somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

মুহাম্মাদ মুজাহিদুল ইসলাম
আমার ব্যাপারে জানতে চান ?লিখা শুরু করলে তো অনেক কিছুই লিখতে হবে।সংক্ষেপে শুধু এটা জেনে রাখুন, আমি একজন 'বইপোকা'।জ্বি, আমি খুব বেশি অধ্যয়ন করি।লিখতে ভালোবাসি সেই ছোটবেলা থেকেই।এ জন্যেই ব্লগে আমার আগমন।ধন্যবাদ।

কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতি বিভ্রাটের অন্তরালে

০২ রা জুলাই, ২০১৬ রাত ১২:৩৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মূল :আলহাজ্জ সর্দার মুহাম্মদ আব্দুল হামিদ
তরজমা : মনসুর আজিজ
▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬

[খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি লিখা। অনেক আগে পড়েছিলাম। আপনাদের জন্য অনেক কষ্টে লিখাটা বই থেকে হুবহু লিখে এখানে দিলাম। সম্পূর্ণ পড়ার অনুরোধ রইলো। _ মুজাহিদুল ইসলাম]
▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬

বিখ্যাত বাঙালি কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্ম্রতি বিভ্রাটের আসল কারণটি যখন আমার মনে পড়ে,তখন আমি খুব দু:খ অনুভব করি । কবি বন্ধু মইনুদ্দীন তাঁর 'যুগস্রষ্টা নজরুল'-এ এই বিষয়টা লিপিবদ্ধ করেছেন । পরে এটা বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয় ।

আমার যদ্দুর মনে পড়ে, এটা ছিল ১৯৪৫ সালের মে মাস । তখন আমি ভারতের মালদহে মাদ্রাসা ইসলামিয়া আরাবিয়া প্রতিষ্ঠা করি । আমি এই মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলাম । মাদ্রাসার ফান্ড সংগ্রহের জন্য রশিদ বই ছাপতে আমি কলকাতায় যাই । সীল, রাবার স্ট্যাম্প সহ অন্যান্য কিছু জিনিসপত্র ক্রয় করাও ছিল উদ্দেশ্য । এর সাথে ছিল আমার 'থাম' (stop) গ্রন্থের পান্ডুলিপি । (এটার ইংরেজী শিরোনাম ছিল 'The mound';) USIS এর টাকার প্রধান তথ্য কর্মকর্তার কাছে আমি ১৯৬২ সালে নোবেল পুরস্কার প্রতিযোগিতার জন্য এটার ইংরেজী অনুবাদ পাঠিয়েছিলাম । এটা ছাপানোও উদ্দেশ্য ছিল আমার ।

সেই সময়ে কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন দৈনিক নবযুগ পত্রিকার সম্পাদক । মাওলানা আহমদ আলী ছিলেন এর সহ সম্পাদক ।
দুজনেই ভালো করে চিনতেন । কয়েকমাস আগেই আমি তাদের দুজনকে আমার গানের বই 'কুসুম' উপহার দিয়েছিলাম । কবি নজরুল ইসলাম এটার উচ্ছসিত প্রশংসা করেছেন । নবযুগ অফিস ছিল কলকাতার লায়ার সার্কুলার রোডের পশ্চিম দিকে ।

আমি মাওলানা আহমদ আলী সাহেবের সাথে দেখা করে আমার 'থাম' (stop) গ্রন্থটি নবযুগ প্রেসে ছাপানোর জন্য অনুরোধ করি।
তিনি দু:খ প্রকাশ করে বললেন, বই ছাপানো আমাদের কাজ নয় । তাছাড়া,দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বই ছাপানোর পর্যাপ্ত কাগজও বাজারে নেই । এরপর তিনি বললেন, ডিকসেন লেনে কমিউনিস্ট পার্টির কার্যালয়ের কাছে তাদের একটি প্রেস আছে । ছাপাখানায় পর্যাপ্ত কাগজও আছে । প্রেসের ম্যানেজার মনিন্দ্র নাথ (এম.এ.) একজন ভদ্র মানুষ । আমি আশা করি মনিন্দ্র বাবু আপনাকে সাহায্য করবেন ।
আমি তৎক্ষনাত মনিন্দ্র বাবুর সাথে দেখা করলাম ।Stop-এর কয়েকটি পাতা উল্টিয়েই তিনি এটা পছন্দ করে ফেললেন । বই ছাপতে ইচ্ছা প্রকাশও করলেন । আমি যেন ফাইনাল প্রুফ-টা নিজে দেখতে পারি, সেজন্য তিনি কলকাতায় আমাকে কমপক্ষে একমাস থাকার জন্য অনুরোধ করলেন । কারণ হিসেবে তিনি বললেন, বইটা মানের দিক থেকে যেমন উচু তেমনি এতে রয়েছে কঠিন কিছু বিষয় । আমি তাঁর সাথে একমত হলাম এবং বই ছাপতে তাকে পান্ডুলিপিটি দিলাম । একমাসের মধ্যে কাজটি শেষ করবেন বলে তিনি আমাকে আশ্বস্ত করলেন ।
এরপর আমি নবযুগ অফিসে গেলাম মাওলানা আহমদ আলী সাহেবের কাছে । তাকে অনুরোধ জানালাম একমাসের জন্য আমাকে একটি কাজ জুটিয়ে দেয়ার জন্য,যাতে আমি আমার ন্যুনতম ব্যয়টুকু উপার্জন করতে পারি । আমি আমার বৃদ্ধ পিতার বোঝা আর বাড়াতে চাইছিলাম না ।
তিনি আমাকে বললেন, আপনার একটি চমৎকার সুযোগ আছে । দুদিন আগেই আমাদের বার্তা সম্পাদক ভালো একটি কাজ পেয়ে ইস্তফা দিয়ে চলে যান । তিনি আমাকে আরো বললেন,আমি যেন সম্পাদকের (কাজী নজরুল) সাথে দেখা করে উক্ত পদের জন্য আবেদন করি । আমি তখনই কবির সাথে দেখা করে তাকে একটা আবেদন পত্র দেই । তিনি হাসিমুখে আমাকে সম্ভাষণ জানালেন এবং তৎক্ষনাত চাকুরিতে যোগদানের জন্য অনুরোধ করেন । নবযুগের বার্তা সম্পাদক পদে আমি সেদিনই যোগদান করি ।
সার্কুলার রোডের আমজাদিয়া হোটেলের একটি রুম ভাড়া করলাম আমি । এটা ছিল শিয়ালদহ রেলওয়ে স্টেশনের কাছে আমজাদিয়া হোটেলের একটি শাখা । আমার থাকার জায়গা থেকে নবযুগ অফিসের দুরত্ব ছিল এক মাইলের কিছু বেশি ।

দুই সপ্তাহের মধ্যে আমার বই ছাপার কাজ প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে । একদিন আমার অফিসের কাজ একটার মধ্যে শেষ হয়ে যায় । কবি নজরুলের সাথে দেখা করে চলে আসার জন্য আমি তাঁর অনুমতি চাচ্ছিলাম । তিনি আমাকে বসতে বললেন । বললেন,আপনার সাথে ধর্ম নিয়ে 'বাহাস' করতে চাই । আমি বসে পড়লাম । তিনি কথা শুরু করলেন ।
আমি বললাম,আপনি একজন বিখ্যাত কবি । তাই আপনার সাথে 'বাহাস' করতে আমি রাজি নই । কিন্তু আমাকে দয়া করে বলুন, আপমি কি জানতে চান । আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে যদ্দুর সম্ভব আল্লাহ'র মেহেরবাণীতে তা আমি আপনাকে জানাতে চেষ্টা করবো ।
তিনি আমাকে বললেন,ধর্মের ব্যাপারে আপনার অভিমত কি ? আপনি কি মনে করেন শুধু মুসলমানরাই বেহেশতে যাবে ? আমি বললাম, হ্যা । কুরআনের আলোকে আমি বিশ্বাস করি সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা:) -এর আগমনের পর পৃথিবীতে সকল ধর্মমত বাতিল হয়ে গেছে । আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেছেন _ "ان الدين عند الله الاسلام (ইন্নাদ্দীনা ইন্দাল্লাহিল ইসলাম)" অর্থ্যাৎ, ইসলামই হচ্ছে আল্লাহ'র মনোনীত একমাত্র জীবন বিধান । তাই যারা ইসলামের এই ঘোষণা শুনেছে তাদের উচিৎ ইসলাম গ্রহণ করা,যদি তারা মুক্তি চায় ।
তিনি বললেন, না । আপনি ভুল বলছেন । আল্লাহ এ আয়াতে তা বলেননি এ আয়াতে আল্লাহ বলতে চেয়েছেন সকল ধর্মের চেয়ে ইসলামই তাঁর কাছে বেশি পছন্দনীয় এবং ইসলামই হচ্ছে তাঁর কাছে পৌছার সহজ ও সংক্ষিপ্ত পথ । কিন্তু অন্যান্য ধর্মের অনুসারীগণও তাঁর কাছে পৌছবে । হয়ত পৌছুতে কিছুটা দেরী হতে পারে ।
আমি বললাম, কবি সাহেব. কিছু মনে করবেন না । আমি আপনার এ যুক্তি মেনে নিতে পারছিনা ।
তিনি বললেন, ঠিক আছে, বিষয়টা আমি আরো পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিচ্ছি । এরপর তিনি বড় একটি সাদা কাগজ টেবিলের উপ রাখলেন । আমরা বসেছিলাম মুখোমুখি । কবি যেদিকে বসেছিলেন সেদিকে সাদা কাগজের উপর কলম দিয়ে একটা 'ডট' চিহ্ন দিলেন । সেখানে 'A' ও 'B' যোগ করে সোজা একটা রেখা টানলেন কাগজটির উপর । এরপর এ সরলরেখার উভয় পাশে কিছু আঁকাবাঁকা রেখা টানলেন যেগুলোর প্রান্তনিন্দু 'A' ও 'B' তে এসে মিলিত হয়েছে । এরপর তিনি বললেন,এখানে দেখুন । মনে করুন আমার পাশের 'A', এটা একজন ব্যক্তি । আর আপনার পাশে 'B' আল্লাহকে মিন করছে । আর সোজা যে রেখাটি, সেটি ইসলাম । যে লোকটা ইসলাম অনুসরণ করছে, সে ঐ সরলরেখাটি ধরে খুব সহজে অল্প সময়ে আল্লাহ'র কাছে পৌছে যাবে । মনে করুন,বক্র রেখাগুলো অন্যান্য ধর্মকে মিন করছে । যদি লোকটি সরল পথে না গিয়ে অন্যান্য ধর্ম অনুসরণ করে বাঁকা পথে চলে, তবুও সে আল্লাহ'র কাছে পৌছুতে পারবে । কিন্তু এতে তার সময় লাগবে বেশি । এটাই আমার বক্তব্য ।
আমি বললাম, কবি সাহেব, আপনি ধর্মকে এভাবে বিশ্লেষণ করতে মৌলিক ত্রুটি করছেন । আল্লাহ কুরআনে ঘোষণা করেছেন, 'বিশ্বাস' বা 'ধর্ম' হলো 'নুর' বা 'আলো' । আপনি কি কখনো টর্চের ফোকাস লক্ষ্য করেছেন ? তিনি বললেন, হ্যা,অনেকবারই লক্ষ্য করেছি ।
আমি বললাম, ফোকাসের আলোর রেখা কি কখনো আঁকাবাঁকা পথে চ্যলে, নাকি সরল পথে চলে ? তিনি বললেন, এটা তো সব সময় সরল পথেই চলে । তিনি কিছুক্ষণ ভাবলেন । এরপর বললেন, আপনি তো চমৎকার একটা যুক্তি দেখালেন । আমিতো আলেম উলামাদের সাথে বহুবার ধর্ম নিয়ে আলাপ আলোচনা করেছি । কি. এমন যুক্তি তো তারা কেউ আমাকে দেখায়নি ! কিন্তু, আপনি নুর বা আলোর এ বিষয়টা এত সহজে কিভাবে ব্যাখ্যা করলেন ? এটা তো আমি সাধুদের রাতের বেলা ধ্যানমগ্ন অবস্থায় দেখতে পাই । যখন আমরা শ্মশ্মান বা বার্নিংঘাটে চিতার ধরে মিলিত হই ।
আমি বললাম, আপনি ধ্যানের মধ্যে যা দেখেন, সব শয়তানের কারসাজি । যদি আপনার পাশে আমার মতো একজন আলেম থাকেন, তাহলে শয়তান আপনার ধরে কাছেও ঘেষতে পারবে না । আর আপনি তেমন অদ্ভূত কিছুই দেখতে পাবেন না । নজরুল বললেন, কিন্তু আমি যখন গভীর ধ্যানে মগ্ন থাকি, তখন যেসব জিনিস দেখতে পাই, তার কি ব্যাখ্যা দেবেন আপনি ?
আমি তাকে বললাম , দয়া করে আপনি আমার সামনে ধ্যানে মগ্ন হোন । আর বলুন, আপনি কি দেখতে পাচ্ছেন । এরপর কবি চোখ বন্ধ করে মোরাকাবায় (গভীর ধ্যান) বসে গেলেন । পাঁচ মিনিট পর তিনি বললেন,(চোখ বন্ধ রেখেই ধ্যান অবস্থায় ) আমি নীল্ আলো দেখতে পাচ্ছি । আমি বললাম, এটা কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয় । আপনি ধ্যান চালিয়ে যান । আবার পাঁচ মিনিট পর তিনি বললেন, এখন আমি লাল আলো দেখতে পাচ্ছি । আমি বললাম,আপনি ধ্যান চালিয়ে যান । আরো কয়েক মিনিট পর তিনি বললেন, এখন আমি কোনো আলো দেখতে পাচ্ছি না । সবকিছুই কালো অন্ধকার । মনে হচ্ছে পুরো আকাশে কে যেন কয়লার কালি মাখিয়ে দিয়েছে ।
আমি বললাম, আমি মনে করি, সাধুরা তাদের ধ্যানের ফলে এ পর্যন্তই পৌছুতে পারে । তারা তাদের ধ্যানের দ্বারা এই কালো পর্দা আর উম্মোচন করতে পারে না । সম্ভবত : এ অবস্থাটাকেই সাধুরা তাদের হৃদয়ে 'মা কালী'র মূর্তি চিত্রিত করে নেয় । আর নিজেদেরকে তুষ্ট করে 'মা কালী'র পূজা করে । আপনার হৃদয়ে তো কালীর মূর্তি থাকার কথা নয় । সেখানে তো থাকার কথা তৌহিদের জ্যোতি । আপনি ধ্যান অব্যাহত রাখুন । আর আমাকে বলুন, এরপর কি দেখতে পাচ্ছেন । যদি আপনি এই কালো পর্দা ভেদ করতে পারেন, তাহলে আপনি দেখতে পাবেন তাওহীদের উজ্জল জ্যোতি । যার রং হবে সাদা ।
তিনি নিবিষ্ট মনে তাঁর ধ্যান অব্যাহত রাখলেন । কয়েক মিনিটের মধ্যেই তাঁর হাসিমাখা চেহারাটা বেদনায় মলিন হয়ে গেল । আর মুখমন্ডল ও কপালে জমতে লাগলো বিন্দু বিন্দু ঘামের ফোটা । দশ মিনিট পর হঠাৎ তিনি বিকট চিৎকারে চারপাশ প্রকম্পিত করে তুললেন । কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলতে লাগলেন, "হায় ! হায় ! আমি তো ধ্বংস হয়ে গেছি । আমার সবকিছু তো বরবাদ হয়ে গেল । ভুল পথ অনুসরণ করে আমি তো শেষ হয়ে গেছি । হায় , কি দুর্ভাগ্য আমার ! আমার কপালে তো জাহান্নাম ছাড়া আর কিছুই নেই ।"
তাঁর বিকট চিৎকার আর আহাজারি শুনে অফিসে কর্তব্যরত সকলেই ছুটে এলেন ।তাঁর অবস্থা দেখে সবাই হতবুদ্ধি হয়ে পড়লেন । তিনি চিৎকার করে সকলকে বললেন, বের হয়ে যাও । বের হয়ে যাও এখান থেকে । এটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত একটা ব্যাপার । এক্ষুনি বের হয়ে যাও এখান থেকে ।
সবাই বিষন্ন মনে রুম থেকে চলে গেল । কবি আমাকে দরজাটি বন্ধ করে দিতে অনুরোধ করলেন । আমি দরজা বন্ধ করে বললাম, কবি সাহেব, আপনার এই মানসিক অবস্থা থেকে পরিত্রান পাওয়া কঠিন কিছু নয় । মহান প্রভু তাঁর অনুতপ্ত বান্দাদের ক্ষমা করার জন্য সব সময় প্রস্তুত রয়েছেন ।
পড়ুন,"ওয়াস্তাগফিরুল্লাহী রাব্বি মিন কুল্লি জাম্বিউ ওয়াতুবি ইলাইহি লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহিল আলিউল আজিম ।"
এরপর পড়ুন, "লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ" । তিনি এটা কয়েকবার পড়লেন । এরপর আমি বললাম, এখন আপনি একজন সাচ্চা মুসলমান । দয়া করে আর কাঁদবেন না ।
আমি আল্লাহ'র কাছে সাক্ষ্য দেব যে, আপনি আমার সামনে পূর্ব গোনাহের জন্য অনুতপ্ত হয়েছেন । আন্তরিকভাবে তওবা করেছেন এবং আল্লাহ'র একত্ববাদের ঘোষণা দিয়েছেন । এখন থেকে আল্লাহ'র নির্দেশ অনুযায়ী প্রতিটি কাজ চালিয়ে যান । ইনশা'আল্লাহ আল্লাহ পাক আপনাকে তাঁর জান্নাতে দাখিল করবেন ।

এ সময় প্রেসের এক কর্মকর্তা এসে কবি নজরুলকে বললেন, স্যার পত্রিকার সব ম্যাটার রেডি শুধু আপনার সম্পাদকীয় বাকী আছে । দয়া করে তাড়াতাড়ি সম্পাদকীয়টা লিখে দিন । যাতে এক ঘন্টার মধ্যে আমরা ছাপার কাজ শুরু করতে পারি । কবি বললেন, আমার মনের অবস্থা ভালো নেই । এখন কোনো কিছু লেখার শক্তি ও মনোবল আমার নেই । মাওলানা সাহেবের (আহমদ আলী) কাছে যান । আজকের জন্য উনাকে সম্পাদকীয় লিখতে বলেন ।
আমি লোকটাকে বললাম, কবি মানসিকভাবে আঘাত পেয়েছেন । তাঁকে রুমের ভেতর একা থাকতে দিন । এরপর কবি বললেন, আমাকে আপনার সাথে নিয়ে চলুন । আমি আপনার সাথে আমজাদিয়া হোটেলে যাব । ওখান থেকে পরে বাসায় যাব ।
তিনি হিন্দু এলাকা শ্যামবাজারে থাকতেন । এটা হোটেল থেকে দুই মাইল উত্তর দিকে । পরের দিন অসুস্থতার জন্য কবি তাঁর অফিসে আসেননি । দ্বিতীয় দিনেও তিনি অফিসে আসেননি । আমি খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম,তাঁর অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে । কবির ডাক্তার বলেছেন । তিনি প্রচন্ডভাবে মানসিক আঘাত পেয়েছেন । এর ফলে তাঁর ব্রেনে কিছুটা ত্রুটি দেখা দিয়েছে । মস্তিস্ক বিকৃতির কিছু লক্ষণ দেখা দিয়েছে । তাই তাঁকে আলাদা একটি রুমে তালা মেরে রাখা হয়েছে । ডাক্তার তাঁর স্ত্রীকে বলেছেন, কারো সাথে যেন কবিকে কথা বলতে দেয়া না হয় । কথাগুলো শুনে আমি খুবই দু:খিত ও অনুতপ্ত হয়েছিলাম ।

পরের দিন তাঁকে দেখতে যাব বলে মনস্থ করলাম । কিন্তু, হোটেলে ফিরে এসেই বড় ভাইয়ের চিঠি পেলাম । মা মৃত্যুশয্যায় পড়ে আছেন । মা আমাকে দেখতে চান । আমি আর দেরী না করে দশটার ট্রেনে উঠে পড়লাম (নর্থ বেঙ্গল এক্সপ্রেসে) । আমি বাড়ি পৌছার পর আল্লাহ'র অশেষ মেহেরবাণীতে আম্মার অবস্থার দ্রুত উন্নতি হলো । এক সপ্তাহ পর আমি সংবাদপত্রে একটি নিউজ দেখতে পাই, কবি নজরুল ইসলাম পুরোপুরি পাগল হয়ে গেছেন । এ সংবাদটা আমাকে প্রচন্ড আঘাত দেয় । এরপর আমি নবযুগে আমার পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেই ।

কবি নজরুল ইসলাম খুব উচু মনের মানুষ ছিলেন । ইসলামের প্রতি তিনি ছিলেন সংবেদনশীল । রাজশাহী কলেজের জনৈক অধ্যাপক আমাকে নজরুলের ভ্রান্ত ধর্মমতের কারণ বলেছিলেন । বিষয়টা ছিল এরকম, কবি নজরুল তাঁর বিপ্লবী প্রতিভা, জ্বালাময়ী প্রবন্ধ আর শত শত গান-এর মাধ্যমে যখন উভয় বাংলায় জনপ্রিয়তার তুঙ্গে তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর এই জনপ্রিয়তা সমূলে উৎখাত করার জন্য ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে কার্যকরী ভূমিকায় অবতীর্ণ হন । রবীন্দ্রনাথ এমন ভান করলেন যে তিনি নজরুলের একজন কল্যানকামী ব্যক্তি । নজরুলকে তিনি তাঁর বাড়িতে দাওয়াত করলেন । এ তরুণ কবি ছিলেন তখন অবিবাহিত । ঠাকুর পরিবারের সবার সাথে নজরুলকে খোলামেলাভাবে মেশার সুযোগ করে দিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর । সেখানে এক তরুনীর দ্বারা নজরুলকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করলেন, যে ছিল ঠাকুর পরিবারের আত্মীয়া । নজরুল অবশেষে সেই হিন্দু তরুণীকে বিয়ে করলেন । বাঙালি মুসলমানগণ নজরুলের এ বিয়ে মেনে নিতে পারেনি । তাঁরা তাঁকে তীব্র ভাষায় সমালোচনা করলো ও তাঁকে বয়কট করলো ।

কবি এ পর্যায়ে এমন এক সংকটে নিপতিত হলেন, যা তাঁকে অনবরত মানসিক যন্ত্রণা দিতে থাকে । এরপর তিনি হিন্দু ধর্মের প্রতি খুব বেশি ঝুকে পড়েন । হিন্দুদের কিছু উপাসনাও তিনি করতে থাকেন হিন্দু সাধুদের সাথে মিলে । সাধুদের সাথে মেলামেশা ও আরাধনা তাঁর মধ্যে প্রভাব বিস্তার করেছিল প্রবলভাবে । যার কারণে তিনি ইসলাম সম্পর্কে বিভ্রান্তিতে পতিত হয়েছিলেন । এ জন্য পরে তিনি ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন এবং নিজেকে শোধরে নেবার চেষ্টাও করেছেন ।
মহান প্রভু তাঁর এ তওবা কবুল করুন । আর তাঁকে দান করুন বেহেশতের শ্বাশ্বত শান্তি । (আমীন) ।
________
(উৎস : The leader, 18th April,1983 Karachi, Pakistan)
সৌজন্যে : মাসিক 'নতুন কলম', আগস্ট ২০০২ সংখ্যা

সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জুলাই, ২০১৬ রাত ১২:৩৪
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ডালাসবাসীর নিউ ইয়র্ক ভ্রমণ

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:৪৪

গত পাঁচ ছয় বছর ধরেই নানান কারণে প্রতিবছর আমার নিউইয়র্ক যাওয়া হয়। বিশ্ব অর্থনীতির রাজধানী, ব্রডওয়ে থিয়েটারের রাজধানী ইত্যাদি নানান পরিচয় থাকলেও আমার কাছে নিউইয়র্ককে আমার মত করেই ভাল ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×