(সিদ্ধার্থ জানে, এ চিত্র সীমান্তের দুই পাড়ের মিথস্ক্রিয়ারই অংশ। সঙ্গে আকাশ সংস্কৃতির জোয়ার তো থাকছেই। প্রতিদিন চিকিৎসার জন্য দিল্লি ছুটে যায় অসংখ্য আফগান নর-নারী। ভারতকে তারা সত্যিকার অর্থেই ভালবাসে। কিন্তু ভারতীয় ক্রিকেট কি তাদের পাত্তা দেয় ? নাকি নাক সিঁটকাতে পারলে বাঁচে ? সিদ্ধার্থ নুরের কাছ থেকে জেনেছে, গত বছর এক মিটিংয়ে বিসিসিঅাই সভাপতি শ্রীনিবাসন তাকে সরাসরি বলেন, দশ মিনিট সময় পাবে। এরমধ্যে যা বলার বলো।
আফগান জাতীয় দল কখনো ভারতের বয়সভিত্তিক দলগুলোর সঙ্গেও খেলার সুযোগ পায়নি। ভারতের অত্যধূনিক ট্রেনিং একাডেমিগুলোতে সময় কাটানো তো অনেক দুরের ব্যাপার !)....তৃতীয় পর্বের পর.....
ভারতের ঠিক বিপরীত প্রান্তে দাঁড়িয়ে পাকিস্তান। দেশটিকে বলা যায়, আফগান ক্রিকেটের 'পালক পিতা'। আফগান 'এ' দল এরই মধ্যে বেশ কয়েকবার পাকিস্তান সফর করেছে। লাহোরের জাতীয় ক্রিকেট একাডেমি মোহাম্মদ নবীদের নখদর্পনে। সেখানে তাদের মিসবাহদের মতোই অধিকার । আর্ন্তজাতিক আঙিনায় আফগানদের প্রথম প্রতিপক্ষও পাকিস্তান। যদিও এই মুহুর্তে পাকিস্তানকে খুব একটা পছন্দ করতে পারছে না আফগানরা। রাজনৈতিক বিবেচনায় তো প্রশ্নই ওঠেনা। ভূ-রাজনীতি আসলে খুবই জটিল বিষয়। আফগানিস্তানের সঙ্গে পাকিস্তানের ভৌগলিক নৈকট্য অস্বীকার করার উপায় নেই। হামিদ কারজাই একবার বলেছিলেন-'আফগানিস্তান এবং পাকিস্তান দুই অবিচ্ছেদ্য সহোদর।' ডুরান্ড লাইন সীমান্তের এপার-ওপারের পশতু জনগোষ্ঠিকে শুধু ভৌগলিকভাবেই আলাদা করতে পেরেছে। কিন্তু তাদের শরীর এবং মনের মিথস্ক্রিয়া থামানো সম্ভব হয়নি । পাকিস্তান এখনো আফগান মাটিতে প্রতি নিয়ত রক্তের হোলি খেলে চলা তালেবানের নিরাপদ আশ্রয়স্থল । এসব ভাবনার ফাঁকে সিদ্ধার্থের মনে ঘা মারে বেশ প্রচলিত একটি কৌতুক-'ভারত হলো, আফগানিস্থানে সেই প্রেমিকা, যাকে তারা কখনো স্পর্শ করতে পারেনি। তাই সুবিধা বুঝে পাকিস্তানকে বিয়ে করেছে আফগানিস্থান' !
সিদ্ধার্থ ভেবে দেখে, তার দেশের এমন বিমাতাসুলভ আচরণ আফগান ক্রিকেটের জন্য একদিক থেকে শাপেবর। দড়ির বাইরের দুনিয়াটা কত স্বার্থপর- তা বোঝার মাধ্যমে খুব ধীর গতিতে হলেও আফগান ক্রিকেটের উন্নতি কিন্তু থেমে নেই । বাংলাদেশের মুখোমুখি হয়ে বিশ্বকাপ অভিযান শুরু করবে তারা। এজন্য কোন ভাতা নেই ! বোনাসের প্রশ্নই ওঠেনা। কিন্তু তারপরও চ্যালেঞ্জটা জীবিত - বাংলাদেশ এবং স্কটল্যান্ডকে অবশ্যই হারাতে হবে। এরপর অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ড এবং শ্রীলংকার মধ্য থেকে যে কোন এক 'দৈত্য'কে পরাভূত করা-তাহলেই পরবর্তি রাউন্ডে উত্তরণ। ক্রিকেটের পথে আরও একধাপ এগিয়ে যাওয়াও বলা যায়।
গ্রীক পুরাণের 'ফিনিক্স' পাখির কথা মনে পড়ে যায় সিদ্ধার্থের। আফগান জাতীয় দলে খেলা ক্রিকেটারদের বেশিরভাগই যুদ্ধশিশু। কিন্তু দড়ির ভেতরে সবাই সমান। শুধু জয়ই তাদের একসুত্রে গেঁথে রাখতে পারে। হতাশা অাছে, বাধাও বিস্তর ; কিন্তু, আশার কথা হলো প্রত্যাশার পরিমাণটাও নেহায়েত কম নয়।
জন্মভূমি এবং পরিবারের বিরোধিতা উপেক্ষা করে এখানে কাজ করছেন কোচেরা। কাবুলে তাদের প্রাত্যহিক জীবনের রোজনামচা একেবারেই অন্যরকম অভিজ্ঞতা। ফোরহুইল ড্রাইভের পশমী সিটে গা এলিয়ে দিয়ে সিদ্ধার্থ তার ভাবনার পাখা মেলে দেয়- আচ্ছা, সে চলে যাওয়ার পরও তো সাইদ রহমানকে ক্রিকেট সর্ম্পকিত নানা প্রশ্নবানে অস্থির করা থেকে নিস্তার দেবে না ক্ষুদেরা ? লন্ডনে মাথার ঘাম পায়ে ফেলেও তো সামান্য ফুরসত পেলেই ইজাতের ওপর নজর রাখবেন তার চাচা ? ফরিদ উইকেট পেলে আনন্দের আতিশায্যে নিশ্চয়ই আকাশপানে কয়েক রাউন্ড একে-৪৭ এর গুলি খরচ করবে তার গর্বিত পিতা ? আগামি শীতে আরেকটু ভাল ঘরের আশায় বুক বেঁধেছেন আফসার ? এতসব আশার মাঝে কেউ কেউ তাদের পেশাদারিত্বকে আরও একধাপ এগিয়ে নেবে। বাকিরা হয়তো ভুলে যাবে জাতিগত সহিংসতা। ঐক্যবদ্ধ হবে একই সীমানার ছায়াতলে। স্বপ্নের চারাগাছে এখন থেকেই জলসিঞ্চন করছে অনেকে- আমার সন্তানকেও যদি মোহাম্মদ নবী বানাতে পারতাম ! ব্যবসায়ীরা দিনরাত খেটে চলছেন। নবী-শেহজাদদের মুখ বেচে কিভাবে, আরও দুই পয়সা বেশি রোজগার করা যায় ? প্রশাসকদের লক্ষ্যও অভিন্ন। সত্যিই, এই বিশ্বকাপ তার বাকি সন্তানদের কাছে হতে পারে মহাগুরুত্বপুর্ণ, কিন্তু আফগানদের কাছে তা বাঁচা-মরার লড়াই। প্রাগৈতিহাসিক কালের অতিকায় হস্তী লোপ পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু ওই একই কালের ক্ষুদ্র তেলাপোকা তো আজও টিকে আছে স্বমহিমায় ? আফগানরা তেলাপোকা নয়, ফিনিক্স পাখির মতো ছাইভষ্ম থেকে উড়াল দিতে চায়। আর তাই, বিশ্বকাপে রোজ প্রত্যুষে ধূমায়িত 'সেঞ্চা'র সৌরভে মৌ মৌ করবে প্রতিটি আফগান কুঁড়েঘর। কান পাতলে, নান রুটির দেহ কয়েক টুকরো হওয়ার শব্দও হয়তো ভেসে আসবে ! তখন এ যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকাটি কি কেবল শুধুই উষর মরুভূমি ? নাকি -'‘ইস দ্যশত ম্যেইন এক শেহের হ্যায়' ?
তথ্যসুত্র : দ্য ক্রিকেট মান্থলি অবলম্বনে ।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জানুয়ারি, ২০১৫ রাত ২:৪৬