ঈদ সামনে রেখে প্রবাসীরা ব্যাপক আকারে দেশে টাকা পাঠিয়েছেন। প্রতি বছরই প্রবাসীরা দুই ঈদে দেশে থাকা আত্মীয়স্বজনের কাছে হাজার হাজার কোটি টাকা পাঠান। এছাড়া সারা বছর তো পাঠাতেই থাকেন। বছর শেষে দেখা যায় এর পরিমাণ প্রায় দেশের জাতীয় বাজেট ছুঁয়ে যায়। সরকারি ব্যয়, বিনিয়োগ এবং সাহায্য সহযোগিতা ছাড়া দেশের প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের খাত হলো প্রবাসী আয়। এ খাতে সরকারের কোনো ব্যয় নেই, বিনিয়োগ নেই এবং সত্যিকারের সহযোগিতা নেই। ঠ্যাঁঙের ওপর পা তুলে সরকারের টাকা গোনা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই। অথচ সঠিক পরিকল্পনা এবং সদিচ্ছার অভাবে বিপুল অঙ্কের প্রবাসী আয় ব্যয় হচ্ছে না কোনো উন্নয়ন খাতে। দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে এই টাকার কোনো ব্যবহার নেই। সঠিক এবং বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা নেই। প্রবাসীদের আত্মীয়রা নিত্য দরকারে এবং জমি, ফ্ল্যাট কিনে টাকা ব্যয় করেন। আর দেশের বড় বড় দুর্নীতিবাজ, ধড়িবাজ রাজনীতিকরা এ টাকা হুন্ডি করে বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়েন। বিদেশি ব্যাংকে গচ্ছিত রাখেন। লাখ লাখ ইউরো ডলার দিয়ে ইউরোপ আমেরিকার পাসপোর্ট খরিদ করেন।
প্রবাসীদের প্রেরিত বিপুল অঙ্কের বিদেশি মুদ্রা সঠিক উপায়ে এবং পরিকল্পনা মাফিক কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে খুব বেশি সময় লাগার কথা নয়। বড়জোর ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে দেশের অবকাঠামো দাঁড় করিয়ে ফেলা সম্ভব। নতুন এবং আধুনিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, গ্যাসকেন্দ্র স্থাপন, সড়ক ও সেতু নির্মাণ, প্রযুক্তিনির্ভর রেললাইন স্থাপন, আধুনিক এয়ারপোর্ট নির্মাণ, বন্ধ হয়ে যাওয়া কলকারখানা পুনঃস্থাপন এবং আধুনিকীকরণ করা সম্ভব। সরকার দেশি পুঁজি এবং প্রবাসীদের টাকা কাজে লাগিয়ে আমাদের দেশেই বিশ্বখ্যাত টাটা, বিড়লার মতো বড় বড় গ্রুপ তৈরিতে সহযোগিতা করতে পারে। আমাদের জনশক্তিকে প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তুলতে পারে। দেশের যুবকদের সৃষ্টিশীল এবং কর্মমুখী করে তুলতে পারে। বিদেশের শ্রম বাজারে আমাদের দেশের দক্ষ শ্রমিক পাঠাতে পারলে দেশের বৈদেশিক আয় আরও অনেকাংশে বৃদ্ধি করা সম্ভব হতো। প্রবাসীদের প্রেরিত অর্থ এবং অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে দেশে হাইটেক ইন্ডাস্ট্রি নির্মাণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে চীন, মালয়েশিয়া বানানো যায় খুব সহজে।
প্রবাসী আয়ের ব্যবহার-সম্পর্কিত সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় প্রকাশ করা হয়েছে, প্রবাসীদের আয়ের অধিকাংশ ব্যয় হচ্ছে অনুৎপাদনশীল খাতে। এ আয়ের মোট ৭২.০৫ শতাংশ ব্যয় হয় জমি ক্রয় করে। ১৫.৮৯ ভাগ ব্যয় হয় ফ্ল্যাট কিনে। বাড়িঘর নির্মাণের ক্ষেত্রে বিভাগভিত্তিক সর্বোচ্চ ব্যয় হয় বরিশালে ৮১.৮৪ শতাংশ। এরপর খুলনায় ৮০.৪৭ শতাংশ, রংপুরে ৭৯.৯৬ শতাংশ, রাজশাহীতে ৭৮.৯২ শতাংশ, সিলেটে ৭৫.৯০ শতাংশ, চট্টগ্রামে ৭০.২০ শতাংশ। ঘরবাড়ি নির্মাণে ঢাকায় প্রবাসী আয়ের ব্যয় হয় সবচেয়ে কম ৬৮.৩০ শতাংশ। অন্যদিকে ফ্ল্যাট ক্রয়ের ক্ষেত্রে ঢাকার অবস্থান সবার ওপরে, ১৯.৭৭ শতাংশ। এরপর চট্টগ্রাম ১৭.০০%, সিলেট ১২.৬৬%, খুলনা ৯.৫৬%, বরিশাল ৮.৬৩%, রংপুর ৮.০১%। রাজশাহীর অবস্থান সর্বনিম্নে, ৭.৮৯ শতাংশ।
সমীক্ষায় আরও প্রকাশ করা হয়, প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে ৯৭.৪ শতাংশ পুরুষ এবং মাত্র ২.৬ শতাংশ মহিলা। প্রায় ৬৩% প্রবাসীর বয়স ৩৫-এর নিচে। বিদেশ থেকে দেশে টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রে প্রবাসীদের কাছে অধিক জনপ্রিয় মাধ্যম হলো ব্যাংক। প্রবাসীদের মোট আয়ের ৬৭.৩২ শতাংশ টাকা দেশে যায় ব্যাংকের মাধ্যমে। ১০.০৪ শতাংশ অবৈধ হুন্ডিতে এবং ৬.৮৭ শতাংশ ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন বা মানিগ্রামের মাধ্যমে দেশে যায়।
সরকার আন্তরিক হলে এবং সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করলে বিপুল অঙ্কের প্রবাসী আয় উৎপাদনশীল খাতে ব্যয় করে দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
প্রশ্ন উঠতে পারে, প্রবাসীরা কেন জমি বা ফ্ল্যাট কেনেন? অন্য কোনো উপায় থাকে না বলেই প্রবাসীরা জমি, ফ্ল্যাট কেনেন। দেশে বিনিয়োগের কোনো নিশ্চয়তা নেই। কোনো প্রবাসী যদি দেশে গিয়ে উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করতে চায়, তবে পরিকল্পিতভাবে তাকে সর্বস্বান্ত করে দেয়া হয়। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা থেকে শুরু করে প্রতিটি পদে পদে তাকে হয়রানি এবং প্রতারণার মুখে পড়তে হয়। আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকেও নানা ধরনের চাপ মোকাবিলা করতে হয়। লোকাল মাস্তান চাঁদাবাজতো আছেই। কোনো প্রবাসী দেশে গেলে ছলে-বলে, ধার-কর্জের নামে আত্মীয়, বন্ধু, পরিচিতরা তার কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। ভাব দেখে মনে হয়, ওই টাকা ছাড়া তাদের জীবন বিপন্ন। তখন প্রবাসীরা বাধ্য হয়ে জমি বা ফ্ল্যাট কিনে টাকাটা আটকে ফেলতে চেষ্টা করেন। এক্ষেত্রে তাদের সামনে আর কোনো সহজ রাস্তা খোলা থাকে না। এখানেও তারা প্রতারিত হন। যখনই কেউ জানতে পারে ক্রেতা প্রবাসী, ওমনি জমির দাম বাড়িয়ে দেয়। জমির দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। প্রতারিত হন প্রবাসীরা।
এমনকি বিয়ে এবং চিকিৎসার ক্ষেত্রেও প্রতারণার শিকার হতে হয়। যদি কোনো চিকিৎসক জানতে পারেন রোগী প্রবাসী, অমনি চিকিৎসা ব্যয় বেড়ে যায়। এই টেস্ট, ওই টেস্ট করে, ১৪ রকমের ভিটামিন লিখে খামোখা বিরাট খরচের মধ্যে ফেলে দেয়া হয় প্রবাসীকে। আর যদি কোনোভাবে ক্লিনিক, হাসপাতালে ভর্তি করতে পারেন, তো কথাই নেই, কোরবানির গরুর মতো চামড়া ছিলে নেয়া হয় প্রবাসীর।
প্রবাসী আয় দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে ব্যয় হয় না, এত টাকা যায় কোথায়? বিদেশে চলে যায়। কারা বিদেশে নেয়? ধড়িবাজ, দুর্নীতিবাজ রাজনীতিক ব্যবসায়ীরা নেয়। আমাদের দেশের এমপি, মন্ত্রী থেকে শুরু করে প্রায় সব বড় নেতার বিদেশি পাসপোর্ট আছে। এসব পাসপোর্ট তারা কোথায় পেয়েছেন? ইউরোপ, আমেরিকার মাইগ্রেশন আইনের সুযোগ নিয়ে কোটি কোটি টাকার বিনিময়ে তারা গোপনে ওইসব দেশের নাগরিকত্ব কিনে রাখেন। শুধু রাজনীতিক, ব্যবসায়ীরা নন, সামরিক বেসামরিক আমলা ও বড় কর্তারা এই তালিকার বাইরে নন। গোপনে বিদেশি নাগরিকত্ব কিনতে যে বিপুল অঙ্কের ইউরো ডলার দরকার হয়, তা তারা কোথায় পান? টাকা দিয়ে তো নাগরিকত্ব কেনা যায় না। ইউরো ডলার দিতে হয়। প্রায় দেড় কোটি প্রবাসীর রক্ত নিংড়ানো ইউরো-ডলার দিয়ে তারা বিদেশি পাসপোর্ট কেনেন। বিদেশে বাড়িঘর নির্মাণ করেন। ছেলে-মেয়েদের বিদেশে থাকার, পড়াশুনা করার, বিয়ে-শাদি এবং ব্যবসা করার বন্দোবস্ত করেন।
সুইস ব্যাংকে টাকার পাহাড় গড়েন। প্রবাসীদের যদি একটা কার্যকর, স্বচ্ছ, মানসম্পন্ন ব্যাংক থাকত, সেই ব্যাংকে গোটা পৃথিবী থেকে প্রবাসীরা টাকা পাঠাতে পারতেন। ওই ব্যাংকের টাকায় দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন হতে পারত। পদ্মা সেতু করতে বিদেশি সাহায্যের জন্যে হাত পেতে বসে থাকতে হতো না। প্রবাসীদের টাকায় হাসতে হাসতে সেতু করা যেত। ওই ব্যাংকের মাধ্যমে প্রবাসীরা দেশে বিনিয়োগ করতে পারতেন। বিনিয়োগের গ্যারান্টি হিসেবে ব্যাংক থাকলে প্রবাসীরা নিশ্চিন্তে বেশি বেশি বিনিয়োগ করতেন। প্রবাসীদের জন্য বিনিয়োগসহ বিভিন্ন বন্ডের ব্যবস্থা করা যেত। প্রবাসে যেতে ইচ্ছুকদের মধ্যে সহজ শর্তে ঋণ দেয়া যেত। প্রবাসী হতে ইচ্ছুকদের জন্য দেশের প্রতিটি বিভাগে অন্তত একটি করে প্রশিক্ষণ স্কুল করা যেত। প্রবাসে ব্যবসা করতে ইচ্ছুকদের ঋণ দেয়া যেত। প্রবাসীদের গচ্ছিত টাকার ভিত্তিতে পেনশন তহবিল গঠন করা যেত। প্রবাসী এবং তাদের পরিবারের জন্যে বীমা চালু করা যেত। বিভিন্ন মেয়াদের লাভজনক ডিপোজিট সার্ভিস চালু করা যেত। সর্বোপরি এই ব্যাংকের তহবিল প্রবাসীদের টাকায় গঠন করা সম্ভব হতো।
এই ব্যাংক নির্মাণের জন্য নতুন করে কিছু করার দরকার নেই, দেশের পোস্ট অফিসগুলো প্রায় কাজশূন্য পড়ে আছে। হাজার হাজার মানুষ বেকারত্বের ঝুঁকিতে আছে। পোস্ট অফিসেই ব্যাংকিং শাখা খুলে দেয়া যায়। যারা রেমিটেন্স নিয়ে কাজ করবে। এতে করে পোস্ট অফিস বাঁচবে। হাজার হাজার মানুষ বেকারত্বের ঝুঁকি থেকে রেহাই পাবে। নতুন কাজের ক্ষেত্র তৈরি হবে। গ্রাম-গঞ্জে থাকা প্রবাসীদের আত্মীয়দের কাছে অতি সহজে রেমিটেন্স পৌঁছে দেয়া যাবে। সবাইকে সেবার আওতায় আনা যাবে। কিন্তু হায়, কে করবে এসব শুদ্ধ চিন্তা? এ দায়িত্ব কার?
আমাদের সরকার যদি সঠিক প্রক্রিয়ায় প্রবাসীদের আহ্বান করে দেশে বিনিয়োগের জন্য, নিশ্চিত করে বলা যায় অন্তত ৫০ হাজার প্রবাসী আগামী ছয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যে দেশে ছোট-বড় অন্তত ২০ হাজার ইন্ডাস্ট্রি নির্মাণ করার মতো বিনিয়োগ করবেন। আরও অন্তত ৫০ হাজার প্রবাসী যাবেন যৌথ উদ্যোগে। একবার ভাবুন তো, আমাদের দেশটাকে একটা উন্নত দেশের কাতারে নিয়ে যেতে ক বছর সময় লাগতে পারে? শুধু তা-ই নয়, বিদেশের অনেক ভালো ভালো জায়গায় দক্ষতা এবং যোগ্যতার সঙ্গে কাজ করছেন আমাদের প্রবাসীরা। যাদের বিনিয়োগ করার মতো সামর্থ্য হয়তো নেই, ব্যাপক মেধা এবং অভিজ্ঞতা আছে। সরকার যদি তাদের তালিকা করে সঠিক প্রক্রিয়ায় দেশে আহ্বান করে তারা কি আসবে না? দেশের উন্নয়নে কাজ করবে না? অবশ্যই করবে।
মালয়েশিয়া কীভাবে উন্নত হয়েছে? আধুনিক মালয়েশিয়ার নির্মাতা তুন মাহাতির বিন মোহাম্মদ তার দেশের অভিজ্ঞ প্রবাসীদের কাজে লাগিয়ে উন্নয়নের বিপ্লব ঘটিয়েছেন। আমাদের দেশে লোকসানের মুখে থাকা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করা, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন করা, যানজট নিরসন, কৃষি উন্নয়ন, জলবায়ুর পরিবর্তন মোকাবেলা, প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ, পরিকল্পিত নগরায়ণ, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা, পর্যটন, শ্রম ও শ্রমিকসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের উন্নয়নের জন্য বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞ ভাড়া করার দরকার হয় না। যোগ্য, অভিজ্ঞ এবং মেধাবী প্রবাসীদের তালিকা করে ধীরে ধীরে তাদের কাজে লাগাতে পারলে দেশের উন্নয়ন হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র।
http://www.shaptahik.com/v2/?DetailsId=9471