তিন কন্যা ও মা যখন দীর্ঘ ন' মাস ধর্ষিতা হয় -
এ ঘটনাটি চট্টগ্রামের পলোগ্রাউন্ড এবং টাইগার পাস এলাকায় যারা থেকেছেন তারা সবাই জানেন।
লক্ষি রাণী, সরস্বতী, আর মায়া রাণী - তিন কন্যা। বয়স ১৫, ১৭, ২৩। মা জ্যোৎস্না রাণীর বয়স ৪০। একমাত্র ভাই রমেশ, ২০ বছর। এই তিন আগুন রাঙা কন্যার সৌন্দর্যের কথা ছিল মুখে মুখে। বাবা, রাধাকান্ত ছিলেন রেলওয়ের কর্মকর্তা। সেই সময়ে চট্টগ্রাম রেলওয়ের শীর্ষ সব পদসমূহ বিহারীদের দখলে ছিলো। রাধাকান্ত ছিলেন ভীষণ মিশুক এবং পরোপকারী এক মানুষ। হিন্দু, মুসলিম, বিহারী সবার সাথেই তার ছিলো হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক।
২৬ মার্চ ১৯৭১ সালে ঢাকার সাথে চট্টগ্রামেও ব্যাপক হত্যাকাণ্ড শুরু হয়। যাদের ঘরে জোয়ান মেয়ে ছিলো তারা সবাই মেয়েদের দ্রুত অন্য কোথাও রেখে আসতে শুর করেন।
পলোগ্রাউন্ড কলোনির সবাই যখন রাধাবাবুকে দ্রুত মেয়েদের অন্য কথাও রেখে আসার পরামর্শ দিচ্ছিলেন, তখন তার বন্ধু বিহারিরা তাকে অভয় দিয়ে রেখেছিলেন। "আমরা মুসলমান, জবান দিলে জান গেলেও জবানের বলখেলাপ করি না! "
এই ভরসায় হয়তো বা কয়েকদিন দেরি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।আর এই ১০ দিনের অপেক্ষা তার ও তার পরিবারে ভয়ংকর বিপর্যয় নিয়ে আসে।
দিন দশেকের মধ্যেই চট্টগ্রামের বিহারিরা পাক বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ শুরুর পূর্বে নিজেরাই কচুকাটা করতে শুরু করে দেয়। কলোনী থেকে একের পর এক হিন্দুদের ধরে ধরে নিয়ে ঝাউতলায় গণ জবাই করতে থেকে। প্রতিদিনই খবর পাওয়া যেত কেউ না কেউ জবাইয়ের শিকার হয়েছেন।
একদিন বিকালে রাধাকান্ত বাবু অফিস থেকে ফেরার পথে নিখোঁজ হয়ে যান। আর ঠিক সন্ধ্যায় পাকবাহিনীর জিপে এসে থামে ১৯ নং বাসাটির সামনে। আট হানাদার ঢুকে পরে অরক্ষিত সেই বাসায়।
চারপাশ থেকে মানুষ শুনলো গগনবিদারী চীৎকার! একটা সময়ে সেই চীৎকার থেমে যায়। ক্ষতবিক্ষত চারটি নিস্পাপ নারীর দেহ পরে থাকে।
জিপটি চলে যায়। পাহাড়ায় রেখে যায় বিহারীদের। রাত তিনটা, আরেকটি জিপে আবারো ৮ হানাদারের আগমন। সেই পড়ে থাকা ক্ষতবিক্ষত দেহগুলো আবারো ধর্ষিতা হতে থাকে।
আর এ ঘটনা শুধু একদিনের নয়। ১৯ নাম্বার এ বাসাটিতে দীর্ঘ নয় মাসের প্রতিদিন দু 'বার জিপ এসে থামতো।
তারপর?
তারপরের আগে এ ঘটনাটি বাবার কাছে কীভাবে শুনলাম। আমার বাবাও ছিলেন রেলের কর্মকর্তা। বাবার সাথে রেল ভ্রমণের বহু সুযোগ হয়েছে। চট্টগ্রাম রেলস্টেশনের প্রায় সবাইকে আমার বাবা চিনতেন। আর যতক্ষণ ট্রেন না ছাড়তো, ততক্ষণ কারো না কারো সাথে কথা বলতেই থাকতেন।
এর মধ্যে রমেশ দাদাকে দেখে আমি সব সময় ভয় পেতাম। কেমন যেন অস্বাভাবিক তার চেহারা। চোখগুলো সব সময় লাল থাকতো, ভীষণ লাল। একটু বড় হয়ে বুঝলাম রমেশ দাদা সব সময় মদ খেয়ে টাল হয়ে থাকেন।
একদিন আব্বাকে বললাম, "আচ্ছা আব্বা, এই ধরনের মাতাল একটা লোক বছরের পর বছর চাকরি করে কীভাবে? তোমরা কী করো, এই লোকেরে ছাঁটাই করো না কেনো? "
খুব অবাক হতাম, রমেশ দাদাকে সবাই আবার একটু বেশ সম্মানের চোখে দেখে।
তারপর, আমার বাবার কাছ থেকে তার সহকর্মী রাধা বাবুর পরিবারে ঘটে যাওয়া এই নৃশংস ঘটনা জানতে পারি।
দীর্ঘ নয় মাস একদিনের জন্য, একটা মুহূর্তের জন্যও জ্যোৎস্না রাণী আর তিন অপরূপা কন্যা বের হতে পারেন নি ১৯ নং বাসা থেকে।
যেদিন তারা মুক্তি পান (১৪ মার্চ) , চারজন একসাথেই বের হয়ে চলে যান অজানা গন্তব্যের দিকে। আর চারজনই ছিলেন সন্তান সম্ভবা।
এমন অসংখ্য মা বোনের ত্যাগের বিনিময়ে আজ কথা বলি, দেশ এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখি।
কিন্তু রমেশ দাদার কোন স্বপ্ন নেই। সারাক্ষণ পাঁড় মাতাল হয়ে সব কিছু ভুলে থাকতে চান।
কী করে এই হানাদার আর তার দোসরদের মৃত্যুদণ্ড ছাড়া অন্য শাস্তি সম্ভব? মানবতার বিরুদ্ধে এই ভয়াবহ অপরাধ যারা সংঘটিত করেছে, তাদের বিচারের জন্য চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয় এই স্বাধীন দেশে? তাদের বিচারের জন্য দেশের শীর্ষ নেতাকে প্রতিনিয়ত মৃত্যুর প্রহর গুণতে হয়?
হতে পারে, এই অপরাধীদের বিচার চালনা আর রায় বাস্তবায়নের জন্য জাতীয় চার নেতার মত, বর্তমানের অনেক নেতাদের আমরা হারাবো।
মূল্য যত দিতে হয়, আমাদের তা দিতে হবে। গত ৪২ বছর যাবৎ এই সব নিস্পাপ নারীরা আর শহীদরা আমাদের প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্ত অভিশাপ দিচ্ছে।
প্রতিটি ফাঁসির রায়ের বাস্তবায়ন অভিশাপ থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি দিবে।