মুযাফফর বিন মুহসিন
ভূমিকা :
আমলের মাধ্যমে ব্যক্তির পরিচয় ফুটে উঠে এবং সে আল্লাহর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। সৎ আমল করা একজন মুসলিম ব্যক্তির প্রধান দায়িত্ব। আর সেজন্যই তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই আমলের বিশুদ্ধতা যাচাইয়ের প্রয়োজন মনে করে না। যে আমল সমাজে চালু সেটাই সকলে করছে। এমনকি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম ছালাতের ক্ষেত্রেও তাই। কারণ প্রচলিত ছালাতের হুকুম-আহকামের অধিকাংশই ত্রুটিপূর্ণ। ওযূ, তায়াম্মুম, ছালাতের ওয়াক্ত, আযান, এক্বামত, ফরয, নফল, বিতর, তাহাজ্জুদ, তারাবীহ, জুম‘আ, জানাযা ও ঈদের ছালাত সবই দূষিত ও ভুলে ভরা। ফলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছালাতের সাথে আমাদের ছালাতের অনেকাংশেই মিল নেই। এর অন্যতম প্রধান কারণ হ’ল জাল ও যঈফ হাদীছভিত্তিক আমল এবং মানুষের রচিত মনগড়া বিধান। জাল ও যঈফ হাদীছের করালগ্রাসে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছালাত সমাজ থেকে প্রায় বিলীন হয়ে গেছে।
মূলত: বিশুদ্ধভাবে ছালাত আদায়ের গুরুত্ব সম্পর্কে না জানার কারণেই এই করুণ পরিণতি। এছাড়াও অনেকে বলে থাকে, যারা ছালাত পড়ে না তাদের নিয়ে কোন মাথা ব্যথা নেই; যারা ছালাত আদায় করছে তাদেরই ভুল-ত্রুটি ধরা নিয়ে ব্যস্ত। এই অজ্ঞতাও একটি কারণ। অথচ ছালাতের প্রধান শর্তই হ’ল, রাসূল (ছাঃ) যেভাবে ছালাত আদায় করেছেন ঠিক সেভাবেই ছালাত আদায় করা।১ এ ব্যাপারে শরী‘আতের নির্দেশ অত্যন্ত কঠোর। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘সুতরাং দুর্ভোগ সেই মুছল্লীদের জন্য, যারা ছালাতের ব্যাপারে উদাসীন, যারা লোক দেখানোর জন্য আদায় করে’ (মাঊন ৪-৬)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘ক্বিয়ামতের মাঠে বান্দার সর্বপ্রথম হিসাব নেওয়া হবে ছালাতের। ছালাতের হিসাব শুদ্ধ হ’লে তার সমস্ত আমলই সঠিক হবে আর ছালাতের হিসাব ঠিক না হ’লে তার সমস্ত আমল বরবাদ হবে’।২
জনৈক ছাহাবী রাসূল (ছাঃ)-এর উপস্থিতিতে তিনবার ছালাত আদায় করেন। কিন্তু রাসূল (ছাঃ) তিনবারই তাকে বলেন, তুমি ফিরে যাও ছালাত আদায় কর, তুমি ছালাত আদায় করনি।৩ ঐ ব্যক্তি রাসূলের সাক্ষাতে তিন তিনবার অতি সাবধানে ছালাত আদায় করেও তাঁর পদ্ধতি মোতাবেক না হওয়া তা ছালাত বলে গণ্য হয়নি। অন্য হাদীছে এসেছে, হুযায়ফাহ (রাঃ) জনৈক ব্যক্তিকে ছালাতে রুকূ-সিজদা পূর্ণভাবে আদায় করতে না দেখে ছালাত শেষে তিনি তাকে ডেকে বললেন, তুমি ছালাত আদায় করনি। যদি তুমি এই অবস্থায় মারা যাও তাহ’লে মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে যে ফিতরাতের উপর আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন সেই ফিতরাতের বাইরে মারা যাবে।৪ অন্য বর্ণনায় রয়েছে, হুযায়ফাহ প্রশ্ন করলে সে জানায় যে, সে ৪০ বছর যাবৎ ছালাত আদায় করছে। তখন তিনি উক্ত মন্তব্য করেন।৫ উক্ত দলীল সমূহ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, বছরের পর বছর ছালাত আদায় করেও কোন লাভ নেই। হবে না যদি তা রাসূলের পদ্ধতি মোতাবেক আদায় করা না হয়।
আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় হ’ল, সমাজের উপর এই ছালাত যেন কোন প্রভাব ফেলছে না। অথচ আল্লাহ তা‘আলার দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা হ’ল, ‘নিশ্চয়ই ছালাত অন্যায় ও অশ্লীল কর্ম থেকে বিরত রাখে’ (আনকাবূত ৪৫)। সমাজে মুছল্লীর সংখ্যা বেশী হ’লেও অন্যায় কর্ম কিন্তু হ্রাস পাচ্ছে না; বরং মসজিদ ও মুছল্লীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পেলেও অন্যায়, অপকর্ম ও দুর্নীতি কমেনি; বরং আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর কারণ হিসাবে বলা যায়, প্রচলিত ছালাতের কোন প্রভাব সমাজে পড়ছে না। এই ছালাত দুনিয়াবী জীবনে যদি কোন প্রভাব না ফেলে তাহ’লে পরকালে কোন প্রভাব ফেলবে কি?
অতএব প্রচলিত ছালাতে একাগ্রতাও নেই বিশুদ্ধতাও নেই। সঠিক পদ্ধতিতে ছালাত আদায় না করলে একাগ্রতা সৃষ্টি হবে না। আর আল্লাহভীতি ও একনিষ্ঠতা স্থান না পেলে সে পাপাচার থেকে মুক্ত হবে না (বাক্বারাহ ২৩৮; মুমিনূন ২)। তাই আমাদেরকে এই করুণ পরিণতি থেকে উত্তরণের উপায় খোঁজে বের করতে হবে। আর তা হ’ল রাসূল (ছাঃ)-এর দেখানো সঠিক পদ্ধতিতে ছালাত আদায় করা। এজন্য সকল ব্যক্তিস্বার্থ ও মতামতকে ডিঙ্গিয়ে নিম্নের বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দিতে হবে।
১. ছালাতের যাবতীয় আহকাম ছহীহ দলীল ভিত্তিক হ’তে হবে। কারণ এটা ইবাদতে তাওক্বীফী যাতে দলীল বিহীন মনগড়া কোন কিছু করার সুযোগ নেই। প্রমাণহীন কোন বিষয় পাওয়া গেলে তা সঙ্গে সঙ্গে পরিত্যাগ করতে হবে। কত বড় ইমাম, বিদ্বান, পন্ডিত বা ফক্বীহ বলেছেন তা দেখার প্রয়োজন নেই। কারণ প্রমাণহীন কথার কোন মূল্য নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
فَاسْأَلُوْا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لاَ تَعْلَمُوْنَ- بِالْبَيِّنَاتِ وَالزُّبُرِ.
‘সুতরাং তোমরা যদি না জান তাহ’লে স্পষ্ট দলীলসহ আহ’লে যিকিরদের জিজ্ঞেস কর’ (নাহল ৪৩-৪৪)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরাম সর্বদা দলীলের ভিত্তিতেই মানুষকে আহবান জানাতেন।৬
ইসলামের ইতিহাসে প্রসিদ্ধ চার ইমামসহ মুহাদ্দিছ ওলামায়ে কেরামও দলীলের ভিত্তিতে মানুষকে আহবান জানিয়েছেন। ইমাম আবু হানীফা (৮০-১৫০হিঃ) বলেন,
لَايَحِلُّ لِأَحَدٍ أَنْ يَّأْخُذَ بِقَوْلِنَا مَا لَمْ يَعْلَمْ مِنْ أَيْنَ أَخَذْنَاهُ.
‘ঐ ব্যক্তির জন্য আমাদের কোন বক্তব্য গ্রহণ করা হালাল নয়, যে জানে না আমরা উহা কোথা থেকে গ্রহণ করেছি’।৭ ইমাম শাফেঈ (১৫০-২০৪হিঃ) বলেন,
إِذَا رَأَيْتَ كَلاَمِيْ يُخَالِفُ الْحَدِيْثَ فَاعْمَلُوْا بِالْحَدِيْثِ وَاضْرِبُوْا بِكَلاَمِيْ الْحَائِطَ.
‘যখন তুমি আমার কোন কথা হাদীছের বরখেলাফ দেখবে, তখন হাদীছের উপর আমল করবে এবং আমার কথাকে দেওয়ালে ছুড়ে মারবে’।৮ ইমাম মালেক (৯৩-১৭৯হিঃ), ইমাম আহমাদ (১৬৪-২৪১হিঃ) সহ অন্যান্য ইমামদের বক্তব্যও একই।৯
২. জাল ও যঈফ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত সকল প্রকার আমল নিঃসঙ্কোচে নিঃশর্তভাবে বর্জন করতে হবে। কারণ জাল ও যঈফ হাদীছ দ্বারা কোন শারঈ বিধান প্রমাণিত হয় না। জাল হাদীছের উপর আমল করা পরিষ্কার হারাম।১০ সে কারণ ছাহাবায়ে কেরাম যঈফ ও জাল হাদীছের বিরুদ্ধে সর্বদা সোচ্চার ছিলেন। আস্থাহীন, ত্রুটিপূর্ণ, অভিযুক্ত, পাপাচারী, ফাসিক শ্রেণীর লোকের বর্ণনা তারা গ্রহণ করতেন না।
প্রসিদ্ধ চার ইমামসহ অন্যান্য মুহাদ্দিছগণও এর বিরুদ্ধে ছিলেন। ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-এর চূড়ান্ত মূলনীতি ছিল যঈফ হাদীছ ছেড়ে কেবল ছহীহ হাদীছকে অাঁকড়ে ধরা। তাই দ্ব্যর্থহীনভাবে তিনি ঘোষণা করেন, إِذَا صَحَّ الْحَدِيْثُ فَهُوَ مَذْهَبِيْ ‘যখন হাদীছ ছহীহ হবে সেটাই আমার মাযহাব’।১১ ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ) বলেন,
إِنَّ الْعَالِمَ إِذَا لَمْ يَعْرِفِ الصَّحِيْحَ وَالسَّقِيْمَ وَالنَّاسِخَ والْمَنْسُوْخَ مِنَ الْحَدِيْثِ لاَيُسَمَّى عَالِمًا.
‘নিশ্চয়ই যে আলেম হাদীছের ছহীহ-যঈফ ও নাসিখ-মানসূখ বুঝেন না তাকে আলেম বলা যাবে না’। ইমাম ইসহাক্ব ইবনু রাওয়াহাও একই কথা বলেছেন।১২ ইমাম মালেক, শাফেঈ (রহঃ)-এর বক্তব্যও অনুরূপ।১৩
মুহাদ্দিছ যায়েদ বিন আসলাম বলেন,
مَنْ عَمِلَ بِخَبْرٍ صَحَّ أَنَّهُ كِذْبٌ فَهُوَ مِنْ خَدَمِ الشَّيْطَانِ.
‘হাদীছ মিথ্যা প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও যে তার উপর আমল করে সে শয়তানের খাদেম’।১৪
অতএব ইমাম হোন আর ফক্বীহ হোন বা অন্য যেই হোন শরী‘আত সম্পর্কে কোন বক্তব্য পেশ করলে তা অবশ্যই ছহীহ দলীলভিত্তিক হ’তে হবে। (এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা দ্রঃ ‘যঈফ ও জাল হাদীছ বর্জনের মূলনীতি’ শীর্ষক বই)।
৩. প্রচলিত কোন আমল শারঈ দৃষ্টিকোন থেকে ভুল প্রমাণিত হ’লে সাথে সাথে তা বর্জন করতে হবে এবং সঠিকটা গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র গোঁড়ামী করা যাবে না। পূর্বপুরুষরা এবং বড় বড় আলেমগণ করে গেছেন, এখনো সমাজে চালু আছে, বেশীর ভাগ আলেম বলছেন এ সমস্ত জাহেলী কথা বলা যাবে না।
ভুল হওয়া মানুষের স্বভাবজাত। মানুষ মাত্রই ভুল করবে, কেউই ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। তবে ভুল করার পর যে সংশোধন করে নেয় সেই সর্বোত্তম। আর যে সংশোধন করে না সে শয়তানের বন্ধু। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,
كُلُّ ابْنِ آدَمَ خَطَّاءٌ وَخَيْرُ الْخَطَّائِيْنَ التَّوَّابُوْنَ
‘প্রত্যেক আদম সন্তান ভুলকারী আর উত্তম ভুলকারী সে-ই যে তওবাকারী’।১৫ সর্বশ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)ও ভুল করেছেন এবং সংশোধন করে নিয়েছেন।১৬ সাহো সিজদার বিধানও এখান থেকেই চালু হয়েছে। অনুরূপ চার খলীফাসহ অন্যান্য ছাহাবীদেরও ভুল হয়েছে।১৭ তাছাড়া অনেক সময় আল্লাহ তা‘আলা এবং রাসূল (ছাঃ) কোন বিধানকে রহিত করেছেন এবং তার স্থলে অন্যটি চালু করেছেন (বাক্বারাহ ১০৬)। তখন সেটাই সকল ছাহাবী গ্রহণ করেছেন। অতএব বড় বড় আলেমের ভুল হয় না এই ধারণা চরম ভ্রান্তিপূর্ণ। তাই সংশোধনের ক্ষেত্রে কখনো গোঁড়ামী করা যাবে না। কারণ ভুল সংশোধন না করে বাপ-দাদা বা বড় আলেমদের দোহাই দেওয়া অমুসলিমদের স্বভাব (বাক্বারাহ ১৭০; লোকমান ২১)।
৪. খুঁটিনাটি বলে কোন সুন্নাতকে অবজ্ঞা করা যাবে না: ইসলামের কোন বিধানই খুঁটিনাটি নয়। অনুরূপ কোন সুন্নাতই ছোট নয়। এ ধরনের ভ্রান্ত আক্বীদা থেকে বেরিয়ে এসে রাসূল (ছাঃ)-এর যেকোন সুন্নাতকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হ’তে হবে। কেননা রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাতকে অবজ্ঞা করা ও খুঁটিনাটি বলে তাচ্ছিল্য করা অমার্জনীয় অপরাধ। সেই সুন্নাত যতই সাধারণ বা হালকা হোক না কেন। রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবীগণ এই অবহেলাকে মুহূর্তের জন্যও বরদাশত করেননি। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একদা বারা ইবনু আযেব (রাঃ)-কে ঘুমানোর দো‘আ শিক্ষা দিচ্ছিলেন। তার এক অংশে তিনি বলেন, ‘(হে আল্লাহ!) আপনার নবীর প্রতি ঈমান আনলাম যাকে আপনি প্রেরণ করেছেন’। আর বারা (রাঃ) বলেন, ‘এবং আপনার রাসূলের প্রতি ঈমান আনলাম যাকে আপনি প্রেরণ করেছেন’। উক্ত কথা শুনে রাসূল (ছাঃ) তার হাত দ্বারা বারার বুকে আঘাত করে বলেন, বরং ‘আপনার নবীর প্রতি ঈমান আনলাম যাকে আপনি প্রেরণ করেছেন’।১৮ এখানে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ‘নবীর’ স্থানে ‘রাসূল’ শব্দটিকে বরদাশত করলেন না।
জনৈক ছাহাবী ছালাতের মধ্যে সামান্যতম ত্রুটি করলে তিনি তাকে ডেকে বলেন, হে অমুক! তুমি কি আল্লাহকে ভয় কর না। তুমি কি দেখ না কিভাবে ছালাত আদায় করছ?১৯
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একদিন ছালাতের জন্য তাকবীরে তাহরীমা বলতে শুরু করেছেন। এমতাবস্থায় দেখতে পেলেন যে, এক ব্যক্তির বুক কাতার থেকে সম্মুখে একটু বেড়ে গেছে তখন তিনি বললেন, হে আল্লাহর বান্দারা! হয় তোমরা কাতার সোজা করবে না হয় আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের চেহারা সমূহকে ভিন্নরূপ করে দিবেন’।২০
নবী (ছাঃ) একদা এক ব্যক্তিকে ডান হাতের উপর বাম হাত রেখে ছালাত আদায় করতে দেখে তিনি ডান হাতটাকে বাম হাতের উপর করে দেন।২১
অতএব ছালাতের যেকোন আহকামকে খুঁটিনাটি বলে অবজ্ঞা করা যাবে না। বরং সেগুলো পালনে বাহ্যিকভাবে যেমন নানাবিধ উপকার রয়েছে তেমনি অঢেল নেকীও রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের পিছনে রয়েছে ধৈর্যের যুগ। সে সময় যে ব্যক্তি সুন্নাতকে শক্ত করে অাঁকড়ে ধরে থাকবে সে তোমাদের সময়ের ৫০ জন শহীদের নেকী পাবে’।২২ বর্তমানে যুগের প্রত্যেক সুন্নাতের পাবন্দ ব্যক্তির জন্যই এই সুসংবাদ।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি (কাতারের মধ্যে দু’জনের) ফাঁক বন্ধ করবে আল্লাহ তা‘আলা এর দ্বারা তার মর্যাদা বৃদ্ধি করে দিবেন এবং তার জন্য জান্নাতে একটি ঘর তৈরি করবেন’।২৩ যে ব্যক্তি ছালাতে স্বশব্দে আমীন বলবে এবং তা ফেরেশতাদের আমীনের সাথে মিলে যাবে তা পূর্বের পাপ সমূহ ক্ষমা করা হবে।২৪
সবচেযে বড় বিষয় হ’ল, এই সুন্নাতগুলো সমাজে চালু করতে শত শত হকবপন্থী আলেমের রক্ত প্রবাহিত হয়েছে। ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলতে হয়েছে, অন্ধ কারাগারে জীবন দিতে হয়েছে, দীপান্তরে কালাপানির ভাগ্য বরণ করতে হয়েছে। যেমন বুকের উপর হাত বাঁধা, জোরে আমীন বলা, রাফঊল ইয়াদায়েন করা ইত্যাদি। আর সেই সুন্নাত সমূহকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা কত বড় অন্যায় তা ভাষায় প্রকাশ করার প্রয়োজন নেই।
৫. সঠিক পদ্ধতিতে ছালাত আদায় করতে গিয়ে দেখার প্রয়োজন নেই যে কতজন লোক তা করছে, কোন মাযহাবে চালু আছে, কোন ইমাম কী বলেছেন বা আমল করেছেন কিংবা কোন দেশের লোক করছে আর কোন দেশের লোক করছে না :
আল্লাহ প্রেরিত সংবিধান চিরন্তন। যা নিজস্ব গতিতে চলমান। এই মহা সত্যকেই সর্বদা অাঁকড়ে ধরে থাকতে হবে একাকী হ’লেও। ইবরাহীম (আঃ) নানা যুলুম-অত্যাচার সহ্য করে একাই সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। তাই তিনি বিশ্ব ইতিহাসে মহা সম্মানিত হয়েছেন (নাহল ১২০; বাক্বারাহ ১২৪)। সমগ্র জগতের বিদ্রোহী মানুষরা তার সম্মান ছিনিয়ে নিতে পারেনি। সংখ্যা কোন কাজে আসেনি। মূলকথা হ’ল- অহীর বিধান সংখ্যা, দেশ, অঞ্চল, বয়স, সময়, মেধা কোন কিছুকে তোয়াক্কা করে না। অনেকে বলতে চায় চার ইমামের পরে মুহাদ্দিছগণের জন্ম। সুতরাং ইমামদের কথাই গ্রহণযোগ্য। অথচ ছাহাবীরা সুন্নাতকে অগ্রাধিকার দিতে বয়স্ক ব্যক্তি উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও মাত্র ৬/৭ বছরের বাচ্চাকে দিয়ে ছালাত পড়িয়ে নিয়েছেন।২৫ ওমর (রাঃ) কনিষ্ঠ ছাহাবী আবু সাঈদ খুদরীর নিকট থেকে বাড়ীতে তিনবার সালাম দেওয়া সংক্রান্ত হাদীছের পক্ষে সাক্ষী গ্রহণ করেন। কারণ তিনি এই হাদীছ জানতেন না।২৬ অতএব মহা সত্যের উপর কোন কিছুর প্রাধান্য নেই। ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, ‘হক-এর অনুসারী দলই হল জামা‘আত যদি তুমি একাকী হও’।২৭ অতএব হকপন্থী ব্যক্তি একাকী হ’লেও সেটাই জান্নাতী দল।
৬. কোন দল বা মাযহাবী স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্য কৌশল করে কিংবা অপব্যাখ্যা করে ইলাহী বিধানকে এড়িয়ে যাওয়া যাবে না :
উক্ত জঘন্য নীতির জয়জয়কার চলছে সহস্র বছর ধরে। একশ্রেণীর মানুষ অণু পরিমাণ জ্ঞান নিয়ে আল্লাহর জ্ঞানের উপর প্রভাব খাটিয়ে ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থ করছে। এই অপকৌশলের যে কী শাস্তি তা তারা ভুলে গেছে। মূল শরী‘আতকে উপেক্ষা করে দলীয় সিদ্ধান্ত ও মাযহাবী নীতি প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্য থাকলে বানী ইসরাঈলদের মত তাদের উপর আল্লাহর গযব নেমে আসা স্বাভাবিক। দাঊদ (আঃ)-এর সময় তারা মহা সত্যকে না মেনে মিথ্যা কৌশলের আশ্রয় নেওয়ার কারণেই তারা বানর ও শূকরে পরিণত হয়েছিল এবং একই দিনে সব ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল (বাক্বারাহ ৬৫; মায়েদা ৬০)। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের অপব্যাখ্যা করে মানুষকে যারা বিভ্রান্ত করবে তাদের পরিণাম এমনই হওয়া উচিত। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘কুরআন তোমার পক্ষে দলীল হ’তে পারে আবার বিপক্ষেও দলীল হ’তে পারে’।২৮ সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকের জানা উচিত যে, শারঈ সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আমি যাই করি এবং যে উদ্দেশ্যেই করি অন্তরের খবর আল্লাহ সবই জানেন (মুলক ১৩; আলে ইমরান ১১৯)।
নিম্নে আমরা ওযূ থেকে শুরু করে ফরয ছালাতসহ অন্যান্য ছালাতে যে সমস্ত জাল-যঈফ হাদীছ ও ত্রুটি-বিচ্যুতি রয়েছে সেগুলো উল্লেখ করব এবং এর সাথে সঠিক বিষয় সম্পর্কেও আলোকপাত করব ইনশাআল্লাহ।
জাল হাদীছের কবলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছালাত-(১-৯)
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জুন, ২০১২ বিকাল ৪:১২