নবীজীর প্রতি ভালবাসা ঈমানের অঙ্গ। মুমিনমাত্রই নবীপ্রেমিক। নারী সাহাবীদের নবীপ্রেমের বিভিন্ন ঘটনায় ইতিহাসের পাতা উজ্জ্বল।
এখানে নবীপ্রেমিক কয়েকজন মহিয়সী রমনীর ঘটনা উল্লেখ করছি। যাদের অনন্য রাসূল প্রেমের ঘটনা ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। এসব ঘটনা আমাদের হৃদয়েও প্রিয় নবীজীর ভালবাসার সৌধ গড়তে সাহায্য করবে হয়তো।
আল কুরআনে মহান আল্লাহ পাক নির্দেশ দিয়েছেন-
قُلْ إِن كُنتُمْ تُحِبُّونَ اللّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَاللّهُ غَفُورٌ رَّحِيمٌ
''বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তাহলে আমাকে অনুসরণ কর, যাতে আল্লাহ ও তোমাদিগকে ভালবাসেন এবং তোমাদিগকে তোমাদের পাপ মার্জনা করে দেন। আর আল্লাহ হলেন ক্ষমাকারী দয়ালু।'' সূরাহ আলে ইমরান, আয়াত-৩১
অন্য আয়াতে বর্নিত হয়েছে-
وَمَن يُطِعِ اللّهَ وَالرَّسُولَ فَأُوْلَـئِكَ مَعَ الَّذِينَ أَنْعَمَ اللّهُ عَلَيْهِم مِّنَ النَّبِيِّينَ وَالصِّدِّيقِينَ وَالشُّهَدَاء وَالصَّالِحِينَ وَحَسُنَ أُولَـئِكَ رَفِيقًا
''আর যে কেউ আল্লাহর হুকুম এবং তাঁর রসূলের হুকুম মান্য করবে, তাহলে যাঁদের প্রতি আল্লাহ নেয়ামত দান করেছেন, সে তাঁদের সঙ্গী হবে। তাঁরা হলেন নবী, ছিদ্দীক, শহীদ ও সৎকর্মশীল ব্যক্তিবর্গ। আর তাদের সান্নিধ্যই হল উত্তম।'' সূরাহ আন নিসা, আয়াত-৬৯
হাদিসে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
الْمَرْءُ مَعَ مَنْ أَحَب
''যে যাকে ভালবাসে সে তারই সঙ্গী হবে।''
অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে-
''যতক্ষন পর্যন্ত পিতা, সন্তানাদি এমনকি সমস্ত মানুষের চেয়ে আমাকে বেশি ভাল না বাসবে ততক্ষন পর্যন্ত তার ঈমান পরিপূর্ন হবে না।''
উম্মে হাবীবা রা. নিজ পিতাকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, তুমি মুশরিক, নাপাক। এ বিছানার উপযুক্ত নও।
ঘটনার পূর্ণ বিবরণ ইবনে কাছীরের বর্ণনায় নিম্নরূপ :
‘অষ্টম হিজরীর ঘটনা। ঐতিহাসিক মক্কা বিজয়ের পূর্ব মুহূর্তে একদিন কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান মদীনায় হাযির। মদীনায় ঢুকেই তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন সঙ্গিনী তার কন্যা হযরত উম্মে হাবীবার ঘরে প্রবেশ করলেন। আবু সুফিয়ান বিছানায় বসতে গেলে উম্মে হাবীবা বিছানা গুটাতে শুরু করলেন। বিষয়টি লক্ষ্য করে আবু সুফিয়ান বিস্মিত হলেন। উম্মে হাবীবাকে জিজ্ঞাসা করলেন, মা আমি কি এ বিছানার উপযুক্ত নই? না এ বিছানা আমার উপযুক্ত নয় বলে তুমি মনে করছ? উম্মে হাবীবা বললেন, এটা আল্লাহর রাসূলের বিছানা। আর তুমি মুশরিক, নাপাক। তাই আমি চাইনা যে, তুমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিছানায় বস। এ কথা শুনে আবু সুফিয়ান মেয়ের কাছ থেকে বের হয়ে অন্যত্র চলে গেলেন।-আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ৩/৪৭৩ (গযওয়াতুল ফাতহ)
নবীজীকে রক্ষা করতে গিয়ে নিজের দেহকে ক্ষতবিক্ষত করলেন উম্মে আমারা :
উম্মু সাদ বিনতে সাদ বলেন, আমি একদিন উম্মে আমারার নিকট গিয়ে বললাম খালা! আপনার যুদ্ধ-অভিজ্ঞতা সম্পর্কে কিছু বলুন। তিনি বললেন, উহুদ যুদ্ধে আমি সকালেই বের হয়ে পড়ি। লোকজন কী করছে তা আমি দেখছিলাম। আমার সাথে একটি পানিভর্তি মশক ছিল। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট পর্যন্ত পৌঁছে যাই। সেখানে তাঁর সাহাবীগণ ছিলেন। তখন মুসলমানদের বিজয়ের পালা চলছিল। কিন্তু পরবর্তীতে যখন মুসলমানগণ পরাজিত হলেন, তখন আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট গিয়ে আশ্রয় নিলাম। আমি তাঁকে রক্ষার জন্যে সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হই। তরবারি পরিচালনা করে এবং তীর নিক্ষেপ করে শত্রুদেরকে দূরে তাড়িয়ে দিই। এতে আমি যখম হই। বর্নণাকারী উম্মু সাদ বলেন- ‘আমি তাঁর কাঁধে যখমের চিহ্ন দেখেছি। সেটি ছিল বৃত্তাকার গভীর গর্ত।’ কে এই আঘাত করেছিল তা আমি তাকে জিজ্ঞেস করি। তিনি বললেন, ওই আঘাত করেছিল অভিশপ্ত ইবনে কুমাইয়্যা। সাথীগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে দূরে চলে যাওয়ার পর সে এসে বলল, মুহাম্মাদ কোথায় আমাকে দেখিয়ে দাও। তখন আমি নিজে এবং মুসআব ইবনে উমায়ের ও অন্য কতকলোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রক্ষার জন্য দাঁড়িয়ে গেলাম। তখন সে আমার উপর এ আক্রমণ চালায়।-আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ৩/১৬৪-১৬৫
বিখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনে ইসহাক লিখেন-
‘উহুদ যুদ্ধ শেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবাগণ বাড়ি ফিরছিলেন। তারা যখন বনূ দীনার গোত্রের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন তখন এক মহিলার (ওয়াকিদীর বর্ণনা মতে যার নাম সুমাইয়া বিনতে কায়েস) সাথে তাদের সাক্ষাৎ হল যার স্বামী, ভাই ও পিতা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথী হয়ে যুদ্ধ করতে করতে উহুদ ময়দানে শহীদ হয়েছিলেন। লোকেরা তাকে তাঁদের মৃত্যু সংবাদ শোনালেন। মহিলা বললেন, নবীজীর কী অবস্থা! তিনি বেঁচে আছেন তো? তারা বললেন, আপনি যেমন কামনা করছেন, আলহামদুলিল্লাহ তিনি ভাল আছেন! এবার মহিলা বললেন, তাহলে তাঁকে একটু দেখান, আমি তাঁর জ্যোতির্ময় চেহারা একটু দেখে নেই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ইশারা করে তাঁকে দেখানো হল। দেখা মাত্রই তিনি চিৎকার করে বলে উঠলেন- ‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনাকে সুস্থ পাবার পর সকল বিপদ আমার নিকট তুচ্ছ।’ অর্থাৎ এখন আর আমার মনে আমার স্বামী, ভাই ও পিতা হারানোর কোনো কষ্ট বা শোক নেই। আপনাকে সুস্থ পেয়ে সব কিছুই আমি ভুলে গেলাম। (আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া ৩/১৮১’ আলকামিল ২/১৬৩)
কবির কন্ঠে- (ভাবার্থ)
স্বামী, সন্তান না ভাইয়ের খেয়াল
নবীজী আছেন কেমন-একটিই সুওয়াল (প্রশ্ন)
হাঁ, দেখে নিয়েছি তাঁর মোবারক চেহারা
সান্ত্বনা আমার, আমি নই স্বামী- সন্তানহারা।
বস্তুত: সাহাবাদের নবী প্রেম ছিল সম্পূর্ণ নিখাদ। তাতে কোনো কৃত্তিমতা বা কপটতার আভাষও ছিল না। তাঁদের নবী প্রেম দেয়াল লিখন আর বক্তৃতার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। পরিবার, দেশ, সমাজ, রাষ্ট্র ও জনগণের প্রতি তাদেরও ভালবাসা ছিল তবে তা ইসলাম, কুরআন ও নবীর মান মর্যাদার উর্ধ্বে ছিল না। তাইতো মহান রাববুল আলামীন বলেছেন-
‘তোমরা ঈমান আন যেভাবে লোকেরা (সাহাবারা) ঈমান এনেছে।’(সূরা বাকারা)
আর এ কথা তো বলাই বাহুল্য যে, নবীজীর প্রতি ভালবাসা ও ভক্তি ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এটা কোনো ঐচ্ছিক ব্যাপার নয় যে তা অর্জন না করলেও আমাদের চলবে।
অতএব আমরা যদি সত্যিকারার্থেই মুমিন হয়ে থাকি তবে নবীজীর মুহব্বত কেবল আমাদের অন্তরেই লুকিয়ে থাকবে না বরং আমলেও এর প্রতিফলন ঘটবে। মহান সাহাবীদের জীবনালেখ্য থেকে শিক্ষা গ্রহন করে আমরাও যেন নবীপ্রেমের পরশে সিক্ত হতে পারি আল্লাহ পাক আমাদের তাওফিক দান করুন।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মার্চ, ২০১৯ সকাল ৯:১২