গতকাল বিকেল। তখনও অফিস সময় শেষ হয়নি। নিয়ম অনুযায়ী তখনও দু’ঘন্টা বাকি। কিন্তু সহকর্মীদের মধ্যে একটি জোট তৈরি হয়ে গেল। দলবেঁধে যাওয়া হবে। কোথায়? শাহবাগে। যার নতুন নাম এখন শাহাবাগ স্কয়ার। কেউ বলছেন শাহবাগ চত্ত্বর। ৭১ এর যুদ্ধাপরাধী, খুনী ও মানবতাবিরুধী অপরাধে যাবজ্জ্বীবন দন্ডপ্রাপ্ত জামাতের কেন্দ্রীয় নেতা কাদের মোল্লার ফাঁসীর দাবিতে জেগে উঠা দেশপ্রেমিক তারুন্যের উচ্ছলতা আর প্রচন্ড প্রতিবাদের গর্ভ থেকে জেগে উঠা এ এক নতুন জমিন। প্রতিবাদ-প্রতিরোধের নতুন ক্ষেত্র। নতুন ঠিকানা। দেশ মাতৃকার প্রতি গভীর মমতাবোধ, ভালবাসা আর অগ্রজদের প্রতি দায়বোধ থেকে এ এক নতুন দ্রোহের জন্ম। আর এ দ্রোহের সাথে, প্রতিবাদের সাথে, প্রতিরোধে যুক্ত হওয়ার গভীর বাসনার প্রতিফলন হচ্ছে অফিসের রুটিন কাজ ফেলে শাহবাগের উদ্দেশ্যে যাত্রা করা। একজন সহকর্মী বললেন, একাত্তুর দেখিনি। যুদ্ধে যেতে পারিনি। সে অভিজ্ঞতা নিজ চোখে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। আজকের তরুন প্রজন্ম হিসেবে এটি আমাদের জন্য নতুন সুযোগ। নতুন সম্ভাবনা। নতুন এক একাত্তুরকে খুব কাছ থেকে অনুভব করা। অযুত কন্ঠে জানান দেয়া যে, কাদের মোল্লা সহ সকল যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসী চাই-ই-চাই।
শান্তি ও দ্রোহের এক অভাবিত সম্মিলন ঘটেছে আজ শাহবাগে। শাহবাগ হাটতে শুরু করেছে শাহবাগের সীমানা থেকে। হাটতে হাটতে শাহবাগ পৌছে যাচ্ছে পরীবাগ-বাংলামোটর, কাকরাইল, ফার্মগেট। শাহবাগ পৌছে যাচ্ছে রমনা। তারপর শাহবাগ থেকে জন্ম নিচ্ছে নতুন শাহবাগ; চট্রগ্রাম, বগুড়ায়, রাজশাহী, বরিশাল, সিলেট, রংপুর, সবখানে। গোটা বাংলাদেশ আজ যেন শাহবাগ। প্রতিবাদী শাহবাগ। টগবগে শাহবাগ। তারুন্যের শাহবাগ। নতুন মুক্তিযুদ্ধের শাহবাগ। শাহবাগ তোমায় বিনম্র অভিনন্দন।
যুদ্ধাপরাধ এর বিচার বন্ধে সক্রিয় প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী খুব সচেতনভাবে অনেক দিন থেকে বলে আসছিল যে, আজাকের তরুন-তরুনীর কাছে ৭১ এর কোন আবেদন নেই। যুদ্ধাপরাধ এর বিচার নিয়ে তারা ভাবিত নয়। বরং ৪০ বছর পর এমন ইস্যুর অবতারণা নতুন প্রজন্মের অনাগত সম্ভাবনাকে হুমকির মুখে ঠেলে দেয়া। তাদের ধারণা ছিল বাজার আর ভোগবাদী অর্থনীতি যেভাবে ক্রমাগত সামাজিক বিচ্ছিন্নতাবোধের উৎপাদন-পুনরোৎপাদন করছে তাতে জামাত নেতা গোযম গংদের কি রায় হলো, কার কী সাজা হলো তা নিয়ে আজকের তারুণ্য কোন চিন্তা করে না। করবে না। এটি তাদের চিন্তার বিষয় নয়। কিন্তু ব্লগার ও অনলাইনভিত্তিক প্লাটফরমে সক্রিয় তরুন-তরুনীদের তাৎক্ষণিকভাবে ফেটে পড়ার মধ্যে প্রমাণিত হলো আজকের তারুন্যের কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা একেবারেই তরতাজা বিষয়। কোন ভুলে যাওয়া গীত নয়। যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবি আমাদের প্রাণের দাবি। তাইতে প্লাকার্ডের সাদা কাগজ ভরে উঠে কবির কবিতার লাইন দিয়ে- কাঁদতে আসিনি, ফাঁসীর দাবি নিয়ে এসেছি। না শাহবাগে কেউ কাঁদছে না। কান্নার প্রশ্নই আসে না। বরং ফাঁসীর দাবিই উচ্চকিত হয়ে উঠছে শাহবাগের এখানে-ওখানে, গানে, শ্লোগানে, সিনেমায়, প্রতিবাদী কন্ঠস্বর-এ।
সব চেয়ে ইতিবাচক দিক হলো যে এ দ্রোহের সূচনা হয়েছে একেবারে নতুন প্রজন্মের হাতে। এ সময়ের তরুন-তরুনীদের হাতে। কোন ক্ষমতালিপ্সু রাজনৈতিক দলের হাতে নয়। যে সম্ভাবনা রাজনৈতিক সংগঠন জাগিয়ে তুলতে পারে নি, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, নেতাকর্মী গড়ে তুলতে পারেনি, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে শক্তিবলে দাবিদার আ’লীগ পারে নি সেটিই সম্ভব করে তুলেছে এ তরুনরা। রাজনীতিক রথি-মহারথিদের নৈতিকভাবে বাধ্য করেছে শাহবাগ ছুটে আসতে। হাত মেলাতে। ঐকমত্য প্রকাশ করতে।
হে শাহবাগের তারুন্য-তারুন্যের শাহবাগ: বিনম্র অভিবাদন তোমায়!
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ বিকাল ৫:১০