একই কোরান-হাদিসের উপর ভিত্তি করেও মাজহাবের বড় আলেমরা কিভাবে ভিন্ন ভিন্ন উপসংহারে পৌঁছাতে পারে? সেটার একটা উদাহরন দিলাম। এই উদাহরনটা আমি সরাসরি কপি করছি, কেননা এটা আমার জানা অন্যান্য একাডেমিক উদাহরণ থেকে অনেক সহজ উদাহরণ। তাছাড়া লেখার বড় অংশই ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আব্দাল হাকিম মুরাদের লেখার কিয়দংশের ভাবগত অনুবাদ। দুটো সোর্সই শেষে দেওয়া হল।
_____________________________________________________________________________
"দূরবর্তী কোনো ভূখন্ডে যদি কেউ মারা যায় তবে তার মৃতদেহের অনুপস্থিতিতে তার জন্য জানাযার নামায আদায় করা আমাদের জন্য বৈধ হবে কি? এই বিষয়ে ইসলামের আলিমদের মধ্যে চারটি ভিন্ন ভিন্ন মত আছে। প্রথম মত অনুযায়ী, মৃতদেহের অনুপস্থিতিতেও দূরবর্তী স্থানে তার জন্য জানাযার নামায আদায় করা বৈধ, যেহেতু রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আবিসিনিয়ার ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ নাজ্জাশির মৃত্যুর পর আবিসিনিয়া থেকে অনেক দূরবর্তী স্থান মদিনাতে তাঁর জানাযার নামায আদায় করেছিলেন। দ্বিতীয় মত অনুযায়ী, মৃতদেহের অনুপস্থিতিতে দূরবর্তী স্থানে তার জন্য জানাযার নামায আদায় করা বৈধ নয়, কারণ রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এমনটি জীবনে মাত্র একবারই করেছিলেন। রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সময়ে তাঁর অনুপস্থিতিতে সাহাবীরা প্রায় ষাটটির মতো সামরিক অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন, যেখানে অনেক সাহাবী শহীদও হয়েছিলেন, কিন্তু রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কখনোই তাদের জন্য মদিনাতে জানাযার নামায আদায় করেননি। এই মতের অনুসারীদের মতে মৃতদেহের অনুপস্থিতিতেও জানাযার নামায আদায় করা রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর জন্য বিশেষভাবে বৈধ ছিল, কিন্তু তাঁর উম্মতের জন্য নয়। তৃতীয় মত অনুযায়ী, মৃত ব্যক্তি যেখানে মারা গিয়েছেন সেখানে তার জানাযার নামায না হয়ে থাকলে তবেই কেবলমাত্র তার অনুপস্থিতিতে দূরবর্তী স্থানে তার জন্য জানাযার নামায আদায় করা বৈধ। এই মতের অনুসারীদের মতে নাজ্জাশির মৃত্যুর পর আবিসিনিয়াতে তার জানাযার নামায আদায় করা হয়নি যেহেতু তিনি তাঁর ঈমান গোপন রেখেছিলেন এবং তাঁর সভাসদেরা ছিলেন খ্রিস্টান, ফলে রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মদিনাতে তাঁর জানাযার নামায আদায় করেছেন। চতুর্থ মত অনুযায়ী, মৃত ব্যক্তি যদি গোটা মুসলিম উম্মাহর জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যক্তি হয়ে থাকেন এবং তাঁর মৃত্যুর ফলে উম্মাহর মধ্যে এক অপূরণীয় ক্ষতি অনুভূত হয় তবেই কেবল যেকোনো দূরবর্তী স্থানে তাঁর জন্য জানাযার নামায আদায় করা বৈধ। এই মতের অনুসারীদের মতে নাজ্জাশি মুসলিম উম্মাহর জন্য এমন গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তি ছিলেন বলেই তাঁর মৃতদেহের অনুপস্থিতিতেও রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মদিনাতে তাঁর জানাযার নামায আদায় করেছেন, কিন্তু বিভিন্ন জিহাদে শহীদ হওয়া সাহাবাদের জন্য মদিনাতে জানাযার নামায আদায় করেননি।"
____________________________________________________________________________
বুঝতেই পারছেন একই এভিডেন্স ভিন্ন ভিন্ন উপসংহার জন্ম দিতে পারে, এবং সবগুলো মতই সঠিক। তাই মাজহাবসমূহ যদি কোন একটা বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন উপসংহারে পৌঁছেও মনে রাখতে হবে প্রত্যেকটা মতই ভ্যালিড এবং এসব মত হাজার বছরে স্কলাররা অনেক গবেষণা করে এরকম সিদ্ধান্তে পৌঁছেন।
তবে এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে যারা মাজহাবের অনুসারি (মুক্বাল্লিদ - তাক্বলিদকাারি) তাদের অবশ্যই তার দ্বীন এবং মাজহাব সম্পর্কে যত সম্ভব তত জানতে হবে, এবং অন্যান্য মাজহাব থেকে তার মাজহাবের কোন রুলিং ভিন্ন কেন, এবং সে ভিন্নতা কোন দলিলের ভিত্তিতে, কোন ব্যাখ্যার মাধ্যমে, সেটাও জানা দরকার। এতে সে নিজের মাজহাব নিয়ে তো জ্ঞান অর্জন করলই, অন্যান্য মাজহাব নিয়েও জ্ঞান অর্জন করল, এবং অন্যান্য মাজহাব সম্পর্কেও তার শ্রদ্ধা বজায় থাকবে।
কিন্তু একই সাথে এটাও নিশ্চয়ই সত্য যে প্রত্যেক মুসলমানই বড় স্কলার হবে না। ইসলামি জ্ঞান হাসিল করে বড় উলামা হওয়া অনেক সময়ের ব্যাপার, অনেক ত্যাগেরও ব্যাপার, এবং ফিক্বহের মত জটিল বিষয় বুঝার জন্য প্রচন্ড মেধা থাকা প্রয়োজন। তাছাড়া উম্মাহকে যদি সামনে এগুতে হয়, সেখানে উলামা বাদ দিয়ে অন্যান্য বেশিরভাগ মুসলমানদেরকে ডাক্তার, প্রকৌশলী, হিসাববিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ, পাইলট ইত্যাদি থেকে শুরু করে সৈনিক, কশাই, গাড়ীচালক, পরিষ্কারকর্মী এসবের প্রয়োজন অবশ্যাম্ভাবী। তাই সবার যদি ইসলামী জ্ঞান হাসিল করার সমান মেধা থাকেও (যেটা কখনও সত্য না), সবাইকে উলামা বানিয়ে ফেললে উম্মাহ মারাত্মক ক্ষতির মধ্যে পড়বে। তাই নন-ওলামাদের অবশ্যই ওলামাদের কাছেই যেতে হবে ইসলামি জ্ঞানের জন্য, যেমনটা ওলামারা যাবে ডাক্তারের কাছে যখন তার অসুখ হয়।
কোরানে হুকুম এসেছে যে যারা ইসলামের ব্যাপারে কম জ্ঞানী, তারা যেন নিজে নিজে ব্যাখ্যা না করে উলামাদের কাছে হাজির হয় (১৬:৪৩)। শুধু তাই নয়, কোরানের হুকুম উম্মাহর উচিৎ হবে যে আমরা যেন ইসলামি জ্ঞানে বিশেষজ্ঞ (ওলামা) শ্রেণী তৈরী করি, যাদের কাছ থেকে সাধারণ নন-ওলামারা গাইডেন্স পাবে (৯:১২২)। যেহেতু আল্লাহ এবং রাসুল স.-এর বাণী সরাসরি কোরান-হাদিস থেকে বুঝতে অনেক গভীর জ্ঞানের/ইলমের দরকার আছে, এবং যেহেতু আল্লাহ এবং রাাসুল সা.-এর বাণী যাতে বিকৃত না করি, বিকৃতভাবে না বুঝি আমরা সে ব্যাপারে আল্লাহ এবং রাসুল সা. বারবার সতর্ক করেছেন আমাদেরকে, তাই এটা তো দিনের আলোর মত পরিষ্কার যে সাধারণ মুসলমানরা যারা ফিক্হ শাস্ত্রের এক্সপার্ট না, তাদের উপর ওলামাদের অনুসরন করা অবশ্যাম্ভাবী।
যারা প্রথম দিককার মুসলিম ছিলেন, এমনকি প্রসিদ্ধ সাহাবায়ে আকরাম (রা.)-রাও এ ব্যাপারে ওয়াকিবহাল ছিলেন। যেমন ওমার (রাঃ) আবু বাকার (রাঃ)-এর ফাতোয়া অনুসরন করতেন, বলতেন "আবু বাকার (রাঃ)-র ফাতিয়া অনুসরন না করলে আমি আল্লাহর কাছে লজ্জিত হব"। পালাক্রমে ইবন মাসুদ (রাঃ)-এর মত পরাক্রমশালী সাহাবা এবং উম্মাহর সবচেয়ে প্রসিদ্ধ জ্ঞানীদের মধ্যে একজন হয়েও অনেক ক্ষেত্রে নিজের মত অনুসরন না করে ওমার (রাঃ)-এর মত অনুসরন করতেন। মহানবী (সাঃ)-এর ছয়জন সাহাবী সাধারণ লোকজনের কাাছে ফতোয়া দিতেন (লক্ষ্য করুন সব সাহাবারা কিন্তু ফতোয়া দিতেন না), এরা হলেন ইবনে মাসুদ, ওমার, আলি, যায়েদ বিন থাবিত, উবাই বিন ক্বা'ব, আবু মুসা আল-আশ্য়ারি। এদের মধ্যে তিনজন তাঁদের নিজেদের মতামতের উপর অন্য তিনজনের মতামতকে প্রাধান্য দিতেন: ইবনে মাসুদ ওমারকে, আবু মুসা আলিকে, যায়েদ উবাই বিন ক্বাবকে। মানে প্রসিদ্ধ সাহাবি এবং উলামা হয়েও তাঁরা অন্য সাহাবিদেরকে নিজেদের মতামতের জন্য তাক্বলিদ করতেন।
এখন আমরা ১৪০০ বছর পরে এসে দু'পাড়া আমপড়া, তিনটা ইউটিউব ভিডিও, দুটা লিফলেট পড়ে যদি মনে করি আমি তাক্বলিদ করবনা, মুজতাহিদ হয়ে যাব, কোরান-হাদিস পড়ে নিজেই ফতোয়া দিব, তখন সেটা আমার ইগো ছাড়া কিছুই নয়। এরকম চেষ্টা শুধু আমাকে তো ধ্বংস করবেই, পুরা উম্মাতকেও ধ্বংস করে দিবে।
ইসলামের ইতিহাসে আধুনিক কালে সালাফিবাদ প্রচার-প্রসার হওয়ার পূর্বে উম্মাহর বড় আলেমদের মধ্যে এমন মনে হয় একজনও পাবেন না যিনি মাজহাব অনুসরন করেননি, নিঃসন্দেহে শতকরা নিরানব্বুই ভাগ স্কলার মাজহাব অনুসরন করতেন। ইমাম বুখারি বলেন, বা মুসলিম, ইমাম গাজ্জালি বলেন, বা ইবনে কাথির, ইবন হাজর আল-আস্কালানি বলেন বা আব্দুল ক্বাদির জিলানি। উল্লেখ্য লা-মাজহাবি সালাফিদের সবচেয়ে বড় পীর হল ইবনে তায়মিয়্যা। ইবনে তায়মিয়্যা অনেক মেধাবী স্কলার হলেও তাঁর নামে ব্যতিক্রমী এবং ইসলামের মূলের বিপরীতে ভ্রান্ত আক্বীদা (যেটাকে anthropomorphism বলে) ধারণ করার অভিযোগ ছিল, তবে অনেকের ধারণা তিনি শেষ বয়সে এসে এসব ভ্রান্ত আক্বীদা সংশোধন করেছিলেন। ইবনে তায়মিয়্যা গত ছয়শত বছরে ইসলামি চিন্তায় খুবই প্রান্তিক হলেও সৌদি ফান্ডিংয়ে তাঁকে এখন উম্মাহর সবচেয়ে মেধাবী এবং সঠিক স্কলার হিসেবে সালাফিরা হাজির করেছে। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে ইবনে তায়মিয়্যাও কিন্তু মাজহাব অনুসরন করতেন, তিনি ছিলেন হানবালি মাজহাবের অনুসারী।
তাহলে আধুনিককালে এসে এই মাজহাবের প্রতি অসম্ভব ঘৃণারত একটা শ্রেণী কিভাবে আসল? এই লা-মাজহাবি আন্দোলন শুরু করেছিলেন মিশরীয় মডার্নিস্ট মুহাম্মদ আব্দুহ। তাঁর অন্যতম পরিচয় ছিল তিনি ছিলেন ফ্রিমেসন। আপনার অনলাইনে ফ্রিমেসন সম্পর্কে পড়তে পারেন, এটার উৎপত্তি এবং ইতিহাস পড়লে কিছুটা ধারণা হবে। তুরস্কের জংগী সেক্যুলার কামাল আতাতুর্কও ফ্রিমেসন ছিল বলে ধারনা করা হয়। আব্দুহর পরে তারই শিষ্য রশিদ রিদা ধীরে ধীরে লা-মাজহাবি আন্দোলনকে বর্তমান ওয়াহাবি লা-মাজহাবি আন্দোলনের সাথে একীভূত করেন। খেয়াল করেন সালাফি লিটারেলিজমের আগের স্কলাররা, যেমন ইবনে তায়মিয়্যা, কিন্তু মাজহাবি ছিলেন। শুধুমাত্র আধুনিক কালে এসে আব্দুহ আর তার শিষ্য এবং কিছু মডার্নিস্টা সাংগপাংগ মিলে লা-মাজহাবি সালাফি আন্দোলনের গোড়াপত্তন করেন। আব্দুহ আর রাশিদ রিদা পশ্চিমের বস্তুগত সাফল্য দেখে এবং তাদের ফ্রিমেসন বিশ্বাসের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে মাজহাবের "শেকল" থেকে মুসলমানদেরকে মুক্ত করতে উৎসাহিত হলেন।
উল্লেখ্য হাজার বছর ধরে সুন্নি মুসলমানদের মাঝে বড় রকমের বিভক্তি না হওয়ার মূল কারন মাজহাবের মাধ্যমে কোরান-সুন্নাহর ব্যাখ্যা এবং বাস্তবায়নকে শিক্ষিত/যোগ্য ওলামাদের ইখতিয়ারের মধ্যে রাাখাটা এবং মাজহাবগুলো পরস্পরের বৈধতা স্বীকার করাই দায়ী, এটা এখন একাডেমিক ইতিহাসে স্বীকৃত। এটা ইসলামের সাম্রাজ্যবাদী শত্রুরা ভালমতেই জানে। তাই তারা মুসলমানদের ঐক্যকে, বিশেষ করে উসমানীয় সাম্রাজ্যকে ভাংগার জন্য, সেসময় মাজহাব-বিহীন আন্দোলনকে মডার্নিস্টদের মাধ্যমে ধীরে ধীরে সমাজে প্রবেশ করায়। একইভাবে আশির দশকে যখন সাম্রাজ্যবাদীদের মুসলমানদের ব্যবহার করার দরকার পড়ল, তারা সৌদি রাজবংশের সহায়তায় লা-মাজহাবি সালাফিবাদ সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে দিল। লা-মাজহাবি তাক্বলিদ না মানা আন্দোলন থেকেই পরবর্তীতে আইসিস সৃষ্টি। আইসিস কারা স্বার্থ উদ্ধার করে সেটা এতদিনে পরিষ্কার হয়ে যাওয়ার কথা। এই আন্দোলন থেকেই মুসলমান হয়ে মুসলমানদেরকে মসজিদে নামাজরত অবস্থায় বোমা মেরে হত্যা করাকে জায়েজ বলা হয়।
সূুত্র এবং কিছু প্রাসংগিক লিংক (আমি অনুরোধ করব অন্তত প্রথম লিংকটার লেখা পড়ার জন্য, খুবই সুপাঠ্য):
১। Click This Link
২। http://www.masud.co.uk/ISLAM/ahm/newmadhh.htm
৩। https://markajomar.com/?p=1601
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই এপ্রিল, ২০১৮ সকাল ১১:০১