somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিশ্বজিত, আপনার কাছে মাফ চাওয়াও যে অপরাধ, কীভাবে বলি আপনি আমাদের ক্ষমা করবেন!

১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১২ সকাল ৭:৩৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বিশ্বজিত। ২৪ বছরের এক টগবগে তরুন। বাংলাদেশের গড় প্রত্যাশিত আয়ুর হিসেবেও যার কমপক্ষে আরো ৪৫ বছর বেঁচে থাকবার কথা, আরো ৪৫ বছর ধরে প্রিয় বন্ধু, প্রিয় মানুষ, নিকটজনের কাছে ছুটে যাবার কথা, প্রিয় মানুষের আড্ডায় নিমগ্ন হওয়ার কথা, শুধু একবার নয়; বারবার। যার আরো দীর্ঘ সময় ধরে মা ডাকবার কথা, বাবা ডাকবার কথা, বাবা-মা-ভাই-বোন বন্ধুর প্রিয় মুখে 'বিশ্বজিত' নামে ডাক শোনার কথা, জীবনের প্রাত্যাহিক ব্যাকরণে হাসি-আনন্দ-বেদনায় উদ্বেলিত হওয়ার কথা, যার ভালবাসবার কথা; ভালবাসা পাওয়ার কথা, প্রিয় মানুষের প্রিয় চোখে চোখ রেখে 'ভালবাসি' বলবার কথা, বুকে আগলে রাখা স্বপ্নগুলোকে পরিশ্রম আর সৃজনশীলতা দিয়ে একটু একটু করে জয় করবার কথা-তরুন বিশ্বজিতের জীবনের এ রকম অসংখ্য ধারাবাহিক সম্ভাবনাময় 'কথা'র যবনিকা ঘটেছে মাত্র দশ মিনিটের রাজনৈতিক গুন্ডামিতে। প্রকাশ্যে দিনের আলোয়। তাও বিশ্বজিতের মতো অসংখ্য মানুষের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ করের টাকায় বেতনভূগী আইন-শৃঙ্খলার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ বাহিনীর সামনেই। আওয়ামীলীগ-বিএনপির ক্ষমতা দখলে রাখা-না রাখার ধারাবাহিক রাজনৈতিক গুন্ডামি আর বিভৎসতার এক করুণ শিকার এ বিশ্বজিত। কিন্তু শেষ শিকার সম্ভবত নয়; আমি, আপনি, আমরা, আপনারা যে কেউ যেকোন সময় এ নষ্ট রাজনীতিকদের নষ্টামিতে নিমিষেই 'বিশ্বজিত' হয়ে যেতে পারি। বিশ্বজিতের খবর পড়তে পড়তে উঠে আসতে পারি খবরের শিরোনামে। নতুন কোন 'বিশ্বজিত' হয়ে।
জানি না বিশ্বজিতের বাবা-মা অর্থ জেনেই তার নাম বিশ্বজিত রেখেছিলেন কিনা। তবে বিশ্বজিত যে, তার অর্থনৈতিক প্রান্তিকতাকে পরাভূত করে অপেক্ষাকৃত একটি স্বচ্ছল জীবন চেয়েছিলেন তার জন্য, তার পরিবারের জন্য, এবং প্রত্যাশিত সে স্বচ্ছল জীবনকে জয় করার স্বপ্নেই তার শৈশবের গ্রামীণ শ্যামলিমাকে পেছনে ফেলে একদিন ঘর থেকে বের হয়ে এসেছিল, বাবা-মা এবং শৈশবের বন্ধুদের ছেড়ে। তারপর ঢাকার ইট-পাথরে ঢাকা এ নাগরিক জীবনে পা রেখেছিলেন তা কাউকে জিজ্ঞেস না করেও বলা যায়। জনবিজ্ঞানের স্থানান্তর বা মাইগ্রেশন প্রক্রিয়ায় এ মহানগর প্রতিনিয়ত মানুষকে টেনে আনে তার বুকে। গ্রামে দারিদ্র্য আছে বলেই এ মহানগর প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি শ্রমজীবী মানুষে ঠাসা হয়ে থাকে প্রতিদিন-প্রতিনিয়ত। মাইগ্রেশনের 'পুল ফ্যাক্টর ও পুশ ফ্যাক্টর' এর দোলাচলে বিশ্বজিতরাও দুলতে থাকেন। দুলতে দুলতে শেকড় ছাড়া হয়। বিশ্বজিতরা ভিটেমাটি ছাড়ে। ঘরবাড়ি ছাড়ে। এ ছাড়াছাড়ির জীবনে এক সময় জীবনটাই বিশ্বজিতদের ছেড়ে চলে যায়। রাজনৈতিক গুন্ডাদের হাতে। তাতে নষ্ট রাজনীতির, নষ্ট রাজনীতিকদের কিছুই যায় আসে না। জামাত-জাতীয় পার্টি, বিএনপি-আওয়ামী লীগ-কারোরই না। বরং এক একজন বিশ্বজিত তার আগের বিশ্বজিতের স্মৃতিকে ঢেকে দেয়; আড়াল করে দেয়; মুছে দেয় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু থেকে। যেমন তাজরিন ফ্যাশনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া ১১১ জনের স্মৃতি ফিকে হতে বসেছে বিশ্বজিতের স্মৃতির নিচে। তারপর একদিন বিশ্বজিত এর স্মৃতিও ফিকে হয়ে যাবে। হারিয়ে যাবে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু থেকে। জনস্মৃতি থেকে। ঠিক একই নিয়মে।
বিকৃত রাজনৈতিক কাঠামোয় আর রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় এক একটি লাশ নষ্ট রাজনীতির জন্য আশীর্বাদ হয়ে উঠে। সামজিক স্তরায়নের তলায় অবস্থানকারী লাশ হয়ে যাওয়া শ্রমজীবী মানুষকে নিজের দলে টানার চেষ্টা চলে। লাশ দখলের কসরত হয়। বিশ্বজিতকে নিয়েও এ কসরত হয়েছে। বিএনপি প্রথমে তাকে নিজেদের কর্মী বলে দাবি করেছিল। বিএনপির দুর্ভাগ্য। এবার এ দাবিটিকে সফল করে তুলতে পারে নি। আর পারেনি বলেই পরবর্তী হরতালের কর্মসূচিতে বিশ্বজিত তাদের এজেন্ডাভুক্ত হয়নি। অন্তত জোরালোভাবে। ফলে মির্জা ফখরুলের গ্রেফতার যতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে ঠিক ততটাই বা তার চেয়ে বেশি বিপ্রতীপ প্রক্রিয়ায় গুরুত্বহীন হয়ে উঠেন বিশ্বজিত। বিশ্বজিতের মৃত্যু এবং তার খুনের ঘটনা।
বিশ্বজিতকে যেদিন চাপাতির কোপ আর পিটিয়ে হত্যা করছে ছাত্রলীগ এর কর্মীরা ঠিক তারপর দিন সারা বিশ্বে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস পালিত হয়েছে। বিশ্ব মানবাধিকার দিবসে বিশ্বজিতের খুন কার্যকরীর ’রাজনৈতিক গুন্ডামি’র বিভৎসতা শিরোনাম হয়েছে প্রতিটি সংবাদপত্রের পাতায়। বাংলাদেশের মাবাধিকার পরিস্থিতির কঙ্কাল হয়ে বিশ্বজিত দৃশ্যমান হয়েছে বিশ্বমিডিয়ায়। তাও আবার আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের মাসে। বিশ্বজিত যেদিন খুন হয়েছেন সেদিনতো কোন হরতাল ছিল না; ছিল রাজপথ অবরোধের কর্মসূচি। হরতাল হলে বিশ্বজিত বের হতেন কি না জানি না। হয়তো হতেন না। কিন্তু অবরোধ ছিল বলেই হয়তো বিশ্বজিত ভেবেছিলেন পায়ে হেটে গিয়ে দোকান খুলবেন। জানি না কোন কাস্টমারের কাছে বিশ্বজিতের কাজ ডেলিভারির অঙ্গীকার ছিল কি না। হয়তো ছিল। হয়তো ছিল না। কিন্তু একজন সৃজনশীল কর্মঠ মানুষ হিসেবে বিশ্বজিত নিশ্চই তার হাতের কাজটুকু আরেকটু এগিয়ে রাখতে চেয়ে ছিলেন। জীবন-সংগ্রামে আরেকটু এগিয়ে থাকতে চেয়েছিলেন।
বিশ্বজিত কোন রাজনৈতিক দলের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না। এটি নিশ্চিত করেছে বিশ্বজিত এর পরিবার ও তার কাছের মানুষজন। কিন্তু বিশ্বজিত হয়তো ভোট দিয়েছেন। গত নির্বাচনে। নির্বাচনকেন্দ্রীক তথাকথিত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় কাউকে হয়তো সমর্থন করতেন। যদি সেটি হয় তবে তারতো আওয়ামী লীগেরই পক্ষে থাকার কথা। পত্রিকায় বিশ্বজিতের পরিবারের যেটুকু পরিচিতি জানা গেছে তাতে বলা যায়, বিশ্বজিত না হোক, অন্তত তার পরিবারের কেউ না কেউ নোকায় ভোট দিয়েছে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হওয়ায় খুশী হয়েছে। বিশ্বজিতের উপর যখন হামলা হয় তখন নাকি তিনি বারবার বলেছিলেন-’আমি হিন্দু’। বিএনপি-জামাতের কর্মীদের কাছে বিশ্বজিত নিশ্চই বলতেন না- আমি হিন্দু। ধারণা করি ছাত্রলীগ এর কর্মী দেখেই তিনি নিজের ধর্মীয় পরিচয় দিয়ে ছিলেন। আর নিশ্চই আশা করেছিলেন যে, হিন্দু পরিচয়ে ধর্মনিরপেক্ষ দাবিদার ছাত্রলীগ তার প্রতি সদয় হবে। এই যে একজন নাগরিকের স্বাভাবিক নাগরিক পরিচিতির বাইরে গিয়ে নিজের ধর্মীয় পরিচিতির মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকবার শেষ আকুতি প্রকাশ, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে কোন নাগরিকের মুখেই এ রকম আকুতি উচ্চারিত হওয়ার কথা নয়। অথচ বিশ্বজিতকেই সেটি করতে হলো। শুধু বেঁচে থাকাবার প্রত্যাশায়।
বিশ্বজিত তো এ রাষ্ট্রের কাছে, শাসকদের কাছে, প্রধানমন্ত্রীর কাছে, বিরোধীদলের নেত্রীর কাছে, রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে কিছুই চায়নি । সম্ভবত কোনদিন কখনও না। এমনকি একটি চাকরিও না। বরং দর্জি দোকানের কারিগর হিসেবে কাজ শুরু করে রাষ্ট্রকে তার জীবিকা নিশ্চিত করার দায় মুক্তি দিয়েছে। আর শুধু বেঁচে থাকতে চেয়েছে। নিজের মতো করে। নিজের কাজের মাধ্যমে। কিন্তু নীতি-আদর্শহীন চলমান ভুল রাজনীতির জন্য সেটিও সম্ভব হলো না।
আমাদের শাসকগোষ্ঠী, রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা তো দুরে থাক, আমি-আপনি, আমরা কেউ হয়তো বেশি দিন বিশ্বজিতকে মনে রাখবো না। আমাদের মনে রাখা না রাখা নিয়ে এখন না-ফেরার জগতের বিশ্বজিতের কিছুই যায় আসে না। কিন্তু যারা বিশ্বজিতের খুব কাছের মানুষ, আপনজন, বিশ্বজিতের মা, ভাই-বোন, আত্বীয়-স্বজন, তারা কীভাবে ভুলবেন এ দু:সহ রক্তাক্ত স্মৃতি। যে স্মৃতির জন্ম আবার বাঙালির রক্তাক্ত বিজয়ের মাসে। বিশ্বজিতের আয়ের উপর যেসব মানুষরা নির্ভরশীল ছিলেন তারাতো প্রতিদিনের টানাপোড়নের মধ্যেই প্রতিটি মুহুর্তে টের পাবেন যে, তাদের প্রিয় বিশ্বজিত নেই। যেমনটি তাজরিন ফ্যাশনের আগুনে অঙ্গার হয়ে যাওয়া ১১১ জন শ্রমিকের কাছের মানুষরাও ভুলতে পারছেন না তাদের প্রিয় মেয়ে, স্ত্রী, ভাই, প্রিয়তমা, স্বামী, মা অথবা বাবাকে। বিশ্বজিত, আপনার কাছে মাফ চাওয়াটাও যে অপরাধ, কীভাবে বলি নাগরিক হিসেবে আমরা আপনার খুনের প্রতিবাদ করতে পারিনি। আপনি আমাদের ব্যর্থতাকে ক্ষমা করবেন।


২টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:৩২

খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।

পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

একমাত্র আল্লাহর ইবাদত হবে আল্লাহ, রাসূল (সা.) ও আমিরের ইতায়াতে ওলামা তরিকায়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:১০



সূরাঃ ১ ফাতিহা, ৪ নং আয়াতের অনুবাদ-
৪। আমরা আপনার ইবাদত করি এবং আপনার কাছে সাহায্য চাই।

সূরাঃ ৪ নিসার ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×