটা তো এখনো কোন স্টেশনে থামেনি।

‘এক্সকিউকজ মি।মিসেস…’-বললাম আমি।
‘শুভ্র।তুই কেমন আছিস বাবা?’-আচমকা ঘাড়টা ঘোরালেন আমার দিকে আর তারপর খুব দ্রুত উত্তর দিলেন।
উনার চেহারা দেখে আমি চমকে গেলাম।এই মহিলাটি আর কেউ নয়, ইনি আমার মা।প্রিয় মুখটি অনেকদিন হলো ভালো করে দেখা হয় না।কিন্তু এখন যখন দেখছি তখন সেই চেহারার মধ্যে হতাশা আর বিষন্নতার ছাপ লেগে আছে।যে মুখটি সবসময় আমাকে দেখে হাস্যজ্জ্বল থাকে সেই মুখটি এখন এমন মলিন হয়ে আছে যে তা দেখে খুব খারাপ লাগা শুরু করে দিলো আমার মধ্যে।
‘মা তুমি কাঁদছো কেন? আমাকে বল তোমার কি হয়েছে? আর আরেকটা কথা হলো তুমি তো আমাকে আজ রাতে বাহিরে বেরোতে নিষেধ করলে আবার তুমি এই ট্রেনে কি করছো?’-খুব ঠান্ডা গলায় একের পর এক কথাগুলো বলে গেলাম।
‘তোর কাছে একটা জিনিস চাইবো।দিতে পারবি?’-বললেন তিনি।
‘বল মা? কি সেটা?’-কন্ঠে কৌতুহল নিয়ে জানতে চাইলাম।
‘শুভ্র।তুই খুব ব্যস্ত না বাবা।বিশাল বড় এক কোম্পানীর চীফ কো-অর্ডিনেটর।তোর তো কারো জন্য সময় হয় না।তোর বৃদ্ধ দাদীমা গত কয়েকবছর ধরে অসুস্থতা নিয়ে বেডে পড়ে আছেন।বয়েস হয়ে গেছে।আর তোর দাদু অনেক আগেই ওপাড়ে পাড়ি জমিয়েছেন।ছোট্ট একটা সংসার আমাদের।তবুও চলছেনা।তোর বাবার মুদির দোকানটা আস্তে আস্তে বিলুপ্তির দিকে।সংসারের ঘানী টানতে টানতে তিনি এখন বড্ড বেশি ক্লান্ত বাবা।’-বললেন তিনি।
‘আচ্ছা ঠিকাছে মা।তুমি কোন চিন্তা কোরো না।আমি টাকার ব্যবস্থা করছি।’-সব ঠিকঠাক করার ভঙ্গিতে বললাম আমি।
‘হা হা হা... তোর কোম্পানিটি বন্ধ হয়ে গেছে।কোটি টাকার ঋণে তুই এখন হাবুডুবু খাচ্ছিস।আর তোর মনে হচ্ছে আমি তোর কাছে টাকা চাইতে এসেছি? পকেটে পাঁচ টাকা নিয়ে তুই এখন কি করবি আমাদের জন্য?’
ভীষণ লজ্জিত হলাম মায়ের মুখে এমন কথা শুনে।কিন্তু তিনি যে মূলত কি চান তাও জানার বাকি রইলোনা।সফলতার শীর্ষে উঠার জন্য আমি কত কিছুইনা পায়ের তলে পিষে ফেলেছি, কতকিছুইনা মাটি চাপা দিয়েছি।কারো জন্যই আমার হাতে কখনো তেমন একটা সময় থাকতোনা।এসব ভাবতেই নিজের প্রতি ঘৃণা বোধ হচ্ছে।একটু পরেই কাঁধে একজন মানুষের হাতের স্পর্শ অনুভব করলাম।ফিরে তাকাতেই দেখলাম আবার সেই ভদ্রলোকটি।

‘এই যে মি. ভদ্রলোক? আবার কি চাই বলুন তো? বাসি আর পঁচা পাউরুটি খাওয়া হয়েছে? আর খাওয়া হয়ে থাকলে অনুগ্রহ করে আমার মাথা খেতে আসবেন না।’-রাগ্বতস্বরে বললাম আমি।
‘তবুও তো তোমার মতো পাগল নই।ফাঁকা সিটের সাথে কি প্রেমালাপ করছো হে?’-মৃদ মৃদ হাসছেন তিনি।
‘ফাঁকা সিট নয় ব্রেইনলেস ম্যান।আমি আমার মায়ের সাথে কথা বলছি।’-কথাটা বলে চোখ ফিরে তাকালাম সিটের দিকে।আর বুঝতে পারলাম ভদ্রলোকটি ঠিকই বলছে।ওখানে কেউ নেই।

আবার শান্ত হয়ে ফিরে গিয়ে নিজের সিটে বসলাম।ট্রেন চলছে তীব্র গতিতে।জানালা দিয়ে তাকালাম কিন্তু আমবস্যার রাত বিধায় কিছুই দেখতে পাচ্ছিনা।কিছু গাছপালা আর ঝোপঝাড় শাঁ...শাঁ... করে আমাদের রেখে পিছনে চলে যাচ্ছে।আর মনে হচ্ছে একই দৃশ্য বারবার আমাকে দেখানো হচ্ছে।পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে আরো একটা সিগারেট ধরালাম।সিগারেটে দুই টান দিয়ে চোখ বন্ধ করে সিটে হেলান দিলাম।চোখ বুজতেই একটা পরিষ্কার দৃশ্য আমার সামনে মনে হয় ভেসে উঠলো।এক ছোট্ট বাচ্চা।কান্না করছে।ভারি ফুটফুটে একটা ছেলে।দেখতে ঠিক হৃদিতার মতো হয়েছে।একসময় ছেলেটার মুখে কথা ফুটলো।
‘বাবা...বাবা...আমাকে ছেড়ে যাবে না তো।মা আমাকে খুব কষ্ট দিয়েছে।দেখ! এসব দিয়ে আমাকে পুড়ে ছাই করে দিয়েছে।’- হাতে কিছু ইলেক্ট্রিক তার নিয়ে কান্না করতে করতে কথাগুলো বলছিলো সে।আমার ভিষণ মায়া হলো বাচ্চাটাকে দেখে।আমি সায় দিলাম, ‘না, বাবা।আমি তোমাকে ছাড়া কোথাও যাবো না।আমি আছি তো।তোমার মা তোমাকে আর কষ্ট দিতে পারবেনা।’
‘কিন্তু আপনি তো ঠক।একজন প্রতারক।আমি আপনাকে বিশ্বাস করি না।আপনাকে তো আমার বাবা বলতেও কষ্ট হয়।’-এই কথাগুলো বলার সময় আমি ওর গালে লাল আভা লক্ষ্য করলাম।বুঝতে পারছিলাম আমার উপর খুব রেগে আছে।কিন্তু এই বাচ্চাটা কে? আর কেনই বা এসব বলছে?
এরপর কখন জানি সিগারেটটা আমার হাত থেকে পড়ে গেল আর আমার পায়ের এক অংশে সেটা পড়ে ফোসকা উঠলো।চোখ মেলাতেই অনুধাবন করলাম এটা একটা হ্যালুসিনেশন ছাড়া আর কিচ্ছু হতে পারে না।

কিন্তু আজ আমার সাথে কি হচ্ছে আমি সেসবের কিছুই মেলাতে পারছিনা।লোকাল বাসে সব সিট ফাঁকা ছিলো, ট্রেন আসতে আধাঘন্টা দেরি করলো, ট্রেনের ভিতরে প্রবেশ করার পর বিভিন্ন অদ্ভূত আওয়াজ শুনতে পেলাম, একজন কালো পেটমোটা ভূতড়ে ভদ্রলোক যিনি কিনা বিংশ শতাব্দীর মাঝের দিকের মানুষ তার সাথে পরিচিত হলাম, এক্স-গার্লফ্রেন্ড হৃদিতা আহম্মেদের সাথে কথা হলো, আমার মায়ের সাথে কথা হলো, এখন আবার একটা ছোট্ট বাচ্চার সাথে কথা বলছি যাদের কোন বাস্তব অস্তিত্ব নেই।এরকম হাজারো ছোটখাটো ঘটনা আমাকে একটা অমীমাংসীত ঝামেলায় ফেলে দিচ্ছে।ভিতরটায় ভয় ভয় করছে।মাথাটা ধরে আসছে।সমস্ত দুশ্চিন্তাগুলো একত্র হয়ে আমার ভিতর জেঁকে বসেছে।সময়টা একবার দেখতে আবারো ইচ্ছে করছে।ঘড়িতে তাকাতেই দেখতে পেলাম এখন সময় বলছে, “এগারোটা বেজে ঊনষাট মিনিট ঊনষাট সেকেন্ড”।

খুব বেশিক্ষণ আমি এখানে টিকতে পারবোনা।যতদ্রুত সম্ভব এখন আমাকে এই ট্রেন থেকে নেমে যেতে হবে।আর তানাহলে আমি হয়তো আর অল্প সময়ের মধ্যে মারা যাবো।কিন্তু কীভাবেই বা এই ট্রেন থেকে নামবো? সেই কখন থেকে ট্রেন চলছে তো চলছে।মনে হচ্ছে কয়েকদিন ধরে যাত্রা চলছে কিন্তু এই যাত্রার যেন শেষ হচ্ছে না।ভদ্রলোকটি আগের মতোই নির্বিকার।কিছুই বলছেন না।এমনিতেও আমাদের মধ্যে একটা ঝগড়া বেঁধেছিলো তাই উনার কাছে সাহায্য চাওয়া বোকামি হয়ে যায় বৈকি।আমি বরং নিজেই কিছু চেষ্টা করি।মাথাটা খুব দ্রুত চিন্তা করা শুরু করে দিলো।একটু দূরেই ট্রেন থামানোর শিকল দেখতে পেলাম।এখন আমার হাতে শিকলটি টানা ছাড়া আর কোন উপায় নেই।উঠে দাঁড়ালাম।এক পা-এক পা করে এগুতে লাগলাম শিকলটির দিকে।হঠাৎ করে সামনে একটা পিচ্চি বাচ্চার উদয় হলো।গায়ে ছেঁড়া জামা আর নোংরা প্যান্ট পড়ে আছে।হাতে একটা থালা আছে।ভিখারী বলে মনে হচ্ছে।পিচ্চি এই ছেলেটি শুধু আমার দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।পকেট হাতালাম।বের হয়ে আসলো পাঁচ টাকা।কিন্তু এই পাঁচ টাকার বেশি আমার কাছে এখন আর কিছু নেই।যদি এই পাঁচ টাকা আমি তাকে দান করে দেই তবে বাসায় ফেরার জন্য ভাড়ার টাকাটাও আমার কাছে থাকবে না।কিন্তু এতকিছু ভাববার সময় এখন হাতে নেই।তাই ঝটপট করে আমি তাকে পাঁচ টাকা দিয়ে দিলাম।পাঁচ টাকা পেয়ে সে খুব খুশি হলো।আর বললো, ‘রাস্তায় এখনো আমাদের মতো কারো সাথে দেখা হলে আপনি রাস্তার পড়ে থাকা কীট আর নোংরা বস্তু মরে করে লাথি মারেন কি?’

পিচ্চিটার কথা শুনে হঠাৎ মনে পড়ে গেল ফেলে আসা এক স্মৃতির কথা।আমি একদিন এমনটা করেছিলাম।ঢাকা শহর সবসময় জ্যামে ব্যস্ত থাকে।তার উপর এসব স্ট্রিট র‍্যাটের অভাব নেই।এদের আপনি প্রত্যেক গলির মোড়ে মোড়ে খুঁজে পাবেন।কেউ কেউ আবার এসে আপনার পা-দুটো জাপটে ধরবে।বলবে টাকা চাই।একদিকে এরা আমাদের মতো ব্যস্ত মানুষদের সময় নষ্ট করে অন্যদিকে একটা বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেয় সবার সামনে।সহজকথায় কর্পোরেট জীবনের মান-ইজ্জতের বারোটা বেজে দেয়।কিন্তু তবুও প্রতিনিয়ত মুখ বুজে আমাদের এসব সহ্য করে যেতে হয়।একদিন এমনই একটা ছোট্ট বাচ্চা ছেলে ব্যস্ত রাস্তায় আমার পা ধরে বসে।সেদিন পকেটে খুচরা টাকাও ছিলো না যে সেটা দিয়ে একে বিদায় করবো।অফিসে মিটিং ডাকা হয়েছিলো সেদিন।আরো পাঁচ মিনিট দেরি করলে আমার চাকুরী যায় যায় অবস্থা।তাই বাধ্য হয়ে এক লাথি দিয়ে ফেলে রেখে এসেছিলাম রাস্তায়।আমি কি কিছু ভুল করেছি? পৃথিবীটা এমনিতেও তো বলে, “সার্ভাইভাল ফর দ্য ফিটেস্ট”।আমাকেও তো আমার অবস্থান নিয়ে ভাবতে হবে না কি।

থাক এসব কথা।এখন আমাকে আগে এই ট্রেন থেকে নামতে হবে।তাই সোজা গেলাম শিকলটির কাছে।জরিমানার কথা তোয়াক্কা করলাম না।এমনিতেও কোন টিকেট মাস্টারের এখন পর্যন্ত কোন দেখা পেলাম না।শিকলটি খুব জোরে শক্ত করে ধরলাম আর এরপর এক হ্যাঁচকা টান দিলাম।কিন্তু কিছুই হলো না।বরং আমি নিজেই উল্টে পড়ে গেলাম ফ্লোরে।আসলে শিকলটায় জঙ ধরেছে।তাই আবার চেষ্টা করার ইচ্ছা পোষণ করলাম।পরিকল্পনা করলাম এইবার আরো জোরে টান মারবো।কিন্তু যখনই শিকলটা স্পর্শ করতে গেছি ঠিক তখনই বৈদ্যুতিক শক খেলাম।এক ঝাটকায় আমাকে ফেলে দেয়া হলো প্রায় ছয় থেকে সাতগজ দূরে আমার সিটে।যেখানে আমি বসেছিলাম।এরপর লক্ষ্য করলাম আমার নাক দিয়ে রক্ত ঝরছে।শরীরটা একটু পর পর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠছে।নাক দিয়ে অনবরত রক্ত ঝরায় একসময় আমার সাদা শার্টটা রক্তে ভিজে গেল।বুঝতে পারছিলাম আমি আস্তে আস্তে রক্তের সমুদ্রে ডুবে যাচ্ছি।আর আমার শরীরটা ক্রমাগত দূর্বল হয়ে পড়ছে।চোখদুটো দিয়ে এখন সব ঝাপসা দেখতে পাচ্ছি।সামনের ভদ্রলোকটিকে সময় সময় স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আবার সময় সময় তিনিও আমার চোখের সামনে থেকে হারিয়ে যাচ্ছেন।একসময় লক্ষ্য করলাম ভদ্রলোকটি হাসছেন।আমার এই অবস্থায় উনার হাসাহাসি আমি একদম নিতে পারছিলাম না।আমার শরীরটা এখন ঠিক থাকলে উনাকে দেখিয়ে দিতাম।উনার একদিন কি আজ আমার একদিন কিন্তু শরীরে কোন শক্তি নেই উঠে দাঁড়াবার মতো।

‘আপনি হাসছেন কেন? আমার এই অবস্থা থেকে আপনার হাসি পাচ্ছে?’-রাগ্বতস্বরে ভদ্রলোকটিকে বললাম আমি।
‘তোমার কাছে মাত্র পাঁচ টাকা ছিলো।সেটাও দান করে দিলে।তুমি কি মহান!’-হাসতে হাসতে উত্তর দিলেন তিনি।
‘ হ্যাঁ।আমি মহান।সত্যিই মহান।জানতে চান কে আমি এত মহান? শুনতে চান?-এবার আমি সত্যি সত্যি অনেক রেগে গেছি।
কিন্তু ভদ্রলোকটি কোন প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে আস্তে আস্তে বললেন, ‘বলুন, ঘড়ির কাটা এমনিতেই অনেকখন ধরে আটকে আছে’।

আমি সমস্ত কিছু ঘটনা এক এক করে সংক্ষেপে বলতে শুরু করলাম-
আমার নাম শুভ্র।শুভ্র রায়।আমি একজন হিন্দু ছেলে।আমার গার্লফ্রেন্ডের নাম হৃদিতা আহম্মেদ।সে একজন মুসলমান।তার প্রতি আমার ভালোবাসার কোন কমতি ছিলো না কখনো।কিন্তু আমাদের সমাজ এসব মেনে নেয় না।আমাদের সমাজ আমাদের জন্য, আমাদের পদে পদে হেনস্তা করার জন্য সব নিয়ম বানিয়ে রেখেছে।তাই আমি যখন বিষয়টি নিয়ে গুরুত্ব দেয়া শুরু করে দিলাম তখন ভিলেন হয়ে সবার আগে আমাদের সমাজ এসে সামনে দাঁড়ালো।কিন্তু আমরা তো মানুষ না কি।আমাদের মধ্যে কি কোন অনুভূতি থাকতে পারে না।সেই অনুভূতিকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে আমি পদে পদে হৃদিতা কে ছোট করেছি।এক সময় যখন বুঝলাম এই সংগ্রামে আমি জয়ী হতে পারবোনা তখন ঘুরে দাঁড়িয়েছি।একদিকে বাবা-মার অসহায়ত্ব আমায় পুড়ে মারতো।অন্যদিকে আমার স্বপ্নগুলো আমাকে ভিতরে ভিতরে কুঁড়ে খেত।আবার পকেটে টাকাও থাকতো না।না বাবা-মার যত্ন নিতে পারতাম, না কাছের মানুষটির।তাই সব বাদ দিয়ে ভাবলাম নিজের স্বপ্নের জন্য কিছু একটা করা উচিত।সেই রাস্তা এত সহজ ছিলো না যে, চাইলাম আর কেউ একজন আলাদিনের চেরাগ নিয়ে আমার সামনে হাজির হলো আর বললো, ‘এক ঘষা দাও! আর দৈত্যর কাছে থেকে যা ইচ্ছে চেয়ে নাও’।আমাকে কত দিন কত রাত যে না খেয়ে থাকতে হয়েছে সেটা শুধু আমি জানি।দীর্ঘ দশবছরের পরিশ্রমে নিজের একটা পরিচয় পাই বটে।কিন্তু ততদিনে আমি হারিয়ে ফেলেছি আমার দাদুকে, আমার ভালোবাসার মানুষটিকে।ভেবেছিলাম এতদিন পর বাসায় ফিরে গিয়ে সব ঠিক ঠাক করে নিবো।কিন্তু শেয়ার মার্কেটে আমাদের কোম্পনির ধ্বস নামলো।আবার হারিয়ে ফেললাম নিজের পরিচয়।বাসায় ফিরে দেখতে পেলাম, দাদী অনেক অসুস্থ আর কোনরকমে এই বৃদ্ধ বয়সে বাবা সংসারটা চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।সবকিছু আমার সহ্য করতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিলো।মনে হচ্ছিলো এই সব কিছু থেকে যদি পালিয়ে যেতে যদি পারতাম তাহলে বেঁচে যেতাম।কিন্তু কেউ কিচ্ছু বুঝলোনা।আমার পুরনো গল্প তাদের কাছে মিথ্যে আর বানোয়াট বলে মনে হলো।সবাই আমাকে স্বার্থপর ভাবা শুরু করে দিলো।আমি একা হয়ে গেলাম।অনেক একা হয়ে গেলাম।তাছাড়া সেদিন যখন কোন রাস্তার ভিখারি পা জাপটে ধরে আমার কাছে টাকা চাইছিলো, আমি তাকে আঘাত করতে চাইনি।কিন্তু বাধ্য হয়েছি।ওদের কি উচিত নয়, নিজের জীবনের জন্য সংগ্রাম করা।নিজের অধিকারটুকুকে পৃথিবীর কাছে থেকে ছিনিয়ে নেয়া।আর এই ঘৃণা বোধ থেকে আমি এসব করেছি।আর যদি এসব অন্যায় হয় তবে আমি অন্যায় করেছি এবং সেজন্য আমি নিজেকে নিয়ে গর্বিত।

একসময় হাত তালি দেয়া শুরু করলো ভদ্রলোকটি।চোখে তার অশ্রুজল।আর বললেন, ‘জীবন মাঠে সব বলে ছক্কা মেরেছিস।আর কি চাই! এখন আর হাসবো না দাদু।মনে হয় তোর মা তোর জন্য ডালভাত নিয়ে এখনো তোর জন্য অপেক্ষা করেন।হয়তো এখনো অপেক্ষা করছে।দাদু! অনেক হয়েছে।বাড়িতে ফিরে যাও দাদু।বিদায়।’
এরপর নিজেকে সেই জঙধরা রেলওয়ে স্টেশনে আবারো খুঁজে পেলাম।পকেটে হাত চালাতেই বুঝতে পারলাম ভাড়ার জন্য পাঁচ টাকা রয়েছে।একসময় একটা ট্রেন এসে স্টেশনে দাঁড়ালো।আবার ছেড়ে গেল একসময়।জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে এক মেয়ে।ঠিক যেন হৃদিতা।সেই হাসি মুখ, আমার পছন্দের সাদা ড্রেস পড়েছে।মেয়েটি হাত উঠিয়ে বিদায় অভ্যার্থনা জানাতেই বুঝলাম, লাল নেইল পালিশের ব্যবহার।সময়টা আবার দেখে নেবার প্রয়োজন বোধ করলাম।ঘড়িতে তাকাতেই সোডিয়াম মাখানো ঘড়ির কাটাগুলো জ্বলজ্বল করে যেন আমায় বলছে, “শুভ্র! এখন সময় সন্ধ্যা সাতটা”।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই অক্টোবর, ২০১৭ বিকাল ৫:০২
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।

লিখেছেন সাইয়িদ রফিকুল হক, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৩:১৫



ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।
সাইয়িদ রফিকুল হক

বিএনপি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে দেশে অনুষ্ঠিত “দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে”-এ অংশগ্রহণ করেনি। তারা এই নির্বাচনের বহু আগে থেকেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×