প্রথম পর্ব
১)
কমলাপুর স্টেশনের ৪ নং প্লাটফর্মে এসে ট্রেনটা থানতেই ভোর থেকে ঝিমুতে থাকা প্লাটফর্মটা হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে পড়ল। যে ভিক্ষুকটা সকাল থেকে ঝিমুচ্ছিল সে ব্যস্তসমস্তভাবে তার ভিক্ষার থালাটা সাজিয়ে নিয়ে নিজের দৈনতা আরও ফুটিয়ে তোলার জন্য সচেস্ট হয়ে গেল। পত্রিকাওয়ালারা ছুটছে,তারচেয়েও জোরে ছুটছে কুলির দল,জীবনযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। ব্যস্ততার আঁচ লেগেছে ট্রেনের বগির ভিতরও। আধো ঘুম আধো জাগরণে থাকা যাত্রীরা চোখ কচলে যার যার ব্যাগ গোছাচ্ছে। কৌশিকও সেই যাত্রীদের একজন। হালকা-পাতলা গড়নের মাঝারী উচ্চতার কিশোরটি মাথার উপর তাকে রাখা ছোট্ট কলেজব্যাগটি নামিয়ে কাঁধে নেয়। সদ্য গোঁফ ওঠা লম্বাটে মুখটিতে রাজ্যের কৌতুহল খেলা করে। সহজ-সরল দৃষ্টি মেলে সে প্লাটফর্মের প্রতিটা ব্যক্তিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। ধীরে সুস্থে নেমে আসে ট্রেন থেকে। স্বভাবগতভাবে পরিচিত মুখের খোঁজে এদিক-ওদিক তাকায় সে। পরক্ষণেই মনে পরে তার, এই শহরে এই মুহূর্তে তার পরিচিত কেউ নেই!! এমনিতে ঢাকা শহরের বিশালত্ব আর শহুরে জীবনের ব্যস্ততা সম্পর্কে বিভিন্ন গল্প-নাটক পড়ে-দেখে সে ভালই ওয়াকিবহাল। এখন এই বিশালত্বের সাথে নিজের একাকীত্বটা মিলিয়ে কৌশিক কেমন জানি উদাস হয়ে যায়। একটা দীর্ঘশ্বাস তার ভেতর হতে আপনা-আপনি বের হয়ে আসে।তার মনে পরে যায় ক্লাস টেনে পড়ার সময় সে একবার বাসায় না বলে ক্রিকেট "ম্যাচ" খেলতে দুরের পাড়ার মাঠে গিয়েছিলো। তারপর সন্ধ্যায় যখন বাসায় ফিরে তখন সে দেখে বাসায় "মাতম" শুরু হ্যে গেছে। না বলে যাওয়ায় এবং বাসায় ফিরতে দেরী হওয়ায় এলাকার মসজিদ থেকেও নাকি মাইকিং করা হয়েছিলো। এরপর অনেকদিন সে বাসায় না জানিয়ে কিংবা বন্ধুবান্ধব ছাড়া একা একা কোথাও যায়নি। অথচ আজকে ঢাকা শহরে তাকে একলা টিকে থাকতে হবে !! ভরসা বলতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকা এক পরিচিত বড় ভাই !!
হঠাৎ এক কুলির চিৎকারে তার সম্বিত ফিরে আসে। নিজের দেহের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি ওজনের ব্যাগ মাথায় নিয়ে চলতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পরে তার বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা ! ব্যাথায় কাতর কুলির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কৌশিক স্টেশন গেটঅভিমুখী জনস্রোতে গা ভাসিয়ে দেয়।
২)
:মা !! মা!! আমার ব্যাগটা কোথায় রেখেছো?
:তোর পড়ার টেবিলেইতো রেখে আসলাম !
:এখানে তো নেই! কোথায় রাখছ ব্যাগ ? তুমি যে কেন আমার জিনিসপত্রে হাত দাও !! আমি বুঝি না!
মাইশার মা ব্যস্তভাবে রুমে ঢুকল। মাইশা ততক্ষণে পুরা রুমে তোলপাড় শুরু করে দিয়েছে ব্যাগের খোঁজে।
:এই নে তোর ব্যাগ !
মাইশা পিছন ঘুরে দেখে মায়ের হাতে ব্যাগ।
:কোথায় পেলে? (হতভম্ব মাইশার প্রশ্ন)
:তোর টেবিলের নিচেইতো পরেছিলো।
:ধুর ! আমি একটু আগেই খুঁজলাম !
:আর তোর খোঁজাখুঁজি ! সামান্য একটা ব্যাগ আমাকে ছাড়া খুঁজে পাস না, তুই যে কেমনে বিশ্ববিদ্যালয় হলে থাকবি !
: (মাইশা লাজুক হেসে) চিন্তা করো না মা ! ও, আমি এমনিতেই গুছিয়ে নিতে পারব !
মুখে এটা বললেও, মাইশা ভালোভাবেই জানে তার মামণি ছাড়া সে কি পরিমাণ অচল ! আজ দুপুরেই তার মামণিকে ছেড়ে চলে যেতে হবে ঢাকার উদ্দেশ্যে ! এবং সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে সেখানে তাকে সামনের কয়েকটি বছর মামণিকে ছাড়া কাটাতে হবে !!
এদিকে সমানে মায়ের বকুনি আর উপদেশবাণী চলছে, কিন্তু মাইশার আজকে সব বকুনিই খুব মধুর লাগছে। কখন যে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছে সে খেয়াল করেনি। হঠাৎ মাকে জড়িয়ে কাঁদতে থাকে সে। মাইশার মা একটু থতমত খেয়ে যায়। তারপর নিজের মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দেয়।
৩)
গরুটাকে গাছের ছায়ায় বেঁধে দিয়েই রসুল মিয়া দ্রুত গামছাটা গায়ে জড়িয়ে হাঁটা দেয় বাড়ির উদ্দেশ্যে,যাওয়ার পথে পুকুরে দুটো ডুব দিয়ে যেতে হবে। ছেলেটা আজকে চলে যাচ্ছে ঢাকায়। বিদায় দিতে যেতে হবে বাসস্ট্যান্ডে,ঘর্মাক্ত শরীরেতো আর যাওয়া যায় না!
দূর থেকে বাড়িটার চারদিকে অনেক মানুষের ভিড় দেখতে পায় সে। অবশ্য ভিড় হবেই বা না কেন? আশেপাশের দশ গ্রামে এর আগেতো কেউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পায় নি! দ্রুত পায়ে হাঁটতে হাঁটতে রসুল মিয়ার কয়েকমাস আগের কথা মনে পড়ে গেল। কোন এক পরীক্ষার আগের সপ্তাহে তার বাসায় কেরোসিন শেষ হয়ে যায়। প্রত্যন্ত এলাকায় যেখানে কোন বিদ্যুত সংযোগ নেই সেখানে কেরোসিনই একমাত্র ভরসা। কিন্তু নতুন কেরোসিন কিংবা মোমবাতি কেনার টাকা না থাকায় তার বাসায় সন্ধ্যা না হতেই গভীর রাত নেমে আসত ! ছেলেটা সকালে বাজারে যেত সবজী বেচতে। রাতই ছিলো তার একমাত্র পড়ার সময় পড়ার জন্য ছেলেটা তখন প্রায় ৫/৬ কিলোমিটার হেঁটে চলে যেত তার কলেজ লাইব্রেরীতে। কলেজের অধ্যক্ষ অনেক দয়ালু লোক ছিলেন। সে তাঁর নিজ উদ্যোগে রসুল মিয়ার ছেলেকে রাতে লাইব্রেরীতে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়। কত কষ্টই না করেছে ছেলেটা পড়ালেখার জন্য ! আজকে ছেলেটা ঢাবিতে পড়তে যাচ্ছে।
"সোনার টুকরা ছেলে আমার! আল্লাহ্, তুমি ওরে হেফাজত কইরো!" অশ্রুসজল চোখে মনে মনে দোয়া করে ছেলে গর্বে গর্বিত রসুল মিয়া।
৪)
ভোর ৭টা। শুভ্র বডিপ্স্রের শেষ পাফটা দিয়ে নতুন টিশার্টটা গায়ে দেয়। এত ভোরে(!!) সে শেষ কবে উঠেছে তা খুঁজতে গেলে "খড়ের গাদায় সূচ খোঁজার" মত অবস্থা হবে। সকাল ১০টায় যার মনে হয় ঘুম থেকে উঠা উচিত আর তারপর আরও এক ঘণ্টা ধরে আড়মোড়া ভেঙ্গে যে ঘুম থেক উঠে তার জন্য সকাল ৭টা কাকডাকা ভোর বৈকি !
ব্যাগ কাঁধে শুভ্র যখন ডাইনিং রুমের দিকে এগিয়ে যায় তখন তার নাস্তার টেবিলে বসে থাকা ৮ম শ্রেণী পড়ুয়া ছোটবোনের মুখ হাঁ হয়ে যায়। শুভ্র চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকা বোনের দিকে তাকিয়ে ধমকের সুরে বলেঃ কিরে,অমন চোখ বড় বড় করে কি দেখিস ? আগে কখনও স্মার্ট ছেলে দেখস নাই ?
বলেই সবগুলা দাঁত কেলিয়ে হেসে প্রশংসা শোনার আশায় নিজের বোনের দিকে তাকায়।
বোন:কিরে ভাইয়া, তুই কি অসুস্থ ?
বোনের কথা শুনে মুখের হাসি মিলিয়ে যায় শুভ্রের।
রাগত স্বরে বলেঃ কি দেখে তোর আমাকে অসুস্থ মনে হল?
: (ঢোক গিলে) ইয়ে, তোকে আগে কখনও স্কুলে যাওয়ার সময় জাগা অবস্থায় দেখিনি তো !
: (দীর্ঘশ্বাস ফেলে) আমাকে দেখে তোর সবার আগে এই কথাই মনে হল !
হঠাৎ হাসির শব্দে শুভ্র পিছে তাকিয়ে দেখে তার মা আর ভাবী তার দিকে তাকিয়ে হাসছে।
অন্যদিন হলে শুভ্রর ততক্ষণে মেজাজ খারাপ হয়ে যেত। কিন্তু আজ সে পণ করেছে কোনমতেই সে রাগবে না !
গটমট করে বেরিয়ে যেতে যেতে সে তার মায়ের গলা শুনতে পেলঃ"কিরে শুভ্র! খেয়ে যা!"
শুভ্র সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে জবাব দেয়ঃ"খাওয়ার সময় নেই মা, বাস ধরতে হবে!"
বলেই সে ঘড়ির দিকে তাকায়। ঘড়ির কাটার দিকে তাকিয়ে শুভ্র একটা হার্টবিট মিস করে। বাস ছাড়ার আর মাত্র ৫ মিনিট বাকি !
"বাস ধরতেই হবে! প্রথমদিনেই বাস মিস করা যাবে না!" নিজেকে নিজেই কথাটা বলে ঊর্ধবশ্বাসে বাস স্টপেজের দিকে দৌড় দেয় শুভ্র।
হাঁপাতে হাঁপাতে স্টপেজের কাছাকাছি আসতে আসতে সে দেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের লাল বাসটা স্টপেজ ছাড়ার জন্য তোড়জোড় শুরু করেছে। সে বাসের দরজায় তার এলাক্র বড় ভাই রাহাতকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চিৎকার দেয়।
"রাহাত ভাই !!"
রাহাত পিছু ঘুরে শুভ্রকে দৌড়ে আসতে দেখে ড্রাইভার মামাকে বলে বাস থামাতে। কিন্তু ততক্ষণে বোধহয় একটু দেরিই হয়ে গেছে, কারণ বাসের সব যাত্রীই যে বাসে উঠে গেছে!
শুভ্র দৌড়াচ্ছে। আজকে তার বিশ্ব বিদ্যালয় জীবনের প্রথম দিন, কোনমতেই বাস মিস করা যাবে না! কোনমতেই না !
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়,যে বিশ্ববিদ্যালয়ে কৌশিক,মাইশা,শুভ্র কিংবা রসুল মিয়ার ছেলের মতই হাজারো ছেলেমেয় জীবনযুদ্ধের ছোট ছোট গল্প নিয়ে হাজির হয়। এখানে এসে তাদের মাঝে, শিক্ষকদের মাঝে মিথস্ক্রিয়া হয়। জন্ম হয় আরও হাজারো গল্পের। এক একটি মহাকাব্যের সুচনা হয় এই বিদ্যাপীঠের প্রাঙ্গণে। শুভ্র-মাইশাদের প্রথম জীবনের গল্পগুলো "গল্প শুরু গল্প" হিসেবেই থেকে যায়।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা এপ্রিল, ২০১৩ সকাল ৯:১১