somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

মুক্তমনা ব্লগার
কেহ বিশ্বাস করে, কেহ করে না। যে বিশ্বাস করে সেও সত্য-মিথ্যা যাচাই করে না, যে অবিশ্বাস করে সেও না। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্নটা নির্ভর করে মানুষের খুশির উপর। ধর্মান্ধতা নিপাত যাক, মুক্তচিন্তা মুক্তি পাক।

রোহিঙ্গা সমস্যা: গ্যাঁড়াকলে বাংলাদেশ

০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:০৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দীর্ঘদিন ধরে চলমান রোহিঙ্গা সমস্যার ব্যাপকতা এখন আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশী; অথচ কেবল মিয়ানমার আর তাদের অল্পকিছু মিত্র দেশ ছাড়া আর কারও সন্দেহ নেই যে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঠেলে দেয়া সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। যারা দেশভাগের বহু আগে থেকেই কয়েক পুরুষ ধরে মিয়ানমারে বাস করে আসছে তারা কোন অবস্থাতেই বাংলাদেশী নয়। ব্রিটিশ আমলে আফ্রিকার দেশগুলোতে অভিবাসী হওয়া ভারতীয়রা যেমন আর ভারতীয় নাগরিক নয়, তেমনি রোহিঙ্গারা অবিভক্ত ভারত থেকে বার্মায় গিয়ে থাকলেও তাদের আর উপমহাদেশের কোন দেশের নাগরিক হিসাবে বিবেচনা করার সুযোগ নেই।

মিয়ানমারের সামরিকজান্তা বহুদিন ধরে গণতন্ত্রকামী নেত্রী সু চিকে গৃহবন্দী করা রাখার পর আন্তর্জাতিক চাপে পড়ে তাঁকে দেশ শাসনে সম্পৃক্ত করেছে। তবে শাসন আঙ্গিকে কিছু পরিবর্তন হলেও রোহিঙ্গা নির্মূলের ছক ও তা বাস্তবায়নের ধারায় কোন পরিবর্তন আসে নি। এমন কি শান্তিতে নোবেল জয়ী সু চিকে আগে রোহিঙ্গাদের প্রতি সহানুভূতিশীল মনে হলেও আমরা এখন তাঁর ভিন্ন চরিত্র দেখছি। স্বেচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক তিনি এখন কেবল সামরিক নেতৃত্বের ‘শিখণ্ডী’ মাত্র। বাইরে শান্ত-সমাহিত, ‘ভাজা মাছ উল্টে খেতে অপারগ’ ভাব দেখালেও তাঁর সাম্প্রতিক বক্তব্যগুলোতে মিথ্যাচার, তথ্যের গরমিল আর সময়ক্ষেপণের চেষ্টা স্পষ্ট। তাঁর বক্তব্যের সুর ধরে বলা যায় যে মিয়ানমারের নেতৃত্ব ভাবছে এখন এটা-সেটা বলে কিছুদিন কাটিয়ে দিতে পারলে সময়ের সাথে সাথে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার জন্য আন্তর্জাতিক চাপ কমে আসবে। তাতে সাপও মরবে, আবার লাঠিও ভাঙ্গবে না।

মিয়ানমার চায় রোহিঙ্গা-মুক্ত রাখাইন। যদিও ঐতিহাসিকভাবে এই তৎপরতার একটি মুসলিম-বিরোধী চরিত্র রয়েছে, দেখা যাচ্ছে যে সাম্প্রতিক সহিংসতায় কেবল রোহিঙ্গা মুসলিমরাই নয় হিন্দুরাও নির্যাতিত। বোঝাই যাচ্ছে, মৌলবাদী ধর্মীয় নেতাদের মনে যে বৌদ্ধ মিয়ানমার গড়ার আকাঙ্ক্ষা রয়েছে, সেনা-সমর্থিত সরকার তারই প্রতিফলন ঘটাতে চাইছে। সামরিক সরকার মিয়ানমারের শাসনক্ষমতা দখল করার পর রোহিঙ্গাদের রাখাইন-ছাড়া করতে যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছে সেগুলো অত্যন্ত সুপরিকল্পিত এবং দীর্ঘমেয়াদী। দেশটির স্বাধীনতালাভের পরপর রোহিঙ্গাদের রাজনীতিতে অংশ নেয়ার সুযোগ থাকলেও ষাটের দশকে সামরিক সরকার ক্ষমতায় আসার পর তাদের সবধরনের নাগরিক অধিকার কেড়ে নেয়, একাংশকে নাজী কায়দায় মৌলিক সুবিধা-হীন ক্যাম্পে বন্দী করে রাখে, যথেচ্ছা অগ্নিসংযোগ, হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ চালিয়ে বাকিদের বাংলাদেশে (ক্ষেত্র-বিশেষে ভারতে কিংবা মালয়েশিয়ায়) পালিয়ে যেতে বাধ্য করে। বেশ কিছু ঘটনার পর্যবেক্ষণে রোহিঙ্গা-নির্মূলের ছকটি পরিষ্কার — ১) চরম অমানবিক আচরণ করে রোহিঙ্গাদের দেশ ছেড়ে (মূলত বাংলাদেশে) যেতে বাধ্য করা, ২) এরপর যতটা সম্ভব সময়ক্ষেপণ, ৩) আন্তর্জাতিক চাপ বেড়ে গেলে সুর নরম করে কিছু শরণার্থী ফিরিয়ে নেয়া বা নেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া, ৪) কিছুদিন ‘যেখানে যে অবস্থায় আছে’ পরিস্থিতি বজায় রেখে ঘটনার পুনরাবৃত্তি। দেখা যাচ্ছে, যে হারে শরণার্থীদের তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে, ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে তার একটা ভগ্নাংশ মাত্র। কখনও আবার ফিরিয়ে নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা রক্ষা করা হয় নি। এবার লাখ লাখ রোহিঙ্গার বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের পর অতি সম্প্রতি সু চিও যাচাই-বাছাই করে “কিছু” রোহিঙ্গা ফিরিয়ে নেয়ার কথা বলেছেন। এভাবে চলতে থাকলে রাখাইন প্রদেশ রোহিঙ্গা-মুক্ত করার অশুভ পরিকল্পনা যে অচিরেই বাস্তবায়িত হয়ে যাবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

কিন্তু, এই সংকট বাংলাদেশ কিভাবে সামলাচ্ছে?

গরীব দেশ হওয়া সত্ত্বেও শরণার্থীদের (সরকার বলছে অনুপ্রবেশকারী) আশ্রয় দেয়ায় বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে বেশ পিঠ-চাপড়ানিই পেয়েছে। তবে সাম্প্রতিক ঘটনা প্রবাহে বোঝা যাচ্ছে যে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের দীর্ঘ-মেয়াদী পরিকল্পনা বেশ দুর্বল ছিল। ব্যাপকহারে শরণার্থী প্রবেশ করলে কি করা হবে সে বিষয়ে দায়িত্বশীল নেতৃত্বের আদৌ কোন পরিকল্পনা ছিল বলে মনে হয় না। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা দেখেছি যে শুরুতে শরণার্থীদের সীমানা পেরুতে বাঁধা দেয়া হলেও পরবর্তীতে হটাত সীমান্ত খুলে দেয়া হয়। ত্রাণ কার্যক্রম শুরু হতে বহু সময় লেগে যায়, যা এখনও কোন সুনির্দিষ্ট ছকে বাঁধা যায় নি। কোন এক অজ্ঞাত কারণে রোহিঙ্গাদের নিবন্ধনের ব্যবস্থা আগে করা হয় নি যার সুযোগ নিয়ে রোহিঙ্গারা অবধারিতভাবেই মূল জনগোষ্ঠীতে মিশে গিয়েছে। এবার শরণার্থীদের ঢল নামার পর অনেক দেরীতে হলেও ধীর গতিতে নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু হয়েছে, সেনাবাহিনীকে শরণার্থী শিবির নির্মাণ আর ত্রাণ বিতরণের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তবে এই শরণার্থীদের কোথায় রাখা হবে, সীমান্ত-সংলগ্ন এলাকাতেই, নাকি অন্য কোথাও তা নিয়ে এখনও বিতর্ক চলছে।

আন্তর্জাতিকভাবে মিত্রদের পাশে আনার চেষ্টাতেও প্রাথমিক জড়তা কাটাতে বাংলাদেশ অনেক সময় নিয়েছে। চীন আর রাশিয়া যে মিয়ানমারের পাশে থাকবে তা অনুমিতই ছিল। কিন্তু মিয়ানমার সফরে গিয়ে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী এই ইস্যুতে সুস্পষ্টভাবে নেপিডোর পাশে থাকার ইঙ্গিত করায় ঢাকা আকস্মিকভাবে বেকায়দায় পড়ে যায়। সরকার ভারতের সাথে বিভিন্ন দ্বি-পাক্ষিক ইস্যুতে ‘খোলা মনের’ পরিচয় দিয়ে আসার পরেও ‘বন্ধু’ দেশের এই আচরণ আশা করে নি। সরকারী দলের কেউ কেউ সমর্থন পাওয়া যাবে এমন আশা দেখিয়ে ম্লানমুখে মিনমিনে বিবৃতি দিলেও ভারত কিছু ত্রাণ, হাসিমুখ, আলিঙ্গন আর পাশে থাকার মৌখিক আশ্বাস দিয়েই আপাতত বন্ধুত্বের দায়ভার মিটিয়েছে। অবশ্যই এক্ষেত্রে ভারত নিজ স্বার্থে যা করা উচিত তাই করেছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কোন ‘লাইলী-মজনু’ প্রেম কাহিনী বা ‘অবুঝ মন’ ছবির অতিনাটকীয় বন্ধুত্বের গল্প নয়; ভারত তা ভালভাবে বুঝলেও বাংলাদেশ বুঝতে পারছে কিনা প্রশ্ন সেটাই। পাকিস্তান বরাবরই চীনের ক্ষমতা-বলয়ে ছিল; মিয়ানমারও চীনের বলয়ে। চীন চাইছে ভারতের বাকি প্রতিবেশীদের উপরেও প্রভাব বিস্তার করতে; শ্রীলংকা, নেপালে সে চেষ্টা জোরদার। বিএনপি-জামাত আমলে বাংলাদেশও চীনের দিকে ঝুঁকে ছিল। স্বভাবতই: চীন থেকে অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তিতে অনেকটা পিছিয়ে থাকলেও উঠতি শক্তি ভারতের জন্য নিকট-প্রতিবেশীদের উপর চীনের এই প্রভাব যথেষ্ট মাথা ব্যথার কারণ। ভারত যৌক্তিকভাবেই চেষ্টা করছে প্রতিবেশীদের হাতে রেখে অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক গড়ে তুলে লাভবান হতে, আর সেই সাথে চীনের প্রভাব কমাতে। বিশেষত: খনিজে সমৃদ্ধ মিয়ানমার যখন একটি ফলবতী গাছ; মালীর (চীন) চোখ এড়িয়ে দু’এক ফল চেখে দেখার সুযোগ নিতে চাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে প্রভাবশালী প্রতিবেশীরা সরাসরি মিয়ানমারের পক্ষ নেয়ায় বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে। আগের তুলনায় দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি চোখে পড়ার মতো। খাদ্য,বস্ত্রের সহজলভ্যতা সাধারণ মানুষের জীবন যাত্রার মান বাড়িয়েছে। নারীর ক্ষমতায়ন ঘটেছে, শিক্ষার হার বেড়েছে, স্বাস্থ্যখাতেও দেশ এগিয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ব্রান্ড তার প্রাপ্য স্বীকৃতি পেয়েছে। এতসব অর্জনের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও বাংলাদেশের প্রভাব বেড়ে যাওয়ার আশা করাটা খুব অনুচিত ছিল না। কিন্তু সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণ নির্দেশ করে যে তা ঠিক সেভাবে ঘটে নি। আমরা কি নিজেদের এতোটাই সহজলভ্য আর আপোষ-কামী করে তুলেছি যে আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছি? প্রশ্ন উঠতেই পারে যে কেবল ভারতের সাথে সম্পর্কের উন্নতিকে ‘বুলস আই’ বানিয়ে আমরা আমাদের সব ডিম এক ঝুড়িতে রাখার ঝুঁকি নিচ্ছি কিনা। চীনের কাছ থেকে সামরিক সরঞ্জাম কেনার কথা ওঠার পর ভারত তড়িঘড়ি করে তাদের সেনাপ্রধানকে বাংলাদেশ পাঠিয়েছে, ভারত থেকে সরঞ্জাম কেনাসহ প্রতিরক্ষা সহযোগিতার চুক্তি করিয়েছে। এখন মিয়ানমারে ভারতীয় অস্ত্র বিক্রির কথা উঠেছে; এই উদ্যোগ কি বাংলাদেশকে নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ফেলবে?

আমাদের প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘ থেকে দেশে ফিরেই রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত আর চীনের অবস্থান গ্রহণযোগ্য নয় বলে জানিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু এই দেশ-দুটির এক্ষেত্রে আমাদের মতামত বা উদ্বেগকে গুরুত্বের সাথে নেয়ার সম্ভাবনা কম। ভারত এখন পর্যন্ত রাখাইন প্রদেশে চলমান ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘন সম্পর্কে নিন্দা করা দূরে থাক, উদ্বেগ জানাতেও অস্বীকার করেছে। এর পেছনে কেবল মিয়ানমার সরকারের সাথে সম্পর্কের উন্নতিই নয় ভারতের আভ্যন্তরীণ সমস্যাও রয়েছে। ভারতের পূর্ব-সীমান্তের রাজ্যগুলোর সীমান্ত এলাকায় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ঘাঁটিগুলো ধ্বংস করতে মিয়ানমার সাহায্য করেছে। ভবিষ্যতেও এধরনের সাহায্য ভারতের দরকার হতে পারে। এছাড়া মানবাধিকার ইস্যুতে মিয়ানমারের সমালোচনা করলে ভারতে যে চল্লিশ হাজার রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে তাদের মিয়ানমারে ঠেলে পাঠানোর পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সমস্যা হতে পারে। এর মধ্যেই ভারতের সুশীল সমাজ এই পরিকল্পনার প্রতিবাদ জানিয়েছে। আদালতে এই পরিকল্পনার বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারতের অবস্থানে আকস্মিক নাড়া খেলেও বাংলাদেশের জন্য আসল সমস্যা চীন। দেশটি নেহায়েত দায়ে না পড়লে মানবাধিকার বা আন্তর্জাতিক রীতি-নীতির ধার তেমন একটা ধারে না। উত্তর কোরিয়া, মিয়ানমারের মত দেশগুলোর নিপীড়ক সরকারগুলোকে হাতে রেখে আঞ্চলিক প্রতিপত্তি বজায় রাখা দেশটির পররাষ্ট্রনীতির অংশ। সমস্যা আরও জটিল হয়েছে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হিসাবে দেশটির ভেটো দেয়ার ক্ষমতায়। সেজন্যই বাংলাদেশের দেয়া প্রস্তাব মতো জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে আরাকানে রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপত্তা-অঞ্চল গড়ে তোলার প্রস্তাবটির হালে পানি না পাওয়া একরকম নিশ্চিত।

দেখা যাচ্ছে যে মিয়ানমার দীর্ঘদিন ধরেই রোহিঙ্গা খেদানোর একটি পরিকল্পনা দাঁড় করিয়েছে। গত বিশ-পঁচিশ বছরে তারা বাংলাদেশের তুলনায় তাদের সামরিক সামর্থ্য, জনবল এবং সরঞ্জাম উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বাড়িয়েছে। ধর্মীয় সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগিয়ে জনগণের ভেতর রোহিঙ্গা-বিরোধী মনোভাব আরও উসকে দিয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা তারা কেবল চীন বা রাশিয়ার মতো শক্তিশালী মুরুব্বীই যোগাড় করেনি, বাংলাদেশের স্বাভাবিক ‘বন্ধু’ ভারতকেও নিজের পাশে নিতে পেরেছে। যখনই সুযোগ পেয়েছে তারা রোহিঙ্গাদের ঠেলে বাংলাদেশে পাঠিয়েছে। এরপর বড় সুযোগটি নিয়েছে যেদিন আনান কমিশন প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। সেদিন পুলিশ ও সেনা-চৌকিতে হামলার পরপরই রোহিঙ্গাদের উপর সর্বশেষ কেয়ামত নেমে আসে, যা এখনও চলছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে রোহিঙ্গা বিচ্ছিন্নতাবাদীরা হামলার জন্য সেদিনটিই বেছে নিলো কেন? কিভাবে এই হামলা রোহিঙ্গাদের স্বার্থ রক্ষা করেছে? আসলে কারও পরিকল্পনা যদি এতে উপকৃত হয় তা মিয়ানমারের সেনা-সমর্থিত সরকারের। রোহিঙ্গাদের মধ্য থেকে সুবিধাবাদী ‘থাব্বে’ (রাজাকার) নিয়োগ করা মিয়ানমার সেনাবাহিনীই যে এই হামলায় জড়িত ছিল না তা নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই। আবার তৃতীয় পক্ষ পাকিস্তানের আইএসআইও এই কাণ্ড ঘটিয়ে থাকতে পারে। সংস্থাটি এই ধরনের কাজে যে সিদ্ধহস্ত তার বহু প্রমাণ আছে।

মিয়ানমার যেভাবে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে তাদের পরিকল্পনার বাস্তবায়ন করেছে, আমরা এর পালটা ব্যবস্থা হিসাবে আভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সেভাবে সক্রিয় হতে পারি নি। আমরা মূলত মিয়ানমারের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তোলার দিকেই মন দিয়েছি। সাংস্কৃতিক/ শিল্পী দলকে মিয়ানমারে পাঠিয়েছি, ওদের প্রাকৃতিক দুর্যোগে ত্রাণ পাঠিয়েছি, এমনকি ওরা আমাদের বিজিবি জওয়ানের কান কামড়ে ছিঁড়ে দিলেও আমরা ওদের অপহৃত সৈনিকদের উদ্ধার করে সুচিকিৎসা দিয়ে দেশে ফেরত পাঠানো ব্যবস্থা করেছি। এগুলো সবই আমাদের উদার জাতিসত্তার পরিচায়ক; কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে যে কেবল দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্কের উন্নতিই নয়, আমাদের পরিকল্পনায় আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপাদান সক্রিয়ভাবে বিবেচনায় রাখা উচিত ছিল।

ছাপা এবং সামাজিক মাধ্যমসহ অন্যান্য যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে চোখ রাখলে দেখা যায় যে দেশের জনগণ এই ইস্যুতে বরাবরের মতো দেশপ্রেমের পরিচয় দিয়েছে এবং মোটামুটিভাবে সরকারের মানবতাবাদী আচরণ সমর্থন করেছে। আসলে এধরনের জাতীয় সংকট নিয়ে রাজনীতি করার সুযোগ খুব কমই থাকে। তবুও বলতে হয় যে এই সংকটকে সামনে রেখে জাতীয় ঐক্য গড়ার যে সুযোগ ছিল, আমাদের প্রধানমন্ত্রী তা নিতে পারেন নি; বরং তাঁর কিছু প্রগলভ সহযোগী এখনও মাজা-ভাঙ্গা ধরাশায়ী বিএনপি-জামাত নিয়ে পড়ে আছেন। ভেবে দেখতে হবে যে সরকার কেবল বিরোধী দলের ভাঙ্গা মাজা আরও বেশী করে ভাঙ্গতে গিয়ে অতি জরুরী বিষয়গুলো ভুলে যাচ্ছে কিনা।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ ভালই গ্যাঁড়াকলে পড়েছে। কূটনৈতিক তৎপরতা ছাড়া অন্য কোনভাবে এই সমস্যার সমাধানের উপায় আপাতত: বাংলাদেশের সামনে নেই। সু চি তাঁর শেষ সাক্ষাৎকারে আনান কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের ইঙ্গিত দিয়েছেন, যা এখনও কিছুটা আশার আলো দেখায়। বাংলাদেশকেও এই কমিশনের সুপারিশগুলোকে সামনে রেখেই বন্ধু দেশগুলোকে নিয়ে তৎপরতা চালিয়ে যেতে হবে। মিয়ানমারসহ প্রভাবশালী দেশগুলোকে বোঝাতে হবে যে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে দীর্ঘসময় শরণার্থী-শিবিরে অবস্থান করলে আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদ এই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করবে, যা এই অঞ্চলের কোন দেশের জন্যই ভাল হবে না। তবে সেই সাথে এও মাথায় রাখতে হবে যে দেশ ছেড়ে চলে আসা রোহিঙ্গারা হয়তো আর কখনও মিয়ানমারে ফেরত যাবেন না। সেক্ষেত্রে তা বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ব্যর্থতা হলেও কিভাবে এই অনাকাঙ্ক্ষিত অবস্থাকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করা যায় তা ভেবে দেখার সময় এখনই।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:০৬
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ডালাসবাসীর নিউ ইয়র্ক ভ্রমণ

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:৪৪

গত পাঁচ ছয় বছর ধরেই নানান কারণে প্রতিবছর আমার নিউইয়র্ক যাওয়া হয়। বিশ্ব অর্থনীতির রাজধানী, ব্রডওয়ে থিয়েটারের রাজধানী ইত্যাদি নানান পরিচয় থাকলেও আমার কাছে নিউইয়র্ককে আমার মত করেই ভাল ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×