ফুটবল উচ্চতায় ’৫৮-এর পেলেকে হয়তো ধরতে পারলেন না। কিন্তু বিশ্বকাপে নিজের তারকা ইমেজকে নেইমার কোথায় নিয়ে গেছেন, তা গত একদিনেই পরিষ্কার। উসাইন বোল্ট থেকে ক্রিস গেইল। বিশ্বকাপ আয়োজনের বিরোধী রোমারিও থেকে জিমন্যাষ্ট নাদিয়া কোমানিচি! সবার সমবেদনাই পৌঁছে গেছে নেইমারের শিয়রে। অবস্থাটা এমন যে, এখন বোধহয় শুধু পোপ বেনেডিক্ট এবং বারাক ওবামার প্রতিক্রিয়া আসাই বাকি আছে!
মার্কিনিরা ফুটবল থেকে বেসবলটা ভালো বোঝে। তাই দেশটির এক দৈনিকের শিরোনাম- ব্রাজিল জিতল, নেইমার হারল। হিসেবি জার্মান গণমাধ্যম বিশ্বকাপে নেইমারের অনুপস্থিতিকে তুলনা করছে,একসঙ্গে ন্যুয়ার, লাম, কোসা, মুলার এবং পোডলস্কিদের না থাকার সঙ্গে! আর্জেন্টাইন মিডিয়ার দাবি,ব্রাজিল তাদের সোনার ছেলেটিকে হারানোয় তারাও শোকাহত ! অথচ ইতিহাসই দু’দেশের ফুটবল বৈরিতার সাক্ষী। কিন্তু এখন তারা সবাই মিলে মগ্ন প্রার্থনায়, যেন দ্র“তই সেরে ওঠেন নেইমার। ব্রাজিলের অনুশীলন ক্যাম্প তেরেসপোলিস থেকে হেলিকপ্টারে নেইমারকে তার বাসায় নিয়ে যাওয়ার পথে বাইরে দাড়িয়ে ছিল আর্জেন্টাইন সমর্থকরা। হেলিকপ্টার উড়াল দিতেই ব্রাজিলিয়ানদের সঙ্গে তারাও গলা মিলিয়ে চিৎকার করে বলে, ‘ভরসা রাখো নেইমার। শক্ত থাকো।’
পৃথিবীর দুই গোলার্ধেই এখন নেইমারের প্রতি এক দফা এক দাবি ‘ভরসা রাখো। শক্ত থাকো।’ কলম্বিয়ার বিপক্ষে স্ট্রেচারে করে নেইমারকে মাঠ থেকে বের করে নিয়ে যাওয়ার সময় গ্যালারিতে হাউমাউ করে কেঁদেছেন তার বান্ধবী। স্ট্রেচারে তার চলে যাওয়ার দৃশ্যটা এ বিশ্বকাপের সবচেয়ে মর্মান্তিক দৃশ্য। সেই ধাক্কায় এখন ব্রাজিলিয়ানরাও দুই ভাগে বিভক্ত। এক ভাগের দাবি, পেলে বাষট্টির বিশ্বকাপে সেমিফাইনাল থেকে খেলতে পারেননি। কিন্তু ব্রাজিল সেবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল! আরেক ভাগের দাবি, ছেলেটা ’৬৬ বিশ্বকাপের পেলেকে অনুসরণ করল। শোকের দহনটা এতই তীব্র যে, খোদ পেলে পর্যন্ত বাস্তবতা ভুলে ’৬২কে টেনে এনে বলেছেন, ‘আমারও এমন ঘটেছিল। সে বার যেমন আমরা চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম, এবারও পারব!’
বাষট্টিতে যিনি একা ব্রাজিলকে চ্যাম্পিয়ন করেছিলেন, তাকে নিয়ে স্থানীয় লোকগাঁথা হলো, ম্যাচের আগে সারারাত মদ খেতেন! ম্যাচ শেষেও দৃশ্যটা পাল্টাত না! আর ম্যাচের দিন সকালে জিজ্ঞেস করতেন, আজ কার সঙ্গে খেলা? হায়! স্কলারির ঝুলিতে কোনো গারিঞ্চা নেই। সবেধন নীলমণি বলতে যিনি আছেন, তিনি নিজেই এখন ব্রাজিলের হৃৎপিন্ড এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যাওয়ার কারণ। আকাশে পুর্ণিমা জাঁকিয়ে বসামাত্র তাকে অদ্ভুতভাবে অমাবস্যা ঢেকে দিলে যে দৃশ্যের সৃষ্টি হয়, ব্রাজিলজুড়ে এখন সেই পরিস্থিতি। এখনও গ্রেটদের কাতারে জায়গা করে নিতে না পারলেও, যেহেতু সেই পথেই হাঁটছেন নেইমার , তাই স্বাভাবিকভাবেই তিনি দূরদর্শী। শোক পালনের জন্য ব্রাজিলের কোথাও জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়নি, কিংবা রাষ্ট্রীয় কোনো বার্তাও প্রকাশ করা হয়নি। কিন্তু গোটা ব্রাজিল আচমকা ঢাকা পড়ে গেছে এক অদ্ভুত মৌনতায়। এ যেন, আরেক ‘মারাকানাজ্জো!’
৬৪ বছর আগে সেবার ব্রাজিলকে শোকের সরোবর থেকে টেনে তোলার মতো কেউ ছিল না। কিন্তু এবার ব্যতিক্রম। শোকে মুহ্যমান দেশের জনগণ এবং সতীর্থদের জাগিয়ে তোলার ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন ট্র্যাজেডির নায়ক নিজেই! শনিবার অনুশীলন ক্যাম্প ছাড়ার আগ মুহুর্তে ১ মিনিট ২০ সেকেন্ডব্যাপী এক আবেগঘন ভিডিও বার্তায় নেইমার জানান তার স্বপ্ন এবং সাধের কথা। সঞ্চালকসহ সবাইকে চোখের জলে ভাসিয়ে দেওয়া সেই বাক্যগুলো এ রকম‘আমার বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলার স্বপ্নটা শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বপ্ন এখনও শেষ হয়ে যায়নি। জীবন এভাবেই বয়ে চলে। আমি নিশ্চিত, স্বপ্নটা পূরণের জন্য সম্ভাব্য সবকিছুই করবে আমার সতীর্থরা। সব বাধা পেরিয়ে এগিয়ে যাব আমরা। চ্যাম্পিয়ন হয়েই উদযাপন করব।’
আর্জেন্টিনা এখন প্রার্থনায় মগ্ন। ব্রাজিল একই সঙ্গে কাঁদছে এবং রাগে ফুঁসছে। তাদের অশ্রুর প্রতিটি বিন্দু এখন স্ফুলিঙ্গ হয়ে একটা নামই খুঁজে ফিরছে- হুয়ান জুনিগা। নেইমারের স্বপ্নের অপমৃত্যূ ঘটিয়েছে কলম্বিয়ান এ ডিফেন্ডারের হাঁটুর গুঁতো। তাই কলম্বিয়ার হোটেলের সামনে সারারাত বোমা ফাটিয়েছে ব্রাজিল সমর্থকরা। জুনিগা চিঠি পাঠিয়ে মা প্রার্থনার পরও সোশ্যাল মিডিয়ায় রেহাই পাননি হুমকির তীর থেকে‘কলম্বিয়া যে হোটেলে আছে, তার ছাদে হেলিকপ্টার নামাতে হবে। নইলে জুনিগা ব্রাজিল ছাড়তে পারবে না। তুমি বের হলেই মেরে ফেলব। কোন সাহসে এমন কাজ করলে!’
’৬৬ বিশ্বকাপে বুলগেরিয়ার বিপক্ষে প্রচন্ড খেয়ে মাঠের বাইরে চলে যান পেলে। এরপর পর্তুগাল ম্যাচেও মোরেসের কাছে তিনি প্রচন্ড মার খান। কিন্তু ইংরেজ রেফারি জর্জ ম্যাককাবি কার্ড অবধি দেখাননি মোরেসকে। নেইমারের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই ঘটল। আর তাই বাইশ বছরের তরুণটির যে হাস্যোজ্জ্বল ছবিটাকে ‘পোষ্টার’ বানিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল বিশ্বকাপ, কেউ জানত না শেষ পোষ্টারে ফ্রেমবন্দী হবে তার ব্যথাতুর মুখে ষ্ট্রেচারে করে মাঠ ছাড়ার ছবিটা !
(অফিসে বসে ঝিমুচ্ছিলাম। হঠাৎ কিছু একটা লিখতে ইচ্ছে করলো। লিখে ছেড়ে দিলাম।ভুল-ত্রুটি মার্জনার চোখে...)
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুলাই, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:২৯