বন্ধু উইলিয়ামের ট্যুর সংখ্যা কমে যাচ্ছিল এবং আমাদেরও ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া’ বলে পরিকল্পনা করা হলো ‘খৈয়াছড়া জল্পপ্রপাত’ হবে পরবর্তি গন্তব্য। কিন্তু রাঙ্গামাটি – খাগড়াছড়ি ট্যুরের পর আমাদের হাতে যে টাকা ছিল তাতে মাস পার করাই কঠিন ব্যাপার। সিদ্ধান্ত হল কম খরচে যাওয়া হবে, সাথে ‘আল্টিমেট’ ট্যুরের প্রশিক্ষণও হয়ে যাবে। রওনা দেয়ার কথা শুক্রুবার। কিন্তু তর কি সয়? যাত্রার দিন দু’দিন এগিয়ে বোধবার হয়ে গেল। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে মিলিত হলাম আমরা ছয় জন। আমি, উইলিয়াম, ফারাজ, পিয়াল, মাকসুদ ও সনৎ। উদ্দেশ্য চট্টগ্রামের মেইল ট্রেন ধরা। ট্রেনে উঠে দেখি বসার জায়গা নাই। অগত্যা দাঁড়াতেই হল। সনৎ পেয়ে গেল রেলওয়ে পুলিশের একজন। জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে তাঁদের আলাপ আমার কান অবধি অবশ্য আসেনি। কিছুক্ষণপর আসলো চেকার। উইলিয়াম আর মাকু ধুর্ততার পরিচয় দিয়ে সরে পড়লো চেকারের আড়ালে। বাকি চারজনের জন্যে টিকেট নিলাম মূল ভাড়ার তিন ভাগের এক ভাগ দিয়ে। দশ ঘণ্টার পথ দাঁড়িয়ে যাব চিন্তা করতেই আমার পা কেঁপে উঠছিল। নরসিংদী আসতেই উঠে গেলাম ছাঁদে। হু হু বাতাস, রাতের গ্রামীণ পথ, কালি পূজোর আলোকিত সাজ, বিয়ে বাড়ি, টর্সলাইটের আলোয় পুকুরে মাছ ধরা, চারপাশের প্রকৃতি, আঁকাবাঁকা রেলপথ দেখে আমাদের মন ভ্রমণের সাধ পেতে শুরু করলো।
ঘন্টা দুই এভাবে যাওয়ার পর আমাদের বুঝতে বাকি রইলনা আসন্ন ঋতুটা শীত। শিশির পড়ে ভিজে গেছে ছাদ, ঠান্ডা হাওয়া আর চার পাশের ঘন কুয়াশায় বসে থাকাই মুশকিল হয়ে যাচ্ছিল। তারওপর সনৎ কুমার বিশ্বাস একটা অবিশ্বাস্য কাজ করে বসলো। এই শিতে কিনে নিল ফ্রিজ থেকে ঠাণ্ডা পানি। আমাদের অনেকেরই প্রথম ট্রেনের ছাদে উঠা বলে ঘুমানোর সাহস পাচ্ছিলাম না। তারপরেও সনৎ আর উইলিয়াম কিছুটা ঘুমিয়েছে। মাকসুদের হঠাৎ হঠাৎ নাক ডেকে উঠেছে আর আমি ঘুমানোর চেষ্টা করেছি মাঝে মাঝে। ফোন করে এনফিল্ডে রিয়াল মাদ্রিদের জয়ের সংবাদটা দিল বার্সা সমর্থক বন্ধু শিমুল। রিয়াল মাদ্রিদের কাছে লিভারপুলের ৩-০ তে পরাজয়ের পরেও পিয়ালই ছিল আমাদের পাহারাদার। ফারাজ নিচে ছিল বলে অবশ্য তাঁর নাক ডাকা বা না ডাকার শব্দ আমারা পাই নি।
ঢাকা- নরসিংদী- ভৈরব- বি বাড়িয়া- আখাউড়া- কুমিল্লা- লাকসাম- ফেনি হয়ে আমাদের ট্রেন এসে পড়লো মিরসরাই। কিন্তু আমাদের কে অবাক করে দিয়ে ট্রেন প্রতিটা স্টেশনে থামলেও থামলোনা মিরসরাইয়ে। সীতাকুণ্ডে গিয়ে থামল আমাদের মাননীয় ট্রেন। কি আর করা! সীতাকুণ্ড থেকে সি এন জি নিয়ে বড়তাকিয়া হয়ে গেলাম খৈয়াছড়া ঝর্ণার পথে। কিছু দূর গিয়ে একটা সাঁকো পার হয়ে থামলাম একটা ভ্রাম্যমাণ দোকানের কাছে। পোশাক পরিবর্তন ও গাইড ঠিক করে রওনা দিলাম সেই প্রতীক্ষিত ঝর্ণার উদ্দ্যেশে।
পাহাড়ি ঝিরি পথ ধরে হাটা শুরু হলো , পায়ের নিচে বয়ে যাচ্ছে টলটলে স্বচ্ছ ঠান্ডা পানির নহর! পানির তল জুড়ে নুড়ি পাথরের ছড়াছড়ি! পানির গভীরতা শুরুর দিকে সমতলে সমান ছিলো, গোড়ালী বা সর্বোচ্চ হাটু অব্দি! কিন্তু যখন সমতল ছেড়ে আমরা ঝিরিপথ বেয়ে পাহাড় বাইতে লাগলাম তখন দৃশ্যপট বদলে গেলো। আমরাও বদলে নিলাম পথ। ঝিরি পথ ছেড়ে পাহাড়ি পথে চলা শুরু করলাম।
অবশেষে দেখা মিললো সুন্দরী ঝর্ণার। পর্যটকদের কোলাহলের মাঝেও উপর থেকে পড়া পানির শব্দ ভাললাগার মত। প্রথম ধাপে অনেক লোকজন বলে আমরা উপরে উঠা শুরু করলাম। গাছের শেকড়, লতা আর ক্লাম্বিং রোপ ধরে উঠে গেলাম দ্বিতীয় ধাপে। আমি আসলে প্রকৃতির সৌন্দর্য বর্ণনা করতে চাই না। এ দেখার এবং অনুভব করার বিষয়।
দ্বিতীয়- তৃতীয় করে আমরা পাড়ি দিলাম নবম ঝর্ণা। দুর্গম এই পাহাড়ি পথে পরতে পরতে রয়েছে বিপদের হাতছানি। কখনো বা পিচ্ছিল, কখনো বা খাড়া পাহাড় বেয়ে উঠতে হয় এই পথে। সবাই যা দেখে তা দেখে আমাদের মন কিছুতেই শান্তি পাচ্ছিল না। শুরু করলাম আরো উপরের দিকে উঠা। অনেক দূর যাওয়ার পর দেখি আর কোন পথ নাই। গাইডটাও বলতে পারে না পরে কি আছে। ঘন জঙ্গলে ভরা উঁচু পাহাড়। সিদান্তহীনতাই কিছুক্ষণ ভোগার পর ঠিক করা হল শেষ দেখে তবেই ফেরা হবে। হাটতে হাটতে এক সময় সরু একটা গুহার সন্ধান পাওয়া গেল। গুহার ভিতর দিয়ে হাটতে গিয়ে দেখি জোঁক আর বিশাল বিশাল মশা। কিছুদূর যাওয়ার পর একটা ঝর্ণার শব্দ পাওয়া গেল। যত যাই খালি শব্দই পাওয়া যায়। অনেক জায়গাই পানি এত গভীর যে সাঁতরাতে হল আর সূর্যের আলো প্রবেশ করেনি বলে পানি ছিল বরফের মত।
সনৎ আগে লাফ দেয় তারপর আমি। অবশেষে দেখা হল দশম ঝর্ণা। এবার নিজেকে সপে দিলাম ঝর্ণার শীতল জলে। ফারাজ কিছুটা সাতার পারে বলে সেও চলে এল ততক্ষণে। পিয়াল কে নিয়ে আসা হল ভাসিয়ে। উইলিয়াম আর মাকু একটু দূর থেকেই দেখল। দেখা হল রূপসী খৈয়াছড়া।
এবার ফেরার পালা। পাহাড়ে উঠা না যত কঠিন, তারচেয়ে বেশি কঠিন নামা। অনেক সময় শুধুমাত্র মানসিক শক্তির উপর নির্ভর করতে হয়। এবার প্রতিটা ধাপে ভিজিয়ে নিলাম নিজেকে।পাহাড়ি বুনো পথ আর খোলা মাঠ দেখে ফেরার পথে গাইড জানালো পাশেই পাথরে জ্বলন্ত আগুন দেখা যাবে। গিয়ে দেখলাম এ যেন রাজধানী ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অবস্থিত 'শিখা চিরন্তনের' প্রাকৃতিক রূপ। যাওয়ার পথে সেই ভ্রাম্যমাণ দোকানে কথা দিয়েছিলাম ফিরে আমরা তাঁর কলা-চিড়ার স্বাদ নিব। টেলিকম কোম্পানি না হলেও কথা রেখেছি আমরা। খানিকটা বিরতি নিয়ে এবার রওনা দিলাম চট্টগ্রামের পথে। উদেশ্য সেই ট্রেন।
হোটেল আজাদে রাতের খাবার সেরে স্টেশনে এসে দেখি সেই পুরনো ভিড়। এবার মেইল ট্রেন বাদ দিয়ে বেছে নিলাম তুর্ণা। ফারাজ থেকে গেল বাসার টানে। উঠতে যাব এমন সময় পুলিশের দু'জন এসে তাঁদের সাথে যাওয়ার কথা বলতেই আমরা রাজি হয়ে গেলাম। ট্রেনে উঠার পর বুঝতে পারলাম এই জগতে দু'ধরনের জাতি আছে-একটা মানুষ অন্যটা পুলিশ। টিকেটবিহীন আমাদের দুঃসহ অভিজ্ঞতার কথা, সে আর বলতে হয় না। বিপত্তি বাধলো কমলাপুরে এসে। আমাদের টিকেট নেই, সেই পুলিশ জাতিও হাওয়া। গেট পার হতে আমাদের আবার সেই লুকোচুরি খেলা।
হামহাম আর খৈয়াছড়া দেখার পর আমার মনটা খুব খারাপ হয়ে ছিল। আমার ছোটবেলার ‘হিমছড়ি’কে ভীষণ মিস করি। সমুদ্রের পাশেই পাহাড়ি ঝর্ণা। কি যৌবনাই না ছিল হিমছড়ি ঝর্ণাটা!