ধর্ম কিভাবে মরালিটি/নৈতিকতার মানদন্ড ঠিক করে দেয়, সেটা নিয়ে আলোচনা করেছিলাম আগের পোস্টে। সেখানে বলেছিলাম ধর্ম ব্যাতিরেকে কোনভাবেই কোনটা নৈতিক আর কোনটা অনৈতিক সেটা জানা/বুঝা সম্ভব না। আগের পোস্ট থেকে কোট করছি, "ধর্মের নৈতিক রূপরেখা ছাড়া আপনি কোনমতেই বলতে পারবেননা মায়ের সাথে সন্তানের যৌনসম্পর্ক অনৈতিক। তেমনি বিয়েপূর্ব যৌনসম্পর্ক নৈতিক নাকি অনৈতিক সেটাও ধর্মের সাহায্য ছাড়া বলা সম্ভব না। সমকামিতা নৈতিক না অনৈতিক সেটাও ধর্মের সাহায্য ছাড়া বলা সম্ভব না। মূলত কোন কিছু ভাল না খারাপ, নৈতিক না অনৈতিক সেটা শুধুমাত্র সৃষ্টিকর্তার অস্থিত্বকে স্বীকার করে নিয়ে তার প্রদত্ত বিধানমালাকে মেনে নেওয়া ছাড়া বলা সম্ভব না।"
এসবই ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির আন্তঃসম্পর্কে নৈতিকতা নির্ধারণে ধর্মবিহীন নৈতিকতার মানদন্ডের সমস্যা নিয়ে আলোচনা। এখন আমি জাতির সাথে জাতির বা এক মানব সমাজের সাথে অন্য মানব সমাজের ক্রিয়াকর্মে ধর্মবিহীন মানদন্ডের সমস্যার কথা বিবেচনা করব।
০১.
রিচার্ড ডকিনস দ্বারা অনুপ্রাণিত মৌলবাদি নাস্তিকরা বলে ধর্মীয় নৈতিকতার মানদন্ডের প্রয়োজন নেই, মানুষ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সাহায্যে নৈতিকতার মানদন্ড ঠিক করতে পারবে। আব্রাহামিক রিলিজিয়ানগুলো বাদ দিলে মানব সৃষ্টির কাহিনীতে বিজ্ঞানভিত্তিক ন্যাচারেল সিলেকশানের মাধ্যমে বিবর্তনপ্রক্রিয়া কেই সামনে আনতে হয়। এই তত্ত্বের শুধু বৈজ্ঞানিক না, বড় রকমের দার্শনিক এবং নৈতিক মর্ম আছে। সেটা হচ্ছে যে কোন কিছু নৈতিক যদি সেটা সমাজের শক্তিশালী শ্রেণীরা নিজেদের স্বার্থে করে। মানে মানুষ তার নিজের স্বার্থের জন্য, সারভাইভালের জন্য যে কোন কিছু করতে পারবে। মানুষের মধ্যে যে জাতি শক্তিশালী সে দূর্বল জাতিকে কোন কারন ছাড়াই নিশ্চিহ্ণ করে দিতে পারবে, এবং সেটাই নৈতিক। আরো কনক্রিট উদাহরন দিচ্ছি। গত পাঁচশ বছরে সাদারা সবচেয়ে সফল জাতি ছিল, তারা জ্ঞান-বিজ্ঞানে সবচেয়ে অগ্রগামী ছিল। সাথে সাথে তারা সারাবিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষকে হত্যা করেছে, তাদের জায়গাজমি ঘরবাড়ি দখল করেছে, তাদের মেয়েদের ধর্ষণ করেছে, তাদের সম্পত্তি দখল করেছে। তারা কোটি কোটি কাল মানুষকে দাসবৃত্তিতে বাধ্য করেছে, কোটি কোটি আদিবাসিদেরকে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় গণহত্যা করেছে। গত পাঁচশত বছরে সাদারা যতবেশি ক্রাইম করেছে, অন্যসব জাতিকে যদি আপনি একত্রে আনেন তাদের সারা ইতিহাসের সব ক্রাইম সাদাদের গত পাঁচশ বছরের ক্রাইমের ১ শতাংশও হবেনা। ধর্মভিত্তিক নৈতিকতার মানদন্ড ছাড়া এসব ক্রাইম সম্পূর্ণভাবে নৈতিক, কেননা সাদারা সবচেয়ে সক্ষম জাতি ছিল, আর বিবর্তনবাদের মূল নীতি হল সক্ষমদের শোষণ জায়েজ।
০২.
এটা খালি ফিলজফিকাল কথা না। ধর্মবিহীন এই বিবর্তনবাদ জন্ম দিয়েছিল বৈজ্ঞানিক জাতিবাদের (সায়েন্টিফিক রেইসিজম)। বিংশ শতকের শুরুর দিকে সাদা বিজ্ঞানীদের বড় অংশ বিশ্বাস করত সাদারা বিবর্তনের প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে এগিয়ে আছে। তাই তারা যদি অন্য জাতিকে বিলোপ করে, তাদের উপর গণহত্যা চালায় সেসব নৈতিক কাজ হবে, সারভাইভাল অফ দ্যা ফিটেস্টের মর্মানুসারে। মানে ব্রিটিশরা যে বাংলাদেশীদের উপর গণহত্যা চালিয়েছে, কোটি কোটি মানুষকে হত্যা করেছে, বাংলাদেশীদের সম্পত্তি কেড়ে নিয়েছে, চাষীদের নীলচাষে বাধ্য করেছে, একটা উন্নত/ধনী সভ্যতাকে ২০০ বছরে পৃথিবীর গরীবতম সভ্যতায় পরিণত করেছে, এসবই বিবর্তনবাদপ্রসূত নৈতিকতার মানদন্ডে নৈতিক কাজ। সাদারা মূলত অন্যজাতিকে হত্যা করেছে, সেটা বাদ দিয়ে যদি নিজের জাতিকে হত্যা করার কথায় আসি, গত শতকে স্টালিন, মাও আর পলপট মিলে কমবেশি ১৫ কোটির মত নিজের দেশের মানুষকে হত্যা করেছে, এবং সেটা তাদের দৃষ্টিতে নৈতিক ছিল।
০৩.
বৈজ্ঞানিক জাতিবাদের পরবর্তী পর্যায় হচ্ছে ইউজেনিকস। অনেক সাদা বিজ্ঞানীরা বিংশ শতকের শুরুতে এই তত্ত্বে বিশ্বাসী ছিল। এই তত্ত্বানুসারে সমাজের কানা-লুলা-দূর্বল-প্রতিবন্ধীদের বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই। তাই তাদেরকে হত্যা করতে হবে। কানা-লুলারা সমাজে কোন অবদান রাখছেনা, তাই তাদের বাঁচিয়ে রাখার মানে নাই। হত্যা যদি নাও করা হয়, তাদেরকে বিয়ে করতে দেওয়া যাবেনা, কেননা তারা হয়ত কানা-লুলা সন্তানপ্রসব করবে, আর সেটা সমাজের জন্য বোঝা। এই তত্ত্ব থেকেই জন্ম হয়েছিল হিটলারের আর্য্য জাতিবাদ। হিটলার বৈজ্ঞানিক জাতিবাদের ভক্ত ছিল। তার মতে যেহেতু জার্মানরা আর্য্যজাতি, তাই শুধু তারাই বেঁচে থাকবে এবং বংশবৃদ্ধি করবে, অন্যদেরকে কনসেন্ট্রেশান ক্যাম্পে নিয়ে হত্যা করা হবে, এবং এটাই নৈতিক সিদ্ধান্ত বিজ্ঞানবাদ/বিবর্তনবাদ অনুসারে। হিটলার তাই সমাজের কানা-লুলা-প্রতিবন্ধিদেরকে কনসেন্ট্রেশান ক্যাম্পে নিয়ে তাদেরকে গ্যাসের মাধ্যমে বাষ্পীভূত করার কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছিল।
০৪.
বৈজ্ঞানিক জাতিবাদের আরেকটা দিক হচ্ছে নারীদেরকে ঘরের মধ্যে বসে থাকতে হবে, তারা বাইরে কাজ করতে পারবেনা। বিবর্তনবাদের সামাজিক দিক হচ্ছে হাজার বছর ধরে নারীরা ঘরে থাকত, সন্তান-সন্ততি লালন-পালন করাই তাদের কাজ ছিল। পুরুষরা বাইরে কাজ করত, তারা পশু শিকার করত, খাবার-দাবার যোগাড় করত, তারা হান্টার-গেদারার ছিল। যেহেতু এইসব জিন নারী-পুরুষের মধ্যে বংশপরিক্রমায় এসেছে, তাই নারীর আপেক্ষিক সক্ষমতা সন্তানপালনে, ঘরের মধ্যে কাজ করাতে, বাইরের পাওয়ার-পলিটিকসে সে অপরিপক্ব। আর পুরুষরা বাইরের দুনিয়ায় কাজের ক্ষেত্রে পরিপক্ক, তারা পাওয়ার-পলিটিকসে দক্ষ। তাই বিবর্তনবাদপ্রসূুত নৈতিকতা অনুসারে নারীকে অবশ্যই ঘরে থাকতে হবে সমাজের কল্যানের জন্যই, পুরুষ বাইরে কাজ করবে, সেটাও নৈতিক সিদ্ধান্ত। এই ধারণাকে বলা যায় সায়েন্টিফিক সেক্সিজম।
০৫.
উপরের বর্ণিত ঘৃণ্য গণহত্যাকে, বৈজ্ঞানিক জাতিবাদ আর সেক্সিজমকে অনৈতিক বলা যাবে তখনই, যদি আমরা ধরে নিই যে একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন, এবং তিনিই কোনটা নৈতিক আর কোনটা অনৈতিক সেটা ঠিক করে দেবেন। যদি সেরকম এক সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত নৈতিকতার মানদন্ড অনুসারে সকল মানুষ - সে কালা-লুলা-প্রতিবন্ধি হোক বা শারীরিক/মানসিকভাবে সক্ষম/অক্ষম হোক - সৃষ্টিকর্তার দৃষ্টিতে সমান হয় এবং প্রাণ নেওয়া/দেওয়ার একমাত্র এখতিয়ার সেই সৃষ্টিকর্তার হয়, তখনই উপরে বর্ণিত গণহত্যা, জাতিবাদ, সেক্সিজম অনৈতিক। অন্য কোন নৈতিকতার মানদন্ডে এরকম কোন সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব না।
তাই বুঝা যায়, মানুষ নিজেদের সামাজিক কল্যানের জন্য এবং ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনের তাগিদে অবশ্যই সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব স্বীকার করে নিতে হবে। তখনই আমরা কোনটা নৈতিক বা কোনটা অনৈতিক সে প্রশ্ন করার এবং সে দার্শনিক/সামাজিক সমস্যা সমাধান করার কথা ভাবতে পারি।
পরবর্তী মানবীয় সমস্যা হল সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব ধরে নিলেও অনেকগুলো ধর্মের মধ্যে কোন ধর্মের নৈতিকতাকে আমরা মেনে নিব? সে বিষয়ে অন্য এক পোস্টে আলোচনা করার ইরাদা আছে।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ভোর ৬:৪৪