somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

নিশা মাহমুদা
আমি ভাল , আমাকে বাসবেন না :প

শহীদ রুমী- একজন ক্র্যাক যোদ্ধার ইতিহাস

২৯ শে আগস্ট, ২০১৫ রাত ১১:৩৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

২৯ মার্চ ১৯৫১ সালে এক উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারের ঘর আলো করে জন্ম নিল তাদের বড়ছেলে, নার্স পিঠে চাপড় দিয়ে বলল, " ২০ বছর পর ১৯৭১ সালে এই ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হবে"। একসময় সেই ছেলে আদমজী স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ঢাকা কলেজ থেকে এন্ট্রান্স পাশ করে, ২০ বছর পর ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে ভর্তি হয় ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমান বুয়েট)। কিন্তু ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের শিক্ষার্থী থাকা অবস্থাতেও বিশেষ অনুমতি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির ক্লাস করে। এর মাঝেই সুযোগ পেয়ে যায় ইলিনয় ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে (আমেরিকা) ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার। ভিসা, টিকেট সব আয়োজন শেষ। এমনকি সুটকেস গোছানোও শেষ। এর ভেতর দেশে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। ফ্লাইটের দিন ঘনিয়ে আসছে অথচ সারাদিন ছেলের কোন খবর নাই। সেই সকালে বের হয়, ফেরে মাঝ রাতে। মা সারাদিন বাসায় বসে বসে টেনশনে মরে। একদিন ছোটভাইয়ের মাধ্যমে বাবা শুনল বড় ছেলে যুদ্ধে যেতে চাচ্ছে। বাবার কাছে থেকে মা শুনল। মা আতঁকে উঠল।
একদিন দুপুরে, বাবা বাসায় নেই। বড়ছেলে এসে মার কাছে হাটুঁ গেড়ে বসে। মাকে বোঝায় -
'মা, আমাকে এখন আমার দেশের খুব প্রয়োজন। আমি এইসময়ে দেশকে ফেলে কি করে চলে যাই বল মা? মা তুমি যদি অনুমতি না দাও তাহলে আমি যুদ্ধে যাব না, পড়তেই চলে যাব। কিন্তু মনে রেখ মা, আমি তাহলে জীবনে কখনো আয়নায় নিজের মুখে দেখতে পারব না। নিজের কাছে নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারব না।' (মাত্র ২০ বছরের একটা ছেলে কত অল্প কথায় আর কত চমৎকারভাবেই না মায়ের কাছ থেকে যুদ্ধে যাবার অনুমতি নিয়েছিলো)
এরপর আর মা ছেলেকে না করতে পারেনি। ছেলের মাথায় হাত রেখে বলে -
"ঠিক আছে। যা তাহলে। তোকে আমি দেশের জন্য কোরবানি করলাম"।
বলছি প্রকৌশলী শরীফ ইমাম ও জাহানারা ইমাম দম্পতির বড় ছেলে শাফি ইমাম রুমী, আমাদের ক্র্যাক প্ল্যাটুনের শহীদ রুমীর কথা। রুমী যখন ক্লাস এইটে পড়ে তখন মা একদিন দেখে রুমী লুকিয়ে লুকিয়ে কী জানি বই পড়ছে। ছেলে তাকে লুকিয়ে কখনও কিছু করবে এমনটা ভাবাই যায়না। এমনকি রুমীকে বলা আছে সে যদি সিগারেটও খায় তাও যেন মাকে বলেই খায় যদিও বসিগারেট খাওয়া মায়ের পছন্দ না। তাই রুমীর লুকিয়ে বই পড়াটা মায়ের পছন্দ হলনা। কিছুক্ষণপর রুমী পড়ার টেবিলেই ঘুমিয়ে পড়লে মা চুপ করে দেখল নাহ্, খারাপ কোনো বই নয়। সেটা ছিল লেনিনকে নিয়ে লেখা একটা বই। মা ভাবল রিভোলিউশনারিদের নিয়ে রুমীর আগ্রহ কেন? তবে কি রুমীর মতো ছেলেরা এখন চিন্তা করছে রাশিয়ার মতো বাংলাদেশেও একটি বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলবে?
হ্যাঁ ছেলে বিপ্লব ঘটিয়েছিল ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে। একাত্তরের জন্য রুমীর প্রথম প্রয়াস ছিলো ২ মে সীমান্ত অতিক্রম। কিন্তু প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে ফেরত আসতে হয় তবে দ্বিতীয় প্রচেষ্টাটি ছিলো একেবারে সফল। খালেদ মোশাররফ ও রশিদ হায়দার এর পরিচালনার দায়িত্বে থাকা সেক্টর-২ এর অধীনে মেলাঘরে প্রশিক্ষণ শেষে ঢাকায় এসে ক্র্যাক প্ল্যাটুনে যোগ দেয় রুমী। ক্র্যাক প্ল্যাটুন হল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা আক্রমণ পরিচালনাকারী একটি সংগঠন। রুমী ও তার দলের ঢাকায় আসার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন হামলা করা। তারা রাতে অন্ধকারে আর্মির হাতে ধরা পড়ার ভয়ে জলে ডুবে লুকিয়ে থাকে। পকেটের সিগারেট গুলো ভিজে একাকার হয়ে যায়। সিগারেট চাইলেই কেনা যায় না। ঘাসের উপর শুয়ে পরের দিনের যুদ্ধের প্ল্যান করার সময় একটা প্যাকেট অনেকজন মিলে ভাগ করে খায়। সে কারনে ঢাকায় অপারেশন করতে বাসায় এসে মায়ের কাছে রুমীর আবদার ছিল একটা ভাল সিগারেটের বক্স, যেটাতে পানি ঢুকে সিগারেট ভিজে যায় না। মেলাঘরে ছেলে টিলার উপরে বেড়ার ঘরে ,তাঁবুতে থাকে। পরিস্কার কাচের গ্লাসে এক কণা ময়লা দেখলে যে ছেলে আবার গ্লাস ধুয়ে নিত, গমের আটা দু'বার করে চেলে নিতে হত, রান্না ডালে খোসা দেখলে যেই ছেলে আর খাবে না, সে এখন যুদ্ধে গিয়ে খায় পোকা সেঁকা রুটি আর ডাল।
মা জাহানারা ইমাম ঢাকার সব মার্কেট ঘুরে অবশেষে এমন একটা সিগারেটের বক্স কিনল যেটায় সিগারেট রেখে ছেলে পাক বাহিনীর ভয়ে জলের নিচে ডুব দিয়ে লুকিয়ে আত্মরক্ষা করতে পারবে, কিন্তু সিগারেট ভিজবে না।
এর মাঝে রুমীকে ঝুঁকিপূর্ণ আক্রমণ পরিচালনা করতে হয় যার মধ্যে ধানমণ্ডি রোডের একটি আক্রমণ ছিলো উল্লেখযোগ্য। সেখানে একটি পাকিস্তানী সেনা জিপ তাদের বহনকারী গাড়ির পিছু নিলে গাড়ির পেছনের গ্লাস ভেংগে "'লুক লুক, এ জিপ ইজ ফলোয়িং আস"' বলে স্টেনগান ব্রাশফায়ার করে। তার গুলিতে পাকিস্তানি জিপের ড্রাইভার নিহত হয় এবং গাড়ি ল্যাম্পপোস্টে যেয়ে ধাক্কা খায়। বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা তার গুলিতে মারা যায়। ধানমণ্ডি রোডের অপারেশনের পর রুমী তার সহকর্মীদের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
এলিফ্যান্ট রোডের ইষ্টার্ণ মল্লিকার উল্টাদিকে গলির শেষ প্রান্তে, বাসা নম্বর ৩৫৫। এটাই রুমীদের বাসা। ২৯ আগস্ট, রবিবার, ১৯৭১। রাত ১২ টা। রুমী - জামীদের বাসার সবাই তখন ঘুমে। হঠাৎ গেটে ধুমধাম শব্দ। জাহানারা ইমাম আর শরীফ সাহেব নিচে নেমে এল, সারা বাগান পুলিশে ঘেরা। আশেপাশের বজলুর রহমান, সাত্তার, কাসেম সাহেবদের বাড়িগুলোর সামনের রাস্তাতেও অনেক মিলিটারি। শরীফ সাহেব দরজা খুলতেই দেখল খুব অল্প বয়সী আর্মি অফিসার দাঁড়িয়ে যার নাম বলল 'ক্যাপ্টেন কাইয়ুম '। প্রশ্ন করলো 'তোমার ছেলেদের নাম কি? 'রুমি, জামী এগিয়ে গেলো। শরীফ সাহেবকে নিজের গাড়ি চালিয়ে তাদের সাথে আসতে বলে পুলিশ রুমীদের হাঁটিয়ে নিয়ে গেল। সামনের রাস্তায় নিয়ে ক্যাপ্টেন কাইয়ুম রুমীর বাহু চেপে ধরে বলল, 'তুমি এসো আমার সঙ্গে'। তারপর ওরা নামে এম পি হোস্টেলের সামনে। আরেক পাকিস্তানি আর্মি অফিসার এসে বলে ' হু ইজ রুমী? ' রুমী সেদিন বাবাকে ফিসফিস করে বলেছিল, 'তোমরা কেউ কিচ্ছু স্বীকার করবে না, আমি তোমাদের কিচ্ছু বলিনি'। রুমীর বাবা কিছু স্বীকার করে না; রুমি নিখোঁজ হয়। সেরাতে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী বেশ কিছুসংখ্যক যোদ্ধাকে গ্রেফতার করে যার মধ্যে ছিলেন আলতাফ মাহমুদ, আবুল বারাক, আজাদ, জুয়েল।
৪৪ বছর বাদেও তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায় না...আজ ২৯ আগস্ট, ২০১৫। ৪৪ বছর হয়ে গেছে কিন্তু প্রজন্ম জানেনা রুমী, আজাদ, বদি, জুয়েল কে? প্রজন্ম বেবিডল দেখতে ১৫ হাজার টাকার টিকেট কেনার গর্ব করে কিন্তু নিজ দেশের ইতিহাস নিয়ে গর্ব করতে জানেনা ......
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে আগস্ট, ২০১৫ রাত ১১:৩৯
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×