somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একজাতি/দ্বিজাতি তত্ত্ব এবং একাত্তরে ইসলাম ধর্মের ভূমিকা। - ১

০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১১ রাত ২:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

০১.
মানুষ প্রধানত অর্থনৈতিক প্রাণী। মানুষের পরের পরিচয় রাজনৈতিক পরিচয়; রাজনৈতিক পরিচয়ও মূলত অর্থনৈতিক স্বার্থ সংশ্লিষ্টতার জন্যই। এর পরে জাতিগত পরিচয়, ধর্মীয় পরিচয়, ভাষাভিত্তিক পরিচয়, সবগুলোই মূলত অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক পরিচয়ের অধীন, এসব পরিচয় শুধুমাত্র অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক পরিচয় যখন প্রশ্নবিদ্ধ বা সংকটাপন্ন হয়ে উঠে তখনই মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। এসব সাবসিডিয়ারি পরিচয়ের নিজের খাতিরেই না, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক পরিচয়কে পাকাপোক্ত করা বা এই দুই পরিচয়ের প্রতি চ্যালেন্জ মোকাবেলার নিমিত্তেই শুধু অন্যান্য পরিচয় যখন সাহায্য করবে তখন সেসব পরিচয় সামনে চলে আসে।
অনেক আগে আমি যখন ঢাবিতে প্রথমবর্ষে পড়ি তখন কিভাবে জানি আমার হাতে একটা আর্টিকল এসেছিল যার শিরোনাম ছিল "why countries go to war or stay at peace."। আভ্যন্তরীন এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে সবসময় খুবই আগ্রহী ছিলাম বলে লেখাটা পড়েছিলাম, সেসময়ের ১৮-১৯ বছর বয়সের মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিপক্কতা দিয়ে হয়ত সবটুকু বুঝিনি, অন্তত আজ আরো বছর নয়েক পরে এসে তখনকার অনেক বুঝাকেই ভুল মনে হয়, ভবিষ্যতে হয়ত এখনকার বুঝাকে ভুল মনে হবে। কারন "মানুষ মরে গেলে পঁচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়, সকালে-বিকালে বদলায়, কারনে-অকারনে বদলায়।" কিন্তু তবুও যতটুকু মনে আছে তাতে বুঝেছিলাম জাতিরাষ্ঠ্রের মধ্যে যুদ্ধের মূল কারন অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক স্বার্থের দ্বন্ধ। কোন রাষ্ঠ্রব্যবস্থায় যদি একটা জনগোষ্ঠী তার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার থেকে নিজেদেরকে বন্ঞিত মনে করে এবং রাষ্ঠ্রব্যবস্থা তাদের প্রতি সুবিচার করছেনা এরকম অনূভব করে তবে সেই প্রতিষ্ঠিত রাষ্ঠ্রের মধ্যেই সেই জনগোষ্ঠী তাদের অধিকার আদায়ের জন্য বিদ্যমান রাষ্ঠ্রকাঠামোয় (existing state structure) চেষ্টা চালাবে, যদি বুঝতে পারে বিদ্যমান কাঠামোতে অধিকার আদায় সম্ভব না তাহলে তারা নিজেদের জন্য আলাদা রাষ্ঠ্রকাঠামোর চেষ্টা চালাবে। এই প্রচেষ্ঠা সবসময় সফল হবে তা না, এখানে আভ্যন্তরীন এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন রাজনৈতিক সমীকরন কাজ করবে, অধিকারবন্ঞিত জনগোষ্ঠীর নিজস্ব শক্তি, বিদ্যমান রাষ্ঠ্রব্যবস্থার মোকাবেলায় তাদের রুখে দাড়ানোর মত জনবল এবং নিজেদের জনগোষ্ঠীকে সক্রিয় করে তোলার জন্য নেতৃত্বগুণ ও সংগঠনশক্তি ইত্যাকার নানাবিধ ব্যাপার কাজ করে। এরকম আন্দোলন শুরু হওয়ার পর অনেক সময় বিদ্যমান রাষ্ঠ্রব্যবস্থার শাসকগোষ্ঠীও বুঝতে পারে এবং একটা আপোষকামী বা শান্তিবাদী অবস্থান নিতে পারে, তখন বিদ্বেষরত জনগোষ্ঠীদ্বয় হয়ত বিদ্যমান রাষ্ঠ্রব্যবস্থাতেই মিলেঝুলে আপষরফা করে থাকার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। মোদ্দাকথা, কোন রাষ্ঠ্রকাঠামো যদি তার বিভিন্ন শ্রেণীতে, জাতিতে, ধর্মে ইত্যাদি ভাগে বিভক্ত জনগোষ্ঠীর জন্য সাম্যতার ভিত্তিতে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা ভাগাভাগির কাঠামো শক্তিশালী করতে পারে, যেখানে কোন নির্দিষ্ঠ শ্রেনী, ধর্ম বা জাতির প্রতিনিধিত্বকারী অংশ নিজেদেরকে বন্ঞিত বা নিপীড়িত মনে করবেনা, সেরকম রাষ্ঠ্রকাঠামোতে আভ্যন্তরীন জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে যুদ্ধ হওয়ার কোন সম্ভাবনা থাকবেনা। এমনকি যদি এই জনগোষ্ঠীসমূহের মধ্যে পারষ্পরিক জাতীয়তা, ধর্ম, আকার, সংস্কৃতি, ভাষা ইত্যাদি ক্ষেত্রে অনেক পার্থক্যও থাকে, যতক্ষণ না তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকারবোধে আপোষ করতে হচ্ছে এবং কোন অংশ নিজেদেরকে অন্যদের তুলনায় বন্ঞিত মনে না করছে ততক্ষণ এই আপাতবিষম জনগোষ্ঠীসমূহ একই রাষ্ঠ্র কাঠামোয়, একই ছাদের নিচে খুব শান্তভাবেই থাকতে পারবে। আবার যদি কোন রাষ্ঠ্রকাঠামোতে শুধুমাত্র একটা জনগোষ্ঠী থাকে যেখানে তারা সবাই একই ভাষায় কথা বলে, একই ধর্মের অনুসারী, একই নৃতাত্বিক জাতিগোষ্ঠী হয় কিন্তু বিদ্যমান রাষ্ঠ্রব্যবস্থার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা ভাগাভগির ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে সুষ্পষ্টভাবে সুবিচারের অভাব এবং বৈষম্য পরিলক্ষিত হয় , তাহলে সে রাষ্ঠ্র্যব্যস্থার জনগোষ্ঠীর মধ্যে এত মিল থাকা স্বত্ত্বেও সেটাতে আভ্যন্তরীন অস্থিরতা, আন্দোলন এমনকি যুদ্ধ-বিগ্রহ দেখা দিবে। যদি সারাবিশ্বের সমস্ত জনগোষ্ঠী সারাবিশ্বকে একটা জাতিরাষ্ঠ্র হিসেবে দেখতে চায় এবং সমস্ত জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার সুরক্ষিত হয় এরকম একটা বৈশ্বিক রাষ্ঠ্রকাঠামো গঠন করা যায়, তবে সে রাষ্ঠ্রব্যবস্থা টিকবে, কিন্তু একদম ছোট কুয়েত বা মনাকোর মত একটা জাতিরাষ্ঠ্রকাঠামো গঠন করেন যেখানে সমস্ত জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ সংরক্ষিত হয়না, সেরকম রাষ্ঠ্র খুব ছোট এবং জনগোষ্ঠীর সবদিক দিয়ে মিল থাকা স্বত্বেও সেখানে রাজনৈতিক অস্তিরতা-হানাহানি, যুদ্ধ-বিগ্রহ দেখা যাবে, রাষ্ঠ্রকাঠামো ভঙ্গুর হবে। উদাহরন হিসেবে লেবানন মনে আসে, এখানে শিয়া, সুন্নী এবং ক্রিস্টান জনসংখ্যা মোটামোটি সমানে সমান, তা স্বত্ত্বে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতা ভাগাভাগির ক্ষেত্রে দৃশ্যত সাম্যতা এবং সুবিচার প্রতিষ্ঠা পাওয়াই ফ্রান্স থেকে স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত, যখন পিএলও গেরিলারা একটা ফ্যাক্টর হয়ে দাড়িয়েছিল, এসময় পর্যন্ত তুলনামূলক শান্তির দেশ ছিল, লেবাননকে এশিয়ার সুইটজারল্যান্ড বলা হত। এরকম উদাহরন আরো অনেক দেওয়া যাবে।
০২.
এবার আসি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে কিছু কথায়। ইতিহাসের কিছুটা সরলীকরনের ঝুঁকি নিয়ে বলা যায় সিরাজদ্দৌলার পতনের পর থেকে শুরু করে মোটামোটি সিপাহী বিদ্রোহের আগপর্যন্ত, বলা যায় উনিশ শতকের শেষাংশ পর্যন্ত ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানরা ইংরেজী শিক্ষায় শিক্ষিত হয়নি। এর পেছনে মূলকারন ধর্মীয় গোঁড়ামী এবং শাসকের স্থান থেকে নিজেদেরকে শাসিতের ভূমিকায় দেখে মুসলমানদের মধ্যে গড়ে উঠা জাত্যাভিমান। পক্ষান্তরে হিন্দুদের মধ্যে এই জাত্যাভিমান ছিলনা, তাই তারা ইংরেজী শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছিল এবং বিভিন্নক্ষেত্রে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতাকাঠামোর বিচারে মুসলমানদের থেকে বিপুলভাবে এগিয়ে ছিল। এখানে এটাও প্রাসংগিক হতে পারে যে সিরাজদ্দৌলার পতনের পেছনে হিন্দু জমিদারদের ব্যাপক ভুমিকা ছিল, যদিও শেষ পর্যন্ত মীরজাফরের হাত ধরেই সিরাজের পতন হয়েছিল। আরো উল্লেখ্য যে জমিদার শ্রেণী সাধারণ হিন্দুদের প্রতিনিধিত্ব করতনা, এখানে তাদের হিন্দু পরিচয় ততটা মূখ্য না, যতটা তাদের জমিদার পরিচয় মূখ্য। হিন্দু জমিদারদের ইংরেজের পক্ষ নেওয়া এবং এরপরে অনেকবছর ধরে জমিদারশ্রেণী এবং এলিটরা ইংরেজদের আগমনকে ভারতীয় উপমহাদেশের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ ভাবার কারনও কিন্তু হিন্দু জমিদার আর এলিটদের ক্ষমতার রাজনীতিতে অগ্রগামী থাকার ইচ্ছা এবং কারন থেকেই উৎসারিত। সিরাজের পতনের পর অনেক অনেক বছর হিন্দু ইতিহাসবিদগন ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির সহায়তা এবং ইংরেজদের প্ররোচনায় সিরাজের বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে কুৎসা রটনায় ব্যস্ত ছিল। হিন্দু জমিদার, বাবু, এবং ইংরেজী শিক্ষায় শিক্ষিত বর্ধিন্ঞু মধ্যবিত্ত এবং মোসলমান কৃষক-শ্রমিক-মজুরদের এই রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ক্ষমতাকেন্দ্রীক ডিভাইডটা বাংলা ভাষাভাষীদের মধ্যে আরো অনেক বেশি ছিল, তার কারন হল ইংরেজ শাসনের আগেও বাঙাল মোসলমানরা ক্ষমতার কেন্দ্রে সেভাবে ছিলনা। বাংগালি হিন্দুরা ভারতবর্ষের অন্যান্য এলাকার হিন্দুদের চেয়েও এগিয়েছিল, বাঙালি মুসলমানরা ভারতবর্ষের অন্যান্য মুসলমানদের থেকেও পিছিয়ে ছিল। এই ডিভাইডটা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলছিল। তাই বাংলায় যখন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কায়েম হল তখন এর মোটামোটি সামান্য ব্যতিত বাকিটুকুর জমিদারী হিন্দু শিক্ষিতদের হাতেই গেল, রাজনৈতিকও অর্থনৈতিক ক্ষমতাকাঠামোয় এগিয়ে থাকাতে তাদের কাছে জমিদারী যাবে এটা স্বাভাবিকই ছিল। ব্রিটিশ-ভারতে জমিদারী ছাড়াও হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে উঠেছিল, যারা জমিদারী না থাকলেও ইংরেজী শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়াতে সমাজের গন্যমান্যতে পরিণত হয়েছিল। মুসলমান বাঙালিরা (বা বাঙালরা) মূলত কৃষক, মজুর, কারিগর ইত্যাদি শ্রেণীতেই থাকল। তারা শিক্ষার দিকে যখন ঝুঁকল, মূলত উনিশ শতকের শেষের দিকে আর বিংশ শতকের প্রথম দিকে, তখন এই কৃষক, মজুর, কারিগর মুসলমান দরিদ্র বাঙালরা ধান বেচে, পাট বিক্রি করে তাদের সন্তানদেরকে বাবুটাইপ শিক্ষিত বানানোর জন্য স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো শুরু করল। এটা অস্বীকার করার উপায় নাই যে এরা পাকিস্তান চেয়েছিল, কারন হিন্দু জমিদার মহাজনদের অত্যাচারে নিস্পেষিত হওয়ার হাত থেকে বেঁচে যাওয়ার আশা পাকিস্তান হওয়ার মাধ্যমেই সম্ভব বলে তাদের চোখে ধরা দিয়েছিল। সাতচল্লিশের দেশভাগের জন্য পাকিস্তানিদের চেয়ে বাঙাল মুসলমানরা বেশী আগ্রহী ছিল, অন্তত কম আগ্রহী ছিল না। '৪৬ সালের ভোটে বাঙাল মুসলমানরা তাই গণহারে মুসলিম লীগকে ভোট দিয়েছিল। আবার কলকাতাকেন্দ্রীক হিন্দু এলিটরা সমস্ত বাঙালি আর বাঙালদের নিয়ে একটা দেশ হলে তাদের স্বার্থ ক্ষুন্ন হবে এটা ভেবেছিল, কারন বাঙাল মুসলমানরা সংখ্যায় বেশি হওয়াতে সমস্ত বাংলাভাষীদের জন্য একটা দেশ হলে সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠের জোরে মুসলমানদের হাতে ক্ষমতা যাওয়ার সম্ভাবনাকে হিন্দু এলিটরা ভয় পাচ্ছিল, তাছাড়া শতবছর ধরে জমিদারীর মাধ্যমে যাদেরকে শোষন করেছে, সেই প্রজাদের সাথে সমস্ত বাংলাভাষাভাষীর জন্য নির্মিত একই দেশে ক্ষমতা ভাগাভাগি করার সমীকরণ তাদের কাছে খুব উপাদেয় মনে হয়নি, প্রজাদের হাতে প্রতিশোধস্পৃহারও কিছুটা ভয় ছিল। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা ভাগাভাগির সমীকরনের যাঁতাকলে 'হাজার বছরের আবহমান বাঙালি জাতি" বা তথাকথিত "একজাতি" তত্ব ধরা খেয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে বঙ্গভংগের মাধ্যমেই এই দুই শ্রেণীর ডিভাইডটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ইংরেজরা নিজেদের সুবিধার্তেই বঙভংগ করলেও সেই ভাঙ্গাভাঙ্গির সমীকরনে বাঙাল মুসলমানদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থরক্ষিত হয়েছিল বলে বাঙাল মুসলমানরা একবাক্যে সেই ভঙ্গে একমত হয়েছিল। তাই "একজাতি" তত্ত্ব প্রথমবার ধরা খেয়েছিল ১৯০৫ সালে বঙ্গভন্গের সময়, তবে প্রথমবার শুধু বাঙাল মুসলমানদেরই তাতে সাই ছিল। বাঙালি হিন্দু এলিট এবং জমিদার শ্রেণীর তাতে ব্যাপক আপত্তি ছিল, তাও নিজেদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার এবং অনেকটাই বাঙালরা শক্তিশালী হয়ে যাবে এই ভয়ই ছিল। তবে উল্লেখ্য যে জমিদার-বাবু-এলিট কলকাতাবাসী ব্যতীত রবীন্দ্রনাথ এবং অন্যান্য আলোকিত মানুষ যারা বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করেছিল তারা ব্রিটিশদের রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি বুঝতে পেরেছিল বলেই করেছিল, স্বার্থান্বেষী হয়ে নয়। এখানে ভুল পাঠের সম্ভাবনা যাতে না থাকে সে খাতিরে আবারো বলে রাখি, হিন্দু জমিদার-বাবু-শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের এরকম ব্যবহার তারা "হিন্দু" ছিল বলেই নয়, বরং তারা জমিদার ছিল বলেই। মুলকথা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতাকেন্দ্রীক দ্বন্দই মোসলমান ও হিন্দুদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পার্থক্য গড়ে দিয়েছিল। ডিভাইডটা যতটা না ধর্মীয় ছিল, তার চেয়েও বেশি ছিল অর্থনৈতিক এবং সামাজিক শ্রেণীগত। বঙভঙ্গ পরবর্তিতে রদ হলেও আসলে ডিভাইডটা আর জোড়া লাগেনি। প্রথমবার যখন "একজাতি" তত্ত্ব ধরা খেল, তখন শুধু বাঙাল মুসলমানরা সায় দিলেও, যখন সাতচল্লিশে দেশ ভাগ হল, তখন বাংগালি হিন্দু এবং বাঙাল মুসলমান দুই শ্রেণীরই এতে জোর সায় ছিল। "একজাতি"-তত্ত্বের পতন ঘটল চরমভাবে, আপাতদৃষ্টিতে মনে হল ধর্মই জনগোষ্ঠীকে আত্মীয়তাই বাঁধতে পারে, জাতি নয়। অবশ্য অনেক নৃতাত্ত্বিকই এখন পূর্ববাংলাকেন্দ্রীক বাঙাল জাতটাকে কলকাতাকেন্দ্রীক বা পশ্চিমবঙ্গকেন্দ্রীক বাঙালি জাতি থেকে ভিন্ন নৃতাত্ত্বিক গোষ্টী মনে করে, যদিও এই চিন্তাধারা এখনও মূলধারাই জনপ্রিয়তা পায়নি। তর্কের খাতিরে ধরে যদি নিই যে এ দুটি জনগোষ্টী ভিন্ন নৃতাত্ত্বিক মূল থেকে এসেছে, তবুও একথা অস্বীকার করার উপায় নাই যে দু বাংলার মানুষের সংস্কৃতি, ভাষা, আদানপ্রদান ভিত্তিক দিক দিয়ে এ দুটা জনগোষ্ঠীকে পৃথক ধরা যায় না, শুধুমাত্র ধর্ম ব্যতিত। এমনকি ধর্মের দিক দিয়েও পূর্বে যেরকম মুসলমান সুপার-মেজরিট আর পশ্চিমে হিন্দু সুপার-মেজরিটি দেখা যায় সেটাও ১৯০০ সালের পূর্বে এরকম ছিলনা, দু বাংলায় হিন্দু-মুসলমানের হার মোটামোটি কাছাকাছিই ছিল। তাই এ দু'অংশের মূল ডিভিশানটা অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক, ধর্মীয় বা এলাকাভিত্তিক নয়। ১৯৪৭ তাই দেশভাগই শুধু নয়, ১৯৪৭ "একজাতি" তত্ত্বের পতনের বছর। একই জাতির দুই শ্রেণী নিজেদের সজ্ঞানেই "একজাতি"-তত্ত্বকে কবর দিল। দুশ্রেণীর যারা ভুল ইতিহাস পাঠ করেছে তারা মনে করল ধর্ম হয়ত রাষ্ঠ্রকাঠামোতে জনগোষ্ঠীকে একীভূত রাখার জন্য অনেক বড় ফ্যাক্টর। তাদের ভুল ভাঙতে অবশ্য বেশিদিন লাগলনা, মাত্র ২৪ বছরের ব্যবধানে তাদের ভুল ভেঙ্গে গেল যখন দ্বিজাতি-তত্ত্বের পতন ঘটল।
একজাতি তত্ত্বের পতনের মাধ্যমে প্রমাণিত হল যে একটা জাতির ধর্ম ব্যতিত অন্য সবকিছুতে মিল থাকলেও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টি হলে, বা একরাষ্ঠ্রব্যবস্থায় সবার স্বার্থ সমানভাবে সংরক্ষিত না হলে সে জাতি একরাষ্ঠ্র কাঠামোয় থাকতে পারে না।

(দ্বিতীয় পর্ব।)
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই মার্চ, ২০১৩ সকাল ১০:৩২
২০টি মন্তব্য ১৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×