নারায়ণগঞ্জে আবারও শুরু হইতে যাইতেছে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের। ওসমানীয় সাম্রাজ্যের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী ও মাফিয়া গডফাদার মেয়র প্রার্থী শামীম ওসমান গতকাল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের আনুষ্ঠানিক সমর্থন লাভ করিয়াছে। তিনি আগামী ৩০ তারিখ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে যে কোনভাবে জয়লাভ করিয়া মসনদে আসীন হইতে যাইতেছেন। তারপর শুরু হইবে তাহার বিশেষ কায়দায় প্রজা শাসন। ওসমানীয় সাম্রাজ্যে স্বাগতম নারায়ণগঞ্জবাসী।
অবশ্য তিন ওসমানের দুই জন ইতিমধ্যে মসনদে আসীন। একজন জাতীয় পার্টির টিকেটে নারায়ণগঞ্জ - ৫ আসনে এমপি নির্বাচিত । নাসিম ওসমান এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই মূলত ওসমানীয় সাম্রাজ্যের পুনরুত্থান।
আরেক ভাই সেলিম ওসমান বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার রেকর্ড করিয়া ফেলিয়াছেন। তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নিট শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি নির্বাচিত হইয়াছেন। তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নারায়ণগঞ্জের অভিজাত গোষ্ঠীর ক্লাব বলে পরিচিত নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের সভাপতি পদে নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সব জায়গায় নির্বাচিত হন, কারণ যারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন, তাদের জানের মায়া আছে। কে আর অকালে প্রাণবায়ু হারাতে চায় ?
১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সালের নির্বাচন পর্যন্ত শামীম ওসমান ছিলেন নারায়ণগঞ্জের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। তার আঙ্গুলি হেলনে চলত নারায়ণগঞ্জের সকল প্রভাবশালী মহল। চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসে তিনি একজন রেকর্ডধারী নেতা। শোনা যায়, প্রতিদিন তিনি চাঁদা পাইতেন ৩ লাখ টাকা। সেই টাকার বেশির ভাগ তিনি খরচ করতে তার বাহিনী পালতে। তাছাড়া তার কুখ্যাত বাহিনী পালতে তাদের মধ্যে টেন্ডার ভাগাভাগি করে দিতেন। তার বাহিনীর কুখ্যাত সন্ত্রাসী সারোয়ার, লাল, অগা মিঠু ইত্যাদি নামের কয়েক নেতা এখন পর্যন্ত দেশে ফেরেন নাই। গড ফাদার শামীম ওসমানের আশীর্বাদে তারা প্রত্যেকেই কোটিপতি। এই কোটিপতি ক্যাডারদের জন্য নারায়ণগঞ্জ শহরের নানা স্থানে ক্লাবের নামে ছিল রং মহল। এই রং মহলে তারা টার্গেট করে ব্যবসায়ী ও নিরীহ মানুষদের ধরে এনে পেটাত ও চাঁদা আদায় করত। এই সব রং মহল বাইরে থেকে ক্লাব নামে পরিচিত হলেও মূলত এগুলি প্রতিটিই ছিল টর্চার সেল। শামীম ওসমানের এলাকা চাষাড়ায় ছিল ৫টি ক্লাব তথা টর্চার সেল ওরফে রং মহল। এই সব রং মহলের একটার মালিক ছিলেন হেলাল নামের এক ক্যাডার, আরেকটার মালিক ছিলেন তার বড় ভাই কুখ্যাত ক্যাডার সারোয়ার, আরেকটার মালিক ছিলেন আরেক ক্যাডার অগা মিঠু এবং হাইফাই এসিযুক্ত রং মহলের মালিক ছিলেন মানু নামের জনৈক ভদ্র ক্যাডার।
এই সব ক্যাডাররা চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখল ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করে তারা গড়ে তুলেছিলেন সম্পদের পাহাড়। যে কোন নির্মাণ কাজ শুরু করলেই তার বাহিনী এসে হাজির হত চাঁদার জন্য। তার বাহিনীকে সন্তুষ্ট না করে কেউ নির্মাণ কাজ করতে পারেনি। বিপুল পরিমাণ আয় থেকে শামীম ওসমান ও তার বাহিনীর সদস্যরা নারায়ণগঞ্জ শহরের জামতলায় গড়ে তোলেন জমকালো অনেকগুলো প্রাসাদ। সেই প্রাসাদে কোন দেশি ফিটিংস ব্যবহার করা হয়নি। তাদের বিত্তবৈভবের কাহিনী এখনও শহরের মানুষের মুখে। বিত্ত বৈভবের পাহাড়ের কারণেই অনেক ক্যাডারের এখন দুবাই শহরে বিশাল ব্যবসা বাণিজ্য আছে। অগা মিঠু নামের ক্যাডারটি দুবাই শহরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ।
তাছাড়া নাসিম ওসমানের সুযোগ্য পুত্র আজমেরি ওসমান অনেক কুকর্ম করে ইতিমধ্যে কুখ্যাত হয়ে উঠেছেন। তিনি তাদের ক্যাডার বাহিনীর সদস্য নুরুল আমিন মাকসুদের মেয়েকে নিয়ে অনেক লটর পটর করেছেন। পরে ফুর্তি শেষে সেই মেয়েকে ফেরতও দিয়ে এসেছেন। সেই থেকে কাডার মাকসুদের সঙ্গে ওসমানদের দ্বন্দ্বের শুরু। ক্যাডার মাকসুদও বিপুল অর্থ বিত্তের মালিক ছিলেন। মূলত শামীম ওসমানের ক্ষমতা ব্যবহার করে ঠিকাদারী ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে মাকসুদ বিপুল বিত্তের মালিক হন। দুবাইতে মাকসুদের বিরাট ব্যবসা রয়েছে। এই মাকসুদ দেশে আসার পর গুপ্ত হত্যার শিকার হন। এই হত্যার পিছনে আজমেরি ওসমানের হাত রয়েছে বলে ব্যাপক গুঞ্জন রয়েছে। কেননা, মাকসুদের দুবাইয়ের সকল সম্পদ এখন দখল করেছে আজমেরি ওসমান।
অন্য দিকে, ২০০১ সালের নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি করেও জিততে পারেননি শামীম ওসমান। জোট প্রার্থী গিয়াস উদ্দিনের কাছে ধরা খেয়ে রাতের আধারে পালিয়ে যান এক সময়ে গড ফাদার। প্রথমে ভারত ও পরে কানাডায় আশ্রয় নেন তিনি।
দীর্ঘদিন কানাডায় পালিয়ে থাকার পর ২০০৬ সালের ২৬ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জে ফিরেন তিনি। শহরে ফিরেই ব্যাপক শো ডাউন করেন। ২২ জানুয়ারি ২০০৬ সালের বাতিল হওয়া নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ - ৪ আসন থেকে মহাজোটের মনোনয়নও পেয়ে যান এই গড ফাদার। কিন্তু বিধি বাম। ২২ জানুয়ারি ২০০৬ সালের নির্বাচন বাতিল হয়ে গেলে ও দেশে জরুরী অবস্থা জারি হলে তিনি আবারও পালিয়ে যান।
পলাতক অবস্থায় থাকা অবস্থায় তার বিরুদ্ধে থাকা মামলা ৭ বছরের সাজাও হয় তার।
গত ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে তিনি মহাজোটর টিকিট পান নাই আইনগত জটিলতার কারণে। কিন্তু তাহার চাচী সারাহ বেগম কবরী ওরফে চিত্রনায়িকা কবরী নারায়ণগঞ্জ - ৪ আসনে মনোনয়ন পান। অন্য দিকে নারায়ণগঞ্জ - ৫ আসনে মনোনয়ন পান তার আপন বড় ভাই জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য নাসিম ওসমান। কবরী ও নাসিম ওসমান দুজনই পাস করেছেন।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে নির্বাচন কমিশনে দাখিল করা হলফনামা থেকে জানা যায়, স্ত্রী-ছেলের চেয়ে শামীম ওসমানের আয় কম। তার বিরুদ্ধে মোট ১৭টি মামলা রয়েছে। বর্তমানে হাইকোর্টের নির্দেশে তার বিরুদ্ধে চারটি মামলার কার্যক্রম স্থগিত আছে। এর মধ্যে দুটি মামলা দুর্নীতি দমন আইনে দায়ের করা। অস্ত্র আইনের একটি মামলা বিচারাধীন। তবে রাষ্ট্রকর্তৃক প্রত্যাহারের আবেদন শুনানির জন্য ধার্য আছে।
শামীম ওসমানের অতীতে নারায়ণগঞ্জ থানায় নয়টি, সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় একটি, দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়ের করা দুটি মামলাসহ মোট ১২টি মামলা ছিল। তার মধ্যে রাষ্ট্রের আবেদনে তিনটি মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে। হাইকোর্টের নির্দেশে বাতিল করা হয়েছে একটি মামলা। দুটি মামলায় নিম্ন আদালতে সাজা হলেও পরে হাইকোর্টের রায়ে খালাস পেয়েছেন। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জ থানায় ১৯৯৫, ৯৬ ও ২০০১ সালে দায়ের করা পৃথক তিনটি মামলায় তিনি বেকসুর খালাস পেয়েছেন। ২০০১ সালে নারায়ণগঞ্জ থানায় দায়ের করা একটি মামলায় এফ আর.টি গ্রহণ করা হয়েছে। ১৯৯৪ সালে নারায়ণগঞ্জ থানায় দায়ের করা দুটি মামলায় অভিযোগ থেকে আওয়ামী লীগ সরকার আসার পরে ১৯৯৭ সালে অব্যাহতি পান। নির্বাচন কমিশনে দেয়া হলফনামায় পেশার বিবরণীতে শামীম ওসমান নিজেকে জ্বালানি তেল আমদানি পরিবহণ ও সরবরাহ ব্যবসায়ী উল্লেখ করেছেন। শামীম ওসমান তার হলফনামায় দেয়াল ঘড়ি প্রতীক চেয়েছেন। তার শিক্ষাগত যোগ্যতা উল্লেখ করেছেন বিএ ও এলএলবি।
তার আয়ের উৎস হচ্ছে বাসা ভাড়া, ব্যবসা এবং স্ত্রীর চাকরি। বাসা ভাড়া থেকে তিনি বছরে পান চার লাখ ৬৭ হাজার ৮৬৩ টাকা। আর ব্যবসা থেকে পান নয় লাখ ৪০ হাজার ৮০০ টাকা। ব্যবসা থেকে তার স্ত্রীর আয় হচ্ছে একই পরিমাণ ৯৪০৮০০ টাকা। ছেলের আয় ১৭ লাখ ৩৩ হাজার ৪৮০ টাকা। স্ত্রীর নামে ৯২হাজার ১৫০ টাকার শেয়ার ও সঞ্চয়পত্র রয়েছে।
তার স্ত্রী চাকরি থেকে আয় করেন ২৪ লাখ টাকা। তবে তিনি কী চাকরি করেন তা উল্লেখ করেননি। স্থাবর সম্পদের মধ্যে তিনি উল্লেল করেছেন, নিজ নামে ১০ শতাংশ জমি যা বিক্রির জন্য চুক্তি মূল্য ৬৫ লাখ টাকা। ১৬ শতাংশ জমির ওপর আবাসিক বাড়ি। যার মূল্য দেখিয়েছেন ৭৪ লাখ ৩০ হাজার টাকা।
তিনি বিদেশে কর্মরত এক বন্ধুর কাছ থেকে সুদবিহীন ঋণ নিয়েছেন ২৬,৬৯৯৫০ টাকা। স্ত্রীর বড় ভাইয়ের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছেন ৬০ লাখ টাকা, স্ত্রীর ছোট ভাইয়ের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছেন ৪০ লাখ টাকা। বাড়ি ফেরতযোগ্য সুদবিহীন অগ্রিম পেয়েছেন ১০ লাখ টাকা। কর দেয়ার সময় তিনি তার মোট সম্পদের পরিমাণ দেখিয়েছেন তিন কোটি ২৫ লাখ ৩২ হাজার ৫৭৫ টাকা। এর মধ্যে দেনা এক কোটি ৩৬ লাখ ৬৯ হাজার ৯৫০ টাকা। তার নিট সম্পদ এক কোটি ৮৮ লাখ ৬২ হাজার ৬২৫ টাকা। আয়কর রিটার্নে তিনি যে সম্পত্তির পরিমাণ দেখিয়েছেন তার মধ্যে এক কোটি টাকার এফডিআর চলতি অর্থবছরে জমা করেছেন। একইভাবে স্ত্রীর নামে ২৫ লাখ এবং ছেলের নামে এক কোটি ৩১ লাখ টাকার এফডিআর এই বছরে জমা করেছেন। স্ত্রীকে তিনি ব্যবসায়িক অংশীদার এবং চাকরিজীবী বলে উল্লেখ করেছেন। তার স্ত্রীর নামে ২৫ লাখ টাকার এফডিআর এবং ৪৪ লাখ ৪০ হাজার ৮০০ টাকার ব্যবসার আয় রয়েছে। এছাড়া তার ২২ বছর বয়সী ছেলে মোট সম্পদের পরিমাণ এক কোটি ৩৭ লাখ ৫৩৬ টাকা। শামীম ওসমানের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান জেডএন কর্পোরেশনের নামে ২০১১-২০১২ কর বিবরণী দাখিল করা হয়েছে। তাতে দেখানো হয়েছে এই কোম্পানির ব্যাংকে কোনো টাকা নেই। আর নগদ টাকা আছে ৮৮ লাখ ২১ হাজার টাকা। শামীম ওসমানের হলফনামা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, শামীম ওসমান ও তার স্ত্রীর চেয়ে ছেলের আয় বেশি এবং ছেলে বিপুল অর্থ সম্পদের মালিক। অন্যদিকে শামীম ওসমানের চেয়ে তার স্ত্রী সালমা ওসমান লিপির আয়ও বেশি।
এই হলফনামা থেকে দেখা যায়, শামীম ওসমানের ছেলেই মূলত শামীম ওসমানের অর্থের উৎস। কিন্তু আইন পড়ুয়া এক ছেলের পক্ষে এত কেমনে সম্ভব হইল, সেইটা বোধগম্য হইল না।
যাই হোক, আওয়ামী লীগ আনুষ্ঠানিকভাবে সমর্থন জানানোর ফলে শামীম ওসমান যে কোন পন্থায় মসনদ দখলের পাঁয়তারা করবে। আর তিনি যদি একবার মসনদ দখল করতে পারে তবে আবারও নারায়ণগঞ্জে শুরু হতে যাচ্ছে ওসমানীয় শাসনামল। ওসমানীয় শাসনামলে স্বাগতম নারায়ণগঞ্জবাসী।