১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল ভয়াল এই রাতে মুখোমুখি হয়েছিলাম ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের । আমার জীবনে প্রত্যক্ষ চোখে দেখা এক ভয়াবহ রাত । বাতাশের প্রচন্ড বেগ পাশাপাশি অঝোর ধারায় বৃষ্টি, কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই ঘর ভর্তি পানি আর পানি । হাহাকার আর উৎকণ্ঠার মাঝে কিভাবে যে সেই রাতটা পার করে ছিলাম । সকাল বেলার দৃশ্য আরও ভয়াবহ চারিদিকে ভাসমান লাশের পর লাশ, মরা মাছ , গাছপালা গবাদি পশুর ধ্বংসলীলা । খাওয়া দাওয়ার নিদারুন কষ্ট । সহায় সম্পত্তি হারা মানুষের চিৎকার আজো ভেসে উঠে দুই চোখে ।
প্রত্যন্ত গ্রামে থাকার কারনে এর ভয়াবহতা খুব কাছ থেকে উপ্লব্দি করতে পেরেছিলাম । এর ভয়াবহতার বিবরণ লেখার মত শক্তি আমার মধ্যে হবে কিনা তা নিয়ে শঙ্কিত । আমি উলঙ্গ লাশ দেখেছি , ঝোপঝাঁড়ে ভেসে থাকা লাশ । এদের মধ্যে রয়েছে বাচ্চা শিশু, মহিলা , গবাদি পশু । চাচার অক্লান্ত পরিশ্রম , বাড়ির পাশের লাশ গুলো কলা গাছের বেলা বানিয়ে টেনে নিয়ে দাপন করা । আমার দেখা প্রকৃতির এই নিষ্ঠুরতার সবচেয়ে নির্মম শিকার আমাদের দ্বীপের মানুষ ।
এই সব লিখে বুঝানো সম্ভব না । স্মৃতিতে ধারন করে দু ফোটা অশ্রু ঝরে পড়া ছাড়া আর কিছুই বলার নেই । দূর দুরান্ত থেকে আসা আত্মীয় স্বজনের হাহাকার, হারানোর ব্যাথা আজও ভুলতে পারি না । জলোচ্ছ্বাসের পরবর্তী সময়ে খাদ্য এবং পানির সঙ্কট ছিল মহামারি আকারের । রান্না করার জন্য দূর স্কুলের গভীর নলকূপের পানি ব্যাবহার করা হত যা ছিল রিতিমত জগন্য । এ সময়ে অনেক লোক মারা গিয়েছিল খাদ্য পানির সঙ্কট এবং রোগে পড়ে ।
এই সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে বিশেষ ভাবে সাহায্য করেছিল দেশী বিদেশী ত্রান তহবিল । বিভিন্ন এলাকার স্কুল কলেজে অবস্থান করে এ কার্যক্রম পরিচালনা করা হত ক্ষতিগস্রদের মাঝে ।
মৃত্যুর আগ অব্দি ভুলতে পারব না এই সময়কে । ভুলা সম্ভব হবে না । পরম করুনাময়ের কাছে একটাই চাওয়া আগামী দিনে এই অভিশাপ থেকে মুক্তি ।
প্রায় ২২৫ কিলোমিটার বেগে অতিবাহিত ঘূর্ণিঝড়টি উপকূলীয় ( কক্সবাজার, মহেশখালী, চকরিয়া, বাশখালী, আনোয়ারা, সন্দ্বীপ, হাতিয়া, সীতাকুণ্ড, পতেঙ্গা ) অঞ্চলে আঘাত হানে । এ ঝড়ের আঘাতে ১ লাখ ৬০ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলো । গৃহহারা হয়েছিল অসংখ্য মানুষ । প্রবল এ জলোচ্ছ্বাসের পানির উচ্চতা ছিল ২০-২৫ ফুট । এতে প্রায় দু’লাখ গবাদিপশু ও প্রাণ হারায় । গাছপালা উপড়ে গিয়ে ও বেড়িবাঁধ ভেঙে কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছিল । ঝড়ের পড়ে অনাহারে ও মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া রোগে আরো প্রায় ২০-৩০ হাজার লোক প্রাণ হারায় । (তথ্যসূত্র ইন্টারনেট)
মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে ২২শে এপ্রিল, ১৯৯১ বঙ্গোপসাগরে একটি গভীর নিম্মচাপের সৃষ্টি হয়। বাতাসে গতিবেগের ও নিম্মচাপের আকার বৃদ্ধির সাথে সাথে এটি ২৪শে এপ্রিল 02B ঘুর্নিঝড়ে রূপ নেয় । ঘুর্নিঝড়টি উত্তর-পূর্বদিকে অগ্রসর হওয়ার সাথে সাথে এর শক্তি আরও বাড়তে থাকে। ২৮ ও ২৯ এপ্রিল এটির তীব্রতা প্রচন্ড বৃদ্ধি পায় এবং গতিবেগ ১৬০ মাইল/ঘন্টায় পৌছায় যা একটি ক্যাটাগরী-৫ ঘূর্নিঝড়ের সমতুল্য। ২৯শে এপ্রিল রাতে এটি চট্টগ্রামের উপকূলবর্তি অঞ্চলে ১৫৫ মাইল/ঘন্টা বেগে আঘাত করে যা ক্যাটাগরী-৪ ঘূর্নিঝড়ের সমতুল্য। স্থলভাগে আক্রমনের পর এর গতিবেগ ধীরে ধীরে হ্রাস পায় এবং ৩০শে এপ্রিল এটি বিলুপ্ত হয় । (উইকি থেকে পাওয়া)
আজকের প্রজন্মের অনেকের হয়ত জন্ম হয়নি সেই সময়ে । কারো হয়ত ভয়াবহ রাতের কথা মনে নেই । প্রজন্মের কাছে হয়ত গল্পের মত শুনাবে । যারা চোখে দেখেননি তাদেরকে বলে বুঝানো যাবে না প্রকৃতির এই নির্মমতার কথা । এখনো অনেক পরিবার রয়েছেন যারা স্বজন হারিয়েছেন সেই সময়ে । হয়ত স্বজন হারানো ব্যাথা নিয়ে বেঁচে আছেন ।
( ছবি কালেক্টেড ফ্রম ইন্টারনেট )
ফেবু