সুইডেন আসার পর এদেশটাকে দেখে মুগ্ধ ও অবাক হয়েছিলাম সেই ছোটবয়সে। রাস্তা-ঘাট,ঘরবাড়িগুলো এত সুন্দর প্লান করে বানানো ! প্রতিটা বাড়ির সামনে বাচ্চাদের খেলার পার্ক,প্রতিটা রাস্তার সাথেই ফুটপাত , সাইকেলের জন্য আলাদা লেন আছে । গহীন জংগলের ভিতরেও কত সুন্দর হাঁটার রাস্তা ! একটু পরপর বেঞ্চ পাতা ও ময়লার বিন রাখা আছে। যেখানে যেই জিনিটার দরকার সেখানে ঠিক সেই জিনিসটাই আছে। রাস্তা-ঘাট, বাসাবাড়ি,অফিস আদালত গুলো পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। ট্রেন ষ্টেশনগুলো ঝকঝক করছে | বাস ট্রেনের সিটে ছেড়া ফুটা বা ময়লা নেই। রাস্তার ধারে ময়লা পলিথিনের স্তূপ নেই।
প্রথম যেদিন আমাদের প্রতিবেশী এভার সাথে হাঁটতে বেরিয়েছি সাথে তার কুকুর। কুকুর একটু পর পায়খানা করেছে।সেটা রাস্তায় ছিল না জংগলের ভিতরে ছিল,কিন্ত আমি অবাক হয়ে ছিলাম,দেখি এভা তার জ্যাকেটের পকেট থেকে ছোট কালো পলেথিন বের করে পায়খানা তুলে পাশেই ময়লা ফেলার বিনে ফেল্ল। এভার সাথে যখনই হাঁটতে যেতাম তাকে দেখতাম রাস্তায়, গাছের কোন ডাল,বা কোন কাগজ পেলে সেটা তুলে জায়গা মত ফেলে দিত।রাস্তায় গারির জ্যাম নেই, দোকান পাটে ভির নেই। বাসার ভিতর মশা, মাছি নেই | পানি যায় না, কারেন্ট যায় না। সব কিছুই চলছে সুশৃংখল ভাবে, সবাই সব নিয়ম কানুন সঠিক ভাবে মেনে চলছে ,এমনকি এস্কেলেটর দিয়ে উঠা- নামা করার সময়ও সবাই নিয়ম মেনে চলছে।যত তাড়াই থাক কেউ কাউকে টপকে আগে যাচ্ছে না। আমাদের দেশে যেন নিয়ম ভাংগাই নিয়ম । আমরা দেশের মানুষগুলোও এসব দেশে এসে ভদ্র হয়ে যাই,সব নিয়মই মেনে চলি কিন্ত এই আমরাই দেশে যেয়ে আবার নিয়ম ভঙ্গ করি।
আমাদের অনেক কিছু নেই | আমাদের বিত্ত বৈভব এই দেশগুলোর মতো না, টেকনোলজিতে আমরা অনেক বছর পিছিয়ে ।আরো অনেক কিছুতেই আমাদের দেশের সাথে এদের কোনো তুলনা চলে না ।| কিন্তু একটা জায়গায় আমরা কিন্তু এদের চেয়ে এগিয়ে আছি বলেই আমার ধারণা । সেটা হলো সামাজিকতায় আর ভালোবাসায় । এদেশে আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে কিছু ঘটনা বলি ।|
ক্লাস সিক্স থেকে ক্লাস নাইন পর্যন্ত স্টেফিনা নামে একটা মেয়ের সাথে আমি বেশ মিশতাম ।অন্যদের চেয়ে তাকেই আমার একটু ভাল মনে হত যদিও ক্লাসে আরো বিদেশী বা মুসলিম মেয়েও ছিল | স্টেফিনার সাথে মিশার আমার একটাই উদ্দেশ্য ছিল তার কাছ থেকে আমি সঠিক উচ্চারনে সুইডিশ শিখতে পারব । তবে সেটাও যে খুব বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল তাও বলা যাবে না । ক্লাস নাইনের শেষ দিকে সেই আগ্রহ করে বল্ল , আমাদের তো স্কুল শেষ হয়ে যাচ্ছে আমরা দুইজন কলেজে চলে যাচ্ছি হয়ত আমাদের আর দেখা হবে না, চল আমরা একদিন এক সাথে খাই । আমি তো কারো বাসায় যাই না, তাহলে একদিন তুমি আমাদের বাসায় আস ? সে বল্ল, না কারো বাসায় যাব না , আমরা এক সাথে রেস্টুরেন্টে খাব । আমি বললাম, ‘ঠিক আছে’। তখন স্টেফিনা নামী দামী এক সুইডিস রেস্টুরেন্টে নাম বলে আমাকে বললো, ‘শনিবার সন্ধ্যায় তুমি ওখানে এস’।
আমি শনিবার দিন একটু আগেই বের হয়ে তার জন্য একটা গিফ্ট কিনলাম (যেহেতু সে আমাকে খাওয়াবে তাই তার জন্য গিফট কেনা একটা সাধারণ সৌজন্য)। রেস্টুরেন্টে পৌঁছে দেখি সে আমার আগেই এসেছে। ‘আস, আস আমরা খাবার নিয়ে আসি’ । লাইনে সে আগে আমি পিছনে দাঁড়িয়েছি |
তার সিরিয়াল আসলে সে খাবার অর্ডার করে টাকা পেমেন্ট করে, আমাকে বলে তুমি তোমার মত খাবার পছন্দ করে পেমেন্ট করে এদিকে এস খাবার নেওয়ার জন্য । তার কথায় আমি এতটা সারপ্রাইজড হয়েছিলাম, যা কখনো ভুলব না । কিন্ত সমস্যা হল আমি যে খাবার অর্ডার করলাম ( যদি ঐ রেস্টুরেন্টের সব চেয়ে কম দামী খাবার) আর তার যা বিল আসল সে টাকাও আমার কাছে নেই । রাগে আর লজ্জায় আমার চোখে পানি আসার অবস্থা । কিন্ত এত মানুষের সামনে তো এটা করা যাবে না ! তখন তার কাছ থেকেই বাকী টাকাটা ধার করলাম। আমিও কি কম নাকি ! তার জন্য কেনা গিফ্টটা তাকে না দিয়ে পরের দিন সেটা দোকানে ফিরত দিয়ে টাকা নিয়ে সেই টাকাই তাকে দিয়ে দিলাম। হা হা হা !
আমাদের প্রতিবেশী এভা’র তার স্কুলে খুব ঘনিষ্ট এক বান্ধুবী ছিল এখনো আছে, তখন তাদের একটা কমিটমেন্ট ছিল তারা যতদিন বেঁচে থাকবে যত ব্যাস্ততা আর যেখানেই থাক ১৫ নভেম্বর সন্ধ্যায় তারা একটা রেস্টুরেন্টে তারা খাবে ও কিছুটা সময় তারা একত্রে কাটাবে। খুবই আশ্চার্য লাগে এখনও (১৫-৬২ বছর) তারা একবারের জন্যও এটা মিস করে নাই, যদিও তারা দুজন দুই শহরে বাস করে বছরে হয়ত তেমন কথাও হয় না। তাকে একদিন জিজ্ঞেস করে ছিলাম, আচ্ছা তোমরা কি ভাবে খাও, এক বছর সে তোমাকে খাওয়ায়, আরেক বছর তুমি তাকে খাওয়াও এভাবে ? এভা না, তা কেন হবে, সে তার টাকা দিয়ে খায় আমি আমার টাকা দিয়ে খাই। একসাথে বসি কিছুক্ষন গল্প করি এই আর কি।
তখন মনে মনে ভাবলাম তাহলে ইষ্টেফিনা ঠিকই আছে আমার সাথে তো বন্ধুত্ব তো এতটু নয় আর সে তো বলেছে আমারা একত্রে খাব, সে আমাকে খাওয়াবে তাতো বলে নাই। আমারই বুঝার ভুল ছিল।আসলে বয়স কম ছিল তো এই সব ছোট খাট বিষয়গুলো মনে দাগ কাটত।
বিদেশে থাকি বলেই যে আমার দেশের প্রতি মায়া বা ভালবাসা অন্য অনেকের চেয়ে বেশি আমি সেটা কখনোই বলিনা বা দাবি করি না | তবে আমার দেশ সম্পর্কে কেউ খারাপ কিছু বল্লে আমার খুব কষ্ট হয়, একেবারে আমার বুকের ভিতরে লাগে সেটা। মানুষের জন্য আমাদের ভালোবাসার ক্ষমতা এই দূর বিদেশে আমাকে দেশকে নিয়ে আরো একবার গর্বিত হবার সুযোগ কর দিলো কিছুদিন আগে |
স্কুলে আমার প্রোগ্রামের পড়ার অংশ হিসেবে একবার এক ডাক্তারের সাথে এপয়েন্টমেন্ট করতে হলো | ডক্টর ডবিড | তার সাথে কিছুদিন কাজ করতে হবে যদি সুযোগ পাওয়া যায় | সে শুরুতেই আমাকে প্রশ্ন করে তুমি কোন দেশ থেকে এসেছ? ডক্টর ডবিড
-‘বাংলাদেশ’। আমি বলি ।
-‘হ্যা, হ্যা এই দেশটাকে আমি চিনি,মানে টিভিতে দেখেছি | খুব গরীব আর ছোট একটা দেশ, অনেক মানুষ প্রতি বছর বন্যা আসে তাতে অনেক মানুষ মারা যায়’ উনি বলেন ।
-‘আচ্ছা তুমি কি ড: ইউনুসের নাম শুনেছ’? মেজাজটা করে আমি জানতে চাই ।
-ড: ইউনুস !! ওহ্ হ্যা, তুমি কি নবেল লরিয়েট ড: ইউনুসের কথা বলছ?
- ‘জী, সে কিন্ত আমার দেশের’।
-‘সুইট গার্ল তুমি কি আমার কথায় মাইন্ড করেছ’? উনি আমার চেহারা দেখে জিজ্ঞেস করেন।
-আচ্ছা আমি যদি তোমার পরিচয়ে বলি তোমাদের দেশের লোকেরা ভাইকিং ছিল, বা এখন তোমাদের দেশের নাম্বার ওয়ান আয়ের উৎস ( গোপন অস্ত্র রফতানী) তাহলে কি তুমি মাইন্ড করবে?
-‘আরে মেয়ে তুমি তো দেখি ভাল মাইন্ড করেছ’ ! ডক্টর ডবিড এবার বেশ জোরে হেসে বললেন |
-দেখ মাইন্ড করি বা না করি আমি তোমার সাথে কাজ করব না | আমি আমার সুপারভাইজার হিসাবে অন্য কাউকে চাই | উনি অবশ্য খুশী মনেই এটা হ্যান্ডওভার করে দেন এলিসা মানের এক মহিলা ডাক্তারের কাছে।
অক্টোবরের প্রথম দিকে(যখন আমার দেশে রোহিঙ্গা আশ্রয় নেয়) একদিন ক্লাস শেষে স্কুলের পার্কিং লটের দিকে যাচ্ছি | গাড়ি ড্রাইভ করে বাসায় ফিরতে হবে | হঠাৎ শুনি ইয়ং লেডী, ইয়ং লেডী বলে কেউ ডাকছে । পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি একজন ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ছেন । আমি তাকাতেই হাত ইশারায় কাছে যেতে ডাকছেন । আমি দূর থেকে প্রথমে তাকে চিনতে না পারলেও কাছে এসেই চিনতে পারলাম। ডক্টর ডবিড ! আর উনি এবারও বেশ উচ্ছসিত হয়েই বললেন, ‘ইয়ং লেডী, আমি তোমার দেশকে আর একটা রুপে দেখতে পেয়েছি যদিও তাও টিভিতেই ।কাজেই আমার ধারনাটা এখন পরিবর্তন হয়েছে, তোমার দেশ আয়তনে ছোট হলেও মানবিকতার দিক দিয়ে অনেক বড়’। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার ব্যাপারে আরও অনেক প্রশংসাই করলেন ডক্টর দবিদ । আমি এবার একটু গর্বের হাসি দিয়েই বললাম, আমাদের দেশ হতে পারে অনেক ধনী না, প্রতিবছর বন্যা হয় কিন্তু তবুও মানুষের জন্য আমাদের দেশের মানুষের ভালোবাসা হারিয়ে বা ভেসে যায় নি।আর আরেকটা কথা, আমার ধারনা কিন্ত তোমার সম্পর্কে সেই রকমই আছে’।