somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

বিজু চৌধুরী
সহজ সরল সোজা সাদা ভাষায় জীবনের কথা লিখতে পছন্দ করি। কাদা মাটিতে বেড়ে ওঠা একজন নিতান্তই সাধারন মানুষ। মনের কথাগুলি বরাবরই মুখে এসে বের হতে চায় না, কলমে আসতে চায়।

শেকড়

১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ রাত ৩:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


১।
শ্রীমতী মায়া চক্রবর্তী, বয়স ৭০। কলকাতার মেদেনীপুরের একটি কলোনীর গেট থেকে বেরিয়ে, সদর রাস্তায় এলেন। বৃদ্ধার পরনে সাদা শাড়ী, খয়েরি পাড়, পায়ে চপ্পল, চোখে চশমা। বয়সের তুলনায় শরীর স্বাস্থ্য মোটামুটি ভালই আছে। লাঠি ছাড়াই হাঁটতে পারেন। হাতে একটি ছোট্ট স্টিলের বাটি। ফুটপাথ দিয়ে তিনশত মিটার দক্ষিণে হেঁটে চৌরাস্তার মোড়ে দাড়ালেন। তিনি রাস্তা চারটিকে দেখছেন বারবার। বোঝা যাচ্ছে তিনি রাস্তা ভুলে গেছেন। রাস্তার অপর পার্শ্বে দাড়ানো সুধাময় বাবু তাকে দেখে, রাস্তা পেরিয়ে এগিয়ে এসে বললেন -
- মাসি আপনি কোথায় যাচ্ছেন?
- এইতো দক্ষিণের রশিদ প্রামানিকের বাড়ী আছে না? সেখানে। তার মেয়ের নাম মোসলেমা, চিনতে পেরেছ? আমার বান্ধবী।
- চিনব না কেন? আমি তো ভাল করেই চিনি। হাতে কি মাসি?
- ও! একটু সুজির হালুয়া করেছি। মোসলেমার বাবা অসুস্থ্য তো। সুজির হালুয়া খেতে চেয়েছিল। তাই নিয়ে যাচ্ছি।
- মাসি, আমি আপনাকে মোসলেমাদের বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি?
- তাইলে তো বাবা ভালই হয়।
সুধাময় বাবু ঘড়ির দিকে তাকিয়ে, তাড়াতাড়ি হাঁটা শুরু করলেন। তার তাড়া আছে। একই কলোনীতে থাকবার পরেও মাসি তাকে আজ চিনছেন না। এটি অবশ্য কলোনীর কারও কাছে অজানা নয়। মাসি জোড়েই হাঁটতে পারেন। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই কলোনীর কাছাকাছি পৌঁছানোর পরেই, সুধাময় বাবু রনিকে দেখতে পেলেন। রনিকে ডাকা মাত্রই রনি দৌড় দিয়ে এসে বৃদ্ধার হাত ধরল। রনিকে সেরকম কিছুই বলতে হল না। বিষয়টির যেভাবে বরাবর সমাপ্তি ঘটে, ঠিক সেভাবেই সুধাময় বাবু রনিকে শুধু বললেন -
- দক্ষিণের রশিদ প্রামানিকের বাড়ী। সেই বাড়ীর মেয়ে মোসলেমা। মোসলেমার বাবা অসুস্থ্য, তাই সুজি নিয়ে যাচ্ছেন, তিনি খেতে চেয়েছেন। তোমার দিদার বান্ধবী মোসলেমা।
সুধাময় বাবু বৃদ্ধাকে বললেন -
- মাসি, রনি আপনাকে নিয়ে যাচ্ছে।
এই বলে সুধাময় বাবু জোরে হাঁটতে শুরু করেন। রনি কলোনীর ভেতরেই আরেকটি বাসার দরজায় নক করছে। বৃদ্ধা এদিক ওদিক তাকিয়ে বলছেন -
- এখানে একটা তাল গাছ ছিল যে, কোথায়?
- তাল গাছটা ঐ পাশের নতুন বিল্ডিংয়ের কারণে ঢাকা পড়ে গেছে দিদা।
বৃদ্ধা উকি দিয়ে তাল গাছ দেখার চেষ্টা করেন। ভেতর থেকে দরজা খোলে মাঝবয়সী দোলা। রনি দোলার কাছে গিয়ে আস্তে আস্তে বলে -
- পিসি, বাসায় কেউ নেই। দিদা রশিদ প্রামানিকের বাড়ী যাচ্ছেন। ওনার মেয়ে মোসলেমা দিদার বান্ধবী। রশিদ প্রামানিক অসুস্থ্য, সুজি খেতে চেয়েছেন।
এই বলে ১৪ বছরের রনি তড়িঘড়ি করে মাঠের দিকে রওনা করে, খেলতে। দোলা তার মা মায়া চক্রবর্তীকে ঘরে বসিয়ে বাংলাদেশে উৎপল চক্রবর্তীকে মেসেঞ্জারে মেসেজ পাঠায় -
- "বান্ধবী মোসলেমার বাবা রশিদ প্রামানিক।"
মিনিট দশেক পরে উত্তর পেয়ে দোলা, মায়া চক্রবর্তীকে রশিদ প্রামানিকের বাসায় নিয়ে যায় - গল্পের মধ্য দিয়ে।

২।
সাল ১৯৪৭। পূর্ব পাকিস্তান। পাড়ার নাম চৌধুরী পাড়া, গ্রাম - কাশিমপুর, জেলা টাঙ্গাইল। যে বাড়ীর নামেই চৌধুরী পাড়ার নামকরন, সেই চৌধুরী বাড়ীর একান্নবর্তী ছয়টি পরিবারের মধ্যে পাঁচটি পরিবারই চলে গেল কলকাতায় সেবছর। রয়ে গেলেন শুধু শৈলেন চৌধুরী। বড্ড নরম মনের ছেলেটির বুকেই যে এতটা সাহস! এতটাই মাটির টান - আগে কেউই বুঝতে পারে নাই। শৈলেন চৌধুরীর পরপর তিন বছরের ব্যবধানে দুই ছেলে অজয় চৌধুরী আর বিজয় চৌধুরী। এরপরে পাঁচ বছরের ব্যবধানে মেয়ে অঞ্জলি চৌধুরী। দেশভাগের সে বছরেই প্রথম সন্তানের জন্মের দশ বছর পরে, শেষ সন্তানের জন্ম হল, মেয়ে। দুই ছেলে, তারপরে দুই মেয়ে। প্রথম তিনজনের নাম স্ত্রী রাখলেও, এবারই প্রথম শৈলেন চৌধুরী তার ছোট মেয়ের নাম রাখলেন মায়া চৌধুরী -
- যে বছরে তার পাঁচ ভাই চলে যাবার পরেও, তিনি মাটির মায়ায় যেতে পারেননি, এই মেয়ে তো সেই মায়ারই সাক্ষী।
যে মাটির মায়ায় শৈলেন চৌধুরী যেতে পারেননি, সেই মাটি ছেড়ে তার বড় সন্তান অজয় চৌধুরী ১৮ বছর বয়সে কলকাতা চলে গেল ১৯৫৫ সালে। মায়ার তখন আট বছর বয়স। ছেলে চলে যাবার পরে বাসার সবাই ক্রন্দনরত। শুধু শৈলেন চৌধুরী নিশ্চুপ পাথর হয়ে রইলেন। তার মনে হচ্ছিল, তিনি আজ মাটির কাছে পরাজিত। মায়া যখন চিৎকার করে কান্না শুরু করে, তখন শৈলেন চৌধুরীর বুকের পাথর ভেঙ্গে চোখে জল হয়ে আসে। তিনি মায়াকে জড়িয়ে গগনবিদারী চিৎকার করে কাঁদতে থাকেন জীবনে প্রথমবার।

৩।
মায়া চক্রবর্তী ভাত খেয়ে দুপুরে নিজের ঘরে বসে আছেন। পাশের স্কুলে চাকরি করা তার বড় ছেলের বউ রত্না সব গুছিয়ে ভাত খেয়ে আবার স্কুলে চলে যান। মায়া চক্রবর্তী, তার বড় মেয়ে দোলার বাসায় যান আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে। দোলার বিয়ে হয়েছে অবস্থাপন্ন ঘরে। জামাইয়ের আর্থিক অবস্থা ভাল, ব্যবসায়ী। ছেলে হিসেবেও যথেষ্ট ভাল। মায়ের কথা ভেবেই দোলাকে সে এই কলোনীর ছোট বাসাতেই থাকতে বলে, যাতে মায়ের দেখাশোনা করতে পারে। নিজস্ব বড় বাসা দোলার জামাইয়ের আছে। সেটি বাধ্য হয়ে ভাড়া দিয়েছে। মায়া চক্রবর্তী কাঁদতে কাঁদতে দোলাকে বলেন -
- বৌমা নিজে খেয়ে চলে গেল, আমাকে খেতে দিল না।
দোলা বোঝে। তারপরও টেবিলে ভাত করকারী দিলে, মায়া চক্রবর্তী বসেন। এক লোকমা ভাত মেখে দোলাকে বলেন -
- আয় মা, তোকে খাইয়ে দেই। আমার ক্ষিদে নেই।
বিকেল নাগাদ তিনি সব ভুলে যান এবং জিজ্ঞেস করলে বলেন -
- কেন? বৌমা আমাকে মাছের তরকারী, সব্জি দিয়ে ভাত খাইয়ে, তারপরে নিজে খেয়েই না তবে স্কুলে গেল। লক্ষী বউ আমার।
যেদিন দোলা থাকে না, সেদিন কলোনীর অন্য বাসায় ভুলে না খাবার কথা বললেও সবাই বোঝে ব্যপারটি। প্রথমদকে রত্নার একটু খারাপ লাগলেও এখন মনে হয়, মন খারাপের কিছুই নেই। মায়া চক্রবর্তীর সবচেয়ে বড় ঔষধ হচ্ছে তার একমাত্র নাতি রনি। রনি যা বলবে, তিনি তাই শুনবেন। বেশী বিপদ হলে রনিই সামলায় তার দিদাকে।

৪।
মায়া আর মোসলেমা দুজনই বছরের এই দিনটির জন্য সারাটি বছর অপেক্ষা করে থাকে। ধান কাটার পরে ক্ষেত যেদিন পোড়ান হয়। যতদুর দৃষ্টি যায় আগুন আর ধোয়া। সন্ধ্যার পরে মায়া আর মোসলেমা বসত মোসলেমাদের বাসার পেছনে। তখন আগুনের শিখা নেই, ধোয়া নেই, তবে ছাইয়ের মধ্যকার আগুন রয়ে আছে। বিস্তীর্ণ ক্ষেতজুড়ে সেই দৃশ্য দেখলে মনে হয় কালো একটি চাদর ফুটো করে লাল আগুনের আলো বের হয়ে আসছে। অদ্ভুত সে দৃশ্য। মায়া আর মোসলেমা ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে থাকত সেই দিকে। মায়ার কাছে মনে হত রশিদ কাকা তাকে তার বাবার চেয়ে কোন অংশেই কম স্নেহ করেন না। বেশ কয়েকদিন স্বপ্নে মায়া দেখেছিল - পাড়ার নুরা পাগলটা তাকে তাড়া করেছে। মায়া চিৎকার করে বাবা বাবা বলে ডাকছে। কিন্তু রশিদ কাকা প্রতিটিবারই এসে মায়াকে বাঁচায়।
মায়া আর মোসলেমার বয়স এখন বার। দুজনের বাবাই খুব ভাল মানুষ ও ভাল বন্ধু। বছর তিনেক আগে মায়ার বড় বোনের বিয়ে হয়েছে ময়মনসিংহের নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দি গ্রামের মঙ্গলসিদ গ্রামে। দিদি চলে যাবার পরে মায়ার মনে প্রথম এই ভয় জাগে -
- আমারেও কি বাবাকে ছেড়ে যেতে হবে?
বাবাকে মায়া এই কথা জিজ্ঞেস করতে ভয় পায়। বাবা যদি বলে হ্যাঁ। মা তো প্রায়শই বলেন -
- স্বামীর ঘরই মেয়েদের আসল ঘর।
বাবার মনটাও খারাপ ছিল, তাই জিজ্ঞেস করতে সাহস পায়নি মায়া। কিন্তু রশিদ কাকা মায়াকে দেখে মনের অবস্থা বুঝতে পেরেছিলেন। মায়া ও মোসলেমা পুকুরের ধারে বসে সেদিন। রশিদ কাকা মায়াকে ডেকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে -
- মা মায়া, মনটা খারাপ?
মায়া ফোপাতে ফোপাতে বলে -
- কাকা, আমি ও মোসলেমা আপনাগো ছাইড়া কোথাও যামু না।
এই বলে চাচাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলে, মোসলেমাও সেই কান্নায় যোগ দেয়। কাকা দুইজনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেন -
- কাইন্দো না মা জননী। তোমরা দুইজন যেখানেও থাক, আল্লাহ ভগবান যেন তোমাদের দুইজনকেই ভাল রাখে।
মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে রশিদ কাকা সেদিন নিজেই মায়া ও মোসলেমার চেয়ে অধিক জোড়ে কাঁদতে শুরু করেন। মায়ার মনে হয়, তিনজনের চোখের জলে আজ পুকুরের জল বর্ষাকালের মত উছলিয়ে বাহিরে চলে আসবে।
মায়ার এসব কথা মনে আসে আজ, মোসলেমার বিয়ের দিন। একই গ্রামে বিয়ে হওয়াতে মায়ার মন সেরকম খারাপ নয়। বিদায় বেলা এসে রশিদ কাকার কান্না দেখেই মায়ার আরও বেশী মনে আসে। মোসলেমার বিয়ে হল ক্লাস টেনে ওঠার পরপরই। এরপরেও দুজন মেট্রিক পাশ করল একই সাথে। মেট্রিক পরীক্ষার পরে কলেজে মায়া ভর্তি হলেও মোসলেমা ভর্তি হয় না। কলেজে সাতদিন ক্লাস করার পরেই মায়ার জীবনেও বৈশাখের ঝড়ের মত আকষ্মিক হাজির হয় বিয়ে। ছেলে কুমিল্লার রেজিষ্ট্রার অফিসে চাকুরি করেন। মায়ার কিছুই বলার থাকে না। মায়া বোঝে সবই কপালের লিখন। মায়া বিয়ে করে তার স্বামী অমলেন্দু চক্রবর্তীর সাথে চলে আসে কুমিল্লায়।

৫।
মায়া চক্রবর্তীকে নিয়ে বড় মেয়ে দোলা এসেছে ডাক্তারের তাছে। তার মা আজ আঠারবার তার বাসায় এসেছে। প্রতিবারই বাসার কাজে সাহায্যকারী মেয়েটা দরজা খুলেছে আর মা একই কথা বলেছে -
- দোলা আসলে বলিস, সন্ধ্যা বেলা আসব। অনেকদিন মেয়েটার সাথে দেখা হয় না।
অথচ প্রতিদিনই দু থেকে তিন চারবার দেখা হচ্ছে। বছর সাতেক আগে দোলার বাবা মারা যায়। তার দুই বছর পর থেকেই মায়া চক্রবর্তীর এই রোগের শুরু। দোলার বাসায় যাবার মত সমস্যাগুলো ঘটে খুবই কম। বেশীরভাগ সময়েই ঘটে বাংলাদেশে অবস্থানকালীন তার স্মৃতিপটে আঁকা সমস্যাগুলো নিয়ে। মায়া চৌধুরীর পরিবারের বাংলাদেশে জীবিত আত্নীয়দের মধ্যে ছোট ভাইয়ের স্ত্রী রমা চৌধুরী ও তাদের ছোট ছেলে সমীর চৌধুরী। বড় ছেলে ও মেয়ে তাদের পরিবার সহ আমেরিকায়। সমীরই মায়াদের পরিবারের খুঁটি ধরে রয়েছে বাংলাদেশে। যে দেশের জন্য তার বাবা কখনই চাইতেন না ইন্ডিয়ায় আসতে, সে দেশে সমীরই এখন একমাত্র ভরসা। মাসে এক দুইবার নিয়ম করে সমীরের সাথে ফোনে কথা বলে মায়া চক্রবর্তী। টাংগাইলে মোবাইল আছে। ফোনে কথা বলা ব্যয়বহুল। মেসেঞ্জার সহ যাবতীয় ইন্টারনেটে কথা বলার সুবিধাগুলি টাঙ্গাইলে শুরু হলেও, সমীর অভ্যস্ত হয়নি। এই ঘটনাগুলোর সময়ে তাদের একমাত্র ভরসা বাংলাদেশে মায়া চক্রবর্তীর দেবরের ছেলে উৎপল চক্রবর্তী। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার ছেলেটি থাকে ঢাকায়। এ জাতীয় সমস্যায় পড়লে, তাকে মেসেজ করে নাম বললে, সে সমীরকে ফোন করে সব জেনে মেসেজ করে জানায়। তখন, তার মাকে সেসব ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বললে তিনি শান্ত হন। ঘন্টা তিন চারেক থাকে হয়তোবা তার এই ছোটবেলার স্মৃতিতে ফিরে যাওয়া। একজন মানুষের দ্বৈত অবস্থান নিয়ে কতরকম যে যন্ত্রণা হতে পারে, তা ভুক্তভোগী না হলে কেউ বুঝবে না।

৬।
দোলার বয়স যখন দুই বছর, তখনই মায়া চক্রবর্তী কলকাতায় চলে আসেন। সে সময় পূর্ব পাকিস্তানে একটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়। মায়া চৌধুরী এখানে আসার পরে প্রায়শই মাঝ রাতে ঘুম থেকে উঠে, কখনও বাবা, কখনও মা, কখনও বা মোসলেমা বলে কাঁদতে থাকেন। সেই অবস্থাতেই মায়া আবার গর্ভধারন করে এবং জন্ম নেয় প্রথম ছেলে শৈলেন চক্রবর্তী। মায়া চলে আসার পরে তার বাবা অসম্ভব রকমের মুষড়ে পরেন ও হটাৎই হার্ট এ্যাটাক করে মারা যান। তার মাস তিনেক পরেই ছেলের জন্ম হয়। মায়াকে স্বাভাবিক হতে, স্বামীই ছেলের নাম, মায়ার বাবার নামে রাখতে বলে। তাই ছেলের নাম রাখা হয় শৈলেন চক্রবর্তী। এটি এন্টিবায়োটিকের মত কাজ করে মায়াকে পিতৃশোক কাটিয়ে উঠতে। পরবর্তীতে মায়া চৌধুরী আরেকটি মেয়ে নীলার জন্ম দেন বছর তিনেক পরে। নীলা বিয়ে করে স্বামী সহ আমেরিকায় সেটলড করেছে। বছর চার পাঁচেক পরে একবার আসে। জামাই ইঞ্জিনিয়ার।

৭।
বিয়ের পরে স্বপ্নের মত দুই মাস না কাটতেই, মায়া একদিন মাথা ঘুরে পড়ে যায়। মায়ার নিজের মা হতে যাবার আনন্দের চেয়ে অধিক আনন্দের খবর বয়ে নিয়ে আসে মায়ের চিঠি - মোসলেমাও মা হতে চলেছে। মোসলেমার বছর গড়িয়ে গর্ভধারন করতে না পারাটা রশিদ কাকা ও কাকীর জন্য বড্ড চিন্তার ব্যপার হয়ে দাড়িয়েছিল। মায়ার মনে হয়, মোসলেমা যেন মায়ার জন্যই অপেক্ষা করছিল। ছোটবেলা থেকেই দুজন সবকিছুই তো একসাথে করত।
সাত মাস পরে যেদিন ভারি শরীরটা নিয়ে মায়া আসে বাপের বাড়ী, সেদিন তার কোন কষ্টই মনে হয় না। মোসলেমা যেদিন মায়াকে দেখতে আসে, দুজনই দুজনকে দেখে এই প্রথম লজ্জা পায়। মুচকি হাসে। কার পেট বেশী বড়?
দুইটা মাস কিভাবে যে চলে যায়? দুজনই বুঝতে পারে না। প্রথমে মোসলেমা একটি মেয়ে জন্ম দেয়। মোসলেমা ভাল নাম শ্বশুর বাড়ীর লোকদের রাখতে দিলেও ডাক নামটি রাখার জন্য অপেক্ষা করে। আঠার দিন পরে মায়ার যেদিন মেয়ে হল, সেদিন মোসলেমা এসেই বলছে -
- মায়া, দেখি দোলা কই?
দুই বান্ধবীই মেয়ের ডাক নাম রাখে দোলা।
মায়ার বড় বোন মায়াকে দেখতে আসে। সাথে নিয়ে আসে পাশের বাসার একটি মেয়ে নির্মলাকে। বয়স চৌদ্দ। দেখতে খুবই সুন্দর। মায়া মাকে বলে -
- মা, তোমার ছোট ছেলের বউ বানিয়ে ফেল।
যে কারণেই হোক, সেই মেয়ের সাথে মাস ছয়েকের মধ্যে মায়ার ছোট দাদার বিয়ে হয়ে যায়। বড় দাদা কলকাতায় ভালই করছে, কাপড়ের ব্যবসায়। বিয়ে থা করেছে, বাচ্চা হয়নি তখনও। মাঝে কয়েকবার এসেছিল, কিন্তু দুদিনও থাকেনি। শুধু মায়ার বিয়ের সময় পাঁচদিন ছিল। মায়ার ছোট দাদা বিজয় চৌধুরীর বিয়েতে, বড় দাদা অজয় চৌধুরী আসতেই পারেনি ব্যবসা এবং ভিসার জটিলতা মিলিয়ে।

৮।
দোলা খবর পেয়ে শ্বশুর বাড়ী থেকে বাসায় চলে এসেছে। দোলার জামাইও এসেছে। এমনকি দোলার শ্বশুর ও দেবরও এসেছে। সবাই দোলার বাসায়। সেখানে দোলার একমাত্র ভাই শৈলেন ও তার স্ত্রী রত্নাও হাজির। তারা কেউই বুঝতে পারছে না, কি করে সামলাবে আজ? বাসায় রনির সাথে মায়া চক্রবর্তী। একমাত্র রনিই এখন ভরসা।
মায়া চক্রবর্তী রনিকে বলে -
- দাদা ভাই, চল না তাড়াতাড়ি। সন্ধ্যার মধ্যে পৌঁছুতে না পারলে মজা নেই। তুই কিছুই দেখতে পাবি না।
- দিদা, একটু অপেক্ষা কর, তালাটা খুঁজে পাচ্ছি না। আর বেশীদুরের রাস্তা তো নয় দিদা। সমস্যা কি?
- তা অবশ্য ঠিক। এই রনি, দেখতো আমাকে কেমন লাগছে?
বিধবা মায়া চক্রবর্তী আজ বেশ খানিকটা সেজেছেন, যেটি সাধারনত এই বয়সে মানুষ সাজে না। তার উপরে তিনি বিধবা। এখনও কলকাতায় গরম। তারপরেও মায়া চক্রবর্তী শুধু যে শরীরে শাল জড়িয়েছেন তা নয়, মামলারও পেঁচিয়েছেন। তিনি আজ যাচ্ছেন মোসলেমাদের বাসায়। দুজন মিলে সেই ধান ক্ষেত পোড়ানোর দৃশ্য দেখবেন। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে এই সময়টিতে শীত শুরু হয়। কলকাতায় এখনও সিলিং ফ্যান ছাড়তে হয়। ফ্যান চলছে এবং মায়া চক্রবর্তী তারপরেও ঘামছেন। তিনি তাড়া দেন রনিকে -
- দাদু ভাই, তাড়াতাড়ি চলনারে ভাই। মোসলেমা অস্থির হয়ে বসে আছে যে। সোনা দাদু ভাই।
রনি তার পিসির বাসায় মিটিংয়ে ব্যাস্ত বাবা মা, পিসি, পিসোমশাইদের সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করছে। কেউই বুঝে উঠতে পারছে না যে, কি করে? তারা -
- মায়া চক্রবর্তীকে আজ মোসলেমা মাসির মৃত্যু সংবাদটি দিবে?

লেখার অন্তরালের কিছু কথা
হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের একটি বড় অংশ কলকাতায় বাস করছেন, যাদের জীবনের একটি স্বর্ন সময় কেঁটেছে বাংলাদেশ, তথা পূর্ব পাকিস্তানে। জীবনের স্মৃতি কি দেশভাগের মত এত সহজেই দ্বিখন্ডিত করা যায়? এরকমই একটি সত্য ঘটনার ছায়া অবলম্বনে এই শেকড় গল্পটি রচিত। এটিকে আমার লেখা প্রথম উপন্যাসে পরিণত করার একটি ইচ্ছে আছে মনে। এরকমই আরও কিছু সত্য ঘটনা খুঁজছি আমি। কয়েকটি ঘটনা পেলে, একেকটি ঘটনাকে ফুল ধরে, উপন্যাসের মালাটি গেঁথে ফেলতে পারতাম। আবারও অনুরোধ করছি। আপাতত: ছোট গল্প হিসেবেই রইল - "শেকড়" -
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ রাত ৩:৪১
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পিরিতের সংস্কৃতিওয়ালা তুমি মুলা’র দিনে আইলা না

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:৫৬


---- আমাদের দেশে ভাষা, সংস্কৃতি এবং সামাজিক সমুন্নয়ন তলানিতে। তেমন কোন সংস্কৃতিবান নেই, শিরদাঁড়া সোজা তেমন মানুষ নেই। সংস্কৃতির বড় দান হলো ভয়শূন্য ও বিশুদ্ধ আত্মা। যিনি মানবের স্খলনে, যেকোন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসরায়েল

লিখেছেন সাইফুলসাইফসাই, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৪৮

ইসরায়েল
সাইফুল ইসলাম সাঈফ

এ মাকে হত্যা করেছে ইসরায়েল
এ বাবাকে হত্যা করেছে ইসরায়েল
নিরীহ শিশুদের হত্যা করেছে ইসরায়েল
এই বৃ্দ্ধ-বৃদ্ধাদের হত্যা করেছে ইসরায়েল
এ ভাইক হত্যা করেছে ইসরায়েল
এ বোনকে হত্যা করেছে ইসরায়েল
তারা মানুষ, এরাও মানুষ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

গ্রামের রঙিন চাঁদ

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১২


গ্রামের ছায়া মায়া আদর সোহাগ
এক কুয়া জল বির্সজন দিয়ে আবার
ফিরলাম ইট পাথর শহরে কিন্তু দূরত্বের
চাঁদটা সঙ্গেই রইল- যত স্মৃতি অমলিন;
সোনালি সূর্যের সাথে শুধু কথাকোপন
গ্রাম আর শহরের ধূলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১৭



পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের ধ্বংসাবশেষঃ
পালবংশের দ্বিতীয় রাজা শ্রী ধর্মপালদেব অষ্টম শতকের শেষের দিকে বা নবম শতকে এই বিহার তৈরি করছিলেন।১৮৭৯ সালে স্যার কানিংহাম এই বিশাল কীর্তি আবিষ্কার করেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

পরবাসী ঈদ

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:২৩

আমার বাচ্চারা সকাল থেকেই আনন্দে আত্মহারা। আজ "ঈদ!" ঈদের আনন্দের চাইতে বড় আনন্দ হচ্ছে ওদেরকে স্কুলে যেতে হচ্ছে না। সপ্তাহের মাঝে ঈদ হলে এই একটা সুবিধা ওরা পায়, বাড়তি ছুটি!... ...বাকিটুকু পড়ুন

×