somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভাষা-সাহিত্য-অনুবাদ : আস্তিত্বের স্বরূপ

২৪ শে জুলাই, ২০১৪ সকাল ১০:৪৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

।। নাসীমুল বারী ।।

১.
মানুষ ভাব প্রকাশ করতে পারে। অন্য একজন সহজেই মনের ভাব জানতে পারে, এমন মনের ভাব প্রকাশটাই ভাষা। ভাষার মাধ্যমেই গুহাবাসী অবস্থান থেকে মানুষ সভ্যতার দিকে এগিয়েছে। ভাষা মানব সভ্যতার এক অপরিহার্য অংশ। শুধু সভ্যতা নয়—সৃষ্টির শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের একটা কারণ ভাষার জন্যে, এমন ধারনাও ভুল নয়।
পরিবেশ, পরিস্থিতি আর ভৌগোলিক কারণে মানব সভ্যতা পৃথিবীর প্রান্তরে প্রান্তরে ছড়িয়ে আছে। পৃথিবী বিশাল বলেই মানুষের এমন বিস্তৃতিও বিশাল। প্রতি প্রান্তরে মানুষের পারিবাশিক ও মনোজাগতিক অনুভবের ভিন্নতায় ভাব প্রকাশের ভাষাটাও হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন। পৃথিবীতে তাই আজ ভাষার অস্তিত্ব প্রচুর। সঠিক সংখ্যা নিরূপণ সম্ভব হয় নি।
ভাষার মার্জিত আর পরিশীলিত অবয়ব থেকেই সাহিত্যের উৎপত্তি। মনের বিশেষ আবেগ অনুভূতি সাধারণ দৈনন্দিন কথোপকথনের বাইরে বিশেষ কৌশলে উন্নততর পরিবেশে প্রকাশ করাটাই সাহিত্য। মানুষ তখনও ভাষার প্রকাশকে স্থায়ীত্ব দিতে লেখার কৌশল আবিষ্কার করে নি। মানুষের মনে আবেগ-অনুভূতিটা প্রথম দিকে মুখে মুখেই রচিত হতো। সূর-ছন্দেই মনের অনুভূতির প্রকাশ পেত—যা পরবর্তীতে সাহিত্যের অবয়বে সভ্যতায় স্থান করে নেয়। অলিখিত এ সাহিত্যই স্মৃতির সড়ক ধরে প্রচার ও বিকাশ লাভ করে। এভাবেই সাহিত্যের গোড়াপত্তন হয় সুনির্দিষ্ট তারিখ সময় ছাড়া দীর্ঘ সময়ের পথ পরিক্রমায়। সাহিত্যের জন্ম তাই সন-তারিখে বলা সম্ভব নয়। কোন ভাষার সাহিত্যই সুনির্দিষ্ট তারিখে জন্ম নিয়েছে—পৃথিবীতে এমন কোন ইতিহাস-উদাহরণ নেই। এসব বিচ্ছিন্ন ও অলিখিত মৌখিক সাহিত্য সভ্যতার একটা পর্যায়ে এসে সংগৃহিত ও লিখিত হয়ে স্থায়ীত্ব পেয়ে আজও বেঁচে আছে। যেমন ওডিসি, রামায়ণ, ইলিয়াড, মহাভারত প্রভৃতি আদি মহাকাব্যগুলো।
মানুষ যতই সভ্যতার পথে এগিয়েছে—সাহিত্যও তত মানুষের জানার আবেগ-অনুভূতির আগ্রহকে জাগ্রত করেছে। নিজেকে ছাড়িয়ে অপর সভ্যতা, সংস্কৃতিকে জানার জন্যে মনের মধ্যে তৃষ্ণা সৃষ্টি হয়েছে। এমন তৃষ্ণা মেটাতেই প্রয়োজন অপর সাহিত্যের রস্বাদন করা। নিজ ভাষা-সাহিত্যের বাইরে অন্যভাষা সাহিত্যের রস্বাদন করার মাঝেই পারস্পরিক ভাব বিনিময় হয়। এভাবেই ভাষার আন্তসংযোগ ঘটে পৃথিবীর বড় বড় ভাষা-সাহিত্যের রস ছড়িয়ে পড়েছে। ভিন্ন ভিন্ন ভাষার আন্তসংযোগের কৌশলকেই বলা যায় অনুবাদ।
সব মানুষের পক্ষে নিজ মাতৃভাষা ছাড়া অন্য আরো ভাষা শিখে তার সাহিত্য থেকে সে সভ্যতাকে জানা সম্ভব নয়। এমনটি বাস্তবও নয়। গুটি কয়েক মানুষ একাধিক ভাষা আয়ত্ব করে তবেই আন্তঃভাষার সংযোগ ঘটায়। আন্তঃভাষার সংযোগটা ভাষার রূপান্তর মাত্র। একটার সাথে আরেকটা ভাষার সম্মিলন ভাষা রূপান্তরের মাধ্যমেই তাবৎ পৃথিবীর ভাষাগুলো আজ খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। এমনিভাবে সমাজ-সভ্যতাও পরিচিত হয়ে উঠেছে।
রূপান্তরের ধারায় কিন্তু সমাজ সভ্যতার রূপান্তর ঘটে না; রূপান্তর হয় ভাব ও ভাষার। আন্তঃভাষার সংযোগটাই ভাষার রূপান্তরের অস্তিত্বে অনুবাদে নামান্তরিত। তাই অনুবাদ বললেই মনের চেতনায় ভেসে উঠে অন্যভাষাকে নিজের ভাষায় রূপান্তর হয়।
সাহিত্যের এ অনুবাদ প্রথায় কিন্তু ভাষার আক্ষরিক রূপান্তর ঘটে না। আক্ষরিক রূপান্তর হলে ভাষা-সাহিত্য উভয়টিরই অপমৃত্যু ঘটে। রবীন্দ্রনাথ তাই আক্ষরিক অনুবাদকে অনুবাদই মনে করতেন না। আসলে অনুবাদ করতে হয় কাঠামো ঠিক রেখে ভাবটাকে অন্যভাষায় রূপান্তরের মাধ্যমে। রূপান্তরে আন্তঃভাষার সংযোগে অনুবাদ হয়ে ওঠে সাহিত্যের একটি ‘ঘটকী ধারা'। দুই ভাষার মধ্যে ঘটকের মতো যোগসূত্র স্থাপনই অনুবাদ প্রথার কাজ। বড় দূরহ আর গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ অনুবাদ—আন্তঃভাষার সম্মিলন।

২.
পৃথিবীর পরিচিত বড় বড় ভাষাই গড়ে উঠেছে সুবিশাল ও সমৃদ্ধ সাহিত্যে। প্রতিটি ভাষার প্রকৃতি, ধ্বনি বৈশিষ্ট্য, স্বকীয় শব্দভান্ডার এবং সর্বোপরি প্রকাশভঙ্গি ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিরাজমান। প্রবাদ-প্রবচন, রূপক-প্রতীকেও ভাষায় ভাষায় ভিন্নতা দেখা যায়। যেমন, বাংলাভাষায় ‘বাড়ি' শব্দটি কখনও আবাসস্থল আবার কখনও আঘাত দেয়াকে বুঝায়। অথচ বানান, শব্দের উচ্চারণে সম্পূর্ণ একই। শুধু প্রকাশভঙ্গিতে এর পার্থক্য নিরূপণ করতে হচ্ছে। তাই দেখা যায় একই ভাষায় সকল ভাবের প্রতিরূপ বা প্রতিশব্দ অন্য ভাষায় পাওয়া যায় না। তাই বলে অন্যভাষায় ভাব প্রকাশ হবে না? হ্যাঁ হবে; আর তাই তা আক্ষরিক অনুবাদে নয়, ভাবানুবাদে।
আমরা আমাদের জাতীয় ভাষায় কথা বলি, লেখি। এসব কথা, লেখা আমরা সবাই বুঝতে পারি। এর কারণ আমরা সবাই একই ভাষাভাষি।
অন্যভাষার একজন যদি কোন কথা বলে বা লেখে আমরা তা বুঝতে পারি না। ওই কথা বা লেখার ভাব বুঝার জন্যে দুইটি পথ আছে। প্রথমত আমাকে সে ভাষাটি পুরোপুরি জানতে হবে, অথবা সে ভাষার কথা-ভাবটা কেউ একজন আমার ভাষায় রূপান্তর করে দিয়ে আমাকে তা বুঝতে ও জানতে সহায়তা করবে। এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় ভাবের এ পরিবর্তন বা রূপান্তরটাই অনুবাদ। অনুবাদ শব্দের আক্ষরিক অর্থই হলো ভাষার রূপান্তর।
ভাষার এ রূপান্তর তথা অনুবাদ ভাষা শিক্ষার একটি অংশ। ভাষা শিখতে গেলে অনুবাদ জানতে ও করতে হয়। অনুবাদ শুধু আক্ষরিক অর্থে করলেই হয় না। প্রতিটি ভাষার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য, গঠনরীতি, পদবিন্যাস, প্রবাদ প্রবচনের রীতি-নীতি আছে। অনুবাদের সময় অনুদিত ভাষার সকল রীতি-নীতি, গঠন বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি প্রয়োগ করে তবেই অনুবাদ করতে হয়। তাহলে অনুবাদটি গোছালো আর প্রকৃত ভাব জানাটাও পরিপূর্ণ হয়। এজন্যে আক্ষরিক অনুবাদ নয়—ভাবানুবাদই অধিক যুক্তযুক্ত।
একজন লেখক তাঁর ভাষায় শব্দ-প্রতীক, ধ্বনি বৈশিষ্ট্য ইত্যাদির মাধ্যমে সাহিত্যের এমন সব মণিহার সৃস্টি করেছে; যা শুধু তার ভাষা-সভ্যতায় নয়; পৃথিবীর সকলের জন্যেই অতীব গুরুত্বের দাবীদার। অনুবাদ প্রথা চালু না হলে এ দাবী পূরণ করে সাহিত্যের আলোয় সমাজ সভ্যতাকে আলোকিত করা সম্ভব হত না। অনুবাদ তাই সাহিত্যের এক গুরুত্বপূর্ণ ধারা। অনুবাদকে নিছক ভাষার রূপান্তর বা আন্তঃভাষার সম্মিলন ভাবলেই হবে না; এটি সাহিত্যের এক বনেদী শাখাও বটে। সাহিত্য-সমাজ-সভ্যতার এক গুরুত্বপূর্ণ আর বিশ্বস্ত সাথী। পুষ্টি সাধনের মাধ্যমে নিজ ভাষাকে সমৃদ্ধ করতেও অন্য ভাষার রূপ-বৈচিত্রের সংস্পর্শে আসতে হয়। এ রূপ-বৈচিত্র থেকে নির্যাস সংগ্রহ করে নিজ ভাষার প্রয়োজনীয় সম্মিলন ঘটাতে হয়। অনুবাদই এ ক্ষেত্রে যথার্থ ভূমিকা রাখে। অনুবাদের এমনি ভূমিকায় নতুন ভাব-তথ্য-জ্ঞান নিয়ে নিজ ভাষা সমৃদ্ধির পথে চলে। এ চলাই সাহিত্যের পুষ্টি সাধন।
অনুবাদকে তাই খাটো করে দেখার কোন অবকাশ নেই। অনুবাদের মাধ্যমে সাহিত্যের রস্বাদন করা যায় না; এমন ধারণাও সঠিক নয়।
অনুবাদ করার জন্যে নির্ধারিত ভাষার শুধু শব্দ-পরিচিতি আর সাধারণ পঠন, পাঠন যোগ্যতা নিয়ে অনুবাদ করলে ভাষার রূপান্তর যথাযথ হয় না। প্রতিটি ভাষারই শব্দ ভা-ার, ভাব প্রকাশ ক্ষমতা, রূপ-বৈচিত্রের একটা ধারাশৈলীর সীমা থাকে। আন্তঃভাষার সম্মিলনে অর্থাৎ অনুবাদ কর্মে পারস্পরিক ভাব বিনিময়ে এমন সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করার পথ খুঁজে পাওয়া যায়। সৃষ্টি হয় নতুন নতুন সাহিত্য উপাদান—শব্দশৈলী, ভাবশৈলী ইত্যাদি। তাই অনুবাদ করার আগে নির্বাচিত ভাষার মৌলিক ও সৃজনশীল ভাষাশৈলী সম্পর্কে তার পরিপূর্ণ নির্ভরশীলতা থাকতে হবে। তবেই হয়ত ভাষার রূপান্তরে পৃথিবীর সুমহান সাহিত্যের সুধারস স্ব স্ব ভাষার পাঠক গ্রহণ ও অনুধাবন করতে পারবে। অনুবাদকই তার যোগ্যতায় ভাষার রসের ট্রানজিট পয়েন্ট খুলে দিতে পারেন। অনুবাদক ব্যক্তি স্বত্তায় নয়—সাহিত্যস্বত্তায় বরণীয় হন।

৩.
অনুবাদকে কেউ মৌলিক বা সৃজনশীল সাহিত্য মনে করে না। এটা শুধু অনুবাদকের প্রতিই নয়—সাহিত্যের প্রতিও অবিচার করা হয়। আজ যোগাযোগ প্রযুক্তির উৎকর্ষতার শীর্ষে পৃথিবীর সভ্যতা। তাই বলা হয় ছোট হয়ে আসছে পৃথিবী। এর মানে এই নয় বিশাল পৃথিবী ক্রমান¦য়ে ধ্বংস হয়ে ছোট হয়ে আসছে। ভাবটা হলো আন্তযোগাযোগে পৃথিবীর এ প্রান্তের মানুষের ভাব, তাদের সমাজ-সভ্যতা কিংবা এখনই ঘটে যাওয়া কোন ঘটনা অন্য প্রান্তের মানুষ তাৎক্ষণিক জানতে ও দেখতে পারে। পৃথিবীকে এমন ছোট করার কাজটা শুরু হয় মূলত সাহিত্যের অনুবাদের মাধ্যমেই। একহাজার বছর পূর্বে সংস্কৃত ভাষায় রচিত ‘পদুমাবৎ'এর ভাব-রস আমরা বাংলায় পাই মহান সাহিত্যিক আলাওলের বদৌলতে ‘পদ্মাবতী' নামে। ষোড়শ শতকের ইংরেজ শেক্সপীয়রকে আজ আমরা অনায়াসেই পড়ে ফেলি আমাদের বাংলায়। বুঝে নিতে পারি সে সময়ের ইংরেজ সমাজ সভ্যতাকে। শুধু কি তাই—আদি সাহিত্য মহাকাব্য ওডিসিকে আমরা আজ সহজেই অনুধাবন, অনুভবে গ্রহণ করে এর রস-সূধা পান করি। মধ্যযুগের ওমর খৈইয়ামের রুবাইয়াতও আজ যেন এখনকারই তরমতাজা সাহিত্য। এমন সব সুযোগ অনুবাদের বদৌলতেই আমরা পাচ্ছি।
রাশিয়ায় কিংবা ইংরেজ মুলুুকের একজন সাধারণ পাঠকও আজ বাংলার রূপ-যৌবন উপলব্ধি করে রবীন্দ্র-সাহিত্যের অনুবাদের বদৌলতে।
হাজার হাজার বছর আগ থেকেই অনুবাদের মাধ্যমে পৃথিবীর বিস্তৃত সমাজ-সভ্যতার স্বরূপ পারস্পরিক বিনিময়ে কাছে চলে আসে। এভাবেই পৃথিবীকে ছোট করার সংগ্রামটা শুরুহয় সাহিত্যের অনুবাদী ধারার। তাই শুধু যোগাযোগ মাধ্যমে নয়, সাহিত্যের অনুবাদী ধারাতেই পৃথিবী ছোট হবার কাজ শুরুহয়েছে।
অনুবাদের এ অনন্য ভূমিকা অনুবাদকে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে একটা ভিন্ন মাত্রার সাহিত্য ধারার মর্যাদা দিয়েছে। অনুবাদ সৃষ্টিশীলতারও উৎকর্ষ কার্যকারণ। আক্ষরিক অনুবাদতো সাহিত্যই না; এমন কি ভাষাও নয়। ভিন্ন ভাষার সৃষ্টিশীল সাহিত্যের রস নিজে গ্রহণ করে নিজ ভাষার অবয়বে তাকে গড়ে তুলতে হয়। অনুবাদে সৃষ্টিশীলতার রূপান্তর ঘটে স্ব স্ব ভাষার মহিমায়—মূল ভাষার ভাব ও কাঠামো ঠিক রেখে। অনুবাদ তাই হয়ে ওঠে ভিন্ন মাত্রার সৃষ্টিশীল সাহিত্য।
নিজ সাহিত্যে শুধু একটি ভাষাশৈলী ও ভাব-অনুভূতি জানলেই চলে—কিন্তু অনুবাদে দুই ভাষারই শৈলি আর ভাবকে ধারণ করতে হয়। তারপর সৃষ্টিশীলতার পথে হাঁটা। অনুবাদের সফলতা এভাবেই আসে।

৪.
সাহিত্য কালের পট। যে কালের সাহিত্য সে কালের সাহিত্যিক রীতিনীতি তাতে স্পষ্ট থাকে। বাক্যগঠন, বাক্যপ্রকরণ, ভাষাশৈলী সবই কালকে ধারণ করেই সাহিত্যের অস্তিত্ব নিবন্ধিত হয়। এভাবে সাহিত্য হয়ত বেঁচে থাকে যুগ যুগান্তরে।
কিন্তু অনুবাদে কোন রীতি অনুসৃত হবে? পাঁচশত বছর আগেকার সাহিত্যের সাথে আজকের সাহিত্যের আঙ্গিক ও গঠনশৈলীতে বিস্তার ফারাক। যেমন, আমাদের বাংলা সাহিত্যে গদ্যের আগমন ১৮০১ সালে। তখনকার ভাষাশৈলী আজ আজকের ভাষাশৈলী এক নয়। সেদিনের ভাব প্রকাশের ধরন, মুন্সিয়ানা, কৌশল, রূপক প্রতীক আর আজের এসবের সাথে মিল নেই। তখন ‘আমারদের' বহুবচনের শব্দটি এখন ‘আমাদের'। এই তো শ'খানেক বছর আগেও এদেশের রেলের বগির আসন নির্দেশিকার লেখা থাকত ‘১৫ জন বসিবেক।' সে বক্তব্যই কখন যেন রেল কর্তৃপক্ষ করে ফেলেন ‘১৫ জন বসিবেন'। এই যে ‘বসিবেক'-এর ‘ক' থেকে ‘ন' প্রতিস্থাপন হয়েছে— তা সময় ও কালের কারণে ভাষাশৈলীর সজ্জায় হয়েছে। তেমনি অনুবাদের ক্ষেত্রেও। অনেক আগের সাহিত্যিক ভাষাশৈলীকে যদি এ সময়ে অনুবাদ কবি— তবে অনুবাদে নব সৃষ্টিশীল ভাষাটি হবে এখনকার। যেহেতু অনুবাদ এ সময়ের; তাই সৃষ্টিশীলতাও এসময়েরই। যদি প্রাচীন রীতিকেই আঁকড়ে ধরে অনুবাদ করি— তবে তা অনুবাদ হবে, অনুবাদী সাহিত্য হবে; ভাব-ভাষার রূপান্তর হবে; কিন্তু মার্জিত ভাষাশৈলীতে অনুপম সৃষ্টি বলা যাবে না। অতএব পরিশ্রমটা বৃথা। অনুবাদে পরিশ্রম যখন করবই; তখন অন্তত কৃতিত্বটুকু মনে রাখার মতই করি। এতেই অনুবাদটা সার্থক।

৫.
সাহিত্যের রস্বাদন করতে মূল সাহিত্য বা অনুবাদ সাহিত্য—দুটোই একই স্বত্তা। এটা আমি সর্বান্তকরণে বিশ্বাস করি। ভিন্ন ভাষা জানা না থাকলেও অনুবাদের মাধ্যমেই সাহিত্যের রস্বাদন করা সম্ভব বলেই পৃথিবীতে আজ অনুবাদ সাহিত্য এক বিশাল ভা-ার সাজিয়ে বসে আছে। অনুবাদ সাহিত্যের বদৌলতে আজ আমরা ইংরেজ, গ্রিক, চীনা, আফ্রিকীয়, আরব বিভিন্ন প্রাচীন সভ্যতা-সাহিত্যকে জানতে পারি। সে সমাজ, রীতিনীতি সম্পর্কে ধারনা করতে পারি।
আমাদের বাংলা সাহিত্যকে অনুবাদ করে বিশ্ব সাহিত্যে, বিশ্ব সমাজে জায়গা করে দেয়া উচিৎ আরো বেশি বেশি পর্যায়ে। আমার মনে হয় বাংলা সাহিত্যের বিশ্ব দরবারে পদচারণা খুব একটা নেই।
বাংলা একাডেমীর—বাংলাভাষা ও সাহিত্যের গবেষণা বিষয়ক একটি প্রতিষ্ঠান। এক্ষেত্রে বাংলাভাষা ও সাহিত্যের বিস্তর গবেষণা, প্রকাশনা হয়। কিন্তু এদের উদ্যোগে বাংলা সাহিত্যের রূপান্তরে আন্তঃভাষার সম্মিলন হয় বা হচ্ছে এমন প্রকল্প নজরে পড়ে নি। প্রতিবছর বাংলা একাডেমি যে পরিমাণ বাংলা গ্রন্থ প্রকাশ করে; তার কিয়দংশ অনুবাদ করে বিশ্ব সাহিত্যে তুলে ধরা উচিৎ বলে আমি মনে করি।

আমাদের লেখকদেরও এ দায় রয়েছে। আমরা অন্য সাহিত্যের যেমন অনুবাদ করি— তেমনি আমাদের সাহিত্যেরও অনুবাদ করতে পারি। আমরা অনুবাদ করলে একজন ভিন্ন ভাষীর চেয়ে বেশি সফল অনুবাদ হবে, এমনটি আমি খুব বিশ্বাস করি। এমন কাজটি করলে ভাষা-সাহিত্য-অনুবাদ— সবই অস্তিত্বের স্বরূপে কালের ক্যানভাসে অক্ষয় হয়ে থাকবে।

জাগ্রত চৈতন্যে এর পথে সুধিজন এগিয়ে এলে অন্তত বাংলা সাহিত্যই লাভবান হবে— এটুকু বিশ্বাস করতে আমার দ্বিধা নেই।
#

অন্যান্য প্রবন্ধ পড়তে টোকা দিন :
স্বাধিকার চেতনার রাজনৈতিক পরিভাষা ‘বিদ্রোহ’
লেখকের স্বাধীনতা
‘লিঙ্গ’-এর বৈয়াকরণিক পরিবর্তন : একটি প্রস্তাবনা
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহমিকা পাগলা

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


এক আবেগ অনুভূতি আর
উপলব্ধির গন্ধ নিলো না
কি পাষাণ ধর্মলয় মানুষ;
আশপাশ কবর দেখে না
কি মাটির প্রণয় ভাবে না-
এই হলো বাস্তবতা আর
আবেগ, তাই না শুধু বাতাস
গায়ে লাগে না, মন জুড়ায় না;
বলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩




তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×