জীবনটা বহতা নদী নয়, সেখানে উঁচু নিচু পাহাড়ও থাকে। এটা একটা সুইডিশ প্রবাদ।
জীবন কখনো বহতা নদীর মতই বয়ে যায় আবার কখনো উঁচু কখনো নিচু কিছু পাহাড় ও পারি দিতে হয়। বহতা নদী বা উঁচু নিচু পাহার পেরুনোর সময় আমার বিভিন্ন ধরনের পরিস্থিতির সন্মোক্ষিন হতে হয়, সেগুলো থেকে আমাদের যেমন অভিজ্ঞতা হয় তেমনি কিছু কিছু ঘটনা মনে গেঁথেরয় আজীবন। আমার ইউরোপের ১৬ বছরের জীবনের কিছু খন্ড খন্ড ঘটনা নিয়ে এটা একটা ধারাবাহিক লিখা ।
সততা :
এখানে আসার কয়েক মাস পর একদিন ভাবীর সাথে মার্কেট এ একটা কাপড়ের দোকানে ঢুকেছি এটা মূলত কাপড়ের দোকান হলেও টুকটাক কসমেটিকসও আছে,ভাবী জামা কাপড় দেখলেও আমি চলে যাই কসমেটিস এর কাছে ও একটা পুতির মালা হাতে নিয়ে দেখতেছি, ভাবী আমার কাছে এসে তুমি কি এটা নিতে চাও? আমি হা/না কিছু বলছি না দেখে ভাবী ভাবছে আমি নিতে চাই। তো ভাবী অন্যান্য জিনিসের সাথে ওটাও কাউন্টারে দিয়েছে। কাউন্টারের মহিলা তখন মালাটা হাতে নিয়ে এটা এই একটাই আমাদের আছে, তবে এটায় একটু ডিফেক্ট আছে,মহিলা ভাবীকে ডিফেক্ট টুকু দেখিয়ে, যদি তুমি এটা নিতে চাও তবে আমি তোমাকে ৫০% ছাড় দিব।
আসলে ডিফেক্টটুকু এতছোট ছিল যা আমার বা ভাবীর কারো নজরেই পরেনি,মহিলার সেই মালাটা এখনো আছে, যখনই মালাটা দেখি মহিলার সততার কথা মনে পরে।
ইভটিজিং :
যখন ক্লাস এইটে পরি এক সুইডিশ ছেলে আমার হিজাব দেখে সারাক্ষন প্রশ্ন করে তুমি মাথায় এটা বাধ কেন? তুমি কি টাকলু নাকি? আমি যতই বলি না আমি টাকলু না কিন্তু তার বিস্বাস হয় না, তার কথা তুমি তাহলে এটা খুলে তোমার চুল দেখাও? আমি ও বলি, তোমার বিশ্বাস- অবিশ্বাসে আমার কিছু আসে যায় আমি তোমাকে আমার চুল দেখাব না।
এখানে ক্লাস ওয়ান থেকে কলেজ পর্যন্ত বাচ্চাদের দুপুরের খাবার ফ্রীতেই দেয়া হয়। একদিন দুপুরের খাবারের সময় খাবার নিতে লাইনে এই ছেলে আমার সামনে দাড়িয়ে আমি তার পিছনে। সে পিছন দিকে ঘুরে, আজকে আমি তোমার চুল দেখবই বলে আমার হিজাব ধরে টান দেয়, হিজাব খুলে না গেলেও হিজাবের একটা পিনের খোজা লাগে আমার মাথায়, আমার খুব খারাপ লাগে, ব্যাথাও পেয়েছি, আমি খাবার না নিয়ে ক্লাস রুমে এসে বসে বসে কান্না করছি। কিছুক্ষন পর মাথায় কারো হাতের পরশ পেয়ে তারাতারি চোখ মুছেঁ পিছন ফিরে তাকাতেই দেখি আমার ক্লাস টিচার।
টিচার : তুমি কাঁদছ কেন !! তোমার সাথে যা করা হয়েছে এটা ইভটিজিং তুমি পুলিশে কল করতে পার, না হলে রেক্টরের( হেড মাষ্টার) কাছে নালিশ করতে পার।
আমি না থাক।
টিচার কেন থাকবে কেন? তুমি কি ভয় পাও, ভয়ের কিছু নেই একজন নাগরিক হিসাবে ওর যতটুকু অধিকার আছে তোমার ও ঠিক ততটুকু অধিকার, এটা কখনো মনে ভেবনা ওরা তোমাকে করুনা করে এখানে থাকতে দিয়েছে, ওদের প্রয়োজনেই ওরা তোমাকে থাকতে দিয়েছে, এটা তুমি এখন বুঝবে না আরও বড় হও তখন বুঝবে। তবে কখনো মাথা নত করে থাকবে না তোমার যা অধিকার সব আদায় করে নিবে। আমি তোমার মত বিদেশী বলেই কথাগুলো তোমাকে বল্লাম।
প্রতারনা :
এটা আসার কয়েক মাস পরের ঘটনা। স্টকহোমের ভিতরেই তবে একটু দুরে বেড়াতে যাব আমি আর ভাবী। প্রথমে মেট্টোতে সেন্টাল ইষ্টিশনে যেতে হবে ওখান থেকে ট্রেনে যেতে ।
মেট্রো থেকে নেমে ট্রেন ইষ্টিশনে যাওয়ার পথে এক লোক সামনে এসে তোমরা ফোনে কোন লাইন ফোন ব্যবহার কর ?
ভাবী : কমভিক।
মাসে কতটাকা লাগে?
ভাবী কোন মাসে ৭৫ টাকা আবার কোন মাসে ১৫০ টাকা লাগে।
আমার কাছ থেকে যদি এই লাইনটাই কিস্তিতে নাও তোমার মাত্র ৩৯ টাকা লাগবে, তুমি যত ইচ্ছা কল করতে পারবে।
ভাবী আমি এখন কথা বলতে পারব না আমার ট্রেন ছেড়ে যাবে, আমরা তারাহুরা করে এসেও দেখি ট্রেন চলে গিয়েছে, এখন ৩০ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে তখন ভাবী, চল আমরা আবার যাই ঐ লাইনটা আমার মোবাইলে নিব। ফিরে যেয়ে ঐ লোকের সাথে কথা বলে ভাবী কন্ট্রাক পেপারে সাইন করে ভাবীর মোবাইলে ঐ লাইন নেয়।
মাস শেষে বিল আসল ৩৫০ টাকা। ভাবীর তো মাথা গরম। ওদের কোম্পানীতে ফোন দিয়ে ভাবী বল্ল, আপনারা বলছেন, মাসে মাত্র ৩৯ টাকা বিল আসবে এখন ৩৫০ টাকা বিল দিয়েছেন।
ওপাশ থেকে : জী আমরা ঠিকই বলেছি আপনি মাসে যত ফোনই করেন কলরেট আমরা ৩৯ টাকাই নিব কিন্ত আপনার প্রতি মিনিট চার্চ আছে না !
ভাবী তখন তো বলেন নাই প্রতি মিনিটের জন্য আলাদা চার্চ নিবেন।
ওপাশ থেকে : এটা কি বলতে হয় নাকি ?
ভাবী : ওকে আমার লাইন বন্ধ করে দেন, আমি এটা রাখব না।
ওপাশ থেকে : সেটা আপনি দিতে পারেন তবে আজকে অফ করলে ও তিন মাস সময় লাগবে ?
ভাবী : ওকে।
এরপর ভাবী নতুন সিম নিয়ে ঐ সিম বন্ধ রেখে তিন মাস শুধু ৩৯ টাকা পেমেন্ট করে উদ্ধার পেয়েছে।
রেসিস্ট :
কলেজ সেকেন্ড ইয়ারে আমার খুব অসুখ প্রায় ১ মাস হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল। আমি এবার একটু চঞ্চল টাইপের মেয়ে বেশীক্ষন শুয়ে বসে থাকতে পারি না, একটু ভাল লাগলেই এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াতাম। একদিন বিকালবেলা ঘুরতে ঘুরতে দেখি এক বয়স্ক মহিলা বসে টিভি দেখছে, মহিলাকে আমার কাছে আমার দাদীর মত লাগতেছে,( আমার দাদী খুব সুন্দর ছিল) আমার কাছে খুব মায়া লাগছে আমি যেয়ে মহিলার পাশে শোফায় বসি।
মহিলা লাফ দিয়ে উঠে, ইনভান্দরা, ( বিদেশী ) এই দেশে এসে পরে মরছিস কেন, পৃথিবীতে আর কোন দেশ নেই, svarige ( সুইডেনের লোকাল নাম) এসেছিস কেন ?
আমি মহিলার কথা ও বলার ঢং দেখে খুব হেসেছিলাম।
এবার বেশী খারাপ গুলো বলে ফেল্লাম মনে হয়। ইউরোপ নিজেদের সভ্যতার ধারক বাহক মনে করলেও আমাদের মতই রক্ত মাংসে গড়া মানুষ, মানবিক দোষ- গুন এদের মাঝেও আছে। জীবনে চলার পথে ভাল মানুষের সংস্পর্শ যেমন পেয়েছি খারাপ মানুষের খারাপ আচরনের মুখোমুখিও হয়েছি দুটোই মনে আছে তবে পার্থক্য হল একটা ভালবাসায় আরেকটা ঘৃণা ভরে।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে মার্চ, ২০২১ সকাল ১১:৫৮