somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একজন দেওয়ানবাগি এবং পীর ব্যবসা

১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ ভোর ৬:৩৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আমার এক ফেসবুক বন্ধু কদিন আগে ইউটিউব থেকে একটি ভিডিও লিংক পাঠিয়েছেন। ছয় মিনিট ২ সেকেন্ডের ওই ভিডিওতে দেখা যায় গোলগাল হাস্যোজ্জ্বল চেহারার একজন যুবক, মাথায় কিস্তিটুপি, গায়ে সাদা পাঞ্জবি, মুখে খোঁচাখোঁচা দাড়ি। ৩৫-৩৬ বছরের ওই যুবক তার নাম বললেন, কুদরতে খোদা। নামের আগে যুক্ত করতে ভুলেননি তিনি সুফি সম্রাট শাহ দেওয়ানবাগী পীরের একজন গোলাম। দেওয়ানবাগী পীরের কথিত আশেকে রাসুল সম্মেলনের জন্যে ভক্তদের কাছ থেকে চাঁদা তোলার চেষ্টা করছেন কুদরতে খোদা। চাঁদা তোলার আগে যথারীতি পীরের গুণকীর্তন এবং চাঁদাদানে ভক্তদের উৎসাহিত করতে কুদরতে খোদা বলেন, বিশ্ব আশেকে রাসুল সম্মেলনে আশেকে রাসুলদের কিছু দায়িত্ব আছে। কিছু নিয়ম কানুন আছে। আমরা যারা সারা বছর মানত করি, মানতের কমিটমেন্ট করি, যদি বিপদ থেকে উদ্ধার পাই তাহলে এই মানত দরবার শরিফে মোরশেদের কাছে আদায় করবো। এই মানত দেয়ার শেষ সময় হচ্ছে বিশ্ব আশেকে রাসুল সম্মেলন। এ জন্যে যাদের যাদের মানত বকেয়া আছে, যাদের যাদের মানত এখনও দেয়া হয়নি, যারা উপকার পেয়েছেন কিন্তু মানত বকেয়া আছে তারা সবাই বিশ্ব আশেকে রাসুল সম্মেলনের আগেই মানত আদায় করবেন। যদি সম্মেলনের আগে আসতে না পারেন অবশ্যই সম্মেলনের দিন মানত আদায় করে যাবেন। এরপর তিনি বেশ নাটকীয় ভঙ্গিতে বলতে শুরু করেন, ‘মোরশেদ কী? মোরশেদ হচ্ছেন এমন একজন মহামানব যিনি মুরিদকে মনজিলে মকসুদে পৌঁছাইতে সক্ষম। মোরশেদ হচ্ছেন এমন একজন মহামানব যিনি মুরিদকে ‘আল্লাহ’ পাওয়াইতে সক্ষম। মোরশেদ হচ্ছেন এমন একজন মহামানব যিনি মুরিদকে ‘রাসুল’ পাওয়াইতে সক্ষম।’ গোলাম কুদরতে খোদা দেওয়ানবাগীর উচ্চমর্যাদা উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন, এমন মোরশেদের কদমে আসার সুযোগ হয়েছে, যাকে আল্লাহ এতো উচ্চ মর্যাদা দিয়েছেন, দুনিয়াতে আর কোনো অলিআল্লাহ, নবি রাসুলকে এতো উচ্চর‌্যাংক দেন নাই। আল্লাহ তাকে আকাশের পূর্ণিমার চাঁদের মতো উচ্চর‌্যাংক দিয়েছেন। আমরা শুধু মোরশেদ পাই নাই, সর্বোৎকৃষ্ট মোরশেদ পেয়েছি। তিনি বলেন, আপনার আমার মোরশেদ কে? দেওয়ানবাগী। বিশ্বাস করেন এই কথা? মনে প্রাণে মানেন এই কথা? তাহলে মনে প্রাণে আজকে থেকে এইটা মানেন, কেয়ামত পর্যন্ত আপনার আমার মোরশেদ থাকবেন দেওয়ানবাগী। কেয়ামত পর্যন্ত এই মোহাম্মদি ইসলামের মোরশেদ থাকবেন কে বলেন? কে থাকবেন? দেওয়ানবাগী। কেয়ামত পর্যন্ত এই মোহাম্মদি ইসলামের মোরশেদ হবেন দেওয়ানবাগী। আমি স্পষ্টরূপে দেওয়ানবাগীর গোলাম কুদরতে খোদা বলছি- চিরকাল, কেয়ামত পর্যন্ত আপনার আমার মোরশেদ হবেন দেওয়ানবাগী। কে হবেন? দেওয়ানবাগী। যদি আপনারা এইটা মানতে পারেন, এই কথা অন্তরে বসাইতে পারেন কেয়ামত পর্যন্ত, মনে রাইখেন ওই মোরশেদ আপনার কবরে যাবে, আর গিয়ে বলবে এ আমার গোলাম ছিল, একে হাজির করো। সম্মানিত আশেকে রাসুলেরা, মুক্তি দেয়ার ক্ষমতা আমার নাই, আমি শুধু মোরশেদের কাছে আপনার জন্যে সুপারিশ করতে পারি। এই কথা বলে কুদরতে খোদা আবার বলেন, মুক্তিদাতা কে বলেন? দেওয়ানবাগী। ঠিক না, ঠিক না? মুক্তি দেয়ার ক্ষমতা কার? মুক্তির সুপারিশকারী কে? আল্লাহর কাছে সুপারিশকারী কে? (ভক্তরা ক্রসগলায় বলেন, দেওয়ানবাগী) মনে থাকবে? যদি এই কথা চিরকাল অন্তরে রাখতে পারেন কোনো দিন বেঈমান হবেন না। যদি বেঈমানের হাত থেকে বাঁচতে চান আমি গোলাম কুদরতে খোদার এই কথা মনে রাইখেন। যতদিন বাঁচবো দেওয়ানবাগীকে মোরশেদ রুপে মানবো। যতদিন বাঁচবো দেওয়ানবাগীর কদমের নিচে থাকবো। মৃত্যুর আগপর্যন্ত, নিজের জীবনের শেষ রক্ত বিন্দু থাকা পর্যন্ত দেওয়ানবাগী আমাদের মোরশেদ থাকবেন। দেওয়ানবাগীর কদমের নিচে আমরা থাকবো। দেওয়ানবাগীর কদমে আশ্রয় ভিক্ষা লাভ করবো। পারবেন? কারা কারা পারবেন হাত ওঠান। আজকে থেকে শপথ করেন, কেয়ামত পর্যন্ত আপনার আমার মোরশেদ হবেন দেওয়ানবাগী। বলেন, কেয়ামত পর্যন্ত আমাদের মোরশেদ হবেন দেওয়ানবাগী। দেওয়ানবাগীর কদমে কেয়ামত পর্যন্ত আশ্রয় চাই। দেওয়ানবাগীর কদমে জীবন মরণ সঁপে দিতে চাই। দেওয়ানবাগীকে মনিবরূপে গ্রহণ করলাম। দেওয়ানবাগীর গোলাম হইলাম। ভাইরা যদি ওই মোরশেদরে অন্তরে বসাইতে পারেন দেখবেন মরণের সময় রাসুলরে নিয়া আইসা মোরশেদ বলবে এ আমার আশেকে রাসুল, আমার কদমের নিচে তাকে ঠাঁই দিলাম। আসুন আমরা সবাই দেওয়ানবাগীর গোলাম হই।
ছয় মিনিট দুই সেকেন্ডের বক্তব্য শোনার পর দেওয়ানবাগী সম্পর্কে বিস্তারিত জানার আগ্রহ নিয়ে গুগল ইঞ্জিনে সার্চ করি। মিলে যায় আরও ডজন খানেকেরও বেশি ভিডিও লিংক। সবগুলো ভিডিওতে দেখা যায় বিশাল স্থুল দেহ এবং গোলগাল চেহারার দেওয়ানবাগীকে। মুখভরা কালো দাড়ি। কারুকাজ খচিত ঝলমলে পোশাক পরে বসে আছেন সিংহাসনে। ঢুলুঢুলু চোখ। কথা বলছেন নেশায় চুর হয়ে থাকা মানুষের মতো। কখনও নিজেকে পূর্ণিমার চাঁদ, কখনও মোহাম্মদি ইসলামের পুণ্যজীবন দানকারী, কখনও ইমাম মেহেদি, কখনও নিজেই রাসুল, নিজেই খোদা আর তার স্ত্রী হামিদা বেগমকে রাসুলের সা.-এর কন্যা ‘ফাতেমা’ দাবি করে বিভিন্ন বিষয়ে বক্তব্য রাখছেন ভক্ত মুরিদদের উদ্দেশে। পা দুইটা সামনের দিকে এমনভাবে বাড়িয়ে রেখেছেন যেন ভক্তদের সেজদা করতে বা পায়ে মাথা ছোঁয়াতে কষ্ট করতে না হয়। ভক্তদের কেউ কেউ পরম ভক্তি নিয়ে মোরশেদ দেওয়ানবাগীর কদমে মাথা রাখছেন। তার বক্তব্যের কিছু অংশ পাঠকদের জন্যে উল্লেখ করছি- দেওয়ানবাগীর ছেলে নাকি একবার সৌদি পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছিল। তখন দেওয়ানবাগী খুব পেরেশানিতে অসুস্থ হয়ে যান এবং আল্লাহর কাছে তার বিশেষ দূত কুতুবুল আকতাবকে পাঠান সাহাহ্যের জন্যে। কুতুবুল দেখেন আল্লাহ নিজেই বিষয়টা নিয়ে চিন্তিত। আল্লাহ কোনো কথা বলছেন না। তখন দেওয়ানবাগী জোর খাটিয়ে কুতুবুল আকতাবকে বলেন, আল্লাহকে আমার রেফারেন্স দিয়ে বলো, আমি বলেছি ব্যবস্থা নিতে। আল্লাহ তখন ব্যবস্থা নেন এবং সমস্যার সমাধান হয়। দেওয়ানবাগী তার ভক্তদের উদ্দেশে বলেন, আপনাদের বিশ্বাস হয় আমার স্ত্রী যে রাসুলের মেয়ে ছিল? উনিই মা ফাতেমা ছিলেন। অন্য এক জায়গায় বলেন, জাকেরদের (তার মুরিদ) অনেকেই স্বপ্নে আমাকে রাসুলের বেশে দেখেন। মদিনায় যান রাসুলকে এই (নিজের) রুপেই দেখবেন। মদিনায় দেওয়ানবাগীর মেয়েকে রাসুলের সা. কন্যা মা ফাতেমা বলেছেন, তোমার বাবার সাথে আগেও ছিলাম, এখনও আছি, ভবিষ্যতেও থাকবো। রাসুলও সা. একই কথা বলেছেন। অন্য এক বক্তব্যে বলেন, আল্লাহর আরশে যদি যান, গিয়ে দেখবেন যে মোরশেদের কদম ধরে গিয়েছেন ওখানে সেই মোরশেদই (নিজেকে উদ্দেশ্য করে) বসা। অন্য এক ভিডিওতে দেখা যায় তিনি বলছেন, যখন ইরাকে যুদ্ধ শুরু হয় তখন বাচ্চাদের (মুরিদদের) বললাম, রাসুলের কাছে অনুমোতি চাও, উনি যদি অনুমোতি দেন তবে ব্যবস্থা গ্রহণ করি। মুসলমানদের মেরে ফেলছে দেখে তো আর সহ্য হয় না। তখন রাসুল বাচ্চাদের বলেন, তোমার বাবাকে বলো ইরাকের ব্যাপারে ব্যবস্থা না নিতে। দেওয়ানবাগী আবার অনুমোতির জন্যে বাচ্চাদের পাঠান রাসুলের কাছে। তখন রাসুল বলেন, তোমার বাবাকে জিজ্ঞেস করো, গজবটা কি সে নেবে? রাসুল সা. ইরাকের পক্ষে ব্যবস্থা নিতে নিষেধ করায় দেওয়ানবাগী তখন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেননি। রাসুল যদি তখন দেওয়ানবাগীকে অনুমোতি দিতেন তবে তিনি ব্যবস্থা নিতেন এবং ওই যুদ্ধে ইরাকিরা বিজয়ী হতো আর আমেরিকানরা পরাজিত হতো। দেওয়ানবাগী বলেন, যে আমাকে বিশ্বাস করবে শুধুমাত্র সে ঈমানদার হবে। কারণ ঈমানের দায়িত্ব এখন আমার হাতে। নিজেকে নবি পরিবারের সদস্য দাবি করে তিনি বলেন, এখন নবি পরিবারের আমি ছাড়া আর কেউ নেই। আমাকে অবিশ্বাস করলে ঈমানদার হওয়ার আর কোনো রাস্তা নেই। যদি বিশ্বাস না হয় যাদের ক্ষমতা আছে আল্লাহকে জিজ্ঞেস করেন, নবিকে জিজ্ঞেস করেন। দেওয়ানবাগীর দাবি মতে তার অনেক মুরিদ আল্লাহ এবং রাসুলের সাথে দেখা করার, কথা বলার ক্ষমতা রাখেন।
এমন অসংখ্য উক্তি আছে দেওয়ানবাগীর। তার গুণ গেয়ে জারিগান করা হয়েছে। তার নামে দুরদ তৈরি করা হয়েছে। তার নামে মিলাদ করা হয়, দুরদ পাঠ করা হয়। মুরিদরা সপ্তাহে অন্তত একদিন তার নামে জিকির করে। মতিঝিলে তার অট্রালিকা বাবে রহমতের ছাদে সবুজ রঙের গম্বুজ করা হয়েছে। সেখানে যখন তার নামে দরুদ পাঠ করা হয় এবং জিকির করা হয়, স্বয়ং আল্লাহ ও রাসুল কাবাঘর নিয়ে তার কাছে হাজির হন। আল্লাহ তার পক্ষে শ্লোগান দেন। রাসুলকে তিনি পূর্ণজীবন দান করেছেন। এমন বহু কথা লেখা আছে তার প্রকাশনা সংস্থা সুফি ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন বই এবং পত্রপত্রিকায়।


সুফি ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত পত্রপত্রিকা, বই পুস্তক ঘেটে জানা যায়, ১৯৪৯ সালে ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার বাহাদুরপুর গ্রামে জন্ম নেন এই কথিক সুফি সম্রাট মাহবুবে খোদা। বাবা আবদুর রশিদ, মা যুবেদা খাতুন। মাদরাসায় সামান্য কিছু লেখাপড়া করেছেন। বিয়ে করেছেন নারায়ণগঞ্জের আরেক বিতর্কিত পীর, চন্দ্রপাড়া পীরের মেয়ে হামিদা বেগমকে। সেখান থেকেই মূলত তিনি পীরব্যবসার তালিম নেন এবং ১৯৮৬ সালে একই জেলার দেওয়ানবাগ এলাকায় এসে আস্তানা গাড়েন। নিজেকে দেওয়ানবাগী পীর বলে প্রচার করতে শুরু করেন। কিন্তু সেখানে তিনি বেশি দিন টিকতে পারেননি। বিতর্কিত কর্মকান্ডের জন্যে এলাকাবাসী তাকে বিতাড়িত করে। এরপর তিনি ঢাকার মতিঝিলের আরামবাগে গড়ে তোলেন নতুন সাম্রাজ্য। রাতারাতি নির্মাণ করেন ১০ তলা একটি দালান। ঢাকায় আসার পর তার পীরব্যবসা জমে উঠতে শুরু করে তর তর করে। শহরের ধনাঢ্য ব্যক্তি থেকে শুরু করে বিচারপতি, রাজনীতিক, আমলা, ব্যবসায়ীদের ক্রমশ আকৃষ্ট করতে সক্ষম হন তিনি। গড়ে তোলেন নিজস্ব মাস্তান বাহিনী। তাদের দিয়ে সরকারি জমিসহ আশপাশের আরও কিছু জমি দখল করে নেন। নির্মাণ করেন বিরাট আস্তানা। সাথে একটি উটের খামার করেন। দেশের পশু সংরক্ষণ আইন লঙ্ঘন করে বেশ কিছু উট পালন করেন সেখানে এবং সেই উটের দুধ বিক্রি করেন চড়া দামে। জানা যায়, প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ কেজি উটের দুধ বিক্রি হয় তার খামার থেকে। কিন্তু উটগুলো দুধ দেয় মাত্র ৪ থেকে ৫ কেজি। বাকি দুধের রহস্য কেউ জানে না। টেলিভিশনসহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে, দেয়ালে দেয়ালে লাল মোটা অক্ষরের চিকা মেরে শুরু করেন বিশ্ব আশেকে রাসুল সম্মেলন। অভিযোগ আছে, দেওয়ানবাগী তার শ্বশুর চন্দ্রপাড়া পীরের বাড়ি থেকে বিপুল পরিমাণের টাকা চুরি করে পালিয়েছিলেন ১৯৮৬ সালে। পরে সেই টাকা দিয়েই দেওয়ানবাগ এবং আরামবাগের আস্তানা গড়ে তোলেন।
দেওয়ানবাগী তার নিজের গুণকীর্তন করার জন্যে এবং তার বিতর্কিত, ঈমান আকিদাবিরোধী বক্তব্য প্রচারের জন্যে সুফি ফাউন্ডেশন নামে একটি প্রকাশনা সংস্থা করেন। সেখান থেকে বিভিন্ন বই এবং চারটি পত্রিকা প্রকাশ করা হয়। এসব পত্রিকার মধ্যে একটি হলো, মাসিক আত্মার বাণী। দেওয়ানবাগীর ভক্তরা মনে করেন এই পত্রিকা চুবিয়ে পানি খেলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। দেওয়ানবাগী তার প্রকাশিত পত্রিকা এবং বইতে অসংখ্য বিতর্কিত এবং ইসলামের মূল বিশ্বাস পরিপন্থি কথা লিপিবদ্ধ করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- আল্লাহ কোন পথে বইয়ের প্রথম সংস্করণের ২৩ নং পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন, তার স্ত্রী হামিদা বেগম এবং তার মেয়ে তাহমিনা সুলতানা আল্লাহকে গোঁফ-দাড়িবিহীন সুন্দর যুবকের আকৃতিতে দেখেছেন। তার আস্তানায় এসে আল্লাহ, সকল নবি রাসুলগণ এবং ফেরেশতারা মিছিল করেন। আল্লাহ নিজে তার পক্ষে শ্লোগান দেন। কোনো লোক যখন নফসির মাকামে গিয়ে পৌঁছায় তখন তার আর ইবাদত করার দরকার হয় না। সুতরাং দেওয়ানবাগীর নিজেরও কোনো ইবাদতের দরকার হয় না। ১৯৮৯ সালে দেখা একটি স্বপ্নের বর্ণনা করে দেওয়ানবাগী তার বইতে লিখেছেন, আমি দেখি, ঢাকা এবং ফরিদপুরের মধ্যবর্তী স্থানে একটি বিশাল ফুলের বাগান। বাগানটির এক জায়গায় একটি ময়লার স্তুপ। ওই ময়লার উপর উলঙ্গ এবং মৃত অবস্থায় নবি পড়ে আছেন। আমি কাছে গিয়ে তার হাত ছোঁয়াতেই তিনি জীবিত হয়ে ওঠেন এবং হাসিমুখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, হে ধর্মের পুনর্জীবনদানকারী। এর পর আল্লাহ এবং সকল নবি রাসুলগণ দেওয়ানবাগীকে নিয়ে মিছিল করেন। আল্লাহ দেওয়ানবাগীর পক্ষে শ্লোগান দেন। দেওয়ানবাগী তার জন্ম নিয়েও এক রসাত্মক কাহিনী রচনা করেছেন। তাতে বলা হয়েছে, সুফি সম্রাট দেওয়ানবাগী হুজুরের জন্মগ্রহণের আগের রাতে তার মা স্বপ্ন দেখেন- আকাশে ঈদের চাঁদ উদিত হয়েছে। চাঁদ দেখতে তিনি ঘরের বাইরে এলে চাঁদটি আকাশ থেকে তার কোলে নেমে আসে। তখন তার মা বুঝতে পারেন, আল্লাহ তাকে সৌভাগ্যবান সন্তান দান করবেন। দেওয়ানবাগী কখনও হজ করতে যাননি। এর ব্যাখ্যায় তিনি তার বইতে লিখেছেন, স্বয়ং আল্লাহ কাবাঘর নিয়ে তার কাছে এসে উপস্থিত হয় তাই হজ করতে সৌদি যাওয়ার কোনো দরকার হয় না। সে নিজেকে মোহাম্মদি ইসলামের একমাত্র ধারক এবং মহামানব উল্লেখ করে নিজের নামে দরুদ রচনা করেছেন এবং তার ভক্তদের সেই দরুদ পাঠ করতে বাধ্য করেন।
দেওয়ানবাগী তার বই এবং বিতর্কিত পত্রপত্রিকার পক্ষে বিশিষ্টজনদের প্রশংসা ও অভিনন্দন বার্তা প্রকাশ করেছেন নানা সময়। বিশিষ্টজনদের মধ্যে সাবেক প্রেসিডেন্ট, বিচারপতি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আইনজীবী, মন্ত্রী, এমপিরাও রয়েছেন। তবে যাদের নামে প্রশংসা বার্তা প্রকাশ করা হয়েছে তাদের প্রায় সকলেই পরে জানিয়েছেন, দেওয়ানবাগী তাদের স্বাক্ষর জালিয়াতি করেছেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট এরশাদ, শামিম ওসমান, ফজলে রাব্বি, শামসুজ্জামান দুদুসহ অনেকেই দেওয়ানবাগীর শাস্তিও দাবি করেছিলেন। তার জালিয়াতি প্রমাণের জন্যে ১৯৯৯ সালের শেষ দিকে একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু তদন্তের ফলাফল আজ অবধি জানা যায়নি। অনেকেই মনে করেন, সে সময়ের তদন্ত রিপোর্ট ধামাচাপা পড়ার নেপথ্য কারণ হলো এমপি, মন্ত্রী, আমলাসহ অনেক ধনকুবের সাথে দেওয়ানবাগীর সখ্যতা। দেওয়ানবাগীর অপকর্ম এবং ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস পরিপন্থি কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে প্রথম ১৯৯৯ সালের শেষের দিকে প্রতিবাদ জানায় ঈমান আকিদা সংরক্ষণ কমিটি নামের একটি সংগঠন। সে সময় তাদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছিল। সেই সংঘর্ষে কয়েকজনের প্রাণহানীও ঘটেছিল। সে সময় পুলিশ দেওয়ানবাগীর আস্তানায় হানা দিয়ে ব্যাপক গোলাবারুদ, হাতবোমা, বন্দুক, গুলি, রামদা, কিরিচ, চাকু, বল্লম, চাপাতি উদ্ধার করেছিল এবং তার ৪৩ জন্যে ক্যাডারকে গ্রেফতার করেছিল।
ক'মাস আগে দেশে গিয়েছিলাম। সে সময় ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় দেখলাম দেওয়ানবাগ, রাজারবাগ, কুতুববাগ, চন্দ্রপাড়া, আটরশি, মাইজভান্ডারি, শুরেশ্বরিসহ প্রভৃতি পীরদের বিশাল বিশাল তোরণ। পথে প্রান্তরে হাজার হাজার ব্যানারে ঝুলছে তাদের বিতর্কিত বাণী। মাইলকে মাইল জুড়ে রাস্তার দুই ধারে তাদের নামে ফ্লাগ টানিয়ে রাখা হয়েছে। মোটা মোটা অক্ষরে শহরের বিভিন্ন জায়গায় লাল কালি দিয়ে চিকা মেরে রাখা হয়েছে। সরকারি জায়গা, সাধারণ মানুষের জায়গা দখল করে, শহরের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলো আটক করে তারা ওরশের আয়োজন করেছে। কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে সারা দেশে তোরণ বানিয়েছে। কোনো কোনো তোরণের চূড়ায় কালো কাপড় দিয়ে কাবাঘরের আকৃতি তৈরি করতে দেখেছি। এসব কা-কারখানা দেখে বারবার শুধু মনে হয়েছে, এরা কোথায় পায় এতো টাকা? এদের আয়ের উৎস কী? এদের বিপুল ক্ষমতার উৎস কোথায়? খোঁজ নিয়ে জেনেছি, এরা মূলত সবাই ইসলামের মৌলিক আদর্শ এবং বিশ্বাস পরিপন্থি কর্মকান্ডে লিপ্ত। এদের সকলের গোড়া একই জায়গায়। বিভিন্ন নামে চালিয়ে যাচ্ছে পীরব্যবসা। এদের অবশ্য পীর বলা ঠিক না। কারণ যে অর্থে আমাদের দেশে পীর শব্দটা ব্যবহারিত হয় এরা তার ঠিক বিপরীত। এরা সমাজের একটি জঘন্য দুষ্টুচক্র। এদের পীর বললে দেশের হক্কানি পীরদের অসম্মান করা হয়। মানুষকে বিভ্রান্ত করা হয়। ইসলামের মৌলিক জ্ঞান এদের কারও মধ্যে নেই। শিক্ষাগত যোগ্যতার পরিধিও খুব সামান্য। ধর্মের নামে সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দেয়াই এদের কাজ। সমাজের বড় বড় অসাধু ধড়িবাজ কালো টাকাধারীরাই এদের বিপুল অর্থের উৎস। অসাধু রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, বিচারপতি এবং আমলারাই এদের মাথার ছাতা। ওরসের সময় অসৎ ব্যবসায়ী এবং নির্বোধ সাধারণ মানুষরা প্রতিযোগিতা করে টাকা দেয় এদের খুশি রাখতে। তারা মনে করে, পীর খুশি থাকলেই তাদের সব মুশকিলের আসান হবে। যাবতীয় নিয়ত পূরণ হবে। বাস্তবে হয়ও তাই। পুলিশের ঘুষের টাকার মতো কথিত এই পীরদের ওরশ বা আশেকে রাসুল সম্মেলন থেকে আয়ের টাকা টপ টু বটম ভাগ হয়। এলাকার মান্তান, প্রশাসন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের শীর্ষমহল পর্যন্ত টাকার ভাগবাটোয়ারা হয়। সমাজের সকল বড় বড় অন্যায়ের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে এইসব কথিত পীররা। ধর্মের আড়ালে তারা তাদের আস্তানা থেকে গুটি চালে। এধার কা মাল ওধার করে। সাধারণ মানুষের সামনে একটা মিথ্যা আধ্যাত্ম্যিক জগত সৃষ্টি করে রাখে।এইসব পীরদের কথা বলার ধরন দেখলে যে কারও মনে হবে এরা স্রেফে নেশাগ্রস্ত বিকার মানুষ ছাড়া আর কিছু নয়। অথচ হাজার হাজার মানুষ মন্ত্রমুগ্ধের মতো এদের কথা শোনে। ভক্তি করে। শ্লোগান দেয়। কারণ এরা ধর্মের নামে এক রকম মিথ্যাজগৎ সৃষ্টি করে রাখে মানুষের চোখের সামনে। তাছাড়া এদের কাছে গেলে নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, পর্দার মতো ইসলামের মৌলিক কোনো নির্দেশ পালন করতে হয় না; বরং মদ, গাঁজা, জুয়া, যৌনাচার সবই করা যায় অবাধে। অন্যায় অপকর্ম কোনো কিছুতেই পীরের নিষেধ নেই। এমন সুযোগ কে হাতছাড়া করতে চায়? যারা কথিত এইসব পীরদের কাছে যায় তারা এতোটা বোকা কেউ না যে জাগতিক এমন সুযোগ হেলায় হারাবে। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, যারা কথিক এই পীরদের কাছে যায় তারা সবাই কোনো না কোনোভাবে অনৈতিক কাজের প্রতি আসক্ত। নির্বিঘ্নে নিজেদের আসক্তি মেটাতেই তারা যায় কথিত পীরদের আস্তানায়। এই সুযোগ গ্রহণ করে কথিত পীররা। ইসলাম সম্পর্কে সাধারণ মানুষের অজ্ঞতা এবং জাগতিক মোহই এইসব পীরদের প্রধান পুঁজি। এরা প্রতিনিয়ত মনগড়া কথা বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করে। ধর্মের আড়ালে এরা অপরাধ জগতের এক একজন ঘাপটিমারা সম্রাট। এদের নিয়ন্ত্রণে দেহব্যবসা, মাদকব্যবসা, খুন-খারাবি থেকে শুরু করে সকল অপকর্ম সংঘটিত হয়। অথচ এসব নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। দুদক বা ইনকাম ট্যাক্স ওয়ালারা এদের আয় ইনকাম বা সম্পদের খোঁজ নিতে যায় না। হেফাজতের নাস্তিকবিরোধী আন্দোলন দেখে কিছুটা আশান্বিত হয়েছিলাম। ওই আন্দোলনটি বাঁচিয়ে রাখতে পারলে এক সময় ইসলামের মৌলিক আদর্শবিরোধী এসব কথিক পীরদের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা যেতো। সাধারণ মানুষকে এদের ভন্ডামির বিষয়ে সচেতন করা যেতো। কিন্তু তা হলো না। সরকারী কূটকৌশলে হেফাজত এখন নিজেই হেফাজতে আছে।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সকাল ১০:২৪
১০টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×