somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পথে চলতে চলত ( পর্ব ২ )

০৮ ই নভেম্বর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:৩৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



সুইডিশরা খুব ভাল চেনা আর অচেনা নেই চোখে চোখ পড়লেই সুন্দর একটা হাসি উপহার আপনি পাবেনই। এদের মাঝে সবচেয়ে বড় যে গুণটা দেখেছি, রাস্তায় কারো কাছে কোন ঠিকানা জানতে চাইলে, তার জানা না থাকলেও পূর্ণ আন্তরিকতার সাথে আপনাকে হেল্প করার চেষ্টা করবে তার পক্ষে যতটুকু সম্ভব।আপনার মনে হবেই কত ভাল মানুষ।

তিন বছর আগে ২ সপ্তাহের জন্য আমাকে যেতে হয়েছিল সুইডেনের উত্তরের শেষ সীমানায় কিরনাতে। আমি যেখানে ছিলাম সেটা শহরের একটু বাহিরে। সেখান থেকে শহরে হেঁটে গেলে ৪০ মিনিট আর বাসে গেলে প্রায় ২০ মিনিট, বাস একটু ঘুরে ঘুরে যায়।
এখানকার একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল, স্যামারে দিন খুব বড় জুনমাসে কয়েকদিন সূর্য অস্তই যায় না আবার উইন্টারে দিন খুব ছোট ডিসেম্বরে কয়েকদিন সূর্য্যই দেখা যায়। তবে এবারে আমার লিখার বিষয় এটা না।

এখানে আমি পেয়েছি এক বিনা সূতার মায়ার বন্ধন, সেই ভালবাসায় কখনো আমার চোখে জল আসে, কখনো আনন্দে উদ্বেলিত হই, কখনো অবাক হয়ে ভাবি , কি ভাবে একটা মানুষ অচেনা অজানা মানুষ হৃদয়ের এতটা কাছাকাছি পৌঁঁছে যায়। আমার জীবনে এই ঘটনা না ঘটলে কারো মুখে এই গল্প শুনলে হয়ত আমার নিজেরই বিস্বাস করতে কষ্ট হত। সুইডিশদের কাছে এই ধরনের আচরন কল্পনাতীত।
চলার পথে কুড়িয়ে পাওয়া আমার সেই অদ্ভুত মায়ার বন্ধনের কথা শুনুন এবার।

এখানে আসার সময় প্লেনে এসেছি, যাওয়ার সময় ভাবলাম ট্রেনে যাই, প্রায় ১৭ ঘন্টার জার্নি একটু উপভোগ করে দেখি না কেমন।
আমি যেখানে আছি ট্রেন ইষ্টেশন সেখান থেকে বেশ দুর, শহরের কাছাকাছি।

শুক্রবার আমি চলে যাব, সমবারে ভাবলাম শহরে একটু ঘুরে ট্রেন ইষ্টেশন দেখে আসব। আমি হাঁটতে অনেক পছন্দ করি তাই বাসে না যেয়ে হেঁটেই যাওয়ার সিন্ধান্ত নিলাম। কিছুদুর যাওয়ার পর রাস্তা চিনতে পারছি না, কয়েকটা রাস্তা কোন দিকে যাব,গুগল ম্যাপসও কাজ করছে না নেট খুব স্লো, এখানে লোকজন এত কম রাস্তা ঘাটে কোন লোকজনও দেখা যাচ্ছে না, বিকাল ৩টা কিন্ত অন্ধকার হয়ে আসছে যে দিকে তাকাই এত উঁচু উঁচু কালো পাহাড় দেখলেই ভয় করে , এদিক সেদিক তাকাচ্ছি দেখি একজন মহিলা আসতেছে, কাছে আসলে তাকে হেই দিয়ে দাড়া করালাম, সরি বলে, বল্লাম, আমি ট্রেন ইষ্টিশনে যেতে যাই, কোন দিকে যাব। সে খুব মিষ্টি করে হেসে বল্ল,আমার সাথে চল।

চলতে চলতে উনার সাথে অনেক কথা হল, আমার,নাম,কোথা থেকে এসেছি,কেন এসেছি,কতদিন এখানে থাকব,এরপর আমার দেশ, আমার পরিবার সম্পর্কে জানার পর তার সম্পর্কে বলা শুরু,উনার নাম মনিকা,বয়স ৫৮,তার স্বামীর নাম পুল,বয়স ৬২,উনাদের দুই ছেলে বয়স ৩০ ও ২৬ তারা অন্য শহরে থাকে। সে একটা স্কুলে জব করে,সে একটু অসুস্থ তাই আজকে স্কুল থেকে ছুটি নিয়ে হাসপাতালে এসেছিল এখন বাসায় ফিরছে। কিছু দুর যাওয়ার পর মহিলা,আমার বাসা সোজা রাস্তায় যেতে হবে, রেল ষ্টেশনে যেতে হাত দিয়ে ইশারা করে তোমাকে এদিকে যেতে হবে। উনার কথার গতি এত বেশী ছিল আমি বুঝতেই পারলাম না কতদূর এলাম।

আমি ওকে, তোমাকে অনেক গধন্যবাদ।

মনিকা : মুচকি হেসে,তার চেয়ে তুমি এখন আমার বাসায় চল এক কাপ কফি খাবে, ৫ টায় আমার হ্যাজব্যন্ড বাসায় আসলে সে তোমাকে ট্রেন ষ্টেশন দেখিয়ে তোমার বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসবে।
আমি তো অবাক,মহিলা পাগল নাকি!! না,না আমি তোমার বাসায় যাব না, এটুকু আমি যেতে পারব। আর যাওয়ার সময় আমি বাসে চলে যাব।
মনিকা : না চল, অন্ধকার হয়েছে তুমি নতুন মানুষ রাস্তাঘাট চিন না, ৫টা তো প্রায় বেজেই গিয়েছে,আমরা কফি খেতে খেতেই পুল চলে আসবে।
সুইডিশদের কাছে এই ধরনের আচরন অসম্ভব!! আমার এখন এই মহিলাকে ভয় লাগছে, তার উদ্দেশ্য কি আল্লাহ ভাল জানেন। আবার মনে মনে ভাবছি এখানে তো আর তেমন বিদেশী নেই তাই হয়ত আমার প্রতি তার এত কৌতোহল। আমি যতই না, না করছি সে ততই জোর করছে, মহিলা এত নাছোর বান্দা আমি কিছুতেই এড়াতে পারলাম না, ভয় নিয়েই মহিলার বাসায় আসলাম।


মনিকা, আমাকে কিচেনে নিয়ে টেবিলের উপর বিভিন্ন খাবার ও ফল দেখিয়ে তোমার যা ইচ্ছা খাও, আমি তোমাকে কফি করে দিচ্ছি।
আমি না আমার অন্য কিছু লাগবে না শুধু একটু কফি হলেই চলবে।

মনিকা দুইমগ কফি নিয়ে, চল আমরা ড্রইংরুমে যেয়ে বসি। এরপর তার ফ্যামেলী এ্যালবাম বের করে, একে একে তার পুরো পরিবারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। তার দাদা দাদী পর্যন্ত।

মনিকা আমার ডান গালে একটা হাত রেখে, তুমি অনেক সুন্দর তোমাকে আমার অনেক পছন্দ হয়েছে,তোমাকে দেখেই তোমার প্রতি আমার একটা মায়া জন্মেছে, আমার দুইটা ছেলে আছে, একটা মেয়ের অনেক শখ ছিল কিন্ত পাইনি।
আমার কাছে বেশ আশ্চার্য লাগছে, উনি কি বলতে চাচ্ছেন,বা আমার কি বলা উচিত তাও বুঝতে পারছি না। আমি প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য বলি, ৫টার উপরে বাজে পুল তো এখনো আসছে না কেন ?

মনিকা : অন্যদিন সে ঠিক ৫ টায় চলে আসে, সবুর কর আসুক না একটু দেরী করে, তোমার কি আমার সাথে গল্প করতে খারাপ লাগছে?
মনের কথাতো মুখে বলা যায় না,তাই বল্লাম, না তা লাগছে না।
সারে ৫টার দিকে পুল এল। পুল খুবই নিরিহ ও নরম স্বভাবের, ঘরে ঢুকতেই মনিকা আমার পরিচয় দিয়েই,এখন তুমি ওকে নিয়ে ট্রেন ইষ্টিশনে যাবে, সেখান থেকে ওকে ওর বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসবে। পুল কোন কথা না বলে, ওকে বলেই যাওয়ার জন্য উঠে দাড়াল।
মনিকা : না বস, আমি খাবার গরম করছি খেয়ে তারপর যাবে
পুল : ওকে, বলেই বসে পরল।
না, আমি খাব না বলেই, আমি মনিকাকে ধন্যবাদ দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে আসলাম বাধ্য হয়ে উনারা আমার পিছু পিছু এলেন।

১দিন পর ৬ টার দিকে আমার মোবাইলে রিং হচ্ছে, অপরিচিত নাম্বার, ( মনিকা তার নাম্বার আমাকে দিয়েছিল কিন্ত সেভ করা হয়নি ) ফোন রিসিপ করে হ্যালো বলতেই, আমি মনিকা, তোমার বাসার নীচে আছি। নীচে যেয়ে বাসায় নিয়ে আসলাম।

মনিকা : সেদিন তোমাকে কিছু খাওয়াতে পারি নাই, আমার খুব খারাপ লেগেছে, তাই আজকে একটু খাবার রান্না করে নিয়ে এসেছি, তোমাকে সাথে নিয়ে খাব।

মনিকাই টেবিলে সব কিছু রেডী করল, মনিকা,পুল আমি একসাথে খেতে বসেছি।
মনিকা : তুমি টিকিট কেটেছ ?
জী, শুক্রবার বিকাল সারে ৫ টায় ট্রেন।

মনিকা : তাহলে তোমাকে ৫ টার মধ্যেই ইষ্টিশনে থাকতে হবে। আমরা সারে ৪টায় এসে তোমাকে নিয়ে যাব তুমি রেডী থেক।

আমি যারপরনাই আশ্চার্য হয়ে, না, না তোমাদের কষ্ট করে আসতে হবে না, আমি বাসে যেতে পারব।

মনিকা : তুমি না করছ কেন? আমার বোন রোজমেরী তোমার সাথে দেখা করতে চেয়েছে, আজকে নিয়ে আসতে চেয়েছিলাম কিন্ত ও ছেলের বাসায় গিয়েছে।
এরপর কি আর কিছু বলা যায়।
উনারা খাওয়া দাওয়ার পর কিছুক্ষন গল্প করে চলে গেল।
মানুষের মন বড়ই অদ্ভুত কখন কাকে ভাললাগে,সেই ভাললাগা জাতি,ধর্ম,বর্ণ ভেদ করে পৌঁছে যায় হৃদয়ের গভীরে বলা মুশকিল।

আমার চলে আসার দিন,মনিকা তার বড় বোনসহ চারটায়ই চলে এল। রাস্তায় আমার খাওয়ার জন্য খাবার রান্না করে হটপটে করে নিয়ে এসেছে। রোজমেরীও খুব ভাল ঠিক খালামনির মতই তার আচরন। আমরা একসাথে কফি খেয়ে পৌনে ৫টায় বাসা থেকে বের হয়ে মাত্র ১০ মিনিটেই আমরা ট্রেনইষ্টিশনে পৌঁছালাম। ট্রেন ছাড়ার আগ মূহুর্ত পর্যন্ত মনিকা আমাকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকল।

মনিকার শেষ কথা গুলো এখনো কানে বাজে, তোমার সাথে হয়ত আর কখনো দেখা হবে না, কিন্ত তোমাকে আমি কখনো ভুলব না, তুমি রবে আমার হৃদয়ে একটা মেয়ের যে শূন্যতা ছিল সেখানে। আমি সব সময় ভাবব ষ্টকহোমে আমার একটা মেয়ে আছে। তার চোখদুটো জলে টলমল করছিল, আমার মনের গভীরেও তার জন্য একটা মায়া অনুভব করলাম খুব কান্নাও পাচ্ছিল। আমি পরেরদিন বাসায় পৌঁছে মনিকাকে ফোন দিয়ে জানালাম আমি ভালভাবে এসে পৌঁছেছি।

কাহিনীটা এখানেই শেষ হতে পারত কিন্ত মনিকা শেষ হতে দেয়নি বাকী টুকু আগামী কাল।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে মার্চ, ২০২১ দুপুর ১২:০৪
৩০টি মন্তব্য ৩১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদী নামের এই ছেলেটিকে কি আমরা সহযোগীতা করতে পারি?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১০:০৪


আজ সন্ধ্যায় ইফতার শেষ করে অফিসের কাজ নিয়ে বসেছি। হঠাৎ করেই গিন্নি আমার রুমে এসে একটি ভিডিও দেখালো। খুলনার একটি পরিবার, ভ্যান চালক বাবা তার সন্তানের চিকিৎসা করাতে গিয়ে হিমশিম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভালোবাসা নয় খাবার চাই ------

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৯ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:০৬


ভালোবাসা নয় স্নেহ নয় আদর নয় একটু খাবার চাই । এত ক্ষুধা পেটে যে কাঁদতেও কষ্ট হচ্ছে , ইফতারিতে যে খাবার ফেলে দেবে তাই ই দাও , ওতেই হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতীয় ইউনিভার্সিটি শেষ করার পর, ৮০ ভাগই চাকুরী পায় না।

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৯ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৭



জাতীয় ইউনিভার্সিটি থেকে পড়ালেখা শেষ করে, ২/৩ বছর গড়াগড়ি দিয়ে শতকরা ২০/৩০ ভাগ চাকুরী পেয়ে থাকেন; এরা পরিচিত লোকদের মাধ্যমে কিংবা ঘুষ দিয়ে চাকুরী পেয়ে থাকেন। এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×