বর্তমান সময়ের মতো সুপ্রাচীন কাল থেকেই বিভিন্ন রাজ্যের শাসকগন বিশেষ কোন উৎসব-অনুষ্ঠান, রাজ্য বিজয়, ধর্মীয় অনুষ্ঠান সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখতে এক ধরণের বিশেষ মুদ্রা জারি করত। এই মুদ্রা গুলো অনিয়মিত ভাবে জারি করা হতো এবং এতে মুদ্রায় নির্দিষ্ট কোন বিষয়ের বা ঘটনার স্মৃতিচিহ্ন বা স্মারক অঙ্কিত থাকত।
স্মারক মুদ্রার প্রচলন ঠিক কখন থেকে শুরু হয় তা সুনিশ্চিত ভাবে বলা সম্ভব নয়। তবে প্রাচীন গ্রিসে বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও খেলাধুলার সময় এক ধরনের বিশেষ মুদ্রা জরি করা হতো। আর এ থেকেই ধারণা করা হয় যে প্রাচীন গ্রিসেই প্রথম স্মারক মুদ্রার প্রচলন ঘটেছিল। গ্রিসের সাইরাকিউসে ডেকা-ড্রাকমা নামক এক ধরনের মুদ্রা পাওয়া গিয়েছে। যার আনুমানিক সময়কাল ৪০০ খ্রি: পূর্ব অব্দ। এই মুদ্রা গুলো শাসকের অন্যান্য মুদ্রার মতো নিয়মিত ভাবে জারি হয় নি। সাইরাকিউস ছাড়াও এই ডেকা-ড্রাকমা মুদ্রা এথেন্স, মিশর ও কার্থেজে পাওয়া যায়। আর এই মুদ্রাকেই পৃথিবীর প্রথম স্মারক মুদ্রা বলা হয়।
চিত্রঃ সাইরাকিউসে প্রাপ্ত ডেকা-ড্রাকমা
আলেকজান্ডার ভারতবর্ষ অভিজানের প্রথম দিকে স্মারক মুদ্রা জারি করে ছিলেন বলে জানা যায়। বর্তমান পাকিস্তান অঞ্চলের শাসক পুরুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয় লাভকে স্মরনীয় করে রাখতে রূপার ডেকো-ড্রাক্মা ও টেট্টা-ড্রাক্মা নামক মুদ্রা জরি করেন। এই মুদ্রা খুব সম্ভবত খ্রি: পূ: ৩২৬-৩২৫ অব্দে জারি রাজা সেলুকাস কর্তৃক জরি করা হয়েছিল। এই মুদ্রার সামনের পিঠে হাতি ও ঘোড়ার উপর আসনীন দুইজন মানব প্রতিকৃতি পাওয়া যায়। ঘোড়ার উপর বসা মানুষটি হাতির উপর বসা মানুষটিকে আক্রমন করছে। প্রত্নতাত্ত্বিক ও মুদ্রাতাত্ত্বিক দের মতে ঘোড়ার উপর বসা মানুষটি অলেকজান্ডার নিজে এবং হাতির উপর বসা মানুষটি পুরুর। একই মুদ্রার বিপরীত পিঠে দেখা যাচ্ছে এক জন দেবে আলেকজান্ডারের মাথায় মুকুট পরিয়ে দিচ্ছেন।
চিত্রঃ আলেকজান্ডারের স্মারক মুদ্রা
বিভিন্ন ব্যাকট্রিয়ান শাসকদের মাঝেও স্মারক মুদ্রা জারির প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। তবে নিতান্তই অল্প পরিমানে।
রোমান রাজাদের মাঝেও স্মারক মুদ্রা জারির প্রবণতা দেখা যায়। সম্রাট লুসিয়াস ভেরাস পার্থিয়ার চতুর্থ ভোলোগাসেস এর বিরুদ্ধে জয়লাভকে স্মরণীয় করে রাখতে স্মারক মুদ্রা জারি করেন।
চিত্রঃ লুসিয়াস ভেরাসের মুদ্রা
ভারতীয় উপমহাদেশেও স্মারক মুদ্রা জরির প্রমাণ পাওয়া যায়।গুপ্ত যুগের বেশ কয়েকটি স্মারক মুদ্রার জারির কথা জানা যায়। প্রথম চন্দ্রগুপ্ত ও সমুদ্র গুপ্তের সময় এক ধরনের মুদ্রা লক্ষ্য করা যায় যেখানে রাজা ও রানীর প্রতিকৃতি অঙ্কিত ছিল। মুদ্রার সামনের পিঠে নাম সহ প্রথম চন্দ্রগুপ্ত ও রাণী কুমারদেবীর দাড়ানো প্রতিকৃতি লক্ষ্য করা যায়। কিছু মুদ্রায় দেখা যায় রাজা রাণীকে বিয়ের অংটি নিবেদন করছেন। এথকে বুঝা যায় চন্দ্র গুপ্ত অনেক রোমান্টিক একটা পাবলিক ছিলেন। এই মুদ্রাটি জারি করা হয়েছিল রাজা রাণীর বিয়েকে স্মারণীয় করে রাখতে। এই মুদ্রার বিপরীত পিঠে রয়েছে সিংহের পিঠে বসা লক্ষীর প্রতিকৃতি।
চিত্রঃ প্রথম চন্দ্রগুপ্ত/ সমুদ্রগুপ্তের ‘ রাজা-রানী’ মুদ্রা
গুপ্তদের অরেক শ্রেণীর মুদ্রাকে স্মারক মুদ্রা হিসেবে বিবেচনা করা। এই মুদ্রাকে অশ্বমেধ মুদ্রা বলা হয়। ধর্মী কারণে এই মুদ্রা অর্থাৎ অশ্বমেধ যজ্ঞকে কেন্দ্র করে এই মুদ্রা জারি করা হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। শতপথ ব্রাহ্মণ অনুসারে কোন সমর যাত্রার শুরুতে অশ্বমেধ যজ্ঞ করা হতো। তাই বলা হয় যে এই মুদ্রা জারির মাধ্যমে ব্রাহ্মণদের অশ্বমেধ মুদ্রা দান করা হতো এবং এটি কোন একটি সমর যাত্রাকে নির্দেশ করে। বাংলাদেশের শালবন বিহারে এই অশ্বমেধ মুদ্রা পাওয়া গিয়েছে।
চিত্রঃ সমুদ্রগুপ্তের অশ্বমেধ মুদ্রা , শালবন বিহার , কুমিল্লা, বাংলাদেশ
বখতিয়ার খলজী বাংলা বিজয়ের সময় বিজয়ের স্মররে এক ধরনের স্মারক মুদ্রা জারি করেন। এই মুদ্রা গৌড় বিজয় মুদ্রা নামে পরিচিত। এই মুদ্রার মূল পিঠে অশ্বারহী মানব প্রতিকৃতি রয়েছে। সুলতানী যুগে আলাউদ্দিন হোসেন শাহ ‘কামরু-কামতা-জাজনগর ও উড়িষ্যা বিজয়’ উপলক্ষে স্মারক মুদ্রা জরি করে।
চিত্রঃ বখতিয়ারের গৌড় বিজয় মুদ্রা
চিত্রঃ সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহের কামরু-কামতা ও উড়িষ্যা বিজয় স্মারক মুদ্রা
মুগল শাসকদের মধ্যে আকবরে সময় বেশ কিছু স্মারক মুদ্রা জারি করা হয়েছিল। আকবরের এই সকল মুদ্রায় অনেক গুলো টাকশালের নাম পাওয়া যায়। যা দেখে ঐতিহাসিকগন ধারণা করেন যে – কোন রাজ্য বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখার জন্য এই সকল মুদ্রা রাজ্য বিজয়ের কেন্দ্র থেকে জারি করা হয়েছিল। আকবরের এই সকল মুদ্রার এক পাশে রাজ পাখির প্রতিকৃতি লক্ষ্য করা যায় এবং অপর পাশে আল্লা আকবর ইস্ফান্দারমুজ ইলাহী জার্ব আসি উৎর্কীণ রয়েছে। আকবরের রাজত্বের ৫০ বছর উপলক্ষ্যে কিছু সোনার ও রূপার মূদ্রা প্রচলন করেন। এই মুদ্রার এক পিঠে ‘রাম-সিয়া’ লিপিসহ রাম ও সীতার প্রতিকৃতি রয়েছে।
চিত্রঃ সম্রাট আকবরের স্মারক মুদ্রা , আসিরগড় জয় উপলক্ষে জারি করা।
চিত্রঃ সম্রাট আকবরের স্মারক মুদ্রা , রজত্বের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে জারি করা।
মুগল সম্রাট জাহাঙ্গীর তার শাসন কালে বেশ কিছু বড় ধরনের স্বর্ণ মুদ্রা জারি করেন। এই সকল মুদ্রার বেশ কয়েকটি মুদ্রা ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো প্রায় ১২ কেজি স্বর্ণ দিয়ে তৈরি একটি মুদ্রা। এই মুদ্রাটিকেও স্মারক মুদ্রা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ধারণা করা হয় সম্রাট হয়োতো বা উপঢৌকন হিসেবে এই মুদ্রা জরি করেন। এই মুদ্রাটি পৃথিবীর সবচাইতে বড় স্বর্ণ মুদ্রা হিসেবে এখনো পরিচিত।
চিত্রঃ জাহাঙ্গীরের ১২ কেজি (স্বর্ণ) ওজনের মুদ্রা
বর্তমান বংলাদেশের সিলেট অঞ্চল জৈন্তারাজ্যের অধীনে ছিল। সিলেট জেলার একটি থানার নামও জৈন্ত। ধারণা করা হয় এই রাজ্যের রাজধানী ছিল এই জৈন্তা। জৈন্তা রাজ্যের শাসকগন সিংহাসনে আরোহনের সময় স্মারক মুদ্রা জারি করতেন। এ পর্যন্ত জৈন্তা রাজ্যের প্রায় ১৫ জন রাজার স্মারক মুদ্রা পাওয়া গিয়েছে। এ্ সকল মুদ্রার বৈশিষ্ট্য হলো এই মুদ্রায় রাজার নাম উল্লেখ থাকে না। জারি করার তারিখের উপর ভিত্তিকরে রাজার নাম চিহ্নত করতে হয়।
চিত্রঃ জৈন্তা রাজা দ্বিতীয় রামসিং এর মুদ্রা।
প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ ও ৩০ এর দশকের অর্থনৈতিক মন্দার কারণে সোনা ও রূপার মুদ্রা বাতিল করা হয় এবং ব্যাংক নোটের প্রচলন করা হয়। এই সময় সীমিত আকারে কম মূল্যবান ধাতব মুদ্রাও প্রচলিত ছিল।
মুদ্রা আবিষ্কারের অনেক পরে কাগজের নোটের প্রচলন ঘটে। প্রথম কাগজের নোটের সন্ধান পাওয়া যায় সপ্তম শতকে চীনের শাং রাজবংশের সময়। ইউরোপে প্রথম কাগজের নোটের প্রচলন ঘটে ১৬৬৬ সালে ব্যাংক অব সুইডেনের মাধ্যমে।
ভারতে প্রথম কাগজের নোট প্রচলিত হয় ১৭৭০ সালে কলকাতাস্থ ব্যাংক অব হিন্দুস্থান এর মধ্যমে। এটি একটি বেসরকারী ব্যাংক ছিল। ১৮০৬ সালে ব্যাংক অব বেঙ্গলও কাগজের নোট জরি করে। এ সকল নোট ভারতবর্ষে ১৮৬১ সাল পর্যন্ত চালু ছিল।
১৮৬১ সালে ভারতের ব্রিটিশ সরকার নোট জারির কর্তৃত্ব গ্রহণ করে এবং পূর্বের সকল নোট জব্দ করে। ১৯৩৫ সালে রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া প্রতিষ্ঠিত হলে এখান থেকে ভারতের সকল নোট জারি করা শুরু হয়।
কগজের নোটের ইতিহাসে প্রথম স্মারক নোটের প্রচলন ঘটে মেক্সিকোতে ১৯১০ সালে। তবে কাগজের স্মারক নোটের জনপ্রিয়াতা লাভ করে ১৯৬০ সালের পরবর্তী সময়ে। ১৯১০ সালে মেক্সিকোর স্বাধীনতার ১০০ বছর উপলক্ষ্যে ৫ পেসো এবং ১০ পেসোর দুইটি স্মারক নোট প্রচলন করেন।
চিত্রঃ ৫ পেসো নোট, মেক্সিকো, ১৯১০
ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম স্মারক নোট জারি করে ১৯৬৯ সালে মহাত্মা গান্ধীর জন্মাশতবার্ষিকী উপলক্ষে। স্মারক নোট প্রচলনের ধারা ১৯৯০ এর শতক থেকে জনপ্রিয় হতে থাকে। বর্তমান সময়ে পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই বিভিন্ন উপলক্ষে স্মারক নোট জরি করে থাকে।
বাংলাদেশর স্মারক মুদ্রা নিয়ে আমার পূর্বের একটি পোস্ট, এখানে